ইজ্জত আলীর ধর্মভীতি – আনোয়ার কামাল

ইজ্জত আলীর ধর্মভীতি

চাচী চাচী বলে হাঁক ডাকতে ডাকতে বাড়ির ভেতর ঢুকে পড়ে ইজ্জত আলী। ইজ্জত আলী অবশ্য পরম ইজ্জতের সাথে রসুলপুর গাঁয়ের এমন কোন বাড়ি নেই যে বাড়িতে তার অবাধ যাতায়াত নেই। পাবনা জেলার সদর থানার রসুলপুর গাঁয়ে মসজিদ-মাদ্রাসা করার জন্য তার মতো পরাণ কাঁদা লোক আর এ গ্রামে কেউ আছে বলে মনে হয় না। অবশ্য ইজ্জত আলী কোনোকালে কোনো মাদ্রাসায় বা মক্তবে লেখাপড়া করেনি। সে হাইস্কুল পার করে কলেজ পাশ করা ছাত্র। ধর্মের প্রতি তার অগাধ বিশ্বাস আর হাদিস কালামের ব্যাখ্যা দিয়ে মা-চাচীদের পরাণে কিঞ্চিৎ হলেও ধর্মভীতি কঠিনভাবে জাগিয়ে তুলতে পেরেছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই।

সেই সাত সকালে বাড়ি বাড়ি হাঁক-ডাক দিয়ে মুষ্টির চাল (গৃহিণীদের ভাত রান্নার আগে একমুঠ চাল অন্য প্রাত্রে আলাদা করে তুলে রাখা) সংগ্রহ করে, আর তা দিয়ে সে মাদ্রাসার আর মসজিদের কাজে ব্যয় করে। একাজে তাকে একটা পরম তৃপ্তির ঢেকুর তুলতে দেখা যায়। আর রসুলপুর গাঁয়ের রাসুল ভক্ত মানুষজন তো আছেই। তাদের ভেতর ধর্মের জিগির তুলে দিয়ে কাঁচা-পাকা দাড়ির ভেতর পাঁচ আঙুলের চিরুনি চালায় আর রাস্তা ঘাটে যাকে পায় তাকেই বলে,

: ভাস্তি, গিরামের মসজিদের লেগিন কিছু করো। বাবারে আল্লার ঘর। ইডাই তুমাক সাক্ষী দিবি। দুনিয়ার সব পইড়ি থাকপি রে বাপ, কিছুই সাথে যাবি না-নে। এই যে আল্লার কালামটা শেখো। ইডাই তুমার সাথে যাবি। আর এই যে গিরামেই মাদ্রাসা-মসজিদ ইডার দিকে কি তুমারে কোনো কর্তব্যনি। কারো কি কোনো দায়-দায়িত্বনি। আরে বাপুরে, আমি তো লাগিই আছি। দিন-রাত গার রক্ত পানি কইরি এর মধ্যি কাম কইরি যাচ্ছি। কি, কি কও? ঠিক নাকি? কতা কও না কে?

: হ, চাচা আপনি ঠিকই কইচেন। আপনি না থাকলি এই মসজিদ পাকা হতি আরো কত দিন লাগতি, তার ঠিক আছে!

ছেলেটার কথা শুনে ইজ্জত আলী মিট মিট করে হাসে। আর মনে মনে তার ইজ্জত যে বাড়ছে সেটা সে অনুভব করে। আর হবেই বা কেন, রসুলপুর গাঁয়ের লাউ, কাঁঠাল, কলা, চাল-ডাল থেকে এমন কিছু নাই যা সে সংগ্রহ করে না। তবে গাঁয়ের মানুষজন তার এ কাজকর্ম দেখে কেউ না করে না। সে তো আর খারাপ কিছু করছে না। ধর্মের কথাই তো বলছে। মানুষজনকে ধর্মভীতি দেখিয়ে নামাজী করে, গাঁয়ের মসজিদটা পাকা হচ্ছে; মাদ্রাসায় এতিম ছেলেদের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা হচ্ছে। ২জন বেকার যুবকের মাদ্রাসায় শিক্ষকতার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে।

সবই চলছে। তবে, গ্রামের মানুষ টের পায় না ইজ্জত আলী নিজের ইজ্জত বাড়ানোর সাথে সাথে গোপনে সংগঠন গোছানোর কাজ করছে। মসজিদে নামাজ শেষ হলে তরুণদের আল্লাভীতি দেখিয়ে দলের খাতার নাম লেখাচ্ছে। কাজটা একটা নীবর বিপ্লবের মতো আর কি। গাঁয়ের অশিক্ষিত মানুষজন তেমন করে আঁচ করতে পারে না। গাঁয়ের বাড়ি বাড়ি ঘুরার ফলে গ্রামের সব বাড়ির চাল-ডাল যেমন তার থলেতে জমা পড়ছে, ঠিক তেমনি বাড়ি-বাড়ি ঘুরে তার সঠিক তথ্য সংগ্রহটাও সেরে নিতে কোনো বেগই পেতে হচ্ছে না। কাকে কিভাবে মগজ ধোলাই করে দলে ভিড়াতে হবে, সে কথা তার চাইতে এই রসুলপুর গাঁয়ে আর কার বেশি জানা আছে! সে কথা রসুলপুর গাঁয়ের মানুষের যেমন জানা আছে, ঠিক তেমনি জানা আছে ইজ্জত আলীরও।

আপন ভাতিজাকে মাদ্রাসায় চাকরি দিয়ে একদিকে যেমন তার কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পেরেছে, অপরদিকে খোদ আপনজন দলের লোকের একটা হিতব্যবস্থা করতে পেরে সে তৃপ্তির ঢেকুর তুলে পান চাবাতে চাবাতে গাঁয়ের কাঁচা পথ ধরে হেলে দুলে চলে আর পানের পিক ফুচ করে ছুড়ে মারে।

: কিরে অসিমদ্দি, মেলা দিন তো তোক মসজিদে দেখিনি রে। কী আল্লা-রাসুলের নাম লেওয়া কি ভুলে গেলুরে। আরে মরতি হবি লে? মরলি কি আজরাইল তোক খাতির করবিনি? ওরে কবরের আজাবটা কি হবিনি, তা কি ঠিক করতি পারিসনি। হাদিস কালাম এক  আধটু পইড়ি দেখ। তাহলি ঠিক পাবুনে। আরে বাপু আমি তো ঢোলে বাড়ি দিয়েই যাচ্ছি। রোজ রোজ তোরে কানের কাছে যে ধর্ম লিয়ে এতো কতা কচ্ছি তাতেই তোরে কানে পানি ঢোকে না দেখছি। বাপুরে আমি কিন্তু আমার কাম করতিসি। এখন তোরা যদি সুপথে না আসিস, তাহলি আমার তো কিছু করার থাকে না।’ ইজ্জত আলি হড় হড় করে একনাগাড়ে কথাগুলো বলে চলে।

করিৎকর্মা জোয়ান ছেলে অসিমদ্দি ঠিক কি বলবে বুঝে উঠতে পারে না। ইজ্জত আলীর কথার পৃষ্ঠে সে কি প্রতিউত্তর দেবে! তার বাবা মারা যাওয়ার পর সংসারের হাল তাকেই ধরতে হয়েছে। মাসহ তিন বোন এক ভাই নিয়ে তাদের সংসারে একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি সে ছাড়া তো আর কেই নাই। সকাল হলেই কাজের জন্যে তাকে হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়াতে হয়। পেটের ধান্দায় জগতের সব কিছু ভুলে সে কেবলই কাজের সন্ধানে হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়ায়। কেবল কাজ ছাড়া তার তো কোন গতি নাই। কাজ নাই তো বাড়িতে খাওয়া নাই। শুধু তার না, পরিবারের মা-ভাইসহ পাঁচজনের খাওয়াই বন্ধ। তার ধর্ম নিয়ে ভাবনা করার সময় কোথায়? তার পরেও ইজ্জত আলীর কথাগুলো তার অন্তরে গেঁথে যায়। সব কথাইতো সত্যি মনে হয়। গাঁয়ের অনেকেই যাকে শ্রদ্ধা করে; এতো পরহেজগার লোকটি কি আর মিথ্যা কথা বলবে। কথাগুলো তার হৃদয়ে গভীর রেখাপাত টেনে দেয়। মনের ভেতর এক ধরনের ভীতি কাজ করে। ঠিকই তো কবরের আজাব তো তাকে ভোগ করতিই হবি। বিষয়টা নিয়ে তাকে বেশ ফাঁপরে ফেলে। কিন্তু সে তো কোনো আকাম-কুমাম করে বেড়ায় না। তাহলে তার তো কোন পাপও হবার কথা না। এসব কথা তার মনের ভেতর ঘুরপাক খায়।

: কিরে? কিছু কচ্ছিস না যে

’ ইজ্জত আলীর কথায় সম্বিত ফিরে আসে অসিমদ্দির। গা ঝাঁকি দিয়ে  বলে,

: চাচা কও। আমি শুনতিছি। তুমি তো ঠিকই বুলতিছো। নামাজ না পড়লি তো কবরের আজাব ভোগ করতিই হবি। কিন্তু তুমি তো জানোই সংসারের হাল টানতি যায়ি আমি যে কোনো দিক তাকাতি পারিনি। সে কারণেই তো মসজিদে আসার সময়ও পাইনি।

: আরে শোন তোক আমি একটা কাজ দেব। হালকা কাজ। তাহলি তুই নামাজ কালাম করতি পারবি। আর তোর সংসাবের খরচ লিয়ে চিন্তা করতি হবি নানে। তুই আমার সাথে সাত দিন এক কামে যাবু। বাস। তোর দিন হাজরিও পাবু। তাতে কোন সমস্যা হবিনানে।

:কামডা কি? অসিমদ্দি জানতে চায়।

: আরে ভাতিজা তোর কি আমার উপর ভরসানি? আমি কি আমার গাঁর ছাবালেক দিয়ে কোন খারাপ কাম করাতি পারি?

: চাচা আমি তো তা কচ্চিনি। তোমার উপর এ গাঁর প্রায় সব লোকের একটা বিশ্বাস আছে। কেউ তুমাক খারাপ কুনো কামে কুনদিন দেখেনি।

: তাহলি তুই এক কাম কর। সামনের শনিবার তোর নতুন কাম শুরু হবি। তবে তোক শুক্কুরবার জুম্মার নামাজে আসতি হবি।

: আচ্ছা আসবোনে বলে, অসিমদ্দি বাড়ির দিকে রওনা দেয়।

 

খুব ভোরে ফজরের নামাজের পর ইজ্জত আলী মসজিদের বারান্দায় মাদ্রাসার ছেলেদের নিয়ে নানান হাদিস কালাম এর ব্যাখ্যা দেয়। মারা গেলে কবরে বড় বড় সাপ কীভাবে দংশন করবে। কবরের মাটি কীভাবে চেপে ধরবে। এসব শুনে কোমলমতি ছোট ছোট ছেলেরা ভয়ে কুঁকড়ে ওঠে। মাদ্রাসার লিল্লা বোডিং এ বারোজন এতিম ছেলে থাকে। তার মধ্যে গ্রামের ৪জন বাকিরা অন্য এলাকার। এদের খাবার ব্যবস্থা করে গাঁয়ের তুলনামূলক অবস্থা সম্পন্ন বাড়ি থেকে। এক একজন ছেলেকে এক এক বাড়িতে একবেলা করে খাওয়ানোর ব্যবস্থা করে দেয়। এতে ছেলেগুলোর একটা প্রতিদিনের খাবারের ব্যবস্থা হয়ে যায়। আর যারা ছেলেদের খাওয়ায়, তারাও পরকালের কথা চিন্তা করে সওয়াবের আশায় এসব এতিম ছেলেদের মুখে খাবার তুলে দিতে পেরে নিজেদের বেশ তৃপ্ত বোধ করে।

শুক্করবার জুম্মার নামাজের পর ইজ্জত আলী অসিমদ্দিকে নিয়ে বারান্দায় বসে তাকে তওবা পড়ায়। কারণ, তার নামাজ কাজা আছে। ইসলামী আদব কায়দা নাই। দোআ-দরুদ পড়ায়ে অসিমদ্দির বুকে একটা ফুঁ দিয়ে দেয়। তার ভেতর ধর্মের একটা কঠিন ভীতি ছড়িয়ে দেয়। মনটাকে আরো ধর্মের প্রতি গভীর মনোযোগী করে তোলে। এমনিতেই অসিমদ্দি আল্লাহ ভীরু ছেলে, তার ওপরে ইজ্জত আলীর হাদিসের নানান বয়ান শুনে তার মনটা মোমের মতো টপ টপ করে গলে নরম হয়ে যায়।

শনিবার ফজরের নামাজের পর ইজ্জত আলী অসিমদ্দিকে সাথে নিয়ে শহরমুখি রওনা দেয়। গ্রামের বেশিরভাগ লোকজন তখনও ঘুম থেকে জেগে ওঠেনি। গ্রামের কেউ জানতে পারে না ইজ্জত আলী এক অজনার পথে গাঁয়ের সরল এক যুবককে নিয়ে হাঁটা দেয়। যুবকটিও জানে না, কী তার কাজ? এক মাস পেরিয়ে গেলেও গাঁয়ে আর কেউ এদের দুজনকে দেখতে পায় না। অসিমদ্দির মা জরিনা বেওয়া এবাড়ি ওবাড়ি ঘুরে ঘুরে ছেলের সন্ধ্যান প্রত্যাশা করে। কেউ কোনো খবর দিতে পারে না। লোকে শুধু জানে ইজ্জত আলী চিল্লায় গেছে। তবে কেউ জানতে পারে না অসিমদ্দি কোথায় গেছে। তবে কি সে কাজের সন্ধানে কোনো অজানার উদ্দেশ্যে পাড়ি দিয়েছে। গাঁয়ের চা এর দোকানগুলোতে কানাঘুরা চলতে থাকে। ‘ব্যাপার কিরে! এই সহজ সরল ছাবালটা গেল কোনো?’

ভোরের আযানের সাথে সাথে মুসল্লিরা মসজিদের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। নাটোরের বনপাড়ার কাছে হাইওয়েতে চলনবিলের পথে আঁকা বাঁকা হয়ে যে পথটা গেছে, সেখানে পথের ঢালে দু’জনের মৃত দেহ পড়ে আছে। পুলিশ ভ্যান পাশেই রাখা আছে। কয়েকজন পুলিশ জটলা করে দাঁড়িয়ে আছে। মুসল্লিদের মধ্য থেকে একজন পুলিশের কাছে জানতে চায় :

:এরা কারা? পুলিশ জানায় :

: রা জঙ্গি। তাদের ব্যাগে বোমা আছে। ওদিকে যাওয়া যাবে না। দূর থেকে মুসল্লিরা দেখতে পায় একজন চল্লিশোর্ধ দাঁড়িওয়ালা লোকের পাশে চব্বিশ পঁচিশ বছর বয়সি এক তরতাজা যুবক পড়ে আছে। তবে তারা কেউ তাদের নাম ঠিকানা জানতে পারে না।