গ্রামগাথা-১ / খাতুনে জান্নাত

খাতুনে জান্নাত

খাতুনে জান্নাত

 

ঢাকা-রায়পুর বাস থেকে লক্ষীপুরে নেমেই তেমুনির পথ ধরে রিকসা বা সিএনজি যত যেতে থাকে আমার আয়ু বাড়তে থাকে। দুপুরের রোদখেলা, বিকেলের খুশি, সন্ধ্যার ঐকতান, রাত্রির সুনসান।নাকেমুখে ছড়িয়ে পড়া বাতাস জীবন প্রবাহ হয়ে সামনে নিয়ে যায়।আমার চোখে ভাসে শৈশবের মাছ ধরা ও বনে বাদাড়ে দৌড়ে বেড়ানোর আশ্চর্য ঝিলিক। ছায়াঢাকা স্কুলের পথ, শুকনো ও বর্ষার দিনে সহপাঠিদের সাথে গল্পমাতা প্রহরের উঁকিঝুঁকি।  হাট পেরিয়ে বড় রাস্তা শেষ হলে বাড়ির রাস্তা। বড় পুকুরের ঘাট, মসজিদ, কাচারি ঘর আর পরিচিত হাতনাড়া ডেকে বলে ‘আয় আয় আয়’।

ঘরের ভিতরের দরোজা দিয়ে উত্তরের পুকুর-পাড় ধরে টোয়া বাগানে ঢুকতে যতদূর দৃষ্টি যায় গাছ-গাছালি আর প্রান্তর। বাগানের কিনার ঘেঁষে  গড় (ছোট খাল বিশেষ) সংযুক্ত করেছে তিনটি পুকুরকে। তাই অনেকটা বিচ্ছিন্ন বাইরের জগৎ থেকে এ জায়গাটা। ঘন সুপারিবন ও বনের কিনারে সারি সারি নারিকেল গাছের শোভা প্রাণ হরণ করে।  শহরের আদলে গড়ে ওঠা বাড়িগুলো অন্যপ্রান্তে পালের হাটের কাছাকাছি। পাকারাস্তার নিকটের নতুন বাড়িগুলো পরিবারের বিলিবণ্টন করা নতুন অংশীদারদের বাড়িঘর। এ প্রান্তে এখনো কেউ বসতি বানায়নি। শীতের এ সময়ে এ জায়গাটা প্রতিদিন আমি কয়েকবার হাঁটি আর ভাবি, আমি গ্রামেই থাকবো। এত নির্জনতা আর নির্জনতা ভঙ্গকারী  ডাহুক, হুদহুদ, মাছরাঙা আরও কত পাখির কলকাকলি; শিমুল, কৃষ্ণচূড়া,  জারুল ও চালতা ফুলের আবীর মাখা ইশারা, নাড়ির গভীর সংযোগ- মা বাবার কবরের চিহ্ন  আর  স্নিগ্ধতা রেখে তবুও চলে আসতে হয় বাস্তবতার কঠিন ঠাসবুননের ঢাকা শহরে। আজ থেকে পয়ত্রিশ বছর আগে এখানেই ছুটে এসেছিলাম বড় ভাইয়ের হাত ধরে। গ্রামে এখন আমাকে কেউ আর নাইওরী মনে করে না যা আমি চেয়েছিলাম আজীবন। প্রথম-দ্বিতীয় পৃথিবী ঘুরে ঘুরেও মা-বাবার রেখে যাওয়া ঘর আর খাট আর খাটালই যেন আমার। একচিলতে উঠান, কয়েক পা পেরুলেই পুকুর-ঘাট- এখানেই চলত থালাবাটি-পাতিল ধুতে ধুতে ভাবী-বোনদের সাথে গল্পের আসর। কখনো পাড়ে বসে বসে চুপটি করে শুনে নিতাম বড়দের লুকানো কাহিনির এপিঠ ওপিঠ। শৈশবের মাধুরীমা, কৈশোরের প্রাণচঞ্চলতা, যৌবনের প্রারম্ভিক জটিলতা মেশানো স্মৃতির মধুর হাঁড়ি উপছে পড়া রসালো দিনগুলো মায়ের মতো মিষ্টি আদরে শাসনে বলে, ‘এখানেই ঠিকানা তোমার ‘। পুকুর পাড়ের মুত্রা ও আসামলতা-তেলাকুচা ঝোপ ও ডুমুর গাছ, পানিতে ঝুলে পড়া আমের ডাল, হরকারি বাগানের আমগাছের কোলে জড়ানো যে নারিকেল গাছ থেকে পাখির বাচ্চা নিতাম সে স্মৃতির পায়ের ছাপ, সে পালক-ঘূর্ণি, গিলা ক্ষেত ও গোলা ক্ষেত ও বনঝাড় মনের অলক্ষ্যে কত কথাই শুনিয়ে থমকে রেখে চমকে দিতে থাকে। আমি আঙ্গিলার ডালে ফুল ও স্বর্ণলতার ছবি আঁকি।  বোনদের সাথে নিয়ে ঢেঁকি শাক ও কচুবনে কচুরলতি খুঁজি… বাইলের খোলে করে নিয়ে আসি বাদুর ও পাখির আধখাওয়া কামরাঙা ও মৌমাছির ভাঙা বাসার মচমচে প্রাণভরানো গ্রামের সোঁদা গন্ধ…

করই ও বরই পাতা ঝরতে থাকে, উড়তে থাকে বনদুবলা, জামরুলের পরাগ…দুপুর হাসতে থাকে কচি ডাবের উৎসবে…কোন দূর থেকে পোড়া নারিকেলের স্বাদ…

পুরনো খাতা খুলে গলা মিলিয়ে প্রাণখোলা গান…

নিশিরাতের নিঝুমতায় পুকুর ঘাটে দেখি জোনাকি বোনেরা  আলোর মালা জ্বালিয়ে রাখে, ঝিঁঝিরা তৈরী করে শব্দের কুহকজাল। কোথাও শব্দ হয়। পানিতে কিছু পড়ে ঝপাৎ… হোক কিছু আদিভৌতিক, হেঁটে আসুক খোলাচুলে সাদা কাপড়ের প্রেতরূপ, প্যাঁচার ডাকের সাথে বিপদের আগাম সতর্ক  সংকেত…আমি ভয়কে ছুঁয়ে দেব শৈশবের সাহসের ছায়া মেখে। জীবনের অভিজ্ঞতা ঝুলি ধরে শুধরে  নেবো নাজুক দিনের খসড়া খাতা। বাতাসের মিষ্টি মেখে   পাতার ঝিরঝিরে মেখে নেবো প্রকৃতির ঋতু বদলের ছ্ন্দ ও খুনসুঁটি; ধুন্দুলের খোলে বাজাবো নির্মিলিতের নির্মল মাধুরি…

(চলবে)

%d bloggers like this: