জীবন ঘড়ি / মর্তুজা আব্দুল্লাহ
গতকাল রাতে বাসায় ঢুকে একটা অদ্ভূত ব্যাপার লক্ষ করলাম। ইয়ে.. আসলে, ব্যাপারটা স্বাভাবিকই, কিন্তু আমি আজ লক্ষ করেছি অদ্ভূত ভাবে!
আমার বাসায় ঢুকতে প্রথমে Dining Room পরে, যার দেয়ালে একটা ঘড়ি লটকানো আছে, আমার সঙ্গে এবং রুমে সময় দেখার একাধিক বাবস্থা থাকলেও ঘরে ঢোকার কিংবা বের হওয়ার সময় ঐ ঘড়িটার দিকে না তাকালে মনে হয় সময়ের সঠিক অবস্থান জানা হয়নি! যাই হোক, গতরাতে যখন বাসায় ফিরলাম, ঐ ঘড়িটার দিকে তাকাতেই দেখলাম ঘড়ির মুহূর্তের কাঁটাটি অল্প অল্প নড়ছে, কিন্তু সামনের দিকে এগোতে পারছেনা, তখনকার মতো ব্যাপারটি ভুলে গেলাম। সকালে বের হওয়ার সময় যথারীতি তাকালাম, তথৈবচ। কিন্তু, আজ রাতে বাসায় ফিরে যখন তাকালাম, সেই মৃদু নড়াচড়াও বন্ধ হয়ে গেছে!!
আমরা সবাই বুঝতে পারছি ঘড়িটি চলার জন্য যেই উৎস থেকে শক্তির যোগান পেতো সেই Battery’র আয়ু ফুরিয়ে গেছে (যদিও আমি আজও তাঁর শক্তির যোগান দিতে ভুলে গেছি), কিন্তু ব্যাপারটি অদ্ভূত হল এইভাবে; দৃশ্যটি দেখা মাত্রই আমার মাথায় একটা চিন্তা নাড়া দিয়ে গেলো। যেই ঘড়িটি আমার সময় জ্ঞান পাবার অন্যতম মাধ্যম ছিল, সে অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে তাঁর দায়িত্ব পালন করতে করতে একসময় নিজের চলার শক্তি হারিয়ে ফেলে নিস্তেজ হয়ে গেলো। কিন্তু কই, তাঁর জন্য তো আমার সময় থেমে থাকেনি, আমার চলাও বন্ধ হয়নি, আমি দিব্যি তাঁর সহজাতিদের দ্বারা কাজ চালিয়ে নিচ্ছি! প্রিয়জনদের সাথে আমাদের সম্পর্কগুলো এরকমই নয়কি?
একসময় মনে হত বাবা হচ্ছে বটবৃক্ষের ছায়ার মতো, কিংবা মাথার ওপর ঘরের ছাদ, তাঁকে ছাড়া আমাদের চলবেইনা, সেই বাবা চলে গেলো, আমাদের দিব্যি চলে যাচ্ছে। মা হচ্ছে ঘরের ভিত (Foundation) যিনি ঘরকে অনেকগুলো সম্পর্কের স্তম্ভের উপর দাঁড় করিয়ে রাখেন, আর, আমরা ভাইবোনরা হচ্ছি ঘরের এক একটা স্তম্ভ (Pillar)। এক সময় মা’ও চলে যাবে , কিন্তু আমাদের জীবন কি থেমে যাবে? নাহ্, সুন্দর চলবে। এক সময় আমিও চলে যাবো, ভাই-বোন বন্ধু-বান্ধব কারো জীবনে কি ছন্দপতন ঘটবে? আলবৎ না, বেশ চলবে। অবশ্যঃ এ ধারাবাহিকতা নাও থাকতে পারে, কিন্তু ফলাফল একই!
জীবনটা আসলে সমুদ্রের সামনে দাঁড়িয়ে চোখের পলক ফেলার মতো। তুমি চোখ মেলে তাঁর সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারো, কিংবা তাঁর নিষ্ঠুর ভয়াল রূপটাও দেখতে পারো। চোখ মেলে রাখলে তোমার জীবন অসীম, বন্ধ করলে তোমার দৃষ্টিসীমা এক মুহূর্তের মধ্যে অন্ধকার কটরের মধ্যে সীমাবদ্ধ। তুমি যখন চোখ বন্ধ করছিলে তখন এই সীমাহীন জলরাশি সমৃদ্ধ সমুদ্র তোমার সামনে ছোট হতে হতে একসময় নেই হয়ে যায়, ব্যাপারটি এতো দ্রুত ঘটে যে তুমি টেরই পাওনি সমুদ্র কখন নেই হয়ে গেলো। সমুদ্র কিন্তু আগের মতোই বহাল তবীয়তে আছে, একটুও ছোট হয়নি, ঢেউগুলোও থেমে যায়নি, শুধু তুমি দেখতে পাচ্ছনা, তাতে কারো কিছু যায় আসে না, সবাই তো দেখছে…
Facebook Comments Sync