গিবত বা পরনিন্দা – ড. মুহাম্মদ নজরুল ইসলাম খান

গিবত বা পরনিন্দা - ড. মুহাম্মদ নজরুল ইসলাম খান

গিবত বা পরনিন্দা সামাজিক শান্তিবিধ্বংসী একটি ঘৃণ্য অপরাধ। আলকুরআনে গিবতকে আপন মৃত ভাইয়ের গোশত খাওয়ার সাথে তুলনা করা হয়েছে আর হাদিসে একে ব্যভিচারের চেয়েও মারাত্মক অপরাধ বলে ঘোষণা করা হয়েছে। অথচ আজকাল অপরের দোষচর্চা যেন আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অপরের দোষচর্চা না করলে মনে হয় আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের কী যেন প্রয়োজনীয় কাজটি বাদ পড়ে গেছে! গিবত এত গোনাহের কাজ হওয়া সত্ত্বেও আমরা গিবত পরিত্যাগ করতে পারছি না, গিবত বর্জনের কোনো প্রচেষ্টাও করছি না। এর জন্য আমাদের অজ্ঞানতা, আমাদের অসচেতনতা, অবহেলা ইত্যাদিই মূলত দায়ী।

 

গিবতের পরিচয়:

গিবত আরবি শব্দ। আভিধানিক অর্থ অন্যের দোষ-ত্রুটি প্রকাশ করা, অসাক্ষাতে দুর্নাম করা, কুৎসা রটনা করা ইত্যাদি। গিবতের পরিচয় প্রসঙ্গে রাসুল (স.) বলেছেন, তোমার ভাইয়ের অনুপস্থিতিতে এমন কিছু উল্লেখ করা যা শুনলে সে অপছন্দ করবে। রাসুল (স.) আরো বলেছেন,“গিবত হচ্ছে, তুমি অপর ব্যক্তির এমন দোষ-ত্রুটি বর্ণনা করছ যা প্রকৃতপক্ষেই তার মধ্যে বিদ্যমান আছে।” ইমাম গাজ্জালী বলেন, গিবত হচ্ছে তুমি তোমার ভাইয়ের দোষ-ত্রুটি এমনভাবে উল্লেখ করলে তা যদি তার কানে পৌঁছে তবে সে তা অপছন্দ করবে। ইবনুল আসিরের মতে, “কোনো ব্যক্তির অনুপস্থিতিতে তার দুর্নাম করা, যদিও তার মধ্যে সেই দোষ থেকে থাকে তাই গিবত।” ইমাম নববীর মতে, “কোনো ব্যক্তিকে এমনভাবে উল্লেখ করা যা সে অপছন্দ করে তা প্রকাশ্যে হোক বা ইশারা ইঙ্গিতে হোক, তাই গিবত।”

আল্লামা বদরুদ্দীন আইনীর মতে, গিবত হচ্ছে,  ‘কোনো ব্যক্তি অপর কোনো ব্যক্তির অনুপস্থিতিতে তার সম্পর্কে এমন কথা বলা যা শুনলে সে চিন্তান্বিত হবে, তা সত্য হলেও। আর সে কথা মিথ্যা হলে তার নাম অপবাদ।’আল্লামা রাগিব ইস্পাহানীর মতে, ‘নিষ্প্রয়োজনে কোনো ব্যক্তির দোষ প্রকাশ করা হচ্ছে গিবত।’

বস্তুত কোনো ব্যক্তির অনুপস্থিতিতে তার এমন দোষ-ত্রুটি বর্ণনা করা, যা শুনলে সে অসন্তুষ্ট হয়, এটাই গিবত বা পরনিন্দা। গিবত বাচনিক অথবা লেখনীর মাধ্যমে অথবা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ইশারা-ইঙ্গিতে কিংবা অন্য যে কোনো উপায়েই বর্ণনা করা হোক এবং সে ব্যক্তি মুসলিম অথবা অমুসলিম হোক সর্বাবস্থায় গিবত ঘৃণ্য কাজ। যদি এমন দোষ-ত্রুটি বর্ণনা করা হয়, যা ঐ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির মধ্যে পাওয়া যায় না, তবে তা মিথ্যা অপবাদ হিসেবে গণ্য হবে। যাকে কুরআনের পরিভাষায় ‘বুহতান’ বলে।

আজকাল এমন কোনো ক্ষেত্র নেই যেখানে কম-বেশি গিবত বা পরচর্চা হয় না। অবশ্য যারা এই পরচর্চায় জড়িত তাদের কাছে গিবতের সংজ্ঞা একটু ভিন্নতর। যেমন তাদের মতে, কারো এমন কোনো দোষ বর্ণনা করাকে গিবত বলে, যা তার সামনে বলা সম্ভব নয়। অতএব, সামনে বর্ণনা করা যায় এমন দোষ-ত্রুটি বলাবলি করলে গিবত হয় না। অথচ রাসুলের (স.) হাদিস থেকে স্পষ্ট জানা যায় যে, কারো সামনে বলার মতো দোষ হোক কিংবা নাই হোক উভয় প্রকার দোষ-ত্রুটির চর্চাই গিবতের শামিল।

সমাজের কিছু লোক এ কথাও বলে যে, কারো মধ্যে যে দোষ নেই তাকে সেই দোষে দোষী করাকে গিবত বলে। কিন্তু যে দোষ প্রকৃতপক্ষে তার মধ্যে আছে তা বর্ণনা করলে গিবত হবে না। তাদের এ ধারণাটিও অমূলক। কেননা উপরের সংজ্ঞা থেকে আমরা জানতে পারলাম যে, যে দোষ বর্ণনা করা হচ্ছে তা যদি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির মধ্যে না থেকে থাকে তবে তা বুহতান (অপবাদ) আর যা গিবতের চেয়েও জঘন্য অপরাধ। আজকের সমাজের অন্য একশ্রেণির মতে, যে দোষটি অন্যের জানা নেই, সে ধরনের দোষ-ত্রুটি বর্ণনা করা গিবত। কিন্তু যা সকলে জানে, তা বর্ণনা করা গিবত হবে না। তাদেরকে গিবত বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তারা বলে, এটা গিবত নয়। কেননা আমি যা বলছি, তা সবাই জানে। এটা গিবত হয় কী করে? আসলে এটাও তাদের একটি ভ্রান্ত ধারণা। কেননা দোষ প্রকাশিত হোক বা গোপন থাক সব ধরনের দোষ বর্ণনা করাই গিবত। বরং কারো গোপন দোষ বলে বেড়ালে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির দুটো গুনাহ হবে। একটি গিবত করার গুনাহ, আর অন্যটি দোষ প্রচার ও প্রকাশ করার গুনাহ।

 

গিবতের বিভিন্ন ক্ষেত্র:

গিবত বা পরনিন্দা বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিদ্যমান। দৈনন্দিন জীবনে গিবতকে আমরা বিভিন্নভাবে লক্ষ করি। যেমন––

মুসলমানের গিবত:

এক মুসলমান অপর মুসলমানের গিবত করা সম্পূর্ণ হারাম। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন,

“তোমরা একে অপরের গিবত করো না। তোমরা কেউ কি তোমাদের মৃত ভাইয়ের গোশত খেতে পছন্দ করো? আসলে তোমরা তা ঘৃণা করো।”

 

অমুসলিম নাগরিকের গিবত:

ইসলামি রাষ্ট্রে বসবাসকারী অমুসলিম নাগরিকের গিবত করাও হারাম। কেননা অমুসলিম নাগরিক ইসলামি রাষ্ট্রে মান-মর্যাদা ও ইজ্জত-আবরু রক্ষার ক্ষেত্রে সমমর্যাদাসম্পন্ন। তাই এদের মান-সম্মানে আঘাত লাগে এরূপ গিবত করা হারাম।

যুদ্ধরত অমুসলিম শত্রুর গিবত:

ইসলামি আইন শাস্ত্রের গ্রন্থসমূহ থেকে জানা যায় যে, অমুসলিম শত্রুর গিবত করা জায়েজ। তাফসিরে কাবিরে ইমাম ফখরুদ্দিন রাযী সুরা  হুজুরাতের ১২ নং আয়াতের ব্যাখ্যায় লিখেছেন যে, কাফেরদের গিবত করা জায়েজ। সম্ভবত তিনি কাফের বলতে যুদ্ধরত শত্রু কাফেরদেরকেই বুঝিয়েছেন। এ ব্যাপারে আল্লাহ তাআলাই সর্বাধিক পরিজ্ঞাত।

 

জীবিত ব্যক্তির গিবত:

জীবিত ব্যক্তির গিবত করাও হারাম। যা উপর্যুক্ত তিন প্রকারের বর্ণনায় উল্লেখ করা হয়েছে।

 

মৃত ব্যক্তির গিবত:

মৃত ব্যক্তির গিবত করাও হারাম। তদ্রুপ মৃত ব্যক্তিকে গালি দেয়া, মন্দ বলা, তার দুর্নাম-বদনাম করাও হারাম। যদিও সে জীবদ্দশায় পাপকর্মে লিপ্ত থাকে। এ প্রসঙ্গে রাসুল (স.) বলেছেন, ‘তোমাদের কেউ মৃত্যুবরণ করলে তাকে ছেড়ে দাও এবং তার গিবত করো না।’ আর তিনি গালি-গালাজ প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘তোমরা মৃতদেরকে গালি দিও না, কারণ তারা তাদের কৃতকর্মের প্রতিদান পাওয়ার স্থলে পৌঁছে গেছে। রাসুল (স.) মৃত ব্যক্তিদের দোষ-ত্রুটি বলতে নিষেধ করার সাথে সাথে তাদের সদগুণাবলি আলোচনা করতে নির্দেশ দিয়েছেন এভাবে– “তোমরা তোমাদের মৃত ভাইয়ের সদগুণাবলি আলোচনা করো এবং দুর্নাম করা থেকে বিরত থাকো।”

 

দৈহিক কাঠামোর গিবত:

কাউকে হেয়-প্রতিপন্ন করার জন্য বেঁটে, কুৎসিত, নাক লম্বা, কানে শোনে না, চোখে দেখে না ইত্যাদি দৈহিক ত্রুটির উল্লেখ করে গিবত করা হারাম। একদা হযরত আয়েশা (রা.) বলেন ,  ‘হে আল্লাহর রাসুল, আপনি কি সাফিয়ার (রা.) বেঁটে হওয়াটা পছন্দ করেন না? রাসুল (স.) বললেন, ‘ হে আয়শা, তুমি এমন একটি কথা বললে যা নদীর পানির সাথে মিশিয়ে দিলে তার উপরও প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবে।’ রাসুল (স.)-এর স্ত্রী উম্মে সালমা (রা.) বেঁটে ছিলেন। তার সহধর্মিণীগণ এজন্যে হাসি-ঠাট্টা করলে আল্লাহ-তাআলা তৎক্ষণাৎ নাজিল করে জানিয়ে দিলেন,   “হে ইমানদারগণ! কোনো পুরুষ যেন অপর কোনো পুরুষের বিদ্রুপ না করে। হতে পারে সে তুলনায় উত্তম। আর কোনো মহিলাও যেন অপর কোনো মহিলার বিদ্রুপ না করে। হতে পারে সে বিদ্রুপকারী অপেক্ষা উত্তম।”

 

পোশাক-পরিচ্ছদের গিবত:

পোশাক-পরিচ্ছদের ক্ষেত্রেও গিবত হয়। যেমন এভাবে বলা যে, অমুক ব্যক্তি বদমায়েশের মতো পোশাক পরে, অমুক মহিলা এমনভাবে ওড়না পরিধান করে যে, তার অভ্যন্তরীণ অংশ খোলা থাকে, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বের করে চলাফেরা করে ইত্যাদি। একদা হযরত আয়েশা (রা.) বলেন, অমুক স্ত্রী লোকটির আঁচল খুব লম্বা। একথা শুনে রাসুল (স.) বললেন, ‘হে  আয়েশা, তুমি তার গিবত করলে। তোমার থুথু ফেলা জরুরি।’ আয়েশা (রা.) বলেন, ‘আমি থুথু ফেললে মুখ থেকে গোশতের একটি টুকরা বেরিয়ে আসে।’

বংশের গিবত:

কেউ যদি কাউকে তুচ্ছ ও হেয়-প্রতিপন্ন করার জন্য বলে, ‘ অমুকের বংশ নীচ বা ইতর অথবা অমুক অজ্ঞাত বংশের’ তবে এটাও গিবত হবে। ইসলামে নিজেকে খুব উচ্চ বংশীয় এবং অন্যকে নিম্ন বংশীয় বলা ঠিক নয়। কেননা বংশীয় মর্যাদা শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠি নয়। রাসুল (স.) বলেছেন,  ‘দ্বীনদারি ও সৎকর্ম ব্যতীত কোনো ব্যক্তির অপর ব্যক্তির উপরে শ্রেষ্ঠত্ব নেই।’ এ প্রসঙ্গে আল্লাহ, “নিশ্চয়ই আল্লাহর কাছে সেই বেশি সম্মানিত যে বেশি আল্লাহভীরু।”

 

অভ্যাস ও আচার-আচরণের গিবত:

কেউ যদি কারো অভ্যাস ও আচার-আচরণের কথা উল্লেখ করে বলে, ‘অমুক কাপুরুষ, ভীরু, অলস, পেটুক, নির্বোধ, স্ত্রীর কথায় ওঠে বসে, পরিণামের কথা ভেবে কাজ করে না’ ইত্যাদি গিবতের অন্তর্ভুক্ত। একদা এক সাহাবি কোনো এক ব্যক্তির নাম উল্লেখপূর্বক বলেন, ‘সে এক আজব লোক। কেউ তাকে খাদ্য দিলে সব সে খেয়ে ফেলে। কেউ বাহন দিলে তাতে সে চড়ে ঘুরে বেড়ায়, কিন্তু নিজে পরিশ্রম করে আয়-উপার্জন করে না।’ রাসুল (স.)  বললেন, ‘ তুমি তোমার ভাইয়ের গিবত করলে।’ সাহাবি প্রশ্ন করলেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল, কারো ত্রুটি তুলে ধরাও কি গিবত?’ রাসুল (স.) বললেন, ‘প্রকৃতপক্ষে কারো ত্রুটি নির্দেশ করাও গিবতের জন্য যথেষ্ট।’

 

ইবাদতের গিবত:

কেউ যদি কারো ইবাদতের সমালোচনা করে বলে, ‘অমুক ভালো করে নামাজ পড়ে না অথবা বলে সে তাহাজ্জুদ বা নফল নামাজ পড়ে না কিংবা সে রমজান মাসের সকল ফরজ রোজা রাখে না’ ইত্যাদিও গিবতের অন্তর্ভুক্ত। তাহাজ্জুদ নামাজের ওয়াক্তের সময় কিছু লোক ঘুমিয়ে থাকলে হযরত শেখ সাদী (র.) তাদের সমালোচনা করে বললেন, ‘এই লোকগুলো তাহাজ্জুদ নামাজ পড়লে কতই-না ভালো হতো।’ শেখ সাদী (র.)-র পিতা একথা শুনে বললেন, ‘কতই-না ভালো হতো যদি তুমি তাহাজ্জুদ না পড়ে এদের মতো ঘুমিয়ে থাকতে, তাহলে এদের গিবত করার পাপ তোমার ঘাড়ে চাপত না।’

 

গুনাহের গিবত:

গুনাহের গিবত হলো যেমন বলা,  ‘অমুক ব্যক্তি ব্যভিচারী, অমুক পিতা-মাতাকে কষ্ট দেয়, আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী, অমুক মদ্যপায়ী, অমুক চোর, অমুকের অন্তর বিদ্বেষপূর্ণ ’ ইত্যাদি। শেখ সাদী (র.) একবার তাঁর শিক্ষককে বললেন, ‘অমুক ব্যক্তি আমার প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে। শিক্ষক বলেন, ‘হে সাদী, তোমার মতে বিদ্বেষ পোষণ হারাম, আর গিবত কি হালাল? তুমি আমার কাছে অমুক ব্যক্তির গিবত করেছ তার বিদ্বেষের উল্লেখ করে।’

 

মুখের গিবত:

রাসুল (স.) কিছু লোককে লক্ষ্য করে বললেন,  “তোমরা খিলাল করে নিজেদের দাঁতের ফাঁক থেকে গোশত বের করে ফেলে দাও ‘ তারা বললো, ‘হে আল্লাহ্র রাসুল, আজ আমরা তো গোশত খাইনি।’ রাসুল (স.) বললেন, ‘আমি তোমাদের দাঁতের ফাঁকে গোশতের লাল টুকরা দেখতে পাচ্ছি। নিশ্চয়ই তোমরা আজ কারো গিবত করেছ।” জানা যায় প্রকৃতপক্ষেই তারা ঐদিন এক ব্যক্তির গিবত করেছিল।

 

ইশারা-ইঙ্গিতে গিবত:

ইশারা-ইঙ্গিতে গিবত করা জায়েজ নয়। যেমন কেউ যদি কারো নাম উল্লেখ না করে এমন ইশারা-ইঙ্গিত ব্যবহার করে দোষ বর্ণনা করে; যা দ্বারা মানুষ বুঝে নিতে পারে যে, অমুক ব্যক্তির গিবত করা হচ্ছে। যেমন কেউ এভাবে বললো, ‘এক ব্যক্তি তার স্ত্রীর কথামতো চলে এবং নিজের পিতা-মাতার কথা শোনে না। এতে শ্রবণকারী বুঝতে পারলো যে, সে অমুক ব্যক্তির গিবত করছে।’ এ ধরনের গিবত বৈধ নয়।

সরাসরি কিংবা অভিনয়ের মাধ্যমে গিবত:

সরাসরি গিবত যেমন–– কোনো ব্যক্তির নাম পরিচয় উল্লেখপূর্বক তার দুর্নাম বর্ণনা করা। আর অভিনয়ের মাধ্যমে গিবত যেমন–– অন্ধ, বধির, বোবা ইত্যাদি সেজে অভিনয় করে তাদের দোষ-ত্রুটির দিকে ইঙ্গিত করা অথবা সমালোচনা করার জন্যে কারো চাল-চলন, কথা-বার্তা ও পোশাক-পরিচ্ছদ পরিধান ইত্যাদি নকল করে অভিনয় করা। রাসুল (স.) বলেছেন, “আমি অপরকে অনুকরণ করা পছন্দ করি না, এত সম্পদের বিনিময়েও না।”

একদা হযরত আয়েশা (রা.) কোনো এক মহিলাকে নকল করে দেখালে রাসুল (স.) বললেন, ‘কাউকে নকল করা আমার কাছে মোটেই পছন্দ নয়, অনেক সম্পদের বিনিময়েও নয়।’

 

কানের গিবত:

কেউ যদি কারো গিবত কানে শোনে অথচ তাতে বাধা না দিয়ে নীরব থাকে তাও গিবতের অন্তর্ভুক্ত। রাসুল (স.) এ প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘ কারো গিবত করা হলো এবং তুমি সেখানে হাজির থাকলে তাকে এভাবে সাহায্য করো যে, তুমি তার প্রশংসা শুরু করে দাও, যাতে লোকেরা তার গিবত করা থেকে বিরত থাকে। গিবতকারীকেও বাধা দাও, অতঃপর স্থান ত্যাগ করো।’ রাসুল (স.) বলেছেন,  “গিবত শ্রবণকারীও গিবতকারীদের একজন।”

 

অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের গিবত:

কেউ যদি নিজের হাত, পা, চোখ ইত্যাদি দ্বারা ইশারা করে কোনো ব্যক্তির দোষ বর্ণনা করে তাও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের গিবত হবে। যেমন কোনো ব্যক্তির কোনো বৈঠক থেকে চলে যাওয়ার পর তার প্রতি উপস্থিত লোকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা। মহানবী (স.) বলেছেন,“কোনো মুসলিম ব্যক্তির জন্য তার ভাইয়ের চোখের দ্বারা এমনভাবে ইঙ্গিত করা জায়েয না যাতে সে মর্মাহত হয়।”

 

মনে মনে গিবত করা:

কারো প্রতি বিদ্বেষবশত মনে মনে কু-ধারণা পোষণ করা হারাম। অবশ্য অনিচ্ছাবশত কারো প্রতি কোনো খারাপ ধারণা জাগ্রত হলে তা ক্ষমার যোগ্য। আল্লাহ বলেন,“ওহে তোমরা যারা ইমান এনেছ! তোমরা অধিকাংশ অনুমান থেকে বিরত থাকো। কেননা অনুমান কোনো ক্ষেত্রে পাপস্বরূপ।”

 

লেখনীর মাধ্যমে গিবত:

লেখনী তথা সাংবাদিকতার মাধ্যমে গিবত করা হয়। যেমন–– কেউ যদি কাউকে হেয়-প্রতিপন্ন করার জন্য সংবাদপত্রে রিপোর্ট করে, কিংবা বই-পুস্তকে অপরের দোষ-ত্রুটি তুলে ধরে, তাও গিবত হবে। কেননা, এর দ্বারা অপরকে ছোট করাই উদ্দেশ্য। আর ইসলাম এসব সমর্থন করে না।

 

প্রশাসনিক ক্ষেত্রে গিবতচর্চা:

আমরা যারা বিভিন্ন প্রশাসনের অধীনে কাজ করি, একটু লক্ষ করলেই দেখতে পাব প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী কম-বেশি গিবত বা পরের দোষচর্চার সাথে জড়িত। কেউ ইচ্ছা করে জ্ঞাতসারে গিবত করছি আবার কেউ অনিচ্ছায় অজ্ঞাতসারেই গিবত করছি। আমরা পরস্পর দোষ-ত্রুটি সহ্যই করতে পারি না। কর্মস্থল থেকে বেরিয়ে বাসায় যতক্ষণ থাকি তার প্রায় অধিকাংশ সময়ই আমরা কারো-না-কারো গিবত করে থাকি। আর গিবতের ব্যাপারটি এমন যে, মনে হয় এটা বলা পাপ নয়, এটা তার দায়িত্ব-কর্তব্যের একটি অপরিহার্য অংশ। সমাজে এমনও রেওয়াজ লক্ষ করা যায়, যে যত বেশি সহকর্মী অথবা অধস্তনদের সমালোচনা বা গিবত করতে পারেন সে তত বেশি দক্ষ ও দায়িত্বশীল। গিবত করতে গিয়ে আমরা নিজের কর্তব্যে অবহেলা করি, ভুলে যাই আমাদের দায়িত্ববোধের কথা। গিবত না করলে পরকালে কেউ জিজ্ঞাসিত হবেন না। অথচ কেউ যদি তার দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন না করে তবে অবশ্যই সে ব্যক্তি পরকালে জিজ্ঞাসিত হবেন। রাসুল (স.) বলেছেন,“তোমরা প্রত্যেকেই প্রত্যেকের দায়িত্বশীল এবং প্রত্যেককেই তার কর্তব্য সম্পর্কে পরকালে জিজ্ঞাসা করা হবে।”

 

জাতীয় পর্যায়ে গিবতচর্চা:

গিবত আজ আর ব্যক্তিপর্যায়ে সীমাবদ্ধ নেই। ব্যক্তিপর্যায় থেকে শুরু করে জাতীয় পর্যায় পর্যন্ত প্রত্যেকটি স্তরে গিবতের কম-বেশি চর্চা হচ্ছে। আর গিবতচর্চাকে মনে করা হয় যোগ্যতা কিংবা সফলতার মাপকাঠি। রাজনীতিতে গিবতের চর্চা এমনভাবে মিশে গেছে, আজ আমরা কেউ এটাকে অন্যায় বা পাপের বিষয় মনে করি না। এটা আমাদের কর্তব্যের একটি বড় অংশ মনে করি। গিবতচর্চা বেশ আগে থেকেই চলে আসছে, বর্তমানে তা জাতীয় জীবনে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। অথচ রাসুল (স.) হলেন বিশ্বমানবতার আদর্শের মূর্ত প্রতীক। তিনি মদিনার ইসলামি রাষ্ট্রের প্রধান ছিলেন, মদিনার জনগণের মাঝে রাষ্ট্র পরিচালনার সঠিক দিকনির্দেশনা দিতেন, জাতিধর্মবর্ণ নির্বিশেষে তাঁকে সকলেই সমর্থন করতেন। কিন্তু তিনি তো কারো গিবত করেননি! আর এ কারণেই তিনি ঘোষণা করতে পেরেছেন, “গিবত বা পরের দোষচর্চা করা জিনা-ব্যভিচারের চেয়েও একটি মারাত্মক অপরাধ।’ সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এটা কিরূপে?’ তিনি বললেন, “এক ব্যক্তি ব্যভিচার করার পর তওবা করলে তার গুনাহ মাফ হয়ে যায় কিন্তু যে গিবত করে তার গুনাহ প্রতিপক্ষের মাফ না করা পর্যন্ত মাফ হয় না।”

 

সমাজজীবনে গিবতের প্রভাব:

গিবত বা পরের দোষচর্চা সমাজে হিংসা-বিদ্বেষ ও যাবতীয় অশান্তির দাবানল সৃষ্টি করে। গিবত পারস্পরিক বিশ্বাস, আস্থা ও সংহতি হারিয়ে সমাজে অবিশ্বাস, হিংসা এবং জিঘাংসার জন্ম দেয়। এতে জাতীয় সংহতি বিনষ্ট হয়। মানুষের অন্তরে অপরের প্রতি সন্দেহ ও অবিশ্বাসের সৃষ্টি হয়। ভালোবাসা, প্রেম-প্রীতি ও পারস্পরিক সৌহার্দবোধ বিলুপ্ত হয়। ফলে সমাজজীবনে নেমে আসে জাহান্নামের অশান্তি। কুরআন ও হাদিসের আলোকে গিবতের ভয়াবহ পরিণাম নিম্নরূপ :

 

দোয়া কবুল হয় না:

যে ব্যক্তি সব সময় গিবতে লিপ্ত থাকে তার দোয়া কবুল হয় না। কেননা সে খুবই কম অনুতপ্ত হয়। লোকেরা ইবরাহিম ইবনু আদহাম-এর কাছে এই মর্মে অভিযোগ করলো যে, তারা দোয়া করছে কিন্তু কবুল হচ্ছে না, এর কারণ কী? তিনি বললেন, তোমাদের মধ্যে আটটি দোষ রয়েছে (এর মধ্যে একটি গিবত) ফলে অন্তরের সজীবতা নষ্ট হয়ে গেছে, তাই তোমাদের দোয়া কবুল হচ্ছে না।৩৪

 

নেক আমল বিনষ্ট হয়:

বিশিষ্ট সাহাবি আবু উমামা আলবাহিলী (রা.) থেকে বর্ণিত আছে যে, কিয়ামতের দিন কোনো ব্যক্তি তার আমলনামায় তার কোনো কোনো আমল লিপিবদ্ধ না দেখে জিজ্ঞেস করবে–– হে আল্লাহ, আমি তো দুনিয়ার জীবনে অমুক নেকআমল করেছি অথচ তা আমার আমলনামায় দেখতে পাচ্ছি না। আল্লাহ বলবেন, তুমি অমুক অমুক ব্যক্তির গিবত করেছো, তাই তোমার আমলনামা থেকে তা বিয়োগ করে তুমি যার গিবত করেছো তার আমলনামায় যোগ করে দিয়েছি।মহানবী (স.) বলেছেন,“বান্দার নেকআমল গিবতের দ্বারা যত দ্রুত নষ্ট হয়ে যায় আগুনও তত দ্রুত শুকনা বস্তু ধ্বংস করতে পারে না।”

 

অসৎ কাজের পরিণাম বেড়ে যায়:

মহানবী (স.) বলেছেন, “সাবধান! তোমরা গিবত থেকে দূরে থাকো। কারণ গিবতের মধ্যে তিনটি বিপদ রয়েছে। গিবতকারীর দোয়া কবুল হয় না, তার সৎকাজসমূহও কবুল হয় না এবং তার আমলনামায় তার পাপ বর্ধিত হতে থাকে।”

 

রোজার সওয়াব নষ্ট হয়

দুই রোজাদার ব্যক্তি রাসুল (স.)-এর সাথে যুহর ও আসরের নামাজ আদায় করলো। আসরের নামাজের পর তিনি তাদের বললেন, “তোমরা উভয়ে অজু করে যুহর ও আসরের নামাজ পুনরায় পড়ে নাও এবং রোজাও কাযা করো।” তারা বললো, “হে আল্লাহর রাসুল, আমাদের জন্য এই হুকুম কেন?” রাসুল (স.) বললেন,“তোমরা রোজা অবস্থায় গিবত করেছ।”

 

গিবত করার কারণসমূহ:

মানুষ বিভিন্ন কারণে অপরের দোষচর্চায় লিপ্ত হয়। এর মধ্যে আটটি কারণ এমন যা সর্বসাধারণের সাথে সংশ্লিষ্ট এবং তিনটি কারণ এমন যা উচ্চ পর্যায়ের দ্বীনদার ব্যক্তিদের সাথে সংশ্লিষ্ট। সর্বসাধারণের আটটি হলো :

১. ক্রোধের বশবর্তী হয়ে মনের সাময়িক ক্ষোভ মেটানোর জন্য; ২. অন্যের দেখাদেখি তথা অন্যের সাথে তাল মেলানোর জন্য; ৩. পরিণাম চিন্তার বশবর্তী হয়ে; ৪. কোনো দোষ থেকে মুক্ত থাকার উদ্দেশ্যে; ৫. অহংকার, গর্ব ও ঔদ্ধত্যের কারণে; ৬. ব্যক্তি প্রতিহিংসাপরায়ণ হলে; ৭. হাসি-তামাশা তথা ঠাট্টাচ্ছলে; ৮. অন্যকে অবজ্ঞা তথা তুচ্ছজ্ঞানার্থে।

 

দ্বীনদার ব্যক্তিদের তিনটি হলো:

১. কোনো দ্বীনদার ব্যক্তির ধর্মীয় কোনো বিষয়ে তাঁর ত্রুটি সম্পর্কে জানার পর এভাবে বলা যে, এই লোকটি থেকে এরূপ ত্রুটি প্রকাশ পাবে তা আমি আশা করিনি। নামোল্লেখ করে এভাবে বলা গিবত হবে এবং এর জন্য মন্তব্যকারী গুনাহগার হবে। তবে নামোল্লেখ না করলে গিবত হবে না।

২. কোনো ব্যক্তিকে কোনো সমালোচনাযোগ্য কোনো কাজে জড়িত হতে দেখে দুঃখ প্রকাশপূর্বক এভাবে বলা যে, লোকটির জন্য আমার আফসোস হয়, যে এমন বিপদে জড়িয়ে পড়েছে। দুঃখ প্রকাশের দিক থেকে ব্যাপারটি যথার্থ মনে হলেও প্রকৃত পক্ষে ঐ ব্যক্তি দুঃখ প্রকাশ করতে গিয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির নামোল্লেখ করায় তা গিবত হয়ে গেল।

৩. আল্লাহর ওয়াস্তে ক্রোধ বা অভিমান করতে গিয়েও গিবতের সূত্রপাত হতে পারে।

গিবত ত্যাগের উপকারিতা:

গিবত অর্জনের বিষয় নয়, এটা বর্জন বা ত্যাগেরই বিষয়। তবুও মানুষ অসচেতনতাবশত এর সাথে জড়িয়ে পড়ে, লিপ্ত হয় এই নিন্দনীয় অপরাধের সাথে প্রাত্যহিক জীবনে বিভিন্নভাবে। এই অপরাধ পরিত্যাগের মধ্যে কিছু উপকারিতা রয়েছে। যেমন, ১. আলকুরআনে গিবতকে মৃত মুসলমান ভাইয়ের গোশত খাওয়ার সাথে তুলনা করা হয়েছে। আল্লাহ বলেন, “তোমরা একে অপরের গিবত করো না। তোমরা কি তোমাদের মৃত ভাইয়ের গোশত খেতে পছন্দ করো? আসলে তোমরা তা ঘৃণা করো।” অতএব, যে ব্যক্তি গিবত ত্যাগ করে সে এরূপ মারাত্মক অপরাধ থেকে বেঁচে যায়।

২. হাদিস শরিফে গিবতকে জিনা-ব্যভিচারের চেয়েও মারাত্মক অপরাধ বলা হয়েছে। রাসুল (স.) বলেছেন, “আল গিবাতু আশাদ্দু মিনায জিনা-গিবত জিনার চেয়েও ভয়াবহ। কাজেই যে ব্যক্তি গিবত পরিত্যাগ করলো সে ব্যক্তি মূলত এই জঘন্য অপরাধ থেকেই নিজেকে রক্ষা করলো।”

৩. গিবত রোজার মতো একটি মর্যাদাপূর্ণ ইবাদতও বিনষ্ট করে দেয়। তাই যে গিবত ত্যাগ করে সে মূলত রোজার মর্যাদাই রক্ষা করে।

৪. আলকুরআনে গিবতকে হারাম ঘোষণা করা হয়েছে। তাই গিবত ত্যাগের মাধ্যমে কবিরা গুনাহ থেকে বেঁচে থাকা যায়।

৫. গিবতের মাধ্যমে অপরকে আঘাত করা হয়। তাই এটা পরিত্যাগের মাধ্যমে অন্যকে আহত করার অপরাধ থেকে বেঁচে থাকা যায়।

৬. গিবতকারীর সর্বশেষ পরিণতি অপমান। অতএব গিবত ত্যাগের মাধ্যমে নিজেকে অপমানের হাত থেকে বাঁচানো যায়।

৭. রাসুল (স.) বলেছেন :৪২ গিবত করার ফলে গিবতকারীর অন্তরে গুনাহের কালো দাগ পড়ে যায়। এটা ত্যাগের ফলে ব্যক্তির অন্তর নির্মল ও পরিচ্ছন্ন থাকে।

৮. গিবত করার অর্থ হচ্ছে কারো মান-সম্মানে হস্তক্ষেপ করা। যে গিবত করে না কিয়ামতের দিন সে লজ্জিত ও অপমানিত হবে না। কেননা সে অন্যের মান-সম্মানে হস্তক্ষেপ করেনি।

৯. হযরত আয়েশা (রা.) বলেছেন, “ঘুমের দ্বারা যেভাবে অজু নষ্ট হয়, তেমনি মিথ্যাচার ও গিবতের মাধ্যমে অজু বিনষ্ট হয়ে যায়। অতএব, যে ব্যক্তি গিবত পরিত্যাগ করলো সে অজুকে রক্ষা করলো।”

 

গিবত পরিত্যাগ করা ইবাদতের চেয়েও উত্তম:

নামাজ ও রোজা সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। কিন্তু সাহাবায়ে কিরাম কয়েকটি কারণে গিবত পরিত্যাগ করাকে তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত মনে করতেন। কারণগুলো হচ্ছে-

১. নামাজ রোজা এমন ইবাদত যা কেউ পরিত্যাগ করলে কেবল আল্লাহ-তাআলাই অসন্তুষ্ট হন। তার কাছে ক্ষমা চাইলে তিনি ক্ষমা করতে পারেন। কিন্তু গিবত এমন একটি অপরাধ যা আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইলেও ক্ষমা পাওয়া যায় না। যার গিবত করা হয়েছে তার কাছেই ক্ষমা চাইতে হয়। কেননা গিবতকারী তারই মান-সম্মানে আঘাত হেনেছে। রাসুল (স.) বলেছেন,“অন্যায়ভাবে কোনো মুসলমানের মান-সম্মান নিয়ে ছিনিমিনি খেলা সুদের পাপের চেয়েও মারাত্মক।”

২. পাপাচার পরিত্যাগ করা ইবাদতের চেয়েও বেশি ফজিলতপূর্ণ। জনৈক ব্যক্তি হযরত আবদুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রা.)-কে জিজ্ঞেস করলো, “এক ব্যক্তি বেশি বেশি ইবাদতও করে আবার বেশি বেশি পাপাচারেও লিপ্ত থাকে এবং অপর এক ব্যক্তি কম ইবাদত করে আর পাপাচারেও কম লিপ্ত থাকে, এদের মধ্যে কে উত্তম?” তিনি বললেন,  “যে ব্যক্তি কম ইবাদত করে এবং কম পাপাচারে লিপ্ত হয়।”

৩. প্রতিটি অপকর্ম ব্যাধি-সমতুল্য। যে ব্যাধির প্রতিষেধক সম্পর্কে মানুষ অবহিত, সে ব্যাধি তুলনামূলক কম জটিল। আর যে ব্যাধির প্রতিষেধক মানুষ এখনও আবিষ্কার করতে পারেনি তা বেশি জটিল। অতএব গিবত এমন ব্যাধি যার প্রতিষেধক মানুষ আজও আবিষ্কার করতে পারেনি। এর পরিণাম যে কতটা ভয়াবহ তা মানুষ অনুমান করতে পারে না।

 

অতএব বলা যায়, গিবত যেহেতু আমাদের বাকযন্ত্র তথা মুখের দ্বারা সম্পন্ন হয় সেহেতু কথা বলার সময় মুখকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। রাসুল (স.) বলেছেন, “আল্লাহ যাকে দুটি জিনিস থেকে বাঁচাবেন সে জান্নাতের অধিকারী হবে।” সাহাবিগণ জিজ্ঞেস করলেন, “সে জিনিস দুটি কী কী?” তিনি বললেন, “একটি হলো দুই ঠোঁটের মাঝখানের জিনিস (জিহ্বা) এবং অপরটি হলো দুই পায়ের মাঝখানের জিনিস (যৌনাঙ্গ)।”

 

যেসব ক্ষেত্রে গিবত করা যায়:

গিবত করা হারাম এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু কোনো ক্ষেত্রে গিবত করা বৈধ আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে গিবত করা শুধু বৈধই নয় পুণ্যেরও কাজ বটে। ইমাম নববী, আল্লামা ইবনু আবেদীন, শামী ও আবদুর হাই লাখনাবী তেরোটি ক্ষেত্রে গিবত করা বৈধ মনে করেছেন। যেমন––

১. কোনো ব্যক্তি বিচারক, মুফতী, সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারী বা পদস্থ কোনো কর্মকর্তার জুলুমের শিকার হলে সে তার প্রতিকারের জন্য রাজদরবারে নালিশ করতে পারবে। এরূপ জালিমের জুলুমের বিরুদ্ধে গিবত করা বৈধ। আল্লাহ বলেন,““মানুষ খারাপ ব্যাপারটি বলুক তা আল্লাহ পছন্দ করেন না, তবে যার উপর জুলুম হয়েছে তার ব্যাপারটি স্বতন্ত্র।”

 

২. কোনো ব্যক্তি যদি পাপাচারে লিপ্ত থাকে, তবে তাকে পাপাচার থেকে বারণ করতে, উপদেশ দিতে কিংবা সংশোধনের জন্য গিবত করা জায়েজ আছে। কুফার গভর্নর সাদ (রা.)-এর বিরুদ্ধে খলিফা উমর (রা.)-এর কাছে এই মর্মে অভিযোগ দায়ের করা হলো যে, তিনি ভালো করে নামাজ পড়েন না এবং যথাযথভাবে কুরআন পাঠ করেন না। উমর (রা.) অভিযোগের ভিত্তিতে সাদ (রা.)-কে গভর্নর পদ থেকে বরখাস্ত করে তদস্থলে হযরত আম্মার (রা.)-কে গভর্নর নিয়োগ করেন।

৩. লজ্জা দিয়ে পাপাচার থেকে বিরত রাখার জন্যে গিবত করা বৈধ। জনৈক ব্যক্তি রাসুলের (স.) কাছে প্রতিবেশীর বিরুদ্ধে অভিযোগ দিলো। রাসুল (স.) তাকে ধৈর্য ধারণের আদেশ করলেন। এভাবে দুইবার বললেন। তৃতীয়বার সে তার প্রতিবেশীর গিবত করলে রাসুল (স.) বললেন, “তোমার ঘরের জিনিসপত্র রাস্তায় ফেলে দাও। তোমার প্রতিবেশী তা দেখে লজ্জিত হয়ে তোমাকে কষ্ট দেয়া ত্যাগ করবে। রাসুলের (স.) কথামতো মালপত্র রাস্তায় ফেললে লোকেরা রাস্তা অতিক্রম করার সময় নিক্ষেপের কারণ জিজ্ঞেস করলে সে বলে, প্রতিবেশী তাকে কষ্ট দিচ্ছে। প্রতিবেশীর কাছে এ খবর পৌঁছলে সে লজ্জিত হয় এবং প্রতিবেশীর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে।

৪. কোনো বিজ্ঞ আলেমের কাছে মাসয়ালা জানার জন্য কারো দোষ বর্ণনা করা জায়েজ আছে। আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দা রাসুল (স.)-এর কাছে তার স্বামীর বিরুদ্ধে এভাবে গিবত করলো যে, তিনি খুব কৃপণ এবং স্ত্রী সন্তানদের ভরণ-পোষণ ঠিকমতো প্রদান করেন না। রাসুল (স.) বললেন, তুমি তার অজান্তে প্রয়োজনীয় মাল নিয়ে নাও।

৬. প্রয়োজনীয় উপদেশ ও সংশোধনের জন্য গিবত করা যায়। মহানবী (স.)-এর কাছে সাহাবায়ে কিরাম লোকদের দোষত্রুটি বর্ণনা করতেন। তবে মুসলমানদেরকে অপমান করা তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল না এবং উদ্দেশ্য ছিল যাতে মহানবী (স.) তাদেরকে নসিহত করেন এবং তারা সংশোধন হয়ে যায়।৫২

৭. প্রকাশ্য পাপাচারে লিপ্ত ব্যক্তির সম্পর্কে গিবত করা জায়েজ। যেমন, বেনামাজি, মদ্যপায়ী ও স্বৈরাচারী শাসকের গিবত করা। এ ধরনের ব্যক্তির আল্লাহর কাছে কোনো মর্যাদা নেই। রাসুল (স.) বলেছেন,“ যখন পাপাচারী ফাসিকের প্রশংসা করা হয় তখন আল্লাহ অসন্তুষ্ট হন।”

৮. কোনো ব্যক্তির দ্বারা যদি অপর কোনো ব্যক্তি তার অজান্তে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তবে তার গিবত করা যাবে। যাতে সে অন্য লোকের ক্ষতির কারণ না হয়। যেমন কোনো ব্যক্তি ওর কথা এর কানে এবং এর কথা ওর কানে দিয়ে মানুষের মধ্যে বিবাদ সৃষ্টি করে এই অবস্থায় তার গিবত করা জায়েজ আছে। তবে লক্ষ রাখতে হবে, কোনো ব্যক্তি গোপনে কোনো খারাপ কাজে লিপ্ত থাকলে এবং তার দ্বারা অপরের কোনো ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা না থাকলে সে ব্যক্তির গিবত করা জায়েজ নেই। এ প্রসঙ্গে হাদিসে এসেছে, “কোনো বান্দা দুনিয়ার অপর কোনো বান্দার দোষ গোপন রাখলে আল্লাহ-তাআলা কিয়ামতের দিন সেই বান্দার দোষ গোপন করে রাখবেন।”

৯. কেউ যদি নির্লজ্জভাবে প্রকাশ্যে পাপাচারে লিপ্ত হয় এবং তাকে কেউ সতর্ক করলেও তার প্রভাব তার উপর পড়ে না এমন ব্যক্তির গিবত করা জায়েজ। এ কারণে সাহাবায়ে কিরাম রাসুল (স.)-এর কলিজার টুকরা হযরত হুসাইন (রা.)-এর হত্যাকারীদের গিবত করতেন এবং তাদের ভর্ৎসনা করতেন। কেননা তারা নির্লজ্জ ও বেহায়া ছিল। শেখ সাদী (র.) তিন ব্যক্তির গিবত করা জায়েজ মনে করেন। তারা হচ্ছে বেহায়া, স্বৈরাচারী শাসক ও যার পাপাচার অন্যের ক্ষতির কারণ হয়।

১০. দুঃখ ও আক্ষেপ প্রকাশের নিমিত্তে কারো গিবত করা যায়। যেমন- কেউ যদি আফসোস করে বলে যে, অমুক নামাজ পড়ে না, রোজা রাখে না, জাকাত প্রদান করে না, আত্মীয়ের হক আদায় করে না, তবে তা গিবত হবে না। এরূপ খারাপ কাজে আফসোস করা উত্তমও বটে।

১১. কেউ যদি বিশেষ কোনো খারাপ উপাধিতে প্রসিদ্ধ হয় এবং সেই খারাপ উপাধি উল্লেখ করা ব্যতীত পরিচয় দেয়া সম্ভব না হয়, তবে এক্ষেত্রে খারাপ উপাধি উল্লেখ করা যাবে, এতে গিবত হবে না। যেমন- কাউকে ‘বিকলাঙ্গ’ বলে পরিচয় করিয়ে দেয়া। তবে এরূপ উপাধি পরিহার করা উত্তম।

১২. কোনো ব্যক্তির সরাসরি নাম উল্লেখ না করে তার গিবত করা জায়েজ আছে।

১৩. ইসলামকে শক্তিশালী তথা বিজয়ী করার লক্ষ্যে গিবত করাতে কোনো দোষ নেই। যেমন হাদিস বিশারদগণ হাদিস বর্ণনার ক্ষেত্রে বর্ণনাকারীদের বিশ্বস্ততার চুলচেরা বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বর্ণনাকারীদের কখনো মিথ্যাবাদী, তার স্মৃতিশক্তি প্রখর নয়, তিনি প্রত্যাখ্যাত ইত্যাদি বলেছেন। এভাবে বলা গিবত নয়।

১৪. মানুষকে পাপাচারে লিপ্ত হওয়ার কঠিন পরিণতি সম্পর্কে সতর্ক করার জন্যে জীবিত কিংবা মৃত ব্যক্তির গিবত করা জায়েজ আছে। যেমন, জীবিত ব্যক্তি সম্পর্কে অমুক জাহান্নামের উপযোগী কেননা সে বড়ই কৃপণ। অপর মৃত ব্যক্তি সম্পর্কে বলা, আমি অমুক ব্যক্তিকে স্বপ্নে শাস্তি ভোগ করতে দেখেছি।

অতএব বলা যায়, গিবত একটি নিষিদ্ধচর্চা হলেও প্রয়োজনে তথা শরিয়তের সীমারেখার মধ্যে থেকে কাউকে হেয়প্রতিপন্ন করার মানসিকতা ব্যতীত সতর্কতা, সংশোধন ও প্রয়োজনীয় জ্ঞান প্রদানের জন্য গিবত করা জায়েজ আছে।

 

গিবতমুক্ত জীবন-যাপন করতে হলে নিম্নোক্ত বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন। তবেই একজন মানুষ গিবত নামক এই ভয়াবহ অপরাধপ্রবণতা থেকে বেঁচে থাকতে পারবে। যেমন,

১. যথার্থ ধর্মীয় জ্ঞানানুশীলন। ধর্মীয় জ্ঞানের অভাবেই আমরা নিজেদের অজান্তে গিবতে লিপ্ত হয়ে পড়ি। ধর্মীয় জ্ঞান থাকলে গিবত থেকে বেঁচে থাকা সম্ভব।

২. কুরআন ও হাদিসের মর্মবাণী স্মরণ। যখনই গিবত করার ইচ্ছা জাগ্রত হবে, তখনই কুরআন ও হাদিসে বর্ণিত গিবতের কঠিন পরিণতির কথা স্মরণ করতে হবে। এতে গিবত করার প্রবণতা আর জাগ্রত হবে না।

৩. গিবতকারীর আমলনামা থেকে পুণ্য কর্মগুলো হ্রাস করা হয় এবং পাপ যোগ করা হয়। অর্থাৎ যার গিবত করা হয় তার পাপ গিবতকারীর আমলনামায় যোগ করে দেয়া হয় এবং গিবতকারীর পুণ্য যার গিবত করা হয়েছে তার আমলনামায় যোগ করে দেয়া হয়, একথা স্মরণ করা যেতে পারে।

৪. গিবত করার ইচ্ছা জাগ্রত হলে নিজের মধ্যে লুক্কায়িত দোষগুলো স্মরণ করলে অপরের দোষচর্চার আগ্রহ থাকবে না। রাসুল (স.) বলেছেন, “ সুসংবাদ সেই ব্যক্তির জন্য যাকে তার নিজের দোষ-ত্রুটি অপরের দোষ-ত্রুটি বর্ণনা থেকে বিরত রাখে।”

৫. লজ্জা, অপমান ও মান-ইজ্জতের কথা স্মরণ রাখা। গিবত করার ইচ্ছা ভুলে তৎক্ষণাৎ কেউ যদি এভাবে চিন্তা করে যে, অমুক আমার গিবত করলে যেমন আমি লজ্জিত ও অপমানিত হই তদ্রুপ আমিও গিবত করলে সে লজ্জিত ও অপমানিত হয় কাজেই এরূপ কাজ থেকে বিরত থাকি।

৬. ক্রোধ সংবরণ করা। ক্রোধকে ধৈর্য দিয়ে মোকাবিলা করতে পারলে গিবত করার প্রয়োজন হয় না। পরকালে ক্রোধের কারণেও মানুষ জাহান্নামে যাবে। রাসুল (স.) বলেছেন : জাহান্নামের একটি বিশেষ দরজা আছে। ক্রোধের বশবর্তী হয়ে যে ব্যক্তি আল্লাহর বিরুদ্ধাচরণ করে সে ঐ দরজা দিয়ে জাহান্নামে প্রবেশ করবে।

৭. অসৎ সঙ্গ ত্যাগ করা। অর্থাৎ যেসব সহকর্মী, বন্ধু-বান্ধব গিবত করাকে কোনো দোষেরই ব্যাপার মনে করে না এমন সব সহকর্মী ও বন্ধু-বান্ধবের কাছ থেকে যথাসম্ভব দূরে থাকা উচিত।

৮. কথা বলার সময় প্রয়োজনীয় সতর্কতা অবলম্বন করে কথা বলা। কেননা অনেক সময় দেখা যায় কথা প্রসঙ্গে অসতর্কতাবশত আমরা অনেক গিবত করি। যা একটু সতর্ক থাকলেই এড়ানো সম্ভব।

 

গিবত সম্পর্কিত উপর্যুক্ত আল্লাহর বাণী ও রাসুল (স.)-এর হাদিসের আলোকে বলা যায়, গিবত একটি সামাজিক ব্যাধি, নিষিদ্ধ পরচর্চা।

 

ইসলাম শান্তির ধর্ম। পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, ভালোবাসা, সহানুভূতি, উদারতা ইত্যাদি শান্তিপূর্ণ জীবনযাপনের পূর্বশর্ত। আর গিবত বা পরচর্চা সংক্রামক ব্যাধির ন্যায় শান্তি-শৃঙ্খলা বিঘ্নিত করে। তাই ইমান-আমল, দুনিয়া-আখিরাত বিধ্বংসী, হিংসা-বিদ্বেষ ও অশান্তি সৃষ্টিকারী জঘন্যতম অপরাধ গিবত বা পরনিন্দা থেকে বেঁচে থাকা আমাদের কর্তব্য। গিবতের মধ্যে কোনো প্রতিরোধকারী না থাকায় নীচ থেকে নীচতর ব্যক্তি কোনো উচ্চতর ব্যক্তির গিবত অনায়াসে করতে পারে। প্রতিরোধ না থাকার কারণে এর ধারা সাধারণত দীর্ঘ হয়ে থাকে এবং এতে মানুষ লিপ্তও হয় বেশি। গিবত করার সময় যদি প্রতিরোধ না করা যায় অন্তত শ্রবণ করা থেকে বিরত থাকা জরুরি। কেননা ইচ্ছাকৃতভাবে গিবত শোনাও নিজে গিবত করার মতোই অপরাধ। অতএব, আমরা নিন্দনীয় স্বভাব গিবতচর্চা থেকে দূরে থাকব। সম্ভব না হলে অন্তত কারো গিবতে কর্ণপাত করবো না, এটাই প্রত্যাশা।

%d bloggers like this: