জল মাখা জীবন/ আফরোজা পারভীন 

আফরোজা পারভীন

আফরোজা পারভীন

জল মাখা জীবন (ধারাবাহিক উপন্যাস) 

এক

 

মধ্যদুপুরে রমনার নির্জন বেঞ্চে বসে ছিল  রফিক। বারবার ঘড়ি দেখছে সে। নিশির আসার কথা আধাঘন্টা আগে। সাধারণত কখনও দেরি করেনা নিশি। সময়ের ব্যাপারে সে খুবই পাংচুয়াল। বরাবর লেট করে রফিক। তাই তার নাম হয়ে গেছে লেট রফিক। নিশির সাথে শুধু নয়, এ্যাপয়েন্টমেন্ট মিস করাতে সে বরাবরই পারদর্শী। বিয়ে বাড়িতে গিয়ে  সাধারণত খাবার পায় না, পরীক্ষার হলে  পেীঁছাবার আগেই খাতা বিলি হয়ে যায়, টিকেট কেটে ট্রেন ধরতে পারে এমন নজির কমই আছে। এসব  পরিস্থিতিতে সে বন্ধুবান্ধবদের  বাস ট্রেন ধরিয়ে দেয়ার দায়িত্ব দিয়ে রাখে। 

কিন্তু  প্রেমের ব্যাপারে সে বরাবরই চাপা। প্রেম একান্ত  নিজস্ব  ব্যাপার, এটা বাজারের সওদা নয় যে সবার কাছে ফলাও করে প্রচারে করতে হবে। অন্তরের নিভৃতে এর জন্ম। নিভৃতেই এর বসবাস হওয়া কাম্য। রফিক নিশির চারবছরের ধুন্ধুমার প্রেমের কথা একান্ত  ঘনিষ্ঠ বন্ধু আসিফও জানে না। নিশিও অবশ্য এদিক দিয়ে খুবই সাবধানী । সে বলে, প্রেমের কথা ঢাক পিটিয়ে সবাইকে বলে বেড়াবার কি আছে, যখন বিয়ে হবে সবাইতো জানবেই । এসব বিষয় না জানানোই ভাল। আল্লাহ জানে কার মনে কি আছে। ভাংচি দেয়ার লোকের তো অভাব নেই। নিশির চিন্তা ভাবনা বরাবরই প্রাকটিকাল। তাই ওদের ভালবাসার কথা জানেনি কেউ। একান্ত  সঙ্গোপনে বছরের পর বছর ওরা জল ঢালছে ভালবাসার শিকড়ে। রফিক এখন নিশি ছাড়া কিছুই ভাবতে পারে না। যদিও প্রতিদিনই দেরি করে আসে। আর বেচারা নিশিকে একা একা রমনার নির্জন বেঞ্চে  বসে থাকতে হয়। অনেক  সময় বসার জায়গাও পায় না। কি অস্বস্তিকর ব্যাপার। এ নিয়ে নিশির অভিযোগের অন্ত  নেই। মাঝে মাঝে বলে,

: আচ্ছা তুমি কি ধরণের মানুষ বলত। আমার জন্য  তোমার কি চিন্তা ভাবনা কিছু  আছে? আমি একা একা এই পার্কে দাঁড়িয়ে থাকলে কতরকমের অসুবিধা হয় তাকি জানো?

: কি হয়?

আচ্ছা তোমার কি আক্কেল বলে কিছু নেই। আবার প্রশ্ন করছ কি হয়!  এতো রকম লোকজন যে ঘুরঘুর করে একা পেলে ওরা কি  বলে আন্দাজ আছে । এjf বেঞ্চে বসা দেখলে হাঁটতে হাঁটতে এসে পাশে বসে পড়ে। দুই রকম লোক আছে বুঝেছ। এক রকম লোক নিজেরাই সমঝদার। মেয়ে বুঝে তারা সরাসরি প্রপোজ করে। আর কিছু আছে দালাল । প্রথমে দূর থেকে দেখে । তারপর কাছে  এসে  রেকি করে যায় । এরপর সুযোগ বুঝে অফারটা জানিয়ে দেয়।

: তোমাকে জানায় কেন? তোমাকে দেখে কি ওদের মতো মনে হয়? 

: আশ্চর্য  ব্যাপার চেহারা দেখে কি আজকাল পরখ করা যায় কিছু! নাকি গায়ে লেখা আছে। অসময়ে একা নারীকে পার্কে  ঘোরাঘুরি করতে দেখলে  প্রস্তাব তো করবেই। 

ক্ষেপে উঠত রফিক। 

: না এটা ওদের বড় অন্যায়। আর যাকে যা ইচ্ছে বলুক তোমাকে বলবে কেন। চেয়ে  দেখতো কোথাও সে সব লোক আছে কিনা। আর তোমারও দোষ আছে। তুমি ওদের প্রস্তাব শোন  কেন। পাত্তা না দিলে কেউ কি প্রস্তাব দিতে পারে।

আরে বাপরে বাপ, এযে দেখছি যতো দোষ নন্দ ঘোষ। দোষ   যিনি করলেন  এখন তিনিই দুষছেন!

: শোন বন্ধু তেলেসমাতি বহু  করেছ, এবার শুনে রাখ । আর একদিন যদি দেরি হয় পত্রপাঠ বিদায় করে দেব। তোমার জন্য নিজের মান সম্মান খোয়াতে পারব না। তোমার নিরেট মাথায় তো কিছুই  ঢোকে না । তাই আজ লজ্জার মাথা খেয়ে আসল ব্যাপারটা বলে দিলাম। মহিলাদের যে কী জ্বালা!

: মহিলা না, রমণী। তা তোমাকে কি কেউ সরাসরি  প্রস্তাব করেছিল নাকি? নাকি অন্যদের দেখে বলছ? 

: না করলে কি বানিয়ে বলছি! 

: আহারে আমাকে যদি কেউ প্রস্তাবটা করতো! তা কি প্রস্তাব করেছিল, অফারটা কি ছিল?

: তুমিতো আচ্ছা অমানুষ, চরম বেঈমান। তোমার প্রেমিকাকে একজন একটা বাজে প্রস্তাব করেছে আর তুমি দাঁত কেলিয়ে হাসতে হাসতে জিজ্ঞাসা করছ অফারটা কি  ছিল।  তোমার কি লাজ লজ্জা বলে কিছু নেই?

: ওটাতো মেয়েদের থাকে। অবলাদের। 

এরপর লেগে যেত। রাগে কাঁপতে কাঁপতে নিশি বলত, 

:এই তোমাকে শেষবারের মতো বলে দিলাম আর যদি একদিন দেরি করে আসো সেদিনই শেষ।  সহ্য করতে করতে মাথায় উঠে গেছো। 

: এ আলটিমেটাম তো এক মনিট আগেও দিলে। ওই যে বললে  শেষবারের মতো বলছ। যাক আশ্বস্ত  হলাম। শেষেরও  তাহলে শেষ আছে। 

এ কথার পর রফিকের পিঠে দুম দুম করে কিল মারত নিশি।

: আমি সেই বাড্ডা খেকে আসতে পারি আর উনি পুরানা পল্টন থেকে আসতে পারেন না।

 নিশি চেঁচাতেই থাকত। এদিক ওদিক তাকিয়ে তাড়াতাড়ি নিশির হাত ধরে ওকে বসাতো রফিক। পকেট থেকে রুমাল বের করে দিতো।

: মুখটা মুছে ফেল। ঘামছ তুমি। মেকআপ নষ্ট হয়ে যাবে। আর কেউ প্রস্তাব করবে না।

 রুমালের দিকে একবার চেয়ে ছুঁড়ে ফলত নিশি।

: ছিঃ কি দুর্গন্ধ !  বস্তিরে মানুষের রুমালও এর চেয়ে পরিষ্কার।

: বস্তির লোকের রুমাল থাকে না নিশি।

: আবার আবার আমার সাথে লাগছ তুমি। রুমালটা পরিষ্কার করতে পারো না । আমি এখন যাবো।

: এলেইতো এখন।  যাবে কি । বসো তো। 

বসে নিশি । আস্তে  আস্তে  ঠান্ডা হযে আসে। তবে  রফিক দেরি করে আসার কথা ভোলে না  । মাঝে মাঝেই ফোঁস করে ওঠে। আমি আধাঘন্টা ধরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘামছি আর উনি  দিবানিদ্রা দিচ্ছেন। 

নিশিকে রাগাতে বড় ভাল লাগে রফিকের। রাগলে নিশিকে খুবই সুন্দর লাগে। ওর দুধে আলাতা রং তখন আগুন বরণ ধারণ করে। ঘন ঘন ওঠা নামা করে বুক। চোখর কিয়দাংশ লাল হয়ে পড়ে।  অভিমানী প্রেমিকাকে তখন অপরূপা লাগে রফিকের। তাই ইচ্ছে করে নিশিকে রাগায় রফিক। 

: আচ্ছা নিশি এককাজ করলে কেমন হয় , আমি যখন লেট রফিক তুমি এক কাজ করবে, আমার সিডিউল টাইমের কমপক্ষে একঘন্টা  পরে আসবে তুমি। তাতে আমাকে কমপক্ষে পনেরো মিনিট দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। চাইকি দুই একটা অফারও পেয়ে যেতে পারি। এ ব্যবস্থায় তোমার আমার দুজনেরই মঙ্গল। 

রাগ করতে গিয়ে হেসে ফেলত নিশি। 

: তুমি পারোও। আসলে এটাই করা উচিত।  কিন্তু কি জানো আমি এটা পারবো না। গুণ বলো দোষ বলো সময় মেইনটেন করা আমার স্বভাব । দশটার ট্রেন ধরতে এগারোটায় আসতে পারবো না। তুমি যেভাবে চলছ তাতে দেখা যাবে লেটের কারণে বিয়ে করতে আসতেই পারবে না।

: আরে না, বড়জোর বিয়ের দিনের পরদিন আসব। কিন্তু আসব যে এটা নিশ্চিত। 

এবার হো হো করে হেসে ওঠে নিশি। এভাবেই চলছে। রফিক ক্রমাগত লেট করছে আর নিশি অফার পেয়েই যাচ্ছে।  রফিক  বহুবার প্রতিজ্ঞা করেছে, সে কিছুতেই লেট করবে না। এটা তার ইজ্জতের সাওয়াল।  নিশিকে কেউ কিছু বলা মানেই তাকে বলা। তাছাড়া একা একা মেয়ে মানুষ পার্কে বসে থাকলে  কত ধরণের বিপদ হতে পারে। সে ঝুঁকি নেয়া ঠিক হবে না। প্রতিজ্ঞা করে বটে কিন্তু  রাখতে পারে না রফিক। একটা জিনিস বোঝেনা রফিক, সে সময় মেইনটেন করতে পারে না অথচ কাজের ব্যাপরে বড়  সিনসিয়ার । এটা কি ভাবে সম্ভব!  একবার কাজে লেগে গেলে উদয়াস্ত  পরিশ্রম করে। ফাঁকি কথাটা তার অভিধানে নেই। কমিটেড মানুষ। সময় ঠিক রাখতে না পারলেও ষোল আনা খাঁটি তার প্রেম। নিশিকে মনে মনে বহুবার ধন্যবাদ দিয়েছে তার সময়ানুবর্তিতার জন্য। মুখে বলেনি। মুখে বললে মাথায চড়ে যাবে নিশ্চিত ।

সেই নিশি আজ আধঘন্টা লেট ! অথচ আজকেই নিশিকে জরুরী দরকার। অনেক কথা বলার আছে নিশিকে। রাতের ট্রেন ধরেই রফিককে যেতে হবে সুনামগঞ্জ।  টিকেট কাটা হয়ে গেছে। অসিফকে বলে রেখেছে সময়মতো ট্রেন ধরিয়ে দেয়ার জন্য সুনামগঞ্জের বিস্তীর্ণ হাওড় এলাকা জুড়ে তার কাজ। নিশি নিশ্চয়ই  খুব খুশি হবে। চাকুরি না জোগাড় করতে পারুক, একটা কাজ তো জুটেছে। পয়সা কড়িও মন্দ পাবে না। বেকার বসে  চাকুরির চেষ্টা করার চেয়ে কাজের মধ্যে থেকে চেষ্টা করা ভাল। এটা নিশ্চয়ই বুঝবে নিশি। নিশির মধ্যে খারাপ কিছু দেখে না রফিক। তবে একটা জিনিস মাঝে মাঝে পীড়া দেয়। বড় বেশি বাস্তববাদী নিশি। আর বড় উচ্চাকাঙক্ষী।  অত্যন্ত  দরিদ্র পরিবার থেকে কঠোর পরিশ্রম আর মেধার গুণে এতোটা রাস্তা পেরিয়ে এসেছে নিশি । জীবনের বাস্তবতা তাকে বাস্তববাদী করে তুলেছে।  যেটুকু হবার কথা ছিল না, পাবার কথা ছিল না তা পেয়ে পাবার আকাঙক্ষা বেড়ে গেছে। আকাঙক্ষা হয়েছে আকাশচুম্বী।  নিশির আকাঙক্ষা পুরণের পথে প্রথম পদক্ষেপটি ফেলতে যাচ্ছেছ রফিক। এ খবর সবার আগে দেয়া দরকার নিশিকে। আজ তারা  ব্যাপারটা সেলিব্রেট করবে। হাতে তেমন পয়সা নেই। তবুও নিশিকে নিয়ে কিছুটা ঘুরবে, হালকা কিছু খাবে বলে ঠিক করে এসেছে রফিক। কে জানে কবে ফিরতে পারবে সুনামগঞ্জ  থেকে। এতদিন নিশিকে ছেড়ে সে থাকবে কি করে! আশ্চর্য আজ নিশি এত লেট! বরাবরই সে আগে আসে। আর খালি পেটে এই বেঞ্চটাতেই বসে বারবার ঘড়ির দিকে তাকায়। চোখে মুখে ফুটে থাকে উৎকন্ঠা। দূর থেকে তার উৎকন্ঠিত মুখ দেখে সংকুচিত হযে পড়ে রফিক। আজ উৎকন্ঠায় ছেয়ে আছে রফিকের মুখ। নিশির কোন বিপদ হয়নি তো! যানজটও ওকে আটকাতে পারে না। বাস  টেম্পুতে চড়তে হয় ওকে। সময় হাতে নিয়েই বের হয় ও। কোন অবস্থাতেই লেট হয় না। কি হলো নিশির! কোন এ্যাকসিডেন্ট নয়তো? ওদের বাড়িতে  ফোনও নেই যে যোগাযোগ করবে। থাকে দূর সস্পর্কের এক মামার বাসায় অনেকটা আশ্রিতের মতো। সেখানে ওর অনেক কষ্ট!  মাঝে মাঝেই বলে তুমি একটা চাকুরি পেলে বেঁচে যেতাম। এত কষ্টের জীবন আমার ভাল লাগে না। তবে তোমাকে আগে ভাগেই বলে রাখছি চাকুরি বাকুরি আমাকে দিয়ে হবে না। আমি বসে বসে খাবো আর পেটে চর্বি জমাবো। 

তা কেন, বসে বসে খাবে আর বছর বছর মা হবে। আমি বাবা মায়ের একমাত্র সস্তান । জনবল দরকার আমাদের। 

:যা অসভ্য!

কি হল নিশির। উৎকন্ঠিত  রফিক চেয়ার ছেড়ে পায়চারি শুরু করে। দুশ্চিন্তায় প্যালপিটিশান শুরু হয়। নিশির কিছু হলে বাঁচবেনা সে। ধুত্তুরি ওদের বাসাটাও ভাল  করে চেনে না রফিক । বাসায় কখনও নিয়ে যায়নি নিশি। ওর মামী নাকি একটুতেই  সন্দেহ করে। তবে বাসার  কাছাকাছি দু একদিন নামিয়ে দিয়ে  সেছে। অবশ্য ওর মামার নাম জানে। খুঁজে বের করতে অসুবিধা হবে না। 

রফিক গেটের দিকে পা বাড়ায়। নিশির মামার বাসাায় যাবে সে। নিশ্চয়ই নিশির কোন বিপদ হয়েছে। ঠিক তখনই বিপরীত দিকে থেকে নিশির চেনা শাড়ির আঁচল চোখে পড়ে। দ্রত হেঁটে আসছে নিশি।  এসে সরাসরি  বেঞ্চে বসে।

: কিভাবে যে এসেছি চিন্তা করতে পারবে না। ভাবিনি আসতে পারব। মামী হঠাৎ করে এক পাত্র এনে হাজির। পারলে বিয়ে পড়িয়ে দেয়। ওরা যাওয়া মাত্র টুপ করে বেরিয়ে এসেছি। মামি দেখলে তুলকালাম করে ফলত। 

:না বলে  চলে এলে তাতে তুলকালাম হবে না? 

: সে যা হয় হবে। আজ তাড়াতাড়ি ফিরবো । কি বলবে তাড়াতাড়ি বলে ফেল। 

:তাড়াতাড়ি বলে ফেল মানে? তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে খালি জরুরী কথা বলার জন্যই যেন আমাদের দেখা করা। বড় নিরস মেয়ে তো তুমি! 

: তা নয়তো কি। আমরা কি ষোল বছরের কিশোর কিশোরী নাকি যে অর্থহীন প্রেমের সংলাপ বলে যাব। আর ড্যাব ড্যাব করে দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে থাকব। পৃথিবী বিস্মৃত, বিমূড়, নিষ্পলক! 

: তুমি ষোল বছরের কিশোরী হবে কেন, ষাট বছরের বুড়ি। তা  বৃদ্ধ বয়সে প্রেমের সাধ কেন? নিশির গা ঘেঁষে বসে রফিক। নাক টেনে লম্বা করে নিঃশ্বাস নেয়। জানো নিশি তোমার শরীরের একটা নিজস্ব  ঘ্রাণ আছে, কেমন যেন পাকা ধানের মতো মিষ্টি সোঁদা গন্ধ।

: কেন আমি গ্রামের মেয়ে বলে কি আমার গা দিয়ে ধানের গন্ধ আসে নাকি?

: আচ্ছা নিশি তুমি কি কখনও বাস্তবতাকে বাদ দিয়ে ভাবতে পারো না? ভাবতে পারো না প্রেমিক প্রেমিকা মাত্রই কিশোর কিশোরী সে যে বয়সেরই হোক না কেন। তাদের একমাত্র কাজ পরস্পরে বিলীন হওয়া।  নিশি আজ তোমার মামী যতোই তুলকালাম করুক না কেন তোমার এখন ফেরা হবে না। এখন তুমি আমার সাথে ঘুরবে । তারপর একসাথে খাবো আমরা। শেষে তোমাকে নামিয়ে দিয়ে আসব। 

: ওরে বাপরে বাপ মামি তাহলে আমাকে আস্ত রাখবে না। এমনিতেই বিয়ের পাকা কথা না দেয়াতে আমার উপর মহাখাপ্পা!

: নিশি তুমি যেন ওই লোকের কথা ভুলতেই পারছ না। আমি যতো প্রসঙ্গটা এড়াতে চাচ্ছি তুমি ততোই টেনে টেনে আনছ। তা তোমার মামির আনা এই সুপাত্রা করেন কি?

: চাকুরি বাকুরি তেমন কিছু করে না  ।   পয়সাপাতি আছে বিস্তর। বয়সটা একটু বেশি এই যা। 

: পয়সা   থাকলে বয়স একটু বেশি হওয়াতে কি আসে যায়।  পাকা কথা দাওনি আবার নাও তো করোনি। রাজি হয়ে যাও।  তোমার তো বরাবরই পয়সার দিকে নজর। 

: হ্যাঁ , রাজি হবো ভাবছি। তোমার যখন চাকরি বাকরি কিছু হল না।

: তাহলে নিশি আমি এখন যাই।

 হনহন করে হাঁটতে থাকেরফিক । দৌড়ে এসে ওর হাত চেপে ধরে নিশি। 

: ওমনি মশায়ের রাগ হয়ে গেল, ঠাট্টাও বোঝ না। বস বস। বললে আমাকে নিয়ে  ঘুরবে , খাওয়াবে,  তা উপলক্ষটা কি । চাকরি পেয়েছ?

: চাকরি না একটা কাজ পেয়েছি সুনামগঞ্জ এলাকায়। একটা এসাইনমেন্ট  নিয়ে যাচ্ছি হাওড় এলাকায়। টার্গেট গ্রুপ হাওড়ের জেলে স¤প্রদায় । ফিজিবিলিটি স্টাডি হয়ে গেছে। ওটাই এখন প্রজেক্ট এরিয়া। 

 : চাকরি নয় কাজ , তাও সুনামগঞ্জের হাওড়ে। আর একজন্য আমাকে তুমি  খাওয়াতে চাচ্ছ! 

এক ফুৎকারে রফিকের সমস্ত আনন্দ  নিভে যায়, গভীর বিষাদে ভরে যায় ওর মন। বিষাদের ভারি পর্দা দোলে আর দোলে। যে তার কাজকে স্বীকার করতে পারত, আনন্দকে শেয়ার করতে পারত সেই তার কাজকে ছোট করে দেখছে। বিষাদক্লিষ্ট কন্ঠে  রফিক বলে,

: তুমি এভাবে ভাবছ কেন বুঝতে পারছি না। কিছু না হওয়ার চেয়ে  কিছু হওয়া কি  ভাল না? এই কাজের মধ্যে থেকে একটা চাকুির যোগাড় করে নেব। একটা প্লাাটফর্ম তো হল। তাছাড়া বেতন মন্দ না।

: চাকুরিই না তার আবার বেতন। ঢাকায় থেকে তুমি চাকুরি যোগাড় করতে পারলে না হাওড়ে বসে যোগাড় করবে। কি আশ্চর্যজনক কথা। বুঝে গেছি তোমার ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে গেছে। কপালে আগুন লাগল আমারও।

: আজই আমাকে যেতে হবে। তুমি এভাবে বললে, এভাবে ভাবলে কি করে আমি যাবো বল । ঠিক আছে তুমি না চাইলে যাবো না আমি। চলো একটু ঘুরে আসি । আজ তোমাকে নিয়ে ঘুরতে না পারলে, তোমার সান্নিধ্য না পেলে মারা যাবো আমি।

:সরি রফিক আজ আমি পারছিনে। বাসায বলে আসিনি। আচ্ছা চলি। 

হনহনিয়ে হাঁটতে থাকে নিশি। রফিকের ইচ্ছে হয় ওকে ডেকে ফেরাতে, ইচ্ছে হয় বলে একান্তই যদি বসতে না পারো চলো তোমায় নামিয়ে দিয়ে আসি। কিন্তু কিছুই করে না, কিছুই বলে না। নিশি তার বিদায়ক্ষণে এমন ব্যবহার করে গেল!  একটাবার জিজ্ঞাসা পর্যন্ত করল না সুনামগঞ্জে গিয়ে ও কোথায় থাকবে,  কিভাবে থাকবে। একবার বলল না, চিঠি লিখতে, শরীরের যত্ন নিতে। কেন এমন করল নিশি!  তার কাজট কি  এতোই ছোট। সে পুরুষ মানুষ। চ্যালেঞ্জি কাজ করাই তার উদ্দেশ্য হওয়া উচিত, উদ্দেশ্য হওয়া উচিত সাধারণ মানুষের জন্য কাজ করা। এখানে সে সুযোগ আছে। নিশি  কোন কথাই শুনল না । রফিকের জন্য সাগর সমান হতাশা রেখে চলে গেল। 

বেঞ্চের উপর বসে থাকে রফিক। আকাশের দিকে তাকায়। আকাশটা একবারেই শূন্য। এই শূন্যতার রাজ্যে  কি ওকে ভাসিয়ে দিয়ে গেল নিশি। দরদর করে দুচোখ থেকে জল ঝরে রফিকের।  হাঁটতে হাঁটতে থমকে দাঁড়িয়ে রফিককে অবাক চোখে  দেখে এক দেহ পসারিনী। ওর চোখও ছলছলিয়ে ওঠে। দ্রুত সরে যায় সে। রফিক চোখ মুছতে মুছতে উঠে দাঁড়ায়। আসিফ  ট্রেন ধরার জন্য তাগিদ দিতে এসে অবাক হয়ে দেখে রফিক একেবারেই তৈরি।

: ব্যাপার কিরে দোস্ত  আজ যে সময়ের আগে, পাংচুয়াল? লেট রফিকের কি নবজন্ম হল? 

:কেন জানি না দোস্ত  ঢাকা শহর আর আমাকে টানছে না। এ শহর ছাড়তে পারলে নির্বিঘ্নে নিঃশ্বাস নিতে পারি। চলি দোস্ত।  

 : ভাল থাকিস। উইস ইউ বেস্ট অফ লাক। রফিকের পিঠে হাত রাখে আসিফ । রফিকের চোখে আবার ও পানি আসে। পেছেনে না ফিরে দ্রুত বেরিয়ে যায়। গলির পানওয়ালার ডাকে ফিরে দাঁড়ায়। 

:চললেন স্যার। আসিফ স্যারে কইল আপনার চাকরি হইছে। শুকুর আলহামদুলিল্লাহ

রফিক একটা সিগারেট নেয়। পয়সা দিতে যায়। পয়সা নেয় না দোকানি। হাসে। রফিক হাঁটে। খোদা হাফেজ।

খোদা হাফেজ। ফি আমানিল্লাহ।

সবাই দোয়া করছে, শুভেচছা জানাচেছ । অথচ যার এতটুকু খুশি মুখ দেখলে রফিকের সমস্ত দুঃখ, না পাওয়া মুহূর্তে প্রাণ পায় সে রইল মুখ ফিরিয়ে। 

নিশি কেন এমন করলে তুমি। কেন একটু উদার হলে না! 

কমলাপুর স্টেশন থেকে ট্রেনে চড়ে রফিক। এ ট্রেন যাবে সিলেট পর্যন্ত।  হু হু  করে ছুটছে ট্রেন। রফিকের সারাটা অন্তর জুড়ে একটাই নাম, নিশি আমার নিশি। ভাল থেকো তুমি, সুখে থেকো। আমি খুব তাড়াতাড়ি ফিরব তোমার কাছে। জোগাড় করে নেব তোমার মনমতো একটা চাকরি। ততোদিন তুমি শধু অপেক্ষা করো। আর দোয়া করো যেখানে যাচ্ছি, যে কাজে যাচ্ছি তা যেন সফলতার সাথে করতে পারি। 

 

 

%d bloggers like this: