যে প্রহরগুলো  তখনও অন্তহীন/ সাহানা শিমু

যে প্রহরগুলো  তখনও অন্তহীন

যে প্রহরগুলো  তখনও অন্তহীন

যে প্রহরগুলো  তখনও অন্তহীন/ সাহানা শিমু

 

প্রতিটা রাত আসে বিভীষিকা নিয়ে। মৃত মানুষটির মুখটা সামনে এসে দাঁড়ায়। জল ছলছলে চোখে করুণ আকুতি জানায়- ‘জোবেদা এভাবে পড়ে থাকতে আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। কিছু একটা করো,প্লিজ জোবেদা প্লিজ।’ জোবেদার চোখে বেয়ে অঝর ধারায় গড়িয়ে পড়ে জল, এভাবেই একসময়ে ঘুমিয়ে পড়ে।

দিনরাত,পল অনুপল একসময়ের জন্যও ভুলে থাকতে পারে না প্রিয় সেই মুখ। মর্গের ফ্রিজারে শুয়ে আছে আজ পাঁচ বছরের বেশি হয়ে গেলো। প্রথম দিকে জোবেদা ঘন ঘন যেতো, মর্গে যেতে কার ভালো লাগে! তবুও যেতো, মনে হতো রহমতের নিশ্চয়ই ভালো লাগছে জোবেদা এখনও আশা ছাড়েনি জেনে। ভাবত, খুব তাড়াতাড়ি নিশ্চয়ই ফয়সালা হয়ে যাবে। স্বামীকে মাটির গহীনে শুইয়ে মনটাকে শান্ত করবে। তার জন্য মন ভরে কাঁদবে, আল্লাহর দরবারে মাগফেরাত চাইবে। কিন্তু আইনের মারপ্যাচে আটকে গেলো সবই। বছরের পর বছর ঘুরে যাচ্ছে , কিন্তু আইনি প্যাঁচ খুলছে না। প্রথমদিককার মতো এখন আর ভয় লাগে না মর্গের ভেতর ঢুকতে। তারপরও জোবেদা যাওয়া কমিয়ে দিয়েছে। কারণ দিন দিন মানুষের বৈশিষ্ট্যগুলো রহমতের শরীর থেকে লুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। স্বাভাবিক লাগে না দেখতে, শরীর থেকে কেউ যেন পানি টেনে বের করে নিয়েছে। চোখ মুখের দিকে তাকানো যায় না। মানুষ আর কংকালের মধ্যবর্তী একটা অবস্থা। মেডিসিন, কেমিক্যাল আর মৃতের শরীরের গন্ধ সয়ে গিয়েছিল জোবেদার। এসবের সাথে এখন যুক্ত হয়েছে গ্যাসের গন্ধ। রহমতের ট্রলিটা টেনে বের করা মাত্র গ্যাসের বোটকা গন্ধে দম আটকে আসে। জোবেদা আর নিতে পারে না, মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠে। দ্রুত বের হয়ে বাড়ি ফিরে ওয়াশরুমের শাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে ভিজতে থাকে, গায়ের কাপড় গায়েই থাকে। রহমতকে দেখে আসার পর এমনিতেই শরীর মন অবসন্ন থাকে । তার উপর ঠান্ডা জলে বেশ অনেকক্ষণ এভাবে দাঁড়িয়ে থাকে, এক সময় হুঁশ ফেরে-

এ আমি কি করছি! ঠান্ডা লেগে যাবে, আবার নিউমোনিয়া হলে কে দেখবে আমাকে! কে আছে আমার! না কেউ নেই।

গতবার ঠান্ডা লেগে নিউমোনিয়া হয়ে গিয়েছিল, বুকে কফ জমে একাকার অবস্থা। এতোটাই খারাপ হয়ে গিয়েছিল যে মেশিন লাগিয়ে কফ বের করতে হয়েছিল। নিজে থেকে শ্বাস নিতে পারছিলো না। অক্সিজেন সিলিন্ডার লাগাতে হয়েছিল। টানা পনেরদিন হসপিটালে থাকতে হয়েছিল। ডাক্তার বার বার করে সাবধান করে দিয়েছিলেন,  ‘সব সময় গরম পানি ব্যবহার করবেন, ঠান্ডা থেকে দূরে থাকবেন। আবার আক্রান্ত হলে সারিয়ে তোলা বেশ মুশকিল হবে’।

রাতে কাঁপুনি দিয়ে প্রচন্ড জ্বর এলো জোবেদার। কিছু খেতে ইচ্ছে করছে না, লেপ গায়ে শুয়ে পড়ল। লাফিয়ে লাফিয়ে জ্বর বাড়ছে, ঘুম আসছে না কিছুতেই। মাথার কাছে থেকে মোবাইল নিয়ে বাড়িওয়ালা আপাকে কল করতে যেয়ে ভাবল,  থাক, নিজে ঔষুধপত্র খেয়ে দেখি দুই একদিন।

পরের দিন, তার পরের দিন জ্বর কমছে না, এদিকে কাশি আর শ্বাস কষ্টও বেড়ে গিয়েছে। খাবারের কোন রুচি নেই, শরীর খুব দূর্বল হয়ে পড়েছে। উঠে দাঁড়ানোর শক্তি নেই, মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠছে। কোনরকমে মোবাইল নিয়ে বাড়িওয়ালা আপাকে কল করার সাথে সাথে তিনি তার স্বামীকে নিয়ে এসে দেখেন জোবেদা অজ্ঞান হয়ে মেঝেতে পড়ে আছে। তাড়াতাড়ি চোখেমুখে পানির ছিটা দিতে চোখ খুলল, তবে খুব দূর্বল। সমানে প্রলাপ বকছে,

“রহমতের একটা সুরাহা না করে মরতে চাই না। নিজ হাতে ওকে মাটিতে শুইয়ে দিয়ে এরপর

নিশ্চিন্ত মনে যেন মরতে পারি।”

বাড়ির মালিক নিজেই আ্যম্বুলেন্স ডেকে হসপিটালে ভর্তি করালেন। এমারজেন্সি ডাক্তার দেখে জানালেন অবস্থা বেশি সুবিধার নয়। সঙ্গে সঙ্গে আইসিইউতে ভর্তি করে নিলেন। গতবারের মতো আবার সেই একই হসপিটালে ভর্তি জোবেদা। নানান রকম যন্ত্রপাতি ওর সারা শরীরে লাগানো। শেষরাতের দিকে জোবেদা বুঝতে পারে সে হসপিটাল বেডে শুয়ে আছে। চেতন আর অচেতনের মধ্যে সময় যাচ্ছে। জোবেদার অতীত বর্তমান মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়…

 

জোবেদার বাবা, চাচারা তিনভাই। দাদার মৃত্যুর পর একখন্ড জমি নিয়ে ভাগাভাগির মধ্যে না যেয়ে তিনদিকে তিনটি ঘর তুলে একই ভিটেয় থেকেছে তিন ভাই বৌ ছেলেমেয়ে নিয়ে। চাচাতো ভাইবোনেরা একসাথে হেসেখেলে বড় হচ্ছিলো। নিজেদের মধ্যে ঝগড়াঝাটি হতো, আবার মিলে যেতো। তবে এক ঘোর লাগা সন্ধ্যায় বড় চাচার ছেলে আখলাকের প্রেম নিবেদন জোবেদাকে এলোমেলো করে দেয়। কী মাদকতায় মোড়ানো সে চাহনী, কী অপরূপ মোহনীয় সেই আহ্বান! সাড়া না দিয়ে থাকতে পারেনি জোবেদা। বিষয়টা বড়দের কাছ থেকে বেশিদিন লুকিয়ে রাখা যায়নি। জানাজানির পর তড়িঘড়ি করে বিয়ের ব্যবস্থা করেন তারা। কারণ এই অবস্থায় এতো কাছাকাছি থাকা নিরাপদ নয়। আবার কোন পরিবারের পক্ষেই নিজের ভিটেবাড়ি ছেড়ে দূরে কোথাও যেয়ে থাকা সম্ভব নয়।

এ বিয়েতে বড় চাচী খুব খুশি না হলেও ছেলের জন্য জোবেদাকে মেনে নিয়েছিলেন। ভালোই কেটে যাচ্ছিল ওদের দিন। তিন বছর শেষেও আখলাক-জোবেদার ঘরে কোন ছেলেপেলে না হওয়াতেই গোল বাঁধলো। উঠতে বসতে বড় চাচী কথা শোনান,ছোট ছোট ভাইবোনদের সামনেই। সন্তান নিয়ে আখলাক আর জোবেদার তেমন সমস্যা না হলেও, বড় চাচীর নানান কথা, অভিযোগে ওদের মধ্যেকার দূরত্ব দিন দিন বাড়িয়ে দিচ্ছিলো।

সবচেয়ে নির্মম ঘটনাটি ঘটল এক দুপুরে। বড় চাচী হাত ধরে ঘোমটা টানা এক মেয়ে এনে ঘরে তুলল। পরিচয় করিয়ে দিলেন আখলাকের বিয়ে করা বৌ বলে। জোবেদা আখলাকের অফিস থেকে ফেরার অপেক্ষা করেনি। প্রতিদিনের ব্যবহারের জিনিসগুলো নিয়ে সরে গিয়েছে। দূরে কোথাও চলে যাবার প্রবল ইচ্ছে হচ্ছিল, কিন্তু উপায় নেই। অগত্যা একই আঙিনায় বাবার বাড়িতে আশ্রয় নেয়। ঘটনাগুলো এতো দ্রুত ঘটে গেলোযে জোবেদার বাবা মায়ের আর কিছুই করার থাকল না। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তারা সম্পর্কের ইতি টানলেন। মেয়ে জোবেদাকে ডিভোর্স করালেন। আইনি সম্পর্ক থাকলো না ঠিকই, তবে একই আঙিনায় চোখের সামনে রহমত ওর বৌ নিয়ে ঘুরে বেড়ায়, হাসি গল্প করে। জোবেদার জন্য মেনে নেয়া খুবই কষ্টের, বেদনার, অপমানেরও। জোবেদা সারাদিনরাত ঘরের দরজা আটকে থাকে, তাতেও মনে শান্তি পায় না। অস্থির লাগতে থাকে, কোথায় যাবে, কি করবে। অবশেষে ঠিক করল আবার পড়াশুনা শুরু করবে, তাহলে অন্তত কিছুটা সময় বাইরে যেতে পারবে,মুক্ত বাতাসে নিশ্বাস নিতে পারবে। এভাবে বি এ পাশ করল, তারপর বিএড। এরই মধ্যে আকলাখের নতুন বৌ-এর ঘর একে একে দুই ছেলে আসল। নিজ ঘরে দম বন্ধ বন্ধ লাগে জোবেদার, হন্যে হয়ে চাকরি খুঁজতে শুরু করল। পেয়েও যায়, মেয়েদের স্কুলের শিক্ষকের পদে যোগ দেয়।

নিজের রোজগারের প্রথম টাকা হাতে নিয়ে আবেগে আপ্লুত হয়ে উঠে। এরপর জোবেদার আর নিজেকে অসহায় লাগে না,অন্যের গলগ্রহ মনে হয় না। মাস গেলেই বেতন, বাসা ভাড়া, চিকিৎসা বাবদ বেশ ভালো অংকের টাকা হাতে আসে। নিজের উপার্জন ওকে সিদ্ধান্ত নিতে শেখালো। মাকে বলল,

মা, আমি নিজে বাসা ভাড়া নিয়ে থাকতে চাই।

মা বাবা বাঁধা দেননি, সেই শুরু একাকী পথ চলা। এভাবেই বাকি পথটুকু কাটিয়ে দিতে পারলে ভালোই হতো। কিন্তু কারও কারও জীবন এতোটা সরলরেখায় চলে না। প্রতি পদে পদে ঝড়,ঝঞ্ঝ। ঘোর কালবৈশাখীর ছোবলে ক্ষতবিক্ষত হয়ে উঠে জীবন। তেমনি জোবেদার জীবন যেন দুঃখ-বেদনরা আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রাখে, সর্বশক্তিতে দু’হাত দিয়ে ছাড়াতে চাইলে আরও জোড়ে জাপটে ধরে।

সকালে বড় ডাক্তার এসেছেন সাথে পাঁচ সাত জন জুনিয়রও আছেন। রুগীর অবস্থা নিয়ে নিজেদের মধ্য কথা বলছেন। কোন অঙ্গ প্রত্যঙ্গ কেমন রেসপন্স করছে, কোন ঔষুধ বদলে দিতে হবে, কোনটার ডোজ পরিবর্তন করতে হবে। ডিউটি ডাক্তারদের সব বুঝিয়ে দিচ্ছেন। কথাগুলো জোবেদার কানের কাছে আসে, কিছু ফিরে চলে যায়, কিছু মস্তিস্কের কোষে কোষে দৌড়াদৌড়ি করে। আচ্ছন্নের মতো শুয়ে আছে, কতো কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছে, কিন্তু গলা দিয়ে কোন আওয়াজ বের করতে পারছে না….

 

এক বিকেলে নিত্যদিনের কেনাকাটা শেষে দু’হাতে বাজার নিয়ে বাড়ি ফিরছিলো জোবেদা। ব্যাগের হ্যান্ডেল ছিড়ে ফুটপাত জুড়ে ছড়িয়ে পড়ল সওদাপাতি। নিজেই তুলছিল, এমনসময় পাশের লোকটি সাহায্যের জন্য এগিয়ে এল। হাতে হাতে ছড়িয়ে পরা জিনিসগুলো হাতল ছেঁড়া ব্যাগ উঠিয়ে জোবেদাকে বাসা অব্দি পৌছে দিল। সেই শুরু। এরপর খুব বেশি দেরি হয়নি দু’জনের গাটছড়া বাঁধতে। বয়স, ধর্ম, সংসার কোন বাঁধা হয়নি। রঞ্জন সনাতন ধর্মাবলম্বী, চল্লিশ পার করা বিবাহিত পুরুষ, সন্তানের পিতা। দু’জনের মধ্যে এত পার্থক্য তবুও দু’জন দু’জনকে ভালোবেসে বিয়ে করে। রঞ্জন ধর্মান্তরিত হয়ে নাম পরিবর্তন করে। নতুন নাম নেয় রহমত। রঞ্জন ধর্মান্তরিত হলেও ওদের এ বিয়ে মেনে নেয়নি জোবেদার বাবা মাসহ অনান্য আত্মীয় স্বজন। তারা জোবেদার সাথে সকল সম্পর্ক ছেদ করে। তবুও জোবেদা ওর সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে না। জোবেদা এলাকা বদলে ফেলে, নতুন বাসা নেয় স্কুল থেকে বেশ খানিকটা দূর। আসা যাওয়ার কষ্ট মেনে নেয়। কারণ পুরোনো এলাকায় থাকলে অনেক ঝামেলা পোহাতে হতো। একে স্কুলশিক্ষক, তার উপর চল্লিশ বছর বয়সে এসে বিবাহিত পুরুষকে বিয়ে করা। তার চাইতে বড় সমস্যা ছিল ধর্ম।

জোবেদার জীবনের কষ্টের করুণ কাহিনী শুনে রহমত আবেগে জড়িয়ে রাখে জোবেদাকে। রহমতও শোনায় ওর কষ্টের কত কথা। রঞ্জনরা চার ভাই,ও সবার বড়। রঞ্জন,অঞ্জন,কাঞ্চন এবং চন্দন। রঞ্জনের বৌ তিলোত্তমা এবং এক মেয়ে মেনোকা। ছেলে অনিরুদ্ধ রঞ্জনের পিতৃ পরিচয়ে বেড়ে উঠলেও রঞ্জন জানে এ সন্তান ওর ঔরশজাত নয়। অনিরুদ্ধের পিতা মেঝ ভাই অঞ্জন। তিলোত্তমার সাথে অঞ্জনের সম্পর্কটা রঞ্জন যেমন জানে ছোট দুই ভাই কাঞ্চন আর চন্দনের কাছেও তেমন গোপন থাকেনি। ওরা বড়ভাইকে বহুবার সাবধান করেছে, তাকে কঠোর হতে বলেছে। কিন্তু রঞ্জন স্ত্রীকে বাঁধা দেয়নি। একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ যখন নিজের স্বামীর বর্তমানে অন্য সম্পর্কে জড়ায় তখন তাকে আর বুঝিয়ে শুনিয়ে ফেরানো যায় না। তাছাড়া তিলোত্তমার উপর থেকে এমনিই মন উঠে গিয়েছিলো। যেদিন নিজের মায়ের পেটের ভাই-এর সাথে আপত্তিকর অবস্থায় দেখতে পায় সেদিনই। নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিল, স্ত্রীর সাথে আর শারীরিরক সম্পর্কে যায়নি, প্রবৃত্তি হয়নি। এর বছরখানেকের মধ্যে অনিরুদ্ধের জন্ম হয়। অঞ্জনের ছেলে পেটে আসবার পরও তিলোত্তমা একটুও কুন্ঠা বোধ করেনি। কারণ স্বামী নামের একটা সার্টিফিকেট তো ওর পিঠে সাঁটাই ছিলো। রহমতের কষ্টে জোবেদা ঠিক একইভাবে তাকে জড়িয়ে রাখে তাকে।

রহমতের টাকার কোন হিসেব ছিল না। অঢেল টাকা পয়সা, ব্যবসা-বাণিজ্য,দোকানপাট,সহায় সম্পত্তি। বাবার সম্পত্তি চার ভাই ভাগ করে নিলেও রঞ্জন নিজের বুদ্ধি,মেধা,বিচক্ষণতায় তার ব্যবস্যার যথেষ্ট উন্নতি করেছে। ছোট দু’জন তেমন আগাতে না পারলেও অঞ্জন মোটামুটি চালিয়ে নিতে পারছে। রঞ্জনের একার পক্ষে এতো বিশাল ব্যবসা,দোকানপাট দেখাশোনা করা মুশকিল তাই বাইরের লোক না ঢুকিয়ে নিজের ছোট দুই ভাই কাঞ্চন,চন্দনকে দায়িত্ব দিয়েছিলো। রঞ্জন রহমতে রূপান্তরিত হলেও ছোট দু’ভাই আগের মতোই তার ব্যবসাপাতির দেখভাল করত। ব্যবসার কাজে কাঞ্চন আর চন্দন বড় ভাই-এর কাছে আসত। জোবেদা তাদের চা নাস্তা খেতে দিত, খুব মধুর না হলেও ওদের মধ্যে সুসম্পর্ক বজায় ছিল। রহমত আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ইসলাম ধর্ম গ্রহন করলেও ওর ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং ব্যাংক হিসেবের খাতায় পুরোনো নাম রঞ্জন মিত্রই ব্যবহার করত। জোবেদার কাছে তখন কিছু মনে হয়নি, কিন্তু রহমতের মৃত্যুর পর এই সব বিষয়গুলো খুব নির্মমভাবে সামনে এসে যাচ্ছে। জোবেদা না চাইলেও রহমত নিজে থেকেই কয়েকটি দোকান এবং ব্যবসার অংশ জোবেদাকে লিখে দিবে জানিয়েছিল। কিন্তু মৃত্যু যে এত কাছে দাঁড়িয়েছিল তা কে জানত!

 জোবেদা অনেক কষ্টে চোখ খুলল। বিবর্ণ দৃষ্টিতে দেখছে ডাক্তার নার্সদের কর্মব্যস্ততা। চার দেয়ালের বিশাল রুমে অনেক বেড। ওরই মতো শরীরে নানান যন্ত্রপাতি লাগানো সিরিয়াস রোগীরা শুয়ে আছেন।

খুব ক্লান্ত লাগছে, চোখ খুলে রাখতেও কষ্ট হচ্ছে। মনে পড়ে যায় রহমতের হার্টএট্যাকের পর তো এই হসপিটালেই নিয়ে এসেছিলো। যন্ত্রপাতি লাগানো এরকমই একটা বেডে শুয়ে ছিল রহমত। তারপর কতোগুলো বছর পেরিয়ে গেলো তবুও মাটিতে শেষ বিছানায় শুতে পারছে না রহমত। এই চাওয়াটা কি খুব বেশি ছিল! না থাকতো মার্বেলে বাঁধানো কবর, এপিটাফ নাহয় নাই লেখা হতো। তবুও শেষ গোসল সেরে শেষ বিছানায় শেষ বারের মতো যদি শুইয়ে দিতে পারত জোবেদা! দু’জন সিস্টার এসে জোবেদার সমস্ত মেশিনগুলো পর্যবেক্ষণ করছে ঠিকঠাক আছে কীনা। রিডিংগুলো নোট করে রাখছে। জোবেদা অবোধ পড়ে আছে…

 

রহমতের সাথে বিয়ের এগারো বছরের মাথায় জোবেদা স্কুলের হেড মিসট্রেসের পদে পদোন্নতি পায়। দায়িত্ব অনেক বেড়ে যায়, এতগুলো ছাত্রী শিক্ষকের দেখভাল, সুষ্ঠভাবে স্কুল পরিচলনা করা। সকাল সকাল স্কুলে যেতে হয়, তাই রাত জাগে না। যখন সাধারণ শিক্ষক ছিল তখনও রাত জাগত না। এটা ওর অভ্যাসের অংশ। রহমতকে রাত জাগতে হতো, কারণব্যবসার হিসেব না মিলিয়ে ঘুমাতে যেতে পারত না। কিন্তু জোবেদাকে বিয়ের কয়েক বছরের মাথায় রহমত নিজের রুটিনে কিছুটা পরিবর্তন এনে জোবেদার সাথেই ঘুমাতে যায়। সকালে জোবেদা স্কুলে চলে যাবার পর ব্যবসার হিসেব নিয়ে ঘন্টা দু’য়েক বসে তারপর বেরিয়ে পড়ে নিজের কাজে। আগে ব্যবসার সব হিসেব না মিলিয়ে ঘুমাতে পারত না।

সেদিন কোন অন্যরকম দিন ছিল না, রাতের খাবার খেয়ে দু’জনে বিছানায় গেছে। রাত একটা দেড়টা হবে, একটা গোঙানির শব্দে জোবেদার ঘুম ভেঙে যায়। ধড়ফড়িয়ে উঠে লাইট জ্বালিয়ে দেখে রহমত কেমন শব্দ করছে। মুখ দিয়ে ফ্যানার মতো বের হচ্ছে। বুকটা খুব জোরে উঠানামা করছে। দু’হাত দিয়ে বিছানার চাদর খামচে ধরে বুক ভরে শ্বাস নেবার চেষ্টা করছে। মুহূর্তকাল যায়।  দ্রুত সিদ্ধান্ত নিল,অ্যামবুলেন্স কল করে রহমতকে হসপিটালে নিয়ে আসে। ম্যাসিভ হার্টএ্যাটাক। ডাক্তারেরা সঙ্গে সঙ্গে সিসিইউ(কার্ডিয়াক কেয়ার ইউনিট)-এ নিয়ে চেষ্টা চালিয়ে যায়। দরজার বাইরে তসবিহ গুনে যায় জোবেদা, যতো দোয়া জানা আছে আউড়ে যেতে থাকে। কোন ডাক্তার বেরিয়ে এলেই, আকুল আগ্রহে জানতে চায়। না কোন আশার বাণী নেই,

‘আমরা আমাদের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি,বাকিটা উপরওয়ালার হাতে’।

চারদিকে রাঙা আলো ছড়িয়ে ভোরের জানান দেয়,জোবেদাও যেন এতোক্ষণে চেতনের মধ্যে আসে। পা দু’টো ব্যাথায় টনটন করছে,সারারাত দাঁড়িয়েই কাটিয়েছে। পুরো শরীর অবসন্ন লাগছে,হাত পা ভেঙ্গে আসছে,জোবেদা থপ করে সিঁড়িতেই বসে পড়ে। মনে পড়ল রহমতের ভাইদের জানানো দরকার, ফোন করল। অল্প সময়ের মধ্যে কাঞ্চন চন্দন এসে জোবেদার পাশে সিঁড়িতেই বসে গতরাতের কথা শুনছে। হঠাৎ সিসিইউ-এর দরজা খোলার শব্দে জোবেদা দৌড়ে ডাক্তারের কাছে যায় সাথে কাঞ্চন চন্দন। ডাক্তার সাহেব বিমর্ষ মুখে মাথা নাড়িয়ে একটা শব্দ বললেন,

সরি!

জোবেদার পুরো পৃথিবীটা দুলে উঠলো। নিজেকে সামলে নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করল। শ্বেতশুভ্র বিছানায় মহা শান্তির ঘুম ঘুমাচ্ছে তার প্রাণপ্রিয় স্বামী রহমত। শরীর থেকে সব যন্ত্রপাতি একে একে খুলে নিচ্ছে সিস্টার। মাথার নিচের বালিশটাও সরিয়ে ফেলল। জোবেদা স্বামীকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ল।

এ্যাকাউন্টসের ফর্মালিটিসি সেরে ডেথ সার্টিফিকেট সংগ্রহ করে নিন।

ডিউটি ডাক্তারের কথায় যেন জোবেদার হুঁস আসল। রহমতকে দাফন কাফন করাতে হবে! জোবেদাকে সাহায্য করার তো কেউ নেই। বাবা মারা গিয়েছেন আট বছর হয়ে গেলো।  আর মা গত বছর। আত্মীয় স্বজন কেউ নেই। একা কীভাবে সামলাবে। ঝট করে স্কুলের কথা মনে আসল। সঙ্গে সঙ্গে এ্যাসিসট্যান্ট হেড মিসট্রেসকে ফোন করে রহমতের মৃত্যুসংবাদ জানালো এবং অফিস সহকারি রফিক আর পিয়ন মোবারককে পাঠিয়ে দিতে বলল। কাঞ্চন চন্দন দু’জনে আছে জোবেদার পাশে তবুও নিজেকে কেমন অসহায় লাগছে। তবে কি ধর্মের বিষয়টাই ওকে ভাবাচ্ছে!

হাতে ট্রে নিয়ে সিস্টার ঢুকল, হাতের ক্যানুলায় ইনজেকশন পুশ করে ম্যাসাজ করে দিচ্ছে। খুব কড়া কোন অ্যন্টিবায়োটিক হবে কারণ ইনজেকশন যেদিক দিয়ে যাচ্ছে জায়গাটা জ্বলে যাচ্ছে। তবুও জোবেদা সামান্য উহ্ আহ্ করল না। কারণ ওর পুরো মনযোগ কেড়ে নিয়েছে রহমত, দু’হাত বাড়িয়ে জোবেদাকে ডাকছে। জোবেদা প্রাণপণ চেষ্টা করছে রহমতের কাছে যাবার। কিন্তু পারছে না। ওর সারা শরীর এমনকি মাথা,নাক,মুখ সবই বড় বড় মেশিন দিয়ে আটকানো। রহমতের ডাকে সাড়া দিতে না পেরে নিস্তেজ, বোধহীন পড়ে রইল বিছানায়…..

 

রফিক মোবারক সময়মতো এসে পড়াতে জোবেদার যেন একটু স্বস্তি লাগছে। তারা এসে লাশ নামানো, অ্যামবুলেন্স ডাকা আনুসঙ্গিক কাজগুলো একটার পর একটা করে যাচ্ছে। এখন শুধু ডেথ সার্টিফিকেটের জন্য অপেক্ষা। হাতে আসলেই ওরা লাশ নিয়ে রওয়ানা করবে।

এমন সময় হঠাৎ এক মহিলা চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে হুড়মুড় করে এসে হসপিটালের ভেতরে ঢুকে রহমতের উপর আছড়ে পড়ে,

‘আমারে একলা ফেলায়ে তুমি কই গেলা গো…তোমারে ছাড়া আমি ক্যামনে বাঁচব…’

মহিলা কাঁদতে কাঁদতে তার কপালের সিঁদুর,টিপ মুছে ফেলছে, শাঁখা জোড়া ভেঙে ফেলছে।

ঘটনার আকস্মিকতায় জোবেদা কিংকর্তব্যবিমুঢ়, অপলক তাকিয়ে রয়েছে। জোবেদা খেয়াল করল,এতক্ষণ কাঞ্চন চন্দন ওকে সাহায্য করছিল। তারাও মহিলার পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। পুরো হসপিটাল জুড়ে হইচই পড়ে গেলো। মুহূর্তের মধ্যে লোকে লোকারণ্য। জোবেদা মানুষের ভিড় ঠেলে স্বামীর লাশের ট্রলি অ্যামবুলেন্সে উঠাতে চায়। ঐদিকে তিলোত্তমা নামের মহিলাটি লাশের ট্রলি আঁকড়ে ধরে বসে আছে, কিছুতেই ছাড়বে না। টানা হেঁচড়া, হাতাহাতি,মারামারি চলতে থাকে দু’পক্ষের মধ্যে। কিছুতেই কিছু হয় না। বিপদ আঁচ করতে পেরে হসপিটাল কর্তৃপক্ষ পুলিশকে কল করে। সংগে সংগে আর্মড পুলিশ এসে হাজির। তারা জোবেদা এবং তিলোত্তমা দু’জনের বক্তব্য শুনে জানিয়ে দিল,

এটা কোর্ট কেইস, কোর্ট সিদ্ধান্ত নিবে লাশ কে পাবে। কী নিয়মে তার সৎকার হবে। আর যতদিন পর্যন্ত ফয়সালা না হবে ততদিন পর্যন্ত লাশ হসপিটালের হিমঘরে থাকবে।

হসপিটালের বিছানায় শুয়ে বোঝার উপায় নেই এখন সকাল দুপুর অথবা রাত। জানালার ভারী পর্দা দেয়া,পুরো রুম জুড়ে বড় বড় লাইট সাদাটে আলো ছড়িয়ে দিচ্ছে। তবে ডাক্তার নার্সদের মধ্যে চাঞ্চল্য বলে দেয়, এখন রাতের প্রথম প্রহর। দুপুরের শিফটের ডাক্তার নার্সরা পরের শিফটের কাছে ডিউটি বুঝিয়ে দিচ্ছে। প্রতিটা রোগীর অবস্থা বিশ্লেষণ করছে। সিরিয়াস রোগীর কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করছে। জোবেদার মাথার কাছে এসে ডাক্তার বললেন,

উনার অবস্থা বেশ ক্রিটিক্যাল। আরো দুই একদিন পরে বোঝা যাবে কোন দিকে টার্ন নেয়। উনাকে স্পেসিয়াল কেয়ার নিতে হবে।

আবার শান্ত হয়ে আসছে হসপিটালের পরিবেশ। জোবেদার মনে পড়ে গেলো, কতো কতো বার এসেছে এই হসপিটালের মর্গে। বড় বড় ফ্রিজারগুলোতে সারে সারে লাশ। কয়েকদিন পর পর বদলে যায়, পুরানো চলে যায় নতুনকে জায়গা দিয়ে। কিন্তু রহমতকে সেই যে নিয়ে ফ্রিজারে রাখল,পাঁচ বছরের বেশি হয়ে গেলো আর বের করা যাচ্ছে না। কোর্টে মামলা হয়েছে, ল’ইয়ার বার বার বলছেন

বিজ্ঞ বিচারক, আমার মোয়াক্কেল জোবেদা বেগমের স্বামী সজ্ঞানে তার সনাতন ধর্ম পরিত্যাগ করে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছেন। উনি নিজের নাম রঞ্জন মিত্র ত্যাগ করে রহমত আলী নাম গ্রহণ করেছেন। মাননীয় বিচারক, উনার ইসলাম ধর্ম গ্রহণ এবং রহমত নাম গ্রহণের সকল নথিপত্র কোর্টে জমা দিয়েছি। বিজ্ঞ আদালত আপনি এই সকল তথ্য প্রমাণের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করুন।

জোবেদার মন বিচারকের বিজ্ঞতা নিয়ে শত সহস্র প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে। রহমতের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে বিচারকের এতো দীর্ঘ সময় কেন লাগছে? উনি তো আমার মতো সাধারণ লোক নন।,উনি বিজ্ঞ বিচারক। উনার সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে আর কতো দিন,মাস,বছর লাগবে! আর কতো দিন অপেক্ষায় থাকতে হবে….

 

জোবেদার সবচাইতে অপছন্দের জায়গা কোর্ট, রহমতের মৃত্যুর পর সেখানেই সবচেয়ে বেশি যেতে হচ্ছে। রঞ্জন যে ধর্মান্তরিত হয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিল এবং নাম পরিবর্তন করে রহমত আলী নাম গ্রহণ করেছিল সেসব কাগজপত্র কোর্টে জমা দেয়। সাক্ষীর কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে স্বামীর ইসলাম ধর্ম গ্রহণ এবং তা মেনে চলার জবানবন্দী দেয়।

উনি নিয়মিত নামাজ পড়তেন,রোজা রাখতেন। এমনকি কোরবানী করে মাংস গরীব দুঃখীদের মাঝে বিলিয়ে দিতেন।

এ ব্যপারে পাড়ার লোকেরাও সাক্ষী দিয়ে গেছেন। তারপরও স্বামীর লাশটি দাফন কাফনের জন্য জোবেদা পায় না। এত বিত্ত বৈভব থাকার পরও মাটির তলার শেষ বিছানায় যেতে পারছে না তার প্রিয়তম স্বামী। বরঞ্চ এই অতিরিক্ত টাকা পয়সাই যেন কাল হলো!

ইসলাম ধর্ম গ্রহণ এবং নাম পরিবর্তনের কাগজপত্র রহমতই একদিন জোবেদাকে দিয়েছিল। জোবেদার কাছে তখন এই কাগজগুলোকে তেমন গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়নি। শুধু মনে হয়েছে বৈধ্য কাগজ থাকলেই কি সম্পর্ক ঠিক থাকে যদি না মনের মিল হয়! বৈধ্য কাগজ দিয়ে কি আখলাককে ধরে রাখা গিয়েছিল! অথচ রহমতের সাথে সতের বছরের যে সংসার জীবন জোবেদা কাটিয়েছে সে সময়টাকে ওর কাছে সবচেয়ে উত্তম সময় মনে হয়েছে। রহমত সংবেদনশীল,সংস্কারবিহীন একজন উঁচু মনের মানুষ ছিল। শুধু স্বামী নয়, জোবেদার একজন ভালো বন্ধু ছিল। যার সাথে সারাদিন কথা বললেও ক্লান্তি আসত না। ওর কষ্ট,বেদনার জায়গাগুলো, মনের ক্ষতগুলো রহমত বুঝত,অনুভব করত। শুধু তাই নয় ক্ষতগুলোর মাত্রা কমানোর চেষ্টা করত। জোবেদার মাঝে মাঝে মনে হতো, সৃষ্টিকর্তা কেন সঠিক মানুষকে সঠিক সময় দেখা করায় না! তাহলে জীবন কতো মধুময় হতো।

গত বছর স্কুলের চাকরী থেকে অবসর নিয়েছে জোবেদা। পেনশনের টাকা দিয়ে সরকারি সঞ্চয়পত্র কিনেছে, সেটার লভাংশ ব্যাংকে এসে যায় প্রতি মাসে। তা দিয়ে সংসার চালিয়ে নেয়। প্রয়োজন ছাড়া তেমন ঘরের বাইরে বের হয় না। তারিখ পড়লে কোর্টে যায়। দিনদিন শরীর ভেঙে পড়ছে, বয়স বাড়ার সাথে সাথে রহমতের লাশটা যেন বোঝার মতো মাথায় চেপে বসেছে। এতোবার কোর্টে যেয়ে,শুনানী করেও ফয়সালা হচ্ছে না। অপরপক্ষ তারিখের দিন কোর্টে উপস্থিত থাকছে না, আবার এটা ওটা বলে তারিখ পেছাচ্ছে। জোবেদার মনে হয়, এভাবে চলতে থাকলে রায় শুনে রহমতের দাফন কাফন সম্পন্ন করা ওর পক্ষে হয়তো আর সম্ভব হবে না। রহমত অর্থাৎ রঞ্জনের আগের বৌ এবং ভাইয়েরা তো তাই চাচ্ছে, জোবেদার মৃত্যুর পর আর কোন বাঁধা থাকবে না রহমত এর ব্যবসাপাতি,দোকানপাট,জমি জমার ভোগ দখলে।

রাত গভীর, হসপিটালও তুলনামূলকভাবে নীরব। রোগীদের শ্বাস- প্রশ্বাস আর গোঙানির শব্দ। এর মধ্যে জোবেদার তীব্র শ্বাসের টান উঠে। সিলিন্ডারের অক্সিজেনও টান মেটাতে পারে না। সিস্টাররা ডাক্তারকে ডেকে আনে। ডাক্তারেরা আর্টিফিসিয়াল ব্রিদিং-এর চেষ্টা করছে, ইলেকট্রিক শক্ দিচ্ছে,কার্ডিয়াক ম্যাসাজ করছে কিন্তু কাজ হচ্ছে না। জোবেদা দেখছে রহমতের মতো ওর শরীর থেকেও একটা একটা যন্ত্র খুলে নিচ্ছে সিস্টাররা, মাথার নিচের বালিশটাও সরিয়ে ফেলল। জোবেদার এখন নিজেকে হাল্কা লাগছে, যেন উড়ে উড়ে চলে যাবে যেখানে যেতে চায়। এতগুলো বছর অপেক্ষার পরও কোর্টের অনুমতি মেলেনি স্বামীর দাফন কাফনের। এই অনুমতিপত্রের আর কোন মূল্য নেই জোবেদার কাছে। কোন কাগজ,কোন আইন, কোন রায় দিয়েই ওকে আটকে রাখা যাচ্ছে না। ঠিক চিনে চিনে চলে এসেছে মর্গের হিমঘরে প্রাণপ্রিয় স্বামীর কাছে।

সাহানা শিমু
সাহানা শিমু