যাপিত জীবনের দায়/ আফরোজা অদিতি

আফরোজা অদিতি

আফরোজা অদিতি

কফিলউদ্দিন সাহেবের খুব মন খারাপ; চারদিকে এতো মৃত্যুখবর ভালো লাগছে আর! বয়স হয়েছে তাঁর। তাছাড়া স্বজনদের ব্যবস্থানুযায়ী নভেল করোনা ভাইরাস বা কোভিড-১৯ এর সংক্রমণরোধের কারণে ‘সামাজিক দুরত্ব’ মেনে চলার জন্য ছুটি ঘোষণা করেছে সরকার; এই ছুটিকাল শেষ হলেই ওল্ডহোম থেকে নিতে আসবে কিংবা তাঁকে দিয়ে আসবে তাঁর পরিবার যেটাই হোক; কথা পাকাপাকি যেতেই হবে! যে ওল্ডহোমে ব্যবস্থা করেছে তাঁর ছেলে-ছেলেবউ সেখানে অবস্থাপন্ন যারা তাদের থাকা-খাওয়া বাবদ কিছু টাকা দিতে হবে; অর্ধেক অর্থ পরিশোধ করা হয়েছে অর্ধেক যেদিন যাবে সেদিন পরিশোধ করা হবে; একবছরের অগ্রিম দিচ্ছেন সানুর বাবা। সানু কফিলউদ্দিন সাহেবের একমাত্র নাতি। তাঁরও একমাত্র ছেলে; সেই ছেলের ঘরের ছেলে সানু; তাঁর বংশধর, তাঁর নয়নজ্যোতি!  

 

কফিলউদ্দিন সাহেব তাঁর যাওয়ার ব্যাপারে ওদের তৎপরতার বহর দেখে ভেবেছিলেন করোনা ভাইরাসের জন্য তাড়াতাড়ি করছে তার ছেলে-ছেলে বউ; চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহরে ভাইরাস সংক্রমণ দেখা দিলেই তৎপরতা শুরু হয়েছিলো ওদের; দিন যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বের সকল দেশেই এই কোভিড-১৯ মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ছে ক্রমশ! ওদের তৎপরতাও বেড়েছে। বাংলাদেশে এই ভাইরাস ভয়াবহ রূপ ধারণ করেনি সত্য তবে কখন কী হয় বলা তো যায় না! সানুর দাদুর বয়স সত্তরের কাছাকাছি; একটানা বাসায় থাকতে ইচ্ছা করে না তাঁর! সব সময় ঘরে বসে থাকতে কারোরই ভালো লাগে না; সানুর দাদুর তো নয়ই! কফিলউদ্দিন সাহেবের ভোরবেলা মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়া তারপর হেঁটে হেঁটে সামনের খোলা জায়গায় গিয়ে কিছুক্ষণ না বসলে ভালো লাগে না। তিনি যখন বসেন তখন তাঁর বয়সী কয়েকজন  আসেন; কথা হয়, চা বিস্কুট খাওয়া হয়; সময় কাটে। অবসরে যাওয়ার পর থেকেই এভাবেই চলছেন; কিন্তু বর্তমান অবস্থায় সকালের এই ব্যাপারটা খুব ভালো চোখে দেখছেন না সানুর মা। চারদিকের এতো মৃত্যুখবর ভীত করে তুলেছে সানুর মাকে! সানুর মায়ের চিন্তা বাইরে গিয়ে কার না কার ছোঁয়া লেগে অসুখ বাধিয়ে বসবে! আর অসুখ হলে বাড়ির সকলের হতে কতোক্ষণ! তখন তো লকডাউনে বাড়ি থেকে বের হতে পারবে না কেউ! এসব কথা যে ভাবেননি তিনি তা নয় তবে ওটুকু না করলে তো ভালো লাগে না তাঁর। এখন তেমন কাজও নেই কাজ করতেও পারেন না তিনি। সানু স্কুলগাড়ি স্কুলে নিয়ে যায় ওকে! সানুকেও সঙ্গ দিতে হয় না এখন।

 

নভেল করোনা ভাইরাসের কারণে ওল্ডহোম তাঁর আবাস ঠিক করলেও তিনি বুঝতে পেরেছেন তাঁকে এই বাড়ি থেকে স্থানান্তর করার করণ অন্য; যা ধীরে ধীরে বুঝতে পেরেছেন কফিলউদ্দিন সাহেব; তিনি বুঝেতে পেরেছেন একবার ওখানে পা রাখলে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ফিরতে পারবেন না আর! তিনি সরকারি  কর্মকর্তা ছিলেন। অবসরে গিয়েছেন অনেকদিন। বয়স বেড়েছে; দ্রুত কমছে শারীরিক কর্মক্ষমতা; আগের মতো সংসারের কাজগুলো গুছিয়ে করতে পারেন না। একটুতেই হাঁফিয়ে ওঠেন। তাঁর স্ত্রী বিয়োগ হয়েছে সানুর বয়স যখন একবছর; এখন দশ চলছে ওর। সানু ওর দিদা চলে যাওয়ার পর থেকেই দাদুর কাছেই থাকে। গোসল-খাওয়া-পড়া-ঘুম সবই দাদুর কাছে! ওর দেখভাল করার জন্য একজন বুয়া আছে ঠিকই কিন্তু ওর কাছে যেতে চায় না সানু। দাদুর কাছে থাকে, দাদু গল্প শোনায় তাকে; রূপকথার গল্প। পরী,রাক্ষস, রাজকুমার, রাজা-রাণীর গল্প শুনতে ভালো লাগে ওর। এছাড়াও খেলাধুলা বিষয়ক গল্প শুনতে ভালো লাগে, বেশি ভালো লাগে দাদুর গলা জড়িয়ে ঘুমাতে। 

 

দাদুর কাছে অঙ্ক পড়ে, ইংরেজি পড়ে। দাদুর কাছে পড়তে ভালো লাগে সানুর। দাদুকে ওল্ডহোমে রাখবে; কথাটা শোনার পর থেকেই ওল্ডহোম নিয়ে ভাবছে সানু! ওল্ডহোম কী? তা জেনেছে ক্লাস-টিচারের কাছে; টিচার বলেছেন, ‘যাদের দেখার কেউ নেই সেইসব বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের থাকার জায়গা, যার নাম ওল্ডহোম বা বৃদ্ধাশ্রম।’ টিচারের কথা শোনার পর থেকে একটা কথাই ভেবে যাচ্ছে সানু, ওর দাদু তো একলা নন! দাদুর তো ওরা আছে! আছেন ওর বাবা, ওর মা আছেন, ও আছে! সানু একাই ভাবে ওর বাবা তো দাদুর ছেলে তাহলে দাদু কেন নিজের ছেলে থাকতে ওল্ডহোমে গিয়ে থাকবেন! আর বাবা কেন দাদুকে ওল্ডহোমে রেখে আসবেন বুঝতে পারছে না কিছুতেই! মাকে প্রশ্ন করে বকা খেয়েছে, বাবাকে ভয়েই প্রশ্নটা করতে পারেনি।  

 

সানু বড়ো হওয়ার পর থেকে দেখেছে বাজার করা, বাগানে পানি দেওয়া, ওকে স্কুল থেকে আনা-নেওয়া সবই করেন দাদু। ওর মা সারাদিন টিভি দেখে; মরিয়ম বুয়া রান্না করে। সানু মাকে এসব কথা বললে রাগ করেন মা। দাদু একদিন কাছে ডেকে বললেন, ‘দাদুভাই, মা হলেন গুরুজন, গুরুজনদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করতে হয়।’ ‘তুমিও তো মায়ের গুরুজন, তাহলে?’ সানুর এই কথার কোন উত্তর দিতে পারেননি কফিলউদ্দিন সাহেব। 

 

দাদু চলে যাবেন আগামিকাল। তাই ভয়ে ভয়ে মাকে প্রশ্ন করে আবার। ‘দাদুকে কেন ওল্ডহোমে থাকবে মা?’  ‘তোমার আলাদা ঘর লাগবে, তুমি বড়ো হচ্ছো।’ ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে বলেন মা।  

‘আমার কোনো আলাদা ঘর লাগবে না মা; দাদুর সঙ্গে ভালো আছি।’ এই কথা শুনে আরো রেগে গেলেন মা। বললেন,

‘যা জানো না তা নিয়ে তর্ক করবে না। যা বলছি তাই হবে।’ এরপর থেকে সানুর মন খারাপ। ও দাদুর কাছে বসে আছে। দাদুর কাপড় বের করে ব্যাগে গুছিয়ে নিতে বলেছেন মা। দাদু কাপড় না গুছিয়ে বসে আছেন। দাদুর পিঠের কাছে বসে থাকতে থাকতে হঠাৎ দাদুকে জড়িয়ে ধরে সানু বলে, ‘আচ্ছা দাদু, একটা কথা জিজ্ঞেস করলে রাগ করবে না তো।’ দাদু ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, ‘না দাদুভাই বলো।’ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে সানু, ‘দাদু তুমি তো চাকরি করতে, রিটায়ার্ড অফিসার। রিটায়ার্ড করলে তো পেনশন পায় শুনেছি; টুম্পা বলেছে, ওর দাদু নাকি অনেক টাকা পেয়েছে আর ব্যাংকে রেখেছে। তুমি পাওনি দাদু।’ সানুর কথা শুনে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন কফিলউদ্দিন সাহেব। তারপর চোখের জল লুকাতে মুখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিজেকে শান্ত করে বলেন, ‘আমিও পেয়েছিলাম দাদুভাই, তোর বাবাকে দিয়েছি; এই বাড়ি সেই টাকায় কিনেছে তোর বাবা। বাঁকি টাকা ব্যবসায় লাগিয়েছে।’ এই কথা শুনে সানু বলে, ‘তাহলে তো এটা তোমার বাড়ি।’ ‘নারে এই বাড়ি তোর মায়ের!’ ‘তুমি দিলে কেন দাদু।’ সানুর সোজাসাপটা কথা। ওর কথা শুনে অবাক হন কফিলউদ্দিন সাহেব। বলেন, ‘তোর মা কি আমার পর।’ এবারে সানু বলে, ‘তাহলে, ওরা তোমাকে ওল্ডহোমে রাখবে কেন? তুমি কী ওদের পর? অসুখ-বিসুখের সময় তো সবাইকে একসঙ্গে থাকতে হয়!’ এই কথার কোন জবাব দিতে পারেন না দাদু। দুজনেই চুপচাপ। আর মাত্র একটা রাত। আগামিকাল সকালে এই বাড়ি থেকে চলে যেতে হবে, ছেড়ে যেতে হবে এদের, নিজের ছেলে-ছেলেবউ-নাতি। চোখের জল গোপন করেন সানুর দাদু।

 

কফিলউদ্দিন সাহেব আলো নিভিয়ে শুয়ে আছেন। আজ আর টিভি দেখতে ভালো লাগছে না। টিভিতে শুধু মৃত্যুখবর! মৃত্যুখাদের কিনারে দাঁড়িয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়ে যাওয়া মৃত্যুসংখ্যা শুনতে ভালো লাগে না! বিশ্বে এখন মৃত্যুমিছিল লেগেছে কথাটা  মনে হলে বুকের ভেতর জল জমে বরফ হতে থাকে তাঁর! বয়স্কদের ভয় বেশি সমস্যা বেশি মনে হয়! কারণ টিভিতে-কাগজে বয়স্কদের দিকে খেয়াল রাখতে বলার ঘোষণা আসছে প্রতিনিয়ত আর তাঁকে বাড়ি থেকে দূরে রাখার ইচ্ছা পোষণ করছে এরা! ছেলেবউয়ের কথা ভাবছেন না, ছেলেবউ পরের মেয়ে, তিনি ভাবছেন তাঁর ছেলের কথা! এই ছেলেকে বড়ো করতে মাথার ঘাম পায়ে ফেলেছেন, কতো ইচ্ছা জলাঞ্জলি দিয়েছেন! তাঁর স্ত্রীর,ওর মায়ের কতো শখ পুরণ করতে পারেননি তিনি! সব সব তো এই ছেলের জন্য! সন্তানেরা তো তা মনে করে না; ওরা মনে করে জন্ম দিয়ে দায় ঠেকেছে বাবা-মা! আসলেই দায়! এই দায় মিটিয়ে যখন স্বস্তি আসে জীবনে তখন কর্মক্ষমতা কমে আসে নিজের তখন নিজের জীবন নিজের কাছেই বোঝা মনে হয়! সন্তান পালন দায় বড়ো কঠিন এই দায়! ‘দায়’ কথাটা মনে হতেই হাসি পায় কফিলউদ্দিন সাহেবের; এই দায় যেন শুধু জনয়িতা-জনয়িত্রীর, সন্তানের নয়! তিনি মন স্থির করেছেন চলে যাবেন এর জন্য কষ্ট নেই বুকে; কষ্ট শুধু সানুকে ছেড়ে যেতে হবে! এই কষ্টই বুকে বাজছে বেশি বেশি; খুব কষ্ট হচ্ছে তাঁর! ওকে ছেড়ে কেমন করে থাকবেন তাই ভাবছেন তিনি। চোখের কোল বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ে বালিশে।  

 

হঠাৎ টিভি দেখা ফেলে দৌড়ে আসে সানু। বলে, ‘দাদু দাদু, তোমার যাওয়া হচ্ছে না কাল। ছুটি বাড়িয়ে দিয়েছে সরকার! পরবর্তী ঘোষণা না দেওয়া পর্যন্ত ঘর থেকে বের হওয়া যাবে না। হোমকোয়ারেন্টাইন; প্রয়োজন ছাড়া ঘর থেকে কেউ বের হতে পারবে না। তুমি তো দাদু একা যেতে পারবে না; ওল্ডহোমে তো ঢুকতেও দিবে না তোমাকে! যেতে হবে না দাদু, তোমাকে যেতে হবে না কোথাও।’ এলোমেলোভাবে কথাগুলো বলে ঝাঁপিয়ে পড়ে দাদুর বুকে। ওকে প্রাণপণে সরাতে চেষ্টা করে দাদু কিন্তু পারেন না! 

 

কথা বলতে পারছেন না কফিলউদ্দিন সাহেব; কথা বলার অবস্থায় নেই তিনি। বুকের ব্যথাটা বেড়েছে; বিকেলে অল্প ছিল, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ব্যথার প্রচন্ডতা বেড়েছে! তিনি বলেননি কাউকে! ইচ্ছা করেনি। কী হবে বলে! তবে এখন সানুর ডাক শুনে সানুর সঙ্গে বাঁচার খুব ইচ্ছা করছে তাঁর! দাদু, দাদু, দাদু। দাদু কথা বলছে না। সানু খুব জোরে মা-বাবাকে ডাকে। বলে, ‘তাড়াতাড়ি এসো।’  

 

সানুর ডাক শুনে ঘরে আসে মা-বাবা। বিরক্তি ফুটে উঠেছে মায়ের মুখে। কথায় প্রকাশ পাচ্ছে তা। ‘কী কী হয়েছে? চেঁচাচ্ছ কেন?’ ঘরে আলো জ্বালে বাবা। সানুর মা সরিয়ে নিতে চান ছেলেকে কিন্তু পারেন না! কী করবেন কিছু ভেবে না পেয়ে সানুর বাবা পত্রিকাতে দেওয়া হট-নম্বরগুলোতে ফোন করতে থাকেন। সব হারানোর ব্যথা ফুটে ওঠে ছেলের চোখে-মুখে।  কিছুক্ষণ পর অ্যাম্বুলেন্সের শব্দ শোনা যায় পাড়াতে! পরদিন লকডাউন ঘোষণা করা হয় এলাকা!