গ্রামগাথা-২/ খাতুনে জান্নাত

খাতুনে জান্নাত

খাতুনে জান্নাত

শিশুবেলা যতোটা  উচ্ছল উজ্জ্বল হয় হয়তো আমাদের শিশুবেলা  ততটাই ছিল। প্রাণ যেখানে স্পন্দনময় জীবন সেখানে আলোকিত হয়ে ধরা দেয় সুকৌশলে। আবার শাসনের সূক্ষ্ম শেকলের ঘেরাটোপেও বন্দি ছিল যতটা শাসন সাজে ততটাই অথবা তার চেয়ে ঢের বেশি।   আমরা বাড়ির আঙ্গিনায়, কাচারিঘরের সামনে খোলা জায়গায়, মসজিদের পাকাথানে খেলতাম। সময় ছিল না বাঁধন ছেঁড়ার। তাই তো গন্ডির ভেতরে থেকে গন্ডি ভাঙার খেলা। এক্কাদোক্কা,  ছিঁ কুতকুত  কখনো বসে বসে ফুলন, খেজুর পাতা দিয়ে চরকা চরকা ছুতা কাট, একজনের কান একজনে টেনে ধরে ঝিঁয়া ঝিঁয়া হেলা খাইতে গেছিলাম, খেঁজুর বিচির গুটির চারগুটি খেলা। আরো বড় হলে শুকনা মৌসুমে দক্ষিণ হাঁতর, গিলাক্ষেত ও গোলাক্ষেতে বউচি, গোল্লাছুট,  কাবাডি, ডাংগুলি এসব। দল বেঁধে পুকুরে সাঁতার কেটে পানি পাড়ে তোল, পানিতে ডুব দিয়ে চোখ খোলা রেখে সোদাকালো সিনেমার মুখ দেখতাম নিজেদের মুখে। ঈদে মুসলমান বাড়ি ও পূজায় হিন্দু বাড়ি ঘুরে বেড়াতে কোন বাধা ছিল না। বৈশাখী মেলা ও বাইদানী মেলায়ও আমাদের উপস্থিতি ছিল  সরব। সাপের নাচনের সাথে সাথে বেহুলার বিরহের গানে পাড়া মাতিয়ে রাখতাম কোরাসে কোরাসে। মেয়ে হওয়ার কারণে পারিবারিক কোন বিধিনিষেধ ছিল না আমাদের ছোটবেলার ঘরে। ছেলেমেয়ে একসাথে পুতুল খেলা, পুতুলের বিয়ে, পুকুরে সাঁতার ও যাবতীয় খেলা ও কাজ এক সাথেই করতাম।

স্কুলের দেয়ালে প্রজেক্টরের মাধ্যমে যখন উন্নয়নমূলক পরিবার পরিকল্পনা, টিকা দান কর্মসূচী, গণশিক্ষা, ‘কলের পানি পান করুন ‘ নাটিকা দেখানো হত আমরা পিতার সাথে গিয়ে দেখতাম। দেখতাম বিভিন্ন মঞ্চ নাটক, যাত্রা, পালাগান পিতা না দেখলেও আমাদের বসিয়ে দিয়ে আসতেন। আবার এসে নিয়ে যেতেন। পিতা এক সময় মঞ্চনাটক করতেন সে কারণে হয়তো চাইতেন সন্তানেরা দেখুক। কৃষ্টি ও সংস্কৃতির রঙে জীবন তো রঙিনই হয়ে উঠে।  চাকরিসূত্রে তিনি ঘুরে বেরিয়েছেন সারাদেশে, দেশের বাইরে কলকাতা ও করাচি। তখন বৃটিশ ও পাকিস্তান আমলের চাকরির প্রয়োজন সম্পৃক্ত ছিল। তাই ধর্মীয় ঘেরাটোপেও তার মনে সংস্কৃতির প্রভাব ছিল উজ্জ্বল।

২১ শে ফেব্রুয়ারির প্রভাতফেরি, স্বাধীনতা ও বিজয় দিবসের প্রাণগ্রাহী বক্তৃতা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। স্কুল পর্বের অনুষ্ঠানা, খেলাধূলা তো ছিলই। নিজের স্কুলে ভালো করলে অন্য স্কুলে প্রমোশন পেয়ে থানা ও জেলা পর্যায়েও গিয়েছি অনেক। গ্রামের হাটের ক্লাবেও নানা টুর্নামেন্টের আয়োজন হত। আগ্রহীরা অংশগ্রহণ করত। আমি তো বাড়ির ছেলেমেয়েদের নিয়ে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করেছিলাম বাড়ির উঠোনে।

 

তার উপর ছিল বিয়ে।  বিয়ে যে ঘরেরই হোক তা সবার। সবাই মিলে হলুদ মাখানো, গাছ থেকে পাতা পেড়ে বেটে মেহেদি মাখানো, পানি দিয়ে ভিজিয়ে দেয়া একজন আরেকজনকে।  গান গাওয়া, নানি দাদিদের রসের কৌতুক ও মজার ভেতর দিয়ে বৌ বা বরের বাড়ি যাওয়া দল বেঁধে  সেসব দিন এখনও রোমাঞ্চিত করে। তালের নাও বা কলার ভেলায় পুকুর বিল ও খাল পাড়ি দিয়ে শাপলা-শালুক, পাটক্ষেতে আইলে শামুক খোঁজার দিন  হাসিখুশি আনন্দ কোলাহল আর মধুময় দিন মধুর রসে, আপনত্বের  আবেশে আবেষ্টিত করে রাখে। পুকুর সেঁচলে কাদাপানিতে বা বর্ষায় উজায়ার মাছ ধরার মৌসুম রাতে দোনালী জ্বালিয়ে ক্ষেতের আলে বা পুকুরের কিনারে টেঁডা দিয়ে মাছ ধরা। চাঁদনী রাতে পৈঠায় বসে গান গাও কিংবা উঠানে বৌচি গোল্লাছুট খেল বাধা দেবার কেউ নেই। বাড়িতে যেমন শিশুদের হাট ছিল তেমনই ছিল গুরুজন সমৃদ্ধ।  কী এক অজ্ঞাত কারণে আনন্দের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াননি কেউ! শুধু রাধাআঁশ জেঠি তার পাটকাঠির বেড়ায় ধাক্কা দিলে একটা লাঠি নিয়ে আসত,“ কেরে আঁর বেড়াত বাড়ি দেছ।” হাসতে হাসতে দৌড়ে পালিয়ে যেত কচিকাচার আসর আবার কিছুক্ষণ পরে আগের সুরেই চলত খেলাধূলা।

শুধু কাজ বা দায়িত্ব  কর্তব্য দৃঢ় পায়ে দাঁড়িয়ে বলত এখন কাজের সময়। তাও নেহায়েত কম নয়। কত ধরনের ও রকমের কাজ নানা সাজ ও ভঙ্গিমার পোশাক পরে দাঁড়িয়ে থাকত। জানিয়ে দিত না করলে কপালে খারাপি আছে। পানি আনতে হবে পালের হাটের টিউবঅয়েল থেকে। আগে তো খুব ভোরে পুকুরের পানি তুলে রাখা হতো খাবারের জন্য । কিন্তু রেডিওতে বা প্রজেক্টরে কলের পানি খেতে বলে। এতে ডাইরিয়া বন্ধ হবে। ধান, কাউন ও ডালের মৌসুম। ধান লওয়ায় মোরগ তাড়ানো বাচ্চাদের কাজ। ডালের ছড়া, কাউনের ছড়া ছেঁড়া ও কাটা। ধান সিদ্ধ হবে ; রেডি হও মোরগ তাড়ানোর জন্য। মোরগেরা কত দিক দিয়ে যে আসে। ঝাঁকে ঝাঁকে পালে পালে। মাঝে মাঝে হাঁস, গরুর ডেকি বাচ্চা। পাখিও খায় তাদের তাড়ানো নিষেধ; প্রকৃতির মুক্ত পাখি।  বড়দের সাথে ধান রোদে দেয়ায় সহায়তা করা। আমসি হবে। খাটের তলা থেকে আম বেছে আনো। সিদ্ধ আম চালতে হবে।  বাঁশের চালুনিতে চালতে চালতে হাত ধরে আসে। তারপর চালনি ধোও আমসিতে নতুন আম ঢালো। ঘাঁটো, কিছুক্ষণ পর হাত ধুয়ে আবার ঘাঁটো। হলুদ রঙ রোদে পুড়ে পুড়ে খয়েরী হয়ে গেলে সেদিনের মতো কাজ শেষ। ভাদ্র মাসের তাল। তালের বিচি পানিতে চিপে চিপে পানি ঘন করে ফেলতে হয়। সে পানি চলায় ফুটতে ফুটতে একসময় ঘন হয়ে এলে নারিকেল মিশিয়ে মজাদার এক খাবার। ভাত বা মুড়ি দিয়ে খাও। কাজের লোক নিয়ে আসা। ধান সিদ্ধ করে, ঢেঁকিতে ধান ভানে, চালের গুড়ি কুটে, হলুদ, মরিচ, ধনিয়ার গুড়ি কুটে। ঝালের নাড়ু বানানো। মুড়ি, চিঁড়া ও খৈ ভাজা। মোয়া বানানো। নারিকেল তেল নেয়া। সব কাজে চাই ছোটদের সহায়তা। উল্টাপাল্টা হলে মাইর। এই রোদ এই বৃষ্টি সে এক মজাদার দৃশ্য। ঘরে তোলা আর উঠানে দেয়ার কসরত।  গ্রামের বৌ ঝিদের মহাপরীক্ষার সময়। নিয়মিত কাজ পরে বাড়তি এত কাজ আজকাল কেউ ভাবতেই পারে না। বর্গাদারের সাথে ক্ষেত থেকে  মরিচ তুলে আনতে আমরা ভোরবেলায় বেরুতাম। কুয়াশাভেজা সবুজ মরিচ ও পাতার মাঝ থেকে লাল মরিচ ছিঁড়ে আনা। তারপর ভাগ করে আধা ভাগ হিসাব করে আনা। ছিল গরু পালন, ছাগল পালন, ভিটা ক্ষেতে বীজ বপন। বাগান থেকে লাকড়ি, ফল কুড়িয়ে আনা। আম, জাম, জামরুল, কামরাঙা, আমড়া, কাউ, এন্না, ঢেউফল, হেলা, জলপাই, মন্ডল, গাব, পেয়ারা, লিচু, কত জাতের কত সাধের ফলের যে সমারোহ। আরও কত বিচিত্র কাজের সমারোহ পল্লি বাংলার বিরচিত কলেবর জুড়ে  আমাদের হাসিকান্নার স্তুতিগাথা।

নারিকেল গাছ  কাটা হবে মানে মাথা পরিষ্কার হবে গাছির পিছু পিছু হাটো এদিক ওদিক ছড়ানো নারিকেল ডাব জড়ো কর। গুনো মনে মনে। ভাদ্র মাসের তাল পাহারা দেয়া, কুড়ানো ও পাড়ানোর কাজে বড়দের সাথে ছোটদেরও অনেক কাজ জড়িয়ে থাকত। তেমনি লাকড়ি করতে গাছ কাটানো ও সেসব লাকড়ি একটার উপর একটা এমনভাবে রাখা হত চারকোনা বাক্স দেখতে দারুণ। সেখানেও বৃষ্টিরোদ খেলা।

পুকুরে মাছ ধরলে জেলের সাথে বাড়ির সব বাচ্চারা কাজ তিন পুকুর ঘুরে ঘুরে মাছ বাড়িতে নিয়ে আসা। বড়দের কাটা শেষ হলে নিজের ভাগ বুঝে নেয়া। এসব কাজের কিছু পরিশ্রম থাকলেও সবাই মিলে গল্প আনন্দের মাঝেও পার হত সময়।

সে সময়ে বাচ্চাদের উপর শাসন হত খুব। নষ্ট হয়ে যাবে তাই   ছোটদের আদর আহ্লাদ করা হত কম। ছোটরা আনত হবে, বাধ্য হবে, বকা খাবে,  মার খাবে এটাই  ছিল রীতি।  বড়রা যা করে ছোটদের ভালোর জন্য। একেবারে ন্যাদা থেকে গা ঝাড়া দিয়ে উঠলেই শুরু হত শাসন। মেয়েদের বিয়ের আগে, ছেলেদের পুরুষ হবার আগ পর্যন্তই শেখানো হত ও শাসন চলত। সন্ধ্যা হলেই সারাদিনের অবাধ্যতা ও ভুলের খেসারতে শোনা যেত এঘরে ওঘরে কান্নার রোল।  হয়তো আজানের সাথে সাথে ঘরে ফেরা হয়নি। হয়তো কেউ কোন কাজের আদেশ না শুনে ঘুরে বেড়িয়েছে অথবা পড়তে বসে দুষ্টামী করছে। কোনো কোনো ঘরে এক সাথে কয়েকজন কাঁদত মরা কান্না। আমাদের এক চাচীর এত রাগ ছিল যে নারকেল পাতার শলার মুঠি বা লাঠি দিয়ে ঘরে মারতে মারতে উঠানে নামিয়ে আনতো বাচ্চাদের। শলার মুঠি বা লাঠি টুকরো টুকরো হয়ে যেত তবু রাগ ভাঙতো না। উঠানে ফেলেও বেঘোরে পেটাতো।  লাথি দিয়ে জামা ছিঁড়ে ফেলতো কখনো। মার খাওয়া পনেরো বছর বয়সী মেয়ে হতভম্ব; তাকিয়ে থাকতো ফ্যাল ফ্যাল।  এঘর ওঘর থেকে কেউ ধরতে গেলে তাকেও পেটাতো। এক ভাবীর ছেলে নিয়মিত স্কুলে যেত না বলে ঘরের কাঠের পিলারে হাত পা বেঁধে ইচ্ছেমত পিটিয়ে চোখে লাল মরিচ মেখে দিয়েছিলো।মারের কত বিষয় যে ছিল। সারাদিনের ফাইফরমাশ এর সাথে সাথে  ভোরের আরবী ও পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ। কাজা হলে চলবে না; পড়তে হবে আউয়াল অক্তে। দুনিয়ার কাজ শুধু চলবে না করতে হবে আখিরাতের কাজও। ঘরে ঘরে বেশীরভাগের বাচ্চা ছিল পাঁচ এর অধিক। মার খেলেও কেউ গুরুজনের বিরুদ্ধে যায়নি কখনো। দুর্বল ছাত্রছাত্রীরা মার খেত স্কুলেও। কত ধরনের শাস্তি! রোদে দাঁড় করিয়ে রাখা, ভালো ছাত্রছাত্রীদের দিয়ে দুর্বলদের কান ধরে মাঠ ঘুরিয়ে আনা। আমাকে অনেকদিন এ কাজটা করতে হয়েছে। কান ধরে ঘুরিয়ে আনতেও আমার কষ্ট হত।

 

আমরা বাধ্য থাকাতে মায়ের মার একটু  কম খেতাম। মায়েরাই মারত বেশি। বাবাগণ বেশীরভাগই শহরে, কাজে।  বাবার হাতে মার পড়ছে শুনলে বুঝতে হবে বড় কোন সঙ্কট উপস্থিত।  আমাদের ঘরে  বড়রা ছোটদের চেতানো যাবে না,   ছোটের উপর অত্যাচার মেনে নেয়া হবে না, এমনই নিয়ম ছিল ।  এসবের কারণে বা কোন অবাধ্যতায় চড়থাপ্পড় যা পড়ত বেশীরভাগ হাত দিয়ে।

মেহমান বা অতিথি আসলে আমাদের আনন্দ উপছে পড়ত। থাকত না শাসনের বালাই আর অনুশাসনের ভার। মজার মজার খাবার, গল্প, গান আনন্দের দিন ছলছল কলকল জল প্রপাতের মতো বয়ে যেত। বেড়াতে গেলেও আনন্দে লুটিয়ে পড়া দিন খেত জীবনে লুটোপুটি । প্রায়ই বেড়ানো হত নানার বাড়ি,  খালার বাড়ি, মার নানার বাড়ি বিভিন্ন ভাই বোনদের শশুর বাড়ি।  বাড়িতে হত প্রায়ই পিঠা উৎসব। পুলি পিঠা, ডালের পিঠা, কলিজা পিঠা, পাকওয়ান পিঠা, ডিমের পিঠা, নারকেলের চিঁড়া, নারকেলের সন্দেশ । নারিকেল পোলাও, কুমড়া ও লাউয়ের মোরব্বা। নারকেল তেল নিষ্কাসন শেষ হলে নীচে জমত মসকা নামের এক মজাদার খাবার। আহা সেসব স্বাদ জিহ্বে লেগে আছে এখনো।হোগলার গুড়ি রান্না হত প্রায়ই। বৃষ্টি দিনে চাল ডাল ভাজা নিয়ে কাড়াকাড়ি ও গল্পের আড্ডা কেউ কি ভুলতে পারে। ঈদের আনন্দ দীর্ঘ দিনের প্রস্তুতির ফল। কাঁচা ঘরের মেঝে ও পিড়া লেপা হত নতুন মাটি দিয়ে। আমরা নিজেরাও কোন কোন পিড়া লেপতাম।  তাতে ফুল লতা পাতা আঁকতাম। মা’র সেলাই মেশিন নষ্ট হয়ে গেলে ক্লাশ সিক্সে উঠার পর থেকে নিজের ঈদের জামাকাপড় নিজেরাই সেলাই করতাম। জামা পায়জামা তৈরী হয়ে গেলে সে আনন্দ সীমাহীন। ঈদের সকাল আলাদা আনন্দের বাতাস বয়ে নিয়ে আসত। খুব ভোরে উঠে ঘর সাজাতাম।  জানালার পর্দা থেকে টেবিল ক্লথ, সবই নতুন,  হাতে কাজ করা নক্সা ও সূচিশিল্প।  তারপর পিঠা সেমাই রান্না করে সবার ঘরে ঘরে দিতাম।  গোসল সেরে নতুন পোশাক ও নতুন গয়না পরে সাজগোজ করে মেলায় যেতাম সবার সেলামী একত্র করে। বড়দের পা ছুয়ে সালাম করলে কারও কারও কাছ থেকে মিলে যেত ঈদের সেলামী।

সেসব আনন্দের দিন মনের গভীর স্তরে পলি জমিয়ে রেখেছে। রেখেছে দায়বদ্ধ করে সে শিশুকাল সে গ্রাম স্মৃতির মিনার হয়ে দাড়িয়ে আছে জীবনের আদ্যপান্তে।

%d bloggers like this: