ঘরহীন মানুষ ঘরে ফেরে না/ রোকেয়া ইসলাম

ঘরহীন মানুষ ঘরে ফেরে না রোকেয়া ইসলাম

ঘরহীন মানুষ ঘরে ফেরে না/ রোকেয়া ইসলাম

 

পুরা তিনটা মাস ঘরে বসা। একটা ফুটা পয়সাও কামাই নাই। এতোগুলান মাইনসের চলে কেমনে?

জিজ্ঞাসাটা কার কাছে করলো নিজেও জানে না সামাদ। একটা গাছের নিচে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বুক ভরে জোরে শ্বাস টানে। আবার ছেড়ে দেয়।

এতোক্ষণে একটু ভাল লাগে। যুদ্ধ করার জন্যও শক্তি লাগে। জীবনের সাথে যুদ্ধ করার জন্য নিজের দেহের শক্তির সাথে মনোবলও লাগে।

ওরা গরীব দেহের জ্বালানী শক্তি তেমন জোগান দিতে পারে না ওরা । বেঁচে আছে শুধু মনোবলের উপর নির্ভর করে। এই মনোবলটাই পায় কোথা থেকে?

আবারও একটা প্রশ্ন জমা হয়। এবার আশেপাশে তাকায়।  কেউ আছে কিনা ভাল করে খেয়াল করে।

আশপাশে গাছপালা ছাড়া কেউ কেউ নেই। একটুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে গাছের ছায়ায়।

দূরের বাড়িগুলো থেকে মানুষের কথার শব্দ ভেসে আসছে।

যাক কেউ না কেউ তো আছে। দূরে হলেও।

আবার হাঁটতে শুরু করে।

এই যে নিজের মনের উত্তরহীন প্রশ্ন তৈরি হওয়া, গাছের ছায়ায় দাঁড়ানো কেন?

কেন নিয়েই হাঁটতে হাঁটতেই উত্তর পেয়ে যায়। বাড়িতে কতগুলো অভুক্ত মানুষ রয়েছে তাদের জন্য খাবারের জোগাড় করতে মানে নিজের জন্য কাজ জোগাড় করতে গিয়েছিল।

কোনটাই হয় নাই। একটা হলে আরেকটা অনায়াসেই হতো।

এই সময় কোথায় পাবে কাজ! কে দেবে কাজ!

 

সামাদ শহরে গার্মেন্টসে বেশ কয়েক বছর আগে থেকেই কাজ  করে । সেখানেই পরিচয় হয় মা মরা শেফালির সাথে। পরিচয় থেকে প্রেম, প্রেম থেকে বিয়ে।

বাবা প্রথমে রাজি ছিল না বিয়েতে। তার ঘাড়ে তখনও তিন তিনটে অবিবাহিত কন্যা। গোণা বেতনের বেশিরভাগ টাকাই সংসার খরচের জন্য বৃদ্ধ বাবার কাছে পাঠায় সামাদ। নিজে টেনেটুনে চলে।

বিয়ের পর টাকা পাঠানো বন্ধ হয়ে যাবে ভেবেই অরাজি তিনি।

মা রাজি হয়ে যায়। সামাদ মেসে কি খায় না খায়,  কে ওর কাপড় ধুয়ে দেয়,  বিছানা গুছিয়ে দেয়। কে তার ছেলেটার যত্ন করে কে জানে। বিয়ে করলে অচেনা শহরে তাও ওর একটা সাথী হবে।

কাজী অফিসেই বিয়ে সেরে ফেলে।

বহুদিন বাবা হররাজী ছিল। বউ নিয়ে বাড়িতে যাবার সাহস পায়নি।

মা বোনেরাই উদ্যোগী হয়ে বউসহ ওকে গ্রামে নিয়ে আসে।

 

মা বাবাকে বোঝায় ওরা দুজনেই শহরে কামাই করছে তাই বাড়িতে টাকা পাঠানো বন্ধ তো হবেই না উপরন্তু সহজ হবে।

বাবা মুক্তিযোদ্ধা যদিও সরকারি তালিকায় নাম নাই।  তবে তিনি তার মুক্তিযোদ্ধা পরিচয়ে গর্ববোধ করেন।

ছেলের টাকার উপর তার অধিকার আছে,  দাবী আছে। তাই বলে পরের মেয়ের কষ্টের কামাই হাত পেতে নিতে হবে বিষয়টা নিয়ে দীর্ঘদিন মনোকষ্টে ভুগতেন।

বোনদের বিয়ে দিয়েছে জমি বিক্রি করে। সামাদের টাকা হাত পেতে নেয়নি। খরচের খাত দেখিয়ে দিয়েছে সামাদই খরচ করেছে।

বাবার এই আত্মমর্যাদার বিষয়টি সামাদের খুব ভালো লাগে। হাড় গলে গেলেও কারো কাছে অন্যায়ভাবে হাত পাতে না।

এই শিক্ষাটা সামাদের ভেতরেও কাজ করে।

তাইতো দুটো ছেলেমেয়েকে মায়ের কাছে রেখেছে ওদের চাকুরী করতে সুবিধা হবে বলে। মা খুব আনন্দের সাথে দুই নাতি নাতনিকে পালছে।

ওদের খরচ বাবদ বেশকিছু টাকা সংসারে দিতে পারে। বাবাও আর মনোকষ্টে দ্বিধান্বিত হয় না

ওরাও নির্ঝঞ্ঝাটভাবে শহরে চাকুরী করে।

শেফালী দুতিনমাস পর পর এসে ছেলেমেয়েদের দেখে যায়।

গ্রামের স্কুলে লেখাপড়া করে ওরা। বাড়িতে পড়ানোর জন্য মাষ্টার রেখে দিয়েছে। সংসারে টাকার অভাব থাকলেও ঝামেলাবিহীন যাপনই করছিল গার্মেন্টসের জটিল বিপদজনক জীবন।

 

হঠাৎ করোনা নামক অদৃশ্য এক অনুজীব পাল্টে দিলো ওদের যাপনের চিত্র।

লকডাউনে চলে এলো গ্রামে একমাসের বেতন গার্মেন্টস মালিকের ব্যাংকে রেখে।

গার্মেন্টস খোলার ঘোষণায় সামাদ আর শেফালী জীবনীশক্তি পানি করে এসেছিলো শহরে।

পনেরোদিনের বেতন হাতে ধরিয়ে খুব তাড়াতাড়ি ওদের কাজে ডাকবে বলে বিদায় করে দেয় মালিক।

এই অসময়ে কোথায় নতুন চাকুরী খুঁজবে, বাড়িওয়ালা বাড়িতে উঠতেই দিচ্ছে না।

চাকুরী হারিয়ে ফিরে আসে গ্রামে।

হাতের টাকাও শেষ হয়ে যায় শহরে আাসা যাওয়ায়।

 

শেফালীর কানের দুল জোড়া একেবারে জলের দরে বিক্রি করে দেয়। বিক্রি যে করতে পেরেছে এই তো বেশি। পাশের গ্রমের এক মহাজনের কাছে বন্ধক রাখতে গিয়েছিল সে । বন্ধকে রাজি হলো না তাই জলের দরে সেঁধে বেঁচা।

সে টাকায় চলেছে বেশ কয়েকদিন। চলা মানে দিন টেনে রাতের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়া। রাত নিয়ে আসে ভোর। ভোরের সূর্য নিয়ে আসে ক্ষুধা আতংক অনিশ্চিয়তা।

আজ সামাদ নিরুপায় হয়ে গিয়েছিল উপজেলায়। ব্যর্থ হয়ে ফিরছে এখন।

 

সন্ধ্যায় পা টিপে টিপে বাড়িতে ঢুকতেই দেখে মা রান্না করছে, শেফালী কাটাকুটি করছে।

অবাক যতটা না তারচেয়ে অনেক বেশি খুশি হয়ে চুলার কাছে যায়।

দূর থেকে শুনতে পায় শাশুড়ী বৌ কথা বলছে।

– মা কদুর তরকারি হইলে আপনে ঘরে যান

আমি ব্যাবাক সাইরা ফালামুনে।

– হ তাই যামুনে।

বলেই কুপির আলোতে দেখে ওদের কাছে সামাদ নিঃশব্দ পায়ে এসে দাঁড়িয়েছে।

 

-ওমা তুই কম্বে আইলি। যা বাজান আত পাও ধুইয়া ল। বৌ ওরে পানি আওগাইয়া দেও।

হাত পা ধুয়ে ঘরে যেতেই ছেলেমেয়ে দুটো গলা জড়িয়ে ধরে আব্বা আব্বা বলে। পাশের চৌকিতে বসে বাবা মাগরেবের নামাজ শেষ করে বসে তজবি গুনছে মনে মনে।

হ্যারিকেনের স্বল্প আলোতে দেখে বাবার ঠোঁট দুটো নড়ছে চোখ দুটো ভক্তিতে আধো বোজা।

কি নামে ডাকছে বাবা তার সৃষ্টিকর্তাকে। কি বলবে তার কাছে।

এই যে ওদের বাড়িঘর নদীতে নিয়ে গেছে ওরা বাঁধের নামায় অস্থায়ী ঘর তুলে আছে তার জন্য নালিশ, না মুক্তিযুদ্ধ করে সনদ পায় নি তার জন্য কোন অভিযোগ, না কি করোনা নামক মহামারীতে সারা দুনিয়ায় বিপদ, সেই বিপদ থেকে উদ্ধার পাওয়ার আবেদন। কি বলবে তার আজীবন সংগ্রামী বাবা তার একমাত্র সৃষ্টিকর্তাকে!

– আব্বা কিছু মিছু আনছো আমগো লিগা?

চমক ভেঙে দেখে মেয়েটা ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।

অসহায়ত্ব গ্রাস করে লজ্জিত ভঙ্গিতে তাকায় ছেলেমেয়ে দিকে। ভেঙে যেতে থাকে সামাদ।

– আইছোস সামাদ। বয় আমার কাছে।

বাবার ডাকটা উদ্ধার করে সামাদকে। বাবার কাছে গিয়ে বসে।

– দেখছোস পানি বাড়তাছে কি চোটে।

– দেখছি। কইমা যাইবনে।

– নারে বাজান গতিক ভালো ঠেকতাছে না। উজানি বাও গেছে আসমান দিয়া। হেইডি যহন ফিরব তহন তো দ্যাশ দুইন্ন্যা তলাইয়া না যায়।

-অতো চিন্তা কইরো না, বাঁধ আছে না।

-বাঁধটাই ভরসা। তয় বাবা কতা অন্য জায়গায়। কাঁচা বাঁধ তো থাকব না । টেন্ডার হইয়া গেছে। যহন কাম শুরু করব তখন তো ঘর বাড়ি এহান রাখব না । সরাইয়া ফালান লাগব।

সামাদ অন্ধকারে তাকিয়ে থাকে বাইরে।

-কিছু চিন্তা করলা বাবা?

-দেহি কি করন যায়। করন তো লাগবই একটা কিছু।

সকালে দরজা খুলতেই একঝাক কিচির মিচির শব্দ উঠোনে তাকায়। মুরগীর খোপ খুলে দিয়েছে মা। হাঁস মুরগী হুড়মুড়িয়ে বেড়িয়ে পড়ে। গত কয়েকদিনের তুলনায় আজ হাঁস মুরগীর বহরে সদস্য সংখ্যা কম মনে হচ্ছে।

 

গতরাতের ভাতের রহস্য ফাঁস হয়ে যায় ওর কাছে। উঠোনের কোনায় খোটায় বাঁধা ছাগল ভ্যাবায়। শব্দ অনুসরণ করে চোখ যায় সামাদের। এখানেও গতদিনগুলো থেকে স্বল্পসংখ্যক । মা ছাগলটাকে দেখতে পায় না। ছোট দুটো বাচ্চা ম্যা ম্যা করছে।

ততোক্ষণে মা বাসি কাজকর্ম সেরে উঠোনের কোণে গাছের ছায়ায় বসে জিড়িয়ে নিচ্ছে। শেফালী চুলো ধরিয়ে রান্নাটা শেষ করছে।

দিন শুরুর সময়টা হঠাৎ সন্ধ্যার আঁধার ঘনিয়ে আসে।

– হায় আল্লাহ কি হইলো বিয়ানকালে এমুন আন্ধাইর রাইত নাইম্যা আইলো ক্যা। ও বৌ তুমার রান্ধনের কতদূর।

– ডাইলডা সুম্বার দিলেই রান্ধন শ্যাষ।

– তাইলে আইসাল নিবাইয়া গরে যাও গিয়া।

মা শেফালীকে কাজের নির্দেশ দিয়ে নিজে দ্রুত হাতে ছাগল গরু ঘরে তুলে উঠোনে ফিরে আসে।

– হায় হায় এইডা কি হইলো এই অসুময়ে তফান উই্ঠা আইলো ক্যা।

সামাদ উঠানে দাঁড়ায়। বাতাসে ধুলোয় চারদিক আঁধার করে দেয়। একটু পরে হালকা বৃষ্টি শুরু হয়।

বৃষ্টি শুরু হতেই বারান্দায় দাঁড়ায়। ওর বুকের ভেতর অজানা কাঁপন টের পায়। করোনার সাথে সাথে অভাব চারপাশের খারাপ সময়ের সাথে যুদ্ধ করছে। তবুও আজকের এই কাঁপনটা অন্যরকম।

বাঁধের উপর অনেক মানুষের শোরগোল পাওয়া যায়। গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি উপেক্ষা করে সড়কে যায়। মা ওর পেছনে পেছনে এসে দাঁড়ায়।

– আচুক বিষয় কুনুদিন এমুনটা দেহি নাই। কি গজব নাজেল হইলো কও দেহি।

সামনের বিশাল জলরাশি বাতাসের তোড়ে ফুলে উঠে আছড়ে পড়ছে বাঁধ উপচে এপাড়ে। সামনের জলরাশিকে বাতাসের বাদ্দ্যের সাথে নাচনে দেখে মনে হচ্ছে জল দৈত্য হুঙ্কার দিয়ে এপাড়ে হামলে পড়ছে।

দেখতে দেখতে পুরো গ্রামসহ আশেপাশের গ্রাম ভেঙে মানুষ ভীড় করে।

বৃষ্টিকে কেউ তোয়াক্কা করছে না। এ তো সামান্য বৃষ্টি। এ ছিঁটে গায়ে লাগলে তেমন কিছুই হবে না। কিন্তু এ জলোচ্ছ্বাস না থামলে মহা সর্বনাশ হয়ে যাবে!

ওরা কেউ কখনো এমন ঝড় জলোচ্ছ্বাস দেখেনি। শুধু টিভিতে দেখেছে।

এ এলাকা সমুদ্র উপকূলোবর্তী নয়।

ওরা নদী ভাঙন দেখেছে। গ্রামের পর গ্রাম ভেঙে যেতে দেখেছে।

সে ভয়ংকর মোলায়েম সত্যের কাছে আজকের এই কঠিন ভয়ংকর সত্য মহাবিপর্যয় রোজ কেয়ামতের ভয়াবহতা নিয়ে নাজেল হয়েছে।

– ব্যাকেই আল্লাহরে ডাকো। আজান দ্যাও জোরে জোরে। আজান দ্যাও

-হুজুর হিন্দুরা কি করব।

মহা আপদের দিনে আরেক সমস্যার কথা নিয়ে হাজির হয় সামাদ। সরু দৃষ্টিতে তাকায় হুজুর সামাদের দিকে।

– হ্যারা হ্যাগো মতন ডাকুক। আমরা মুসলমানগো বাঁচনের কতা ভাবি এই গেরামের ভালার কতা ভাবি।

– হ্যারাও তো আমাগো গেরামের মানুষ। হ্যাগো কতাও ভাবন লাগব। হ্যাগো ক্ষতি মানে গেরামের ক্ষতি।

-তুমি মিয়া দুইদিন শহরে থাইকা খুব বুঝনদার হইছো। গেরামের ভালো-মন্দ তুমি কি বুঝবা।

পেছন থেকে এগিয়ে আসে মেম্বারের ছোট বৌর মেজ ভাই।

-হ্যায় গেরামের ভালামন্দের কি বুঝব । হ্যারাতো এই গেরামেরই না। নদী ভাঙা। উঠুলি আইছে। বাঁধের নামায় বাড়ি কইরা থাহে।

-তাইতো কই গেরামের ভালা বুঝবার গে ক্যারা। হ্যাগো তো পুড়ানি নাই। আইজ নদী ভাইঙ্গা আইচে কাইলঐ বানে ভাইসা চইলা যাইব। গেরাম আমাগো, ভালা মন্দ আমরা বুঝুম।

– আইচ্ছা তুমরা থামবা নাকি হুদাই নাই কতা নিয়া ক্যাচাল করবা?

পেছন থেকে এগিয়ে আসে কাসেম মিয়া।

– আপনে থামেন। দ্যাখলেন না হুজুরের উপর দিয়া কত বড় একহান কতা কইয়া ফালাইলো। গেরাম বিষয়ে হে কতা কওনের ক্যারা

মেম্বারের শ্যালকের গলাটা চড়া।

– ক্যারা কতা কওনের পরে দেহন যাইবনে। আগে তো গেরাম বাচুক।

এতোক্ষণে খেয়াল করে ঝড়ের মাত্রা বেড়ে গেছে। জলোচ্ছ্বাস আরো উঁচু হয়ে পানি বাঁধের উপর দিয়ে গ্রামে প্রবেশ করছে।

– হুজুর আজান দেন জোরে জোরে। নিবারন তুমরা তুমাগো ভগবানরে ডাকো।

সামাদ তাকিয়ে থাকে কাসেম মিয়ার দিকে। আসন্ন সংঘাত কি চমৎকার করে মিটিয়ে দিয়ে সবাইকে এক কাতারে দাঁড় করালো। তবুও দুটো দলেই বিভক্ত হয়েই যার যার প্রিয় নামে সৃষ্টিকর্তাকে ডাকতে থাকে।

জলোচ্ছ্বাসের উচ্চতা বাতাসের গতির সাথে সাথে কমতে থাকে। সৃষ্টিকর্তা ডাক শুনেছে মনে করে খুশি হয়ে আরো জোরে জোরে ডাকতে থাকে।

বাতাসের গতিবেগ একেবারেই থেমে যায়।

তখুনি দৌড়ে আসে সামাদের ছেলে

-আব্বাগো তাড়াতাড়ি আহো দাদায় জানি কিবা করতাছে।

 

বাড়িতে ঢুকতে ঢুকতেই সামাদের বাবা পরপারে যাত্রা করে। আর সাথে সাথে শুরু হলো আকাশ ভেঙে বৃষ্টি। বৃষ্টির শব্দের ভেতর মিশে গেল ওদের হৃদয় ছেঁড়া চিৎকার, কলজে নিংড়ে কান্না।

ঝড় বৃষ্টি থেমে গেল। যাত্রার আয়োজনও সম্পূর্ণ হলো।

হুজুর প্রশ্ন তুললো, মৃত ব্যাক্তি করোনা আক্রান্ত ছিল। তার কবর এই গ্রামে দেয়া যাবে কি?

– তার যে করোনা আছিল এইডা কইলো ক্যারা?

পাল্টা প্রশ্ন গ্রামের আরেক যুবকের। সামাদ শহর থেকে করোনা নিয়ে ফিরেছে এমন একটা কথা বৃষ্টিতে চুপসে গেলেও মৃদু ভেজা বাতাসের মত গায়ে পরশ বুলায়।

সামাদ গ্রামে ফিরেছে তিনমাসের অধিক।  চৌদ্দদিনের কোয়ারেন্টাইন পার হয়েছে অনেক আগেই।

তর্ক বিতর্ক খুব একটা জমে না । সবাই ব্যতিব্যস্ত বাঁধ রক্ষা নিয়ে। গড়িমসি করেও মসজিদ কমিটির চাপে হুজুর জানাজা পড়ায়। তবে লোকজনের উপস্থিতি হাতে গোণা কয়েকজন।

গোরস্থানেন বাবাকে শুইয়ে দেবার আগে বুকের ভেতর বিউগল বেজে উঠে জাতীয় পতাকার রঙে সয়লাব হয়ে যায় চোখের পবিত্র জলের ঢেউয়ে।

মুক্তিযোদ্ধা বাবা, তুমি সারাজীবন নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা বলে জানলে যুদ্ধের কথা বললে স্বাধীনতার কথা বললে। তোমার বিদায় এমন নির্মমভাবে হলো। কেউ এলো না, হুজুর কোনমতে দোয়া পড়লো। গোরস্থানে জায়গা নিয়ে আপত্তি তুললো কেউ কেউ। তোমার যাবার সময় এই স্বাধীন দেশ তোমাকে একটা সালামও দিলো না।

মনের কথাগুলো ভেতরের অদৃশ্য আগুনে চাপা দিয়ে রাখলো।

বাবা মুক্তিযোদ্ধা বললে নানাজনে না না প্রশ্ন তুলবে। সনদ নেই। তখন মৃত বাবাকে ভুয়া উপাধি নিয়েই যেতে হতো।

রাতে বাঁধের একটা অংশ ভেঙে গ্রাম পানিতে সয়লাব হয়ে যায়।  সরকারি লোকজন নৌকা ভর্তি করে জিও ব্যাগ নিয়ে বাঁধ রক্ষার চেষ্টা করে। ততোক্ষণে গ্রামবাসীর যা ক্ষতি হবার হয়ে যায়। উঠোনে পানি ঘরের মেঝেতে পানি।

মা হাঁস মুরগী গরু ছাগল  দিয়ে ছেলেমেয়ে দুটোকে বাঁধের উপর পাঠিয়ে দেয়।

ঘরের ভেতরে চৌকির উপর বসবাস করে ওরা।

– সামাদ ও সামাদ, বাইরে আহো কতা আছে। ও সামাদ সামাদ।

হুজুরের ডাকে চৌকি থেকে লুঙ্গিটা নিতম্ব ছুঁই ছুঁই করে বেঁধে বাঁধের উপরে আসে।

– দেহ তুমাগো শোকের দিন আর সুময়ও ভালা না। দেহ মিয়া আইজ মরলে কাইল দুইদিন। তুমার বাপে মরছে আইজ তিনদিন হইলো।

– হ জানি। বুকের কেমুন জানি করে মনে কয় কি জানি নাই!

-আইজ মুল্লা খিলাইয়া দোয়া করনের দিন । তুমার বাপটা মাটির তলে শুইয়া দেখতাছে। একটু দোয়ার লিগা হাত পাইতা রইছে। বুঝলা।

– আমি আমার বৌ দোয়া করতাছি। আর মায় তো হারাদিনই দোয়া করতাছে আল্লাহর কাছে দুই হাত তুইলা। কাঁনতে কাঁনতে দুইডা চোখ ফুলাইয়া ফালাইছে।

– তুমি সবসময়ই এট্টু বেশি বুঝ। এতো বেশি বুঝা ভালা না। আমি কইলাম মুল্লা খিলাইয়া কোরান হাদিস দেইখা দোয়া পড়নের কতা। আর তুমি কইলা তুমরা কি দুয়া করতাছো হেই কতা। কয়ডা কিতাব পড়ছো কয়ডা হাদিস জানো?

-আমি মক্তবে কুরআান খতম করছি।

-রাখ মিয়া তুমার কুরআন খতম করনের গপ্প। কুন গেরামে আছিলা তুমরা। কুন তরিকার মুল্লার কাছে কুরআন খতম করছো? 

– আপনেরা কয়জন?

হুজুরের কথার ফাঁক দিয়ে মা ঢুকে যায়।

– আপনে। আপনে আবার আইলেন কেন।

– কয়জন কইলেন না? 

শুকনো কন্ঠ চিঁরে বের হয় শব্দগুলো।

-বুঝলেন তো মুর্দার গোর আজাব হইতাছে।

সামাদ কিছু বলার জন্য প্রস্তুতি নিতেই মা ওর হাত চেপে ধরে।

মা ছেলের বিষয়টা হুজুরের চোখ এড়িয়ে যেতে পারে না। মা রাজী হয়েছে,  ছেলের বাড়াবাড়িতে যদি আজকের কুলখানির আয়োজনটা মাঠে মারা যায় তাহলে তো সর্বনাশ! কতদিন ভালমন্দ খাওয়া হচ্ছে না। এই করোনা এই আমফান এই বন্যা কত কিছু যে আসছে। আরে এই গজব কি এমনি এসেছে। এই বান্দারা দুই কলম লিখতে পড়তে পারলেই মুল্লা মৌলবী মানে না।

সামাদের মা উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।

– তা সবমিলাইয়া সাত আস্টজন তো হইবই। গোর দেওনের সময় জানাজার সময় তারা আছিল তো। অহন করোনাকালে জানাজায় মানুষ কই পাইবা।

– আইচ্ছা। ঠিক আছে। নামাজ পইরা গোরস্থানে দোয়া কইরা বক্সাইয়া দিয়া আইসেন।

– তুমাগো অবস্থা তো জানিই। বেশি কিছু করন লাগব না। গোশত ডাইল বেগুন ভাজা আর ভাত। আর অহন দৈ পাইবা কই। খাওনের পর মিঠাই খাওয়া সুন্নত। জাইনা শুইনা সুন্নত ছাড়নডা ঠিক না।

-ঠিক আছে হইবনে। কিন্তক খাইবেন কোনহানে বইসা। উঠানে তো পানি। ঘরেও পানি।

প্রচন্ড সমস্যা হাজির হয় সামনে। কোনভাবে ফসকে যেতে চাইছে সামাদের মা। এতো কষ্ট করে রাজি করালো এখন নতুন সমস্যা বের করে ওকেই বোকা বানানোর মতলব।

দাড়িতে হাত বুলাতে বুলাতেই সমাধান বের কর হুজুর।

-সমস্যা তো হইলোই। খাওনডা বড় কতা না বুঝলা বড় কতা হইলো দুয়া। পরান ভইরা দুয়া করুম। বান্দার কদমে কদমে পাপ। আল্লাহ দয়ার ভান্ডার নিয়া বইসা রইছে। তার কাছে চাওয়ার মত চাওন লাগব।

একটু থামে। চারদিকে তাকায়। মা ছেলের মনোভাব বুঝতে চেষ্টা করে।

– গোর আজাবের জন্য খাস দেলে দুয়া করন লাগব। বড় কঠিন এই গোর আজাব।

আইচ্ছা এক কাম কর রাইন্দা এই দোকান ঘরে খাওন দিয়া যাইও।

বলে আর দাঁড়ায় না এগিয়ে যেতে যেতে একটু থামে।

 

কিছু বলার উপক্রম করতেই ওকে নিয়ে পানি ভেঙ্গে ভেঙ্গে ঘরে ঢোকে সামাদের মা।

চৌকির উপর তোলা উনুনে কাঁচা খড়ি দিয়ে অতি কষ্টে রান্না করতে করতে চোখের পানি নাকের পানি এক করে ফেলে। মনের বেদনাগুলো আল্লাহর কাছে ধোয়ায় পৌঁছে দেয়।

আল্লাহগো গ্যাদার বাপ কি পাপ করছে জানি না গো আল্লাহ। হারাডা জেবন তুমারেই মানছি গো আল্লাহ। আর তো কেউরে ডাকি নাই। হে তো নমাজ পড়ছে। কুনুদিন কেরোর খারাপ চায় নাই।

এই যে পানির তলে মাটি তার তলে হে রইছে তুমার হাওলা। আমরা ব্যাহেই কাইন্দা কাইন্দা না খাইয়া তুমার কাছে মাফ চাইতাছি। তুমি কি আমাগো দুয়া হুনবা না। হুজুর তো গ্যাদার বাপরে ভাল কইরা চিনেও না কি দোয়া করব তার লিগা।

কাঁচা লাকড়ির ধোয়া গোল্লা পাকিয়ে উপরে উঠে। টিনের চালে ধোয়া ছড়িয়ে পড়ে নতুন ধোয়া দল গিয়ে পুরাতন ধোয়ার সাথে মিশে ছড়িয়ে পড়ে যন্ত্রণার আবহ নিয়ে।

রান্না শেষ করে বাটিতে বাটিতে তরকারি গামলায় ভাত চামচ বাসন সাজিয়ে দুই মায়ে পুতে দোকান ঘরে পৌছে দেয়। ওরা পৌছানোর সাথে সাথে হজুর তার দলবল নিয়ে হাজির হয়। খেয়ে  পরিতৃপ্ত হয় সবাই।

সন্ধ্যায় বাঁধের উপর নীরবে দাঁড়িয়ে থাকে সামাদ। চারদিকে পানি থৈ থৈ করছে শুধু বাঁধটাকে দ্বীপের মত মনে হচ্ছে।

ঘর ভাঙা টিনের চাল পালা পাশের গাছের সাথে হেলিয়ে রাখা আছে। গরু ছাগল হাঁস মুরগী ছোট ছোট ছেলেমেয়ের চিৎকার চেঁচামিচি বড়দের কথাবার্তায় বাঁধটাই এখন ওদের বাঁচার একমাত্র আশ্রয়স্থল মনে হচ্ছে। এটাই এখন ওদের গ্রাম।

কেউ ছোট ছোট বেড়া দিয়ে বাতাস আঁটকে রান্না করছে। গাছে হেলান দিয়ে বসে মা শিশুকে মাতৃস্তন পান করাছে।

সামাদ একটু সরে গিয়ে দাঁড়ায়।

ওর সামনে অথৈ পানি। পেছনে সবুজ গ্রাম পানিতে ভাসছে।

হঠাৎ দেখে কাফন মোড়া একটা লাস ভেসে আসছে।

-বাবা বাবাগো ও আমার বাবারে মাটিতে তোমারে গছে নাই। এই মাটির লিগা আমার বাবায় যুদ্ধ করছে সনদ পায় নাই তাই তারে দ্যাশ সালাম দেয় নাই। তাই তুমি ফিরা আইছো ও আমার বাবা। তুমি মাছের প্যাটে যাও গিয়া। বড়লোকরা বড় আদরে তোমারে পাতে নিব বাবা। মাইনসের সেবায় লাগবা

বলেই পানিতে নেমে পড়ে। সামাদ পাগলের মত দুহাত এলোপাতাড়ি পানিতে ছুঁড়তে থাকে। আর জোরে বাবা বাবা চিৎকার করতে থাকে।

ওর চিৎকারে সবাই ছুটে আসে।

রোকেয়া ইসলাম
রোকেয়া ইসলাম
%d bloggers like this: