একুশ / আফরোজা পারভীন

 

রুমার বাম হাত নেই। নেই মানে সত্যিই নেই। কনুইয়ের নিচ থেকে কব্জি পর্যন্ত নেই। বাম হাত না থাকায় রুমাকে সব কাজই করতে হয় ডান হাত দিয়ে। সে ডানহাতে ভাত যেমন খায়, প্রাকৃতিক কাজ শেষে গোপন জায়গাও পরিষ্কার করে। এছাড়া যে তার উপায় নেই! রুমা মাঝে মাঝে ভাবতো, ভাগ্যিস বাম হাতটা কাটা গিয়েছিল। ডানহাত কাটা গেলে সে লিখতে পারত না। অবশ্য ওই ভাবনাই সার। ওই অপরিপক্ক ভাবনাটা সে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়েছে। নিজে নিজেই বুঝে নিয়েছে এখন সে যেভাবে ডান হাতে বাম হাতের কাজ সারছে ডান হাত না থাকলে সে বামহাতেই ডান হাতের কাজ সারত। অনেক লোক আছে যারা ডানহাত থাকা সত্ত্বেও বাম হাতে লেখে। ছেলেবেলায় শিপ্রাকে দেখত বামহাতে লিখতে। শিপ্রা কখনও ফার্স্ট ছাড়া সেকেন্ড হয়নি। জলজ্যান্ত ডানহাত থাকা সত্যেও বামহাতে বল আর ব্যাট করে এ দেশের রফিক, ভারতের যুবরাজ আর ইরফান পাঠান। গাঙ্গুলি অবশ্য সমতা রেখে চলে। সে কোনো হাতের প্রতি অবিচার করতে রাজি নয়। তাই সে বল করে ডানহাতে, ব্যাট ধরে বামহাতে। আরও আছে । পুরো প্যারালাইজড শরীরে সচল দু’তিনটে আঙ্গুল নিয়ে বিখ্যাত বিজ্ঞানী স্টিফেন্স হকিন্স ‘আ ব্রিফ হিস্টোরি অব টাইমস’ এর মতো বই লিখে চলেছেন একের পর এক, দাপটের সাথে। আসলে কোনো কিছু না থাকার ক্ষতি প্রকৃতি কেমন ভাবে যেন পুষিয়ে দেয়। প্রকৃতি বড় সদয়, মানুষের মতো নির্দয় নয়! তাই বামহাত না থেকে ডানহাত থাকাতে ভালো হয়েছে কিংবা ডানহাত না থেকে বামহাত থাকলে ভালো হতো এগুলো কোন কথা নয়। মোদ্দা কথা হচ্ছে রুমার একটা হাত নেই এটাই ক্ষতি, কোন হাতটা নেই সেটা বিবেচ্য বিষয় না। 

হাত থাকা না থাকা নিয়ে তেমন তাপ উত্তাপও ছিল না রুমার। বরং মনে ছিল তীব্র অহংকার। সাথে ক্ষীণ জ্বালাও ছিল, ছিল জিজ্ঞাসা, এ লড়াই কবে শেষ হবে! হাসপাতালে নেবার পর যখন ডাক্তার পরীক্ষা করে অকম্পিত কণ্ঠে ঘোষণা করেছিলেন রুমার বামহাতটা কেটে ফেলতে হবে তখন একযোগে কেঁদে উঠেছিলেন রুমার বাবা-মা। রুমার বাবার কান্না হাহাকারের মতো শুনাচ্ছিল আর মার কান্না আর্তনাদের মতো! মনে হচ্ছিল তাদের কলিজা বুঝি উপড়ে ফেলছে কেউ। রুমার তখন  নিজের হাতের জন্য নয়, কষ্ট হচ্ছিল বাবা মার জন্য। 

মা আর্তনাদ করতে করতে ডাক্তারের হাত জড়িয়ে ধরেছিলেন, 

:ডাক্তার সাহেব আর একবার ভালো করে দেখেন আমার মেয়ের হাতটা বাঁচানো যায় কিনা। আমার ওই একটিই সন্তান। তাছাড়া মেয়ে বলে কথা! হাত না থাকলে এ সমাজে ও টিকে থাকবে কী করে!

ডাক্তারের কণ্ঠ এবারও ছিল অককম্পিত। শুধু অকম্পিত নয়, নিদারুণ নির্লিপ্ত। শীতল কন্ঠে বলেছিলেন,

: ছেলে মেয়ে  বলে তো কথা না। কথা হচ্ছে হাত নিয়ে

: কিন্তু মেয়েদের পরের ঘরে যেতে হয়। হাত না থাকলে ..

 মা কথা শেষ করেননি। ঢুকরে কেঁদে উঠেছিলেন। কাঁদতে কাঁদতে বলেছিলেন,

: আপনি আর একবার একটু ভালো করে দেখেন। 

: আমি যখন দেখি ভালো করেই দেখি, বারবার দেখতে হয় না। মেয়েকে অনেক দেরিতে আমার কাছে এনেছেন। অনেক আগেই হাড়ে পচন ধরেছে। এখন হাত রাখতে হলে মেয়েকে হারাতে হবে। 

: না , না , কিছুতেই না, যুগপৎ আর্তনাদ করে উেেঠছিলেন বাবা-মা। 

এক হাত নিয়ে  বাড়িতে ফিরেছিল রুমা। বাবা-মা রুমার চলাফেরা, গতিবিধির উপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিলেন। যে  নিষেধাজ্ঞার আওতায় বাবা -মায়ের একমাত্র সন্তান রুমা কখনই ছিল না।কিন্তু রুমা মানেনি কোনো নিষেধাজ্ঞা। দেশের প্রয়োজনে ঘর ছাড়তে  তৈরি ছিল সে। তাই বাবা-মা বাধ্য হয়েছিলেন নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে। আর রুমাকেও দেখা গেছে মিটিং-মিছিল আন্দোলনে প্রথম সারিতে। এ আন্দোলনে এক হাত না থাকা কোনো সমস্যা করেনি। বরং রুমা যখন তার কাটাহাত উত্তোলিত করেছে তখন আন্দোলনে যোগ হয়েছে নতুন মাত্রা। 

 কিন্তু লেখাপড়া আন্দোলনের বাইরেও রুমার একটা জীবন ছিল। সে জীবন নিয়ে রুমা না ভাবলেও বাবা মা না ভেবে পারেননি। দেখতে দেখতে মেয়ের বয়স তিরিশ পেরুলো। লেখাপড়া  সেই কবে  শেষ। চাকরি খুঁজছে। রুমার মুখ-চোখ, চেহারা, রঙ, বংশ কৌলীন্য বিত্ত দেখে অনেক পাত্রই এগিয়ে এসেছে। কিন্তু যখনই জেনেছে রুমার এক হাত  নেই নীরবে সরে পড়েছে তারা। কেন রুমার হাত নেই, সে কী জন্মগতভাবে প্রতিবন্ধি নাকি কোনো অসুখ কিংবা এক্সিডেন্টে তার হাত গেছে, নাকি কোনো গৌরববগাথার অংশিদার সে খোঁজ কেউ নিতে আসেনি। অন্যের পঙ্গুত্বের কারণ অনুসন্ধান করার মতো পর্যাপ্ত সময় পাত্রপক্ষের নেই। আর সময় থাকলেই তারা সময় ব্যয় করবে কেন! 

বাবা-মায়ের চোখের নিচে কালি গভীর হয়ে বসেছে। মেয়ের বয়স তেত্রিশে পড়েছে। না বিয়ে না কোনো চাকরি। তা নিয়ে কি মেয়ের কোন ভাবনা আছে! তা একমাত্র ভাবনার বিষয় দেশ। সে নাকি দেশেরই অংশ।  দেশ বাঁচলে সে বাঁচবে দেশ মরলে মরবে সে। এসব কথায় সায় দিলে গার্জিয়ানদের চলে না।  তারা আর ক’দিন। বাবা-মা যখন গভীর দুশ্চিন্তায় নিমজ্জিত তখনই আসিফদের তরফ থেকে বিয়ের প্রস্তাবটা এলো। ছেলে ডাক্তার। সরকারি চাকরি করে না, তবে রোজগারপাতি ভালো। আর রোজগার নিয়ে তেমন মাথাব্যথাও ছিল না রুমার বাবা-মায়ের। তাদের অঢেল আছে। পূর্ব অভিজ্ঞতায় সতর্ক হয়ে গিয়েছিল রুমার বাবা-মা। কথা বেশি এগুবার আগে নিজেরাই হাত না থাকার বিষয়টা তুলেছিল । কিভাবে মেয়ের হাতটা গেছে সবিস্তারে বলতে চেয়েছিল। কিন্তু থামিয়ে দিয়েছিলেন আসিফের বাবা। এ বিষয়টাতে কোন গুরুত্বই দেয়নি আসিফের পরিবার। তাছাড়া এমন নামকরা বাবা মায়ের সন্তান! এত অর্থ-বিত্ত! এমন মেয়ে কোটিতে একটা মেলে। সুতরাং বিয়ে হয়ে গিয়েছিল। বাবা-মার মনে একটু খুঁতখুঁত ছিল, এ দেশে আসিফদের কোনো শিকড় নেই। কিন্তু সব কিছু কি আর মনমতো হয়। কিছু না কিছু ছাড় দিতেই হয়। ওরা আগ্রহ করে নিচ্ছে এটাই বড় কথা!

বিয়ে নিয়ে রুমার ভাবনা না থাকলেও ভাবনা ছিল চাকরি নিয়ে। এ সমাজে মেয়েদের নিজের পায়ে দাঁড়ানো বড় জরুরি। তাই লেখাপড়া শেষ করার আগেই চাকরি খুঁজতে শুরু করেছিল রুমা। এক হাত না থাকার সমস্যাটা রুমা প্রথম উপলব্ধি করল সরকারি চাকরি নিতে গিয়ে। যেখানেই পরীক্ষা দেয় লিখিত পরীক্ষায় এলাউ হয় কিন্তু ভাইভাতে বাদ পড়ে। প্রথম দিকে রুমা বুঝতে পারেনি কারণটা কী। এ নির্মম বিষয়টা বাবা-মা আত্মীয় স্বজন বুঝলেও রুমার সামনে উচ্চারণ করেনি। বরং বাবা বারবার বলছিলেন,

: তুমি এক কাজ করো মা। একটা বেসরকারি কলেজে চাকরি নাও। বদলির ঝামেলা থাকবে না। সারাজীবন এক কলেজেই চাকরি করতে পারবে। সরকারি যে কোনো চাকরিতেই তো আজ এখানে কাল ওখানে । সারাক্ষণ বদলির ভয়। 

: তা ঠিক, কিন্তু সরকারি চাকরিতে নিরাপত্তা নিশ্চয়তা দুটোই বেশি। তাছাড়া বাবা তুমি ভেবে দেখো পশ্চিম পাকিস্তানিরা ভালো ভালো সরকারি চাকরিগুলো কুক্ষীগত করে রাখবে আর আমাদের দেশের ছেলেমেয়েরা যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও  চাকরি পাবে না, এ কেমন কথা! 

: ওসব কথা আর ভেবো না মা। ওসব ভাবতে গিয়েই তো হাতটা খোয়ালে, সারা জীবনের মতো পঙ্গু হলে। আমার একমাত্র সন্তান তুমি, আমার কষ্ট বুঝবে না!

 বাবার বুক চিঁরে দীর্ঘশ্বাস পড়ে। থেমে থেমে বলেন,

: জীবনের সহজ হিসেবগুলো করো মা। 

: আচ্ছা বাবা সহজ হিসেবই করছি । সরকারি চাকরি পাওয়া যেমন কঠিন যাওয়াও তেমন কঠিন। বোনাস আছে, পেনশন আছে। বেসরকারিতে ওসব কিছুই নেই। 

: তুমি  যেটা বলছ ওটাই নিরাপত্তা আর নিশ্চয়তা। কিন্তু রুমা বেসরকারি চাকরিও কথায় কথায় যায় না। আর বোনাস প্রায় সব বেসরকারি চাকরিতেই আছে। পেনশন আজ নেই, একসময় হয়ে যাবে। 

বাবার কথায় দু’একটা বেসরকারি কলেজে ইন্টারভিউ দিয়েছিল রুমা। ফলাফল  একই। লিখিত পরীক্ষায় টেকে, ভাইভাতে আউট হয়ে যায়। এমন যখন অবস্থা তখন এই কলেজের নিয়োগ পরীক্ষায় অংশ নেয় রুমা। রুমার বিয়েও তখন ঠিক। এ নিয়োগে কোন ভাইভা হয়নি। রুমার রেজাল্ট ভালো, রিটেনে খুবই ভালো করেছিল। তাই অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটারটা হাতে এসে যায়। মাত্র ক’দিন আগে বিয়ে হয়েছে রুমার। এক হাতে মেহেদি নিয়েই জয়েন করতে যায় রুমা। প্রিন্সিপাল উৎফুল্ল মুখে তাকে অভ্যর্থনা করেন, হাসেন। কিন্তু এক পর্যায়ে তার চোখ আটকে যায় রুমার কাটা হাতের ওপর। নিজের অজান্তেই তার ঠোঁট চিঁরে অস্ফুটধ্বনি বেরিয়ে যায়। 

: সেকী আপনার একটা হাতই তো নেই! এমন জানলে তো চাকরিটা..

 সেই মুহূর্তে সবকিছু পরিষ্কার হয়ে যায় রুমার কাছে। ও এজন্যই বুঝি তার সরকারি- বেসরকারি কোনে চাকরিই হচ্ছিল না!

 নেহাৎ নিয়োগপত্র দেয়া হয়ে গেছে আর রুমাও জয়েন করে  ফেলেছে, তাই চাকরিটা ফিরিয়ে নেয়ার কোন উপায় ছিল না। নইলে সেটাও ঘটত এটা নিশ্চিত। তবে চাকরিটা থাকলেও ঠিক যেভাবে থাকা উচিত সেভাবে নেই। সবার চেয়ে সিনিয়র হয়েও রুমা হতে পারেনি বিভাগীয় প্রধান। পদোন্নতিতে কিভাবে যেন তাকে টপকে অন্যরা বার বার এগিয়ে যায়। রুমা বিদ্রোহ করতে পারে, প্রতিকার চাইতে পারে, করে না, চায় না। রুমা এসব দেখে মনে মনে হাসে। অনেক বড় ঘটনার প্রতিকার সে চেয়েছিল, প্রতিবাদ সে করেছিল তাই আজ তার হাত নেই। তাই আজ সে যোগ্য হয়েও বঞ্চিত। সবার চোখে অযোগ্য। কিন্তু রুমার এসব নিয়ে কোন আক্ষেপ নেই। হাত না থাকার ব্যাপারটা তাকে কখনোই সেভাবে কোনো কষ্ট দেয়নি বরং মনে সুতীব্র গর্ববোধ ছিল বরাবরই যা কখনোই কারো কাছে প্রকাশ করেনি। 

সন্তানসম্ভবা হবার পর স্বামী আসিফকে রুমা বলেছিল,

: দেখ আমাদের প্রথম সন্তান যদি ছেলে হয় তার নাম রাখব একুশ আর মেয়ে হলে ভাষা । 

স্ত্রীর অনেক খেয়ালিপনায় বরাবর সায় দিয়ে গেছে আসিফ। তার সিংহভাগ ভালোবেসে নয় বরং অযথা সময় নষ্ট করতে চায় না বলে। তাছাড়া যে স্ত্রীর অগাধ বিত্ত বৈভব তাকে একটু সমঝে চলতেই হয়। স্ত্রী গাড়ি রেখে হুডখোলা রিক্সায় ঘোরে, বৃষ্টিতে খোলা ছাদে দাঁড়িয়ে ভেজে, সাতসকালে জানালা খুলে কুয়াশা দেখে, পাখির কিচির মিচির শোনে, গভীর রাতে ছাদে বসে তন্ময় হয়ে আকাশের তারা গোনে, এসব দেখেও দেখে না আসিফ। শুধু কি তাই, রুমা বছরের  পর বছর শুধু ক্যালেন্ডার জমিয়ে যায়। তাও ভালো ছবি আর আর্টের ক্যালেন্ডার হলে এক কথা। সে জমায় শুধু  বাংলা ক্যালেন্ডার। আর প্রতিটি ক্যালেন্ডারের বাংলা ৮ ফাল্গুন আর ইংরেজি ২১ ফেব্রুয়ারিতে সে দাগ দেয়। অদ্ভুত খেয়াল! মানুষ পারিবারিক লাইব্রেরি গড়ে তোলে, পাখি পালে, বাগান করে, স্ট্যাম্প, কয়েন, সিডি  ক্যাসেট কালেক্ট করে, নানান ধরণের রান্না করে, মহিলারা শাড়ি গহনা ভ্যানিটিব্যাগ জমায় কিন্তু এমন অদ্ভুত খেয়ালের কথা কেউ কখনও শুনেছে! তবুও সব দেখে শুনে চুপ করে থেকেছে আসিফ। সে ডাক্তার মানুষ, এসব বিষয় নিয়ে কথা বলে সংসারে অশান্তি করে  যে সময় নষ্ট হবে সে সময়ে দুটো রোগী দেখলে তার বাড়তি পয়সা আসবে। কিন্তু এবার আর সে নিশ্চুপ থাকতে পারল না। প্রথমে বাধা না দিলে রুমা ধরে নেবে সে যা বলছে তাতেই আসিফ রাজি। সেটা হতে দেয়া যাবে না। সন্তানের নাম নিয়ে কথা! নাম জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত বহন করতে হয়। অবশ্যই নাম হতে হবে ইসলামি। নিজেকে নিয়ে যা ইচ্ছা করুক রুমা কিন্তু সন্তানকে নিয়ে খেয়ালিপনা চলবে না। 

: কি বলছ পাগলের মতো, মানুষের নাম একুশ হয় নাকি? আর ভাষা ওটাইবা কেমন নাম! তাছাড়া সন্তানের নামকরণের জন্য বাবা-মা আছেন, তারাই রাখবেন। 

: ওনারা ভালো নাম রাখবেন তাতে তো আমার আপত্তি নেই। কিন্তু ডাকনাম রাখব আমি। তুমি বলছ একুশ কোনো নাম হয় না। কেন হয় না শুনি? একুশ এ দেশের ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় অধ্যায়। এ দেশের স্বাধীনতার প্রথম বীজটি উপ্ত হয়েছিল ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। একুশে ফেব্রুয়ারিতে যে রক্ত ঝরেছিল সেই রক্তস্নাত পথ ধরে এদেশে স্বাধীনতা এসেছে। আর স্বাধীনতা এসেছে বলেই তুমি আমি আজ স্বাধীন দেশের নাগরিক। তোমার সন্তান জন্ম নিতে যাচ্ছে স্বাধীন দেশে। আর যে কারণে একুশ নাম রাখা যায় সেই একই কারণে ভাষা নামও রাখা যায়। 

: কিন্তু 

: কোনো কিন্তু নেই আসিফ। ওই নাম না রাখলে আমার আমিত্বকে অস্বীকার করবে তুমি। এত সহজে সব কথা ভুলে গেলে তুমি! সেই রক্তঝরা ফাল্গুন, ১৯৫২ সাল? আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। মোহাম্মদ আলি জিন্নাহ বলল, উর্দু এন্ড অনলি উর্দু উইল বি দা স্টেট ল্যাঙ্গুয়েজ অব পাকিস্তান। সব ভুলে গেলে তুমি! 

: রুমা তুমি ভুল করছ, এসব কথা আমার মনে থাকার কথা না। আমরা অরজিনালি এ দেশের না। 

: ওহ তাইতো, তাই তো, সেটা তো আমি ভুলেই গিয়েছিলাম। ভুলে গিয়েছিলাম ৬৫-এর পাক ভারত যুদ্ধের পর তোমরা এসেছ এদেশে। ভুলে গিয়েছিলাম তুমি একজন মাইগ্রেটি। 

: সেজন্য কী তোমার মনে কোন দুঃখ আছে রুমা? 

: দুঃখ! তা বোধহয় কিছুটা আছে। যাক, জানো না যখন শোনো সে কথা। শোনো ’৪৮ এর সেই দিনে জিন্নাহ বলল, উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। ভাষা মতিন হাত তুলে বললেন, নো নো নো। এর আগে একবার গণপরিষদের অধিবেশনে কুমিল্লার ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। কিন্তু কোনো ফল হয়নি সে প্রতিবাদে। তা সেদিন ভাষা মতিনের কণ্ঠে সেই না না ধ্বনি সারাদেশের সাড়ে সাত কোটি বাঙালির অন্তরের ধ্বনি হয়ে উঠল। ফুঁসে উঠল বাঙালি, শুরু হলো আন্দোলন। 

: এসব ইতিহাসের কিছু কিছু আমি জানি। 

: না তুমি জানো না। আর জানলেও তোমার চেতনার মূলে নাড়া দেয়নি সে জানা। নইলে ছেলে মেয়ের নাম একুশ আর ভাষা রাখতে তুমি প্রতিবাদ করতে না। আসিফ তুমি শুধু ডাক্তারিই করেছ, এ্যানাটমি, ফিজিওলজি পড়েছ । কিন্তু কখনও কি পড়েছ আবু জাফর ওবায়দুল্লার সেই অমর কবিতা, মাগো ওরা বলে/ পড়েছ কি হাসান হাফিজুর রহমানের সেই, অমর একুশে/ সালাম, রফিকউদ্দিন, জব্বার কী বিষণ্ন থোকা থোকা নাম/ এই শহীদের বর্ষার তীক্ষ্ণ ফলার মতো এখন হৃদয়কে হানে/ পড়োনি। তুমি কি জানো প্রভাতফেরিতে কেন পায়ে জুতো পরা হয় না, কেন নগ্ন পায়ে প্রভাতফেরি হয়? জানো না। জেনে রাখো, সেদিন যারা শহিদ হয়েছিলেন তাদের সবার পা ছিল নগ্ন। অন্য দেশ থেকে এসে এ দেশি হয়েছ। এ দেশের ভাষা-সংস্কৃতিকে ভালবাসতে শেখোনি। শেখোনি করতে এ দেশের শিকড় অনুসন্ধান! 

: অনেক হয়েছে রুমা, অনেক বলেছ । এবার থামো। তোমাকে কিছু বলি না বলে..

: বলো  না কেন, বলো? শোন আজ আমাকে তুমি থামাতে পরবে না। তুমি কি জানো ২১ ফেব্রুয়ারির সেই ঐতিহাসিক ঘটনার কথা? জানো না। জানলে গর্বে বুক ফুলে উঠত তোমার। নিজেই সন্তানের নাম  রাখতে একুশ অথবা ভাষা। 

: রুমা তুমি বলতে বলতে অনেক বলে ফেলেছ। শোনো এমন ইতিহাস পৃথিবীর সব দেশেরই আছে, এমন সংগ্রাম পৃথিবীর সব দেশেই হয়। 

: হয় মানি। কিন্তু ভাষার জন্য সংগ্রাম এ দেশে ছাড়া অন্য কোনো দেশে হয়নি। ভাষার জন্য রক্ত এ দেশ ছাড়া অন্য কোনো দেশের মানুষ দেয়নি। 

: রুমা তোমার এসব কথা শোনার মতো পর্যাপ্ত সময় আমার নেই। আমার পেসেন্টরা বসে আছে। 

: হ্যাঁ সেটাই তোমার জন্য জরুরি। তোমার সাধ্যের দ্বিগুণ তিনগুণ  রোগী দেখবে তুমি। রোগীদের এক মিনিট করেও সময় দেবে না। মানিব্যাগ ভরে পকেট উপচে টাকা উথলে উঠবে আর সেই টাকা নিয়ে তুমি বাড়ি ফিরে আসবে। 

: কিন্তু এসব কার জন্য  করি শুনি? রুমা সারাজীবন তুমি শুধু আমার খারাপ দিকটাই দেখে গেলে। আমি বলে একটা পঙ্গু এক হাতবিহীন মেয়েকে বিয়ে করেছি। বলো দাম্পত্য জীবনে আমি কি পেয়েছি? একজন স্বামীর কি ইচ্ছে হয় না তার স্ত্রী তাকে দু’হাত দিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরুক, তার কি ইচ্ছে হয় না যে স্ত্রীকে সাথে নিয়ে সে পথ চলবে  সে হবে একজন পরিপূর্ণ মানুষ? এই যে তুমি মা হতে চলেছ, তৃুমি কি কখনও পারবে তোমার সন্তানকে দু’হাত দিয়ে কোলে তুলে নিতে? পারবে না। অথচ তোমার মতো একজন অপূর্ণাঙ্গ স্ত্রী নিয়ে আমি জীবন কাটিয়ে দিলাম। এ দুঃখ কি আমার কম! 

রুমা থমকে যায়। ও অনেক আগেই বুঝেছিল বাবার টাকার জন্যই হাত না থাকলেও রুমাকে বিয়ে করেছ আসিফ। তবে বিয়ের আগে বোঝেনি এটাই আক্ষেপ। রুমার চোখে বেয়ে পানির ক্ষীণ ধারা নামে। দ্রুত সে ধারা বেগবান হয়। চোখের পানি পায়ের কাছে জমা হতে থাকে। চোখে পানি নিয়ে ঋজু ভঙ্গীতে আসিফের দিকে  মুখ তুলে তাকায়। কণ্ঠে দৃঢ়তা। 

: দুঃখ করো না আসিফ, গর্ব করো। কারণ তোমার স্ত্রী তার হাত হারিয়েছে একুশে ফেব্রুয়ারির সেই ভোরে একশ চুয়াল্লিশ ধারা ভেঙে ব্যারিকেড টপকাতে গিয়ে পুলিশের গুলিতে। সে জন্মগত প্রতিবন্ধি নয়, ভাষাসৈনিক। তোমার সন্তানকে তার মা দু’হাতে কোলে  তুলে নিতে পারবে না সত্যি কিন্তু দিতে পারবে ভাষাসৈনিকের উত্তরাধিকার। 

এরপর এক সকালে  রুমার ছেলে জন্মায়। রুমা এক হাতে তাকে উঁচু করে বলে , একুশ আমার একুশ। তোর মায়ের দু’হাত নেই তাতে কী হয়েছে বাবা, তোর মায়ের কাটা হাতে যে ভাষা আন্দোলনের চিহ্ন আছে!

আফরোজা পারভীন
আফরোজা পারভীন