যশোর সরকারী এম এম কলেজের শহিদমিনার পুনঃনির্মাণের পিছনের কথা/কাজী মুজাহিদুর রহমান

যশোর সরকারী এম এম কলেজের শহিদমিনার পুনঃনির্মাণের পিছনের কথা

যশোর সরকারী এম এম কলেজের শহিদমিনার পুনঃনির্মাণের পিছনের কথা

যশোর সরকারী এম এম কলেজের শহিদমিনার পুনঃনির্মাণের পিছনের কথা/কাজী মুজাহিদুর রহমান

 

যশোর সরকারী মাইকেল মধুসূদন কলেজে আমরা ভর্তি হই ১৯৭৩ সালের প্রথম দিকে। ভর্তির কয়েক মাস পরে আমাদের ক্লাস শুরু হয়। যখন আমরা ইন্টারমিডিয়েট প্রথম বর্ষে পড়ি, তখন কলেজের শহিদমিনার পুনঃনির্মাণ করা হয়। কেমন করে এই কাজটা সম্পন্ন হলো, তার পিছনের কথাগুলোই আজকের এই লেখায় তুলে ধরছি।

 আমাদের ক্লাস শুরু হওয়ার কিছুদিন পরে কলেজের তৎকালীন ছাত্রসংসদ আমাদের জন্য নবীনবরণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করলেন। সেখানে প্রধান অতিথি হয়ে এসেছিলেন তখনকার তথ্যমন্ত্রী জনাব মিজানুর রহমান চৌধুরী। ছাত্রসংসদের নেতারা তাদের বক্তৃতায় মন্ত্রী মহোদয়ের সামনে কলেজের অনেক সমস্যা ও দাবি তুলে ধরলেন। তার মধ্যে অন্যতম দাবি ছিল কলেজের শহিদমিনার পুনঃনির্মাণ করা। মন্ত্রী ঢাকায় ফিরে শিক্ষামন্ত্রীর সাথে বিষয়গুলি নিয়ে আলাপ করবেন বলে জানালেন। কিন্তু ঢাকায় ফেরার পর কী এক কারণে তাঁর মন্ত্রীত্ব চলে গেল। ফলে চাপা পড়ে গেল সকল দাবি আর আশ্বাস। এর কিছুদিন পরে ঐ ছাত্রসংসদের মেয়াদও শেষ হয়ে গেল, কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হলো না।

নতুন ছাত্রসংসদ নির্বাচনের তোড়জোড় শুরু হলো। দু’এক জন বাদে প্রায় সকল প্রার্থীই রাজনৈতিক পরিচয়ে নির্বাচিত হয়েছিলেন। আমরাও প্রথমবার ছাত্রসংসদ নির্বাচনে ভোট দিলাম। সেবার ভিপি নির্বাচিত হলেন আমাদের মইন ভাই, জিএস হলেন খড়কীর পীর সাহেবের ছেলে আমাদের সিনিয়র ছাত্র বাবলু ভাই আর এজিএস হলো আমাদের সহপাঠী ও বন্ধু ইকবাল। নতুন ছাত্রসংসদ দায়িত্ব বুঝে নেবার পর প্রথমে যে কাজটা শুরু করল তা হলো কলেজের শহিদমিনার পুনঃনির্মাণ। উল্লেখ্য, পাকিস্তান আমলের শেষ দিকে ছাত্রসংসদের উদ্যোগে খড়কীর নতুন ক্যাম্পাসে দৃষ্টিনন্দন একটা শহিদমিনার নির্মাণ করা হয়েছিল।  কিন্তু ১৯৭১ সালে এপ্রিল মাসের কোন এক সময় সেটা পাকিস্তানি সেনারা ধ্বংস করে দেয়। এছাড়াও শহরের পুরাতন কসবা এলাকায় অবস্থিত পুরাতন ক্যাম্পাসে (যেখানে বিজ্ঞানের ক্লাস হতো) একটা তিন স্তম্ভের শহিদমিনার ছিল সেটাও ১৯৭১ সালে ধ্বংস করে দেওয়া হয়।

শহিদমিনার পুনঃনির্মাণ কাজে বিপুল পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন। সরকারি সাহায্যের আশায় বসে থাকলেতো বছর পার হয়ে যাবে। তার চেয়ে ছাত্রসংসদের প্রতিনিধিরা নিজেদের মধ্যে আলাপ আলোচনা করে অর্থের সংস্থানের জন্য কাজে নেমে পড়েন। ক্যাম্পাসে বহুদিন আগে থেকে একটা কংক্রীট মিক্সচার মেশিন পরিত্যাক্ত অবস্থায় ছিল। এটা তাদের নজরে আসলে কলেজের প্রিন্সিপাল জনাব আনোয়ারুল ইসলামের অনুমোদনক্রমে তারা সেটা বিক্রি করে কিছু টাকা আয় করেন। তৎকালীন ছাত্র-ছাত্রীদের স্বতঃস্ফূর্ত দানে সন্তোষজনক পরিমাণ অর্থ তহবিলে জমা হয়। এই টাকা দিয়ে নির্মাণ সামগ্রী কিনে পূর্বের স্থানে কাজ শুরু করা হয়। আমাদের সহপাঠী এজিএস ইকবালের আব্বা ছিলেন সেই সময় যশোরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সাধারণ)। সে তার আব্বার কাছ থেকে সিমেন্ট ও রডের পারমিট যোগাড় করে সাশ্রয়ী মূল্যে ঐগুলি ক্রয়ের ব্যবস্থা করে। গণপূর্ত বিভাগের (সাবেক সি এন্ড বি) এক প্রকৌশলী বিনা পারিশ্রমিকে ড্রইং ও ডিজাইন করে দেন। ঢাকার কেন্দ্রীয় শহিদমিনারের নকশা এক্ষেত্রে অনুসরণ করা হয়। অর্থাৎ শহিদমিনারের মূল রূপকার শিল্পী হামিদুজ্জামানের নকশায় যেভাবে জেলখানার চৌকাঠ ও তাতে লোহার গরাদ প্রতীক হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছে তা অবিকল রাখা হয়। এছাড়া মূল বেদীর উপর যে পাঁচটি স্তম্ভ রয়েছে যেমন মধ্যখানে একজন মা ও দুই পাশে দুই জন করে চারটি সন্তান নিয়ে দন্ডায়মান আছেন, তাও রাখা হয়। হয়তো আকারে ও উচ্চতায় এটা কেন্দ্রীয় শহিদমিনারের চেয়ে কিছুটা কম হতে পারে। তবে কেন্দ্রীয় শহিদমিনারে স্টিলের গোলাকার কাঠামোতে লাল কাপড় দিয়ে পিছনে অস্থায়ীভাবে সে সূর্যের প্রতীক লাগানো হয়, এখানে সেইরকম কোন ব্যবস্থা রাখা হয়নি।

এদিকে ২১শে ফেব্রুয়ারি ভাষা শহিদ দিবস প্রায় সমাগত। তাই দ্রুত ঢালাইয়ের কাজ শেষ করে প্লাস্টার লাগিয়ে তাতে চুনকাম করা হয়। শহিদ দিবসের আগেই ভাষা শহিদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর জন্য  প্রস্তুত হয়ে গেল কলেজের পুনঃনির্মিত শহিদমিনার। জেলা শহর যশোরে তখন ভাষাশহিদদের স্মরণে এটাই ছিল প্রথম শহিদমিনার। উল্লেখ্য,এই শহিদমিনার নির্মাণে সরকারের কোন অর্থ বা বাজেট সহায়তা পাওযা যায়নি।

এরপর কলেজের প্রিন্সিপাল হয়ে আসেন খড়কীর পীর বাড়ির সন্তান জনাব আব্দুল হাই। তিনি ছিলেন একজন পোড় খাওয়া মানুষ। পাকিস্তানি শাসকদের রোষানলে পড়ে অনেক বছর আগে কলেজে অধ্যাপনার চাকরি হারান। দেশ স্বাধীন হবার পর নতুন সরকার তার চাকরি ফিরিয়ে দেয়। খুলনার বিএল কলেজে তিনি প্রিন্সিপাল পদে যোগ দেন। সেখান থেকে পরে এখানে বদলী হয়ে আসেন। তিনি শহিদ মিনারের সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য উদ্যোগী হন। এ উদ্দেশ্যে ছাত্রসংসদের প্রতিনিধিদের সাথে তিনি আলোচনায় বসেন। কিন্তু তখন আগের ছাত্রসংসদের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। তার জায়গায় নতুন ছাত্র সংসদ নির্বাচিত হয়ে এসেছে। এই ছাত্রসংসদের ভিপি ছিলেন মাসুদুল হক, জিএস আজিজুল ইসলাম এবং এজিএস আখতার কামাল। আলোচনায় সিদ্ধান্ত হয়, শহিদমিনারের যে সংস্কার কাজ করা হবে তার অর্থ সংস্থানের জন্য কলেজে ভর্তির আবেদনপত্র বিতরণের দায়িত্ব ছাত্রসংসদকে দেওয়া হবে এবং তারা ফর্ম প্রতি পাঁচ টাকা মূল্য রাখবে যা এই খাতে জমা হবে। এতে পর্যাপ্ত অর্থের সংস্থান হয়। এই অর্থ দিয়ে তিন দিকে সিড়িঁ তৈরি করে তাতে সাদা মোজাইক করা হয়। আগে শুধু সামনের দিকে সিড়িঁ ছিল। বেদীর ফ্লোর আগে সিমেন্টের ফিনিসিং করা ছিল, সেখানেও সাদা মোজাইক করা হয়। এছাড়া পাঁচটি স্তম্ভের আগের প্লাস্টার তুলে ফেলে নতুন করে সাদা মোজাইক করা হয়। লোহার রডগুলো মরিচা পড়ে নষ্ট হচ্ছিল, সেগুলিও অক্সাইড লাগিয়ে কালো রঙ করা হয়। সব মিলিয়ে শহিদমিনার আরও নান্দনিক রূপ লাভ করে। কলেজের মূল রাস্তা থেকে শহিদমিনার পর্যন্ত ইটের একটা রাস্তা নির্মাণের পরিকল্পনা থাকলেও অর্থাভাবে তা আর সম্ভব হয়ে ওঠেনি। 

এই  ছিল যশোর এম এম কলেজের শহিদমিনার পুনঃনির্মাণের পিছনের কথা। ১৯৭৩ সালের ছাত্রসংসদ এবং ১৯৭৪ সালের ছাত্রসংসদ অনেকটা ধারাবাহিকভাবে এই কাজ সফলতার সাথে সম্পন্ন করেন। কারা বেশি কাজ করেছেন, কারা কম কাজ করেছেন তার তুলনা করা এই লেখার উদ্দেশ্য নয়, বরং একটা মহৎ লক্ষ্য নিয়ে সবাই আন্তরিকতার সাথে কাজ করেছেন সেটাই সবচেয়ে বড় কথা। আমরা দেখেছি, ছাত্রসংসদের দায়িত্ববান প্রতিনিধিরা ক্লাস করার ফাঁকে ফাঁকে নির্মাণকাজ তত্ত্বাবধান করেছেন। তাঁদের সম্মিলিত কর্মযজ্ঞের ফলে শহিদমিনার একটা পূণঙ্গ রূপ পায় যা আজও বিদ্যমান আছে। ২০২০ সালে ছুটির দিনের এক বিকেলে যখন কলেজ ক্যাম্পাসে বেড়াতে যাই তখন উপরের ছবি দুইটি আমি নিজে তুলি।

 

তথ্য প্রদানে সহায়তা করেছেন

১. এ্যাডভোকেট আজিজুল ইসলাম, জর্জ কোর্ট, যশোর।

২. ইকবাল করিম, সাবেক কর্মকর্তা, বিশ্ব ব্যাংক ও আই ডি বি।

কাজী মুজাহিদুর রহমান
কাজী মুজাহিদুর রহমান