জীবনের-মোহনায় বাউল বাতাস ২ / বেগম জাহান আরা

ড. বেগম জাহান আরা

 

সেই পদ্মা আর রইলোনা। ফারাক্কা বাঁধের পরে নদী সরে গেলো। মনে হলো, নদীর অর্ধেক গা যেনো কেউ বিশ্রিভাবে কেটে নিয়েছে। রুগ্ন ক্ষীণ শুকনো পদ্মার ধারে দ্বিতীয় বাঁধ দেয়া হলো। সেটাও দেখেছি। পুরনো বাঁধ থেকে নেমে অনেকটা বালিময় পথ হেঁটে গিয়ে দাঁড়িয়েছি বাঁধের ওপর। হায়রে কপাল! এ কি বাঁধ? বেঞ্চ তো দূরের কথা, হাঁটা চলাই যায় না। পদ্মার সে তেজ নেই। সে স্রোত নেই। উথলে ওঠা ঢেউ নেই। সে গর্জনও নেই। কেমন এক রকম ফোঁস ফোঁসানির শব্দ শুধু। যেনো জোরে কাঁদতেও ভুলে গেছে হৃদয়হীনভাবে গা কাটা নদীটা। খুব কষ্ট পেয়েছিলাম দেখে।

 

মনে পড়লো নিজেদের পাড়ার কথা। রাজশাহি শহরে হাতেম খান পাড়ায় আমাদের দৃষ্টিনন্দন বাড়ি। সামনেই বেশ লম্বা বড়ো একটা পুকুর। পেছনেও একটা বড়ো পুকুর। বাড়ির পুব দিকে দুটো বাড়ি পরে আর একটা বড়ো পুকুর। সেটার উত্তর দক্ষিণ দুই ধারে প্রশস্ত বাঁধানো ঘাট। আমরা বলতাম, শান বাঁধানো ঘাটের পুকুর। বেশ গভীর ছিল পুকুরটা। টলটলে পানি।দুই ঘাটে দিন রাত ছেলে পেলেরা ঝাঁপাতো। বড়োরাও গোসল করতো। অনেকে রান্নার পানি নিয়ে যেতো। রাজশাহির পানিতে লোহা বেশি, চুনও বেশি। ডাল সেদ্ধ হতেই চাইতো না। তাই আমাদের বাড়িতেও পুকুরের পানি আনা হতো। ডাল রান্না ছাড়াও সাবান দিয়ে সাদা কাপড় কাঁচার জন্য।

 

বাড়ির সামনে যে পুকুর, আমরা তাতেই ঝাঁপাই পিটতাম। সাঁতার কাটতাম বন্ধুদের সাথে। বাড়ির সামনে রাস্তা, আর রাস্তার পাশেই পুকুর। আমাদের কাজের লোক, আমরা ডাকতাম মওলা ভাই বলে, সে ইঁট কাঠ দিয়ে ছোটো মোটো একটা ঘাটলা বেঁধে দিয়েছিলো। সেখানে শুধু আমরাই না, পাড়ার অনেকেই গোসল করতো। কাঠের পিঁড়ে নিয়ে গিয়ে কাপড় কাঁচতো। কাজের মেয়েরা বাসন মাজতো। মোটামুটি ব্যস্ত থাকতো ঘাটটা। এই পুকুরের পশ্চিম পারে শান বাঁধানো একটা ঘাট। সেখানে প্রায় সারাদিনই গিজ গিজ করতো মানুষ। গোসল করা,কাপড় কাঁচা, কোনায় বসে বাসন মাজা, কি না? মনে মনে হাসি আমি, কি সহজ সরল জীবন ছিলো আমাদের। কতো অল্পে সন্তুষ্ট থাকতাম।

 

আমাদের বাড়ির সামনের প্রধান দরজায় যেতে হলে ছয়টা সিঁড়ি ভাঙতে হতো। তারপর বেশ বড়ো বারান্দা। বারান্দায় পা দিতেই  সিঁড়ির দুই পাশে দুটো গোল থাম্বা। সেই দুই থাম্বার ওপর খিলান। দুই পাশে জায়গা রেখে বারান্দার কোনা। ঐ দুই ফাঁকা জায়গার ওপরেও খিলান। তিনটে খিলানেই লাল ইঁটের গাঁথুনি। রাস্তা থেকে দেখতে খুব ভালো লাগতো। বারান্দাটা চৌকোনা এবং বেশ বড়ো বলে গরমকালে আমরা সবাই সন্ধ্যের পরে ঐ বারান্দায় বসতাম। অন্দরে যাওয়ার জন্য বারান্দার তিন দিকে তিনটে দরজা। সবই শোয়ার ঘরের দরজা। 

 

মাঝের দরজা দিয়েই আমরা বাসায় ঢুকতাম। এটা সবার ঘোর।এই ঘরে ঢুকলে আবার দুই দিকে দুটো দরজা দুই শোয়ার ঘরে যাওয়ার জন্য। পুব দিকে বাবা মায়ের ঘর। আর  পশ্চিম দিকে বড়োভাইয়ের ঘর। পুব দিকের ঘরের উত্তরে আরও একটা শোয়ার ঘর। আর পশ্চিম দিকের ঘরের উত্তরে ছাদে ওঠার সিঁড়ি ঘর। তার পরে ভাঁড়ার ঘর আর রান্নাঘর সোজা চলে গেছে উত্তর দিকে। বেশ বড়ো বাড়ি। ভেতর দিকে ঘরগুলো ঘেঁষে ইংরেজি এল শেপ-এর মতো চওড়া উঁচু বারান্দা। বারান্দার গা ঘেঁষে সিঁড়ি। তারপর টানা ড্রেন। রান্নাঘরের বারান্দা থেকে সারা বাড়ি ঘুরে একেবারে বাড়ির পেছন দিকে গিয়ে সোক পিটে পড়েছে।

 

ড্রেনের পর থেকে শুরু হলো উঠোন। অনেক বড়ো উঠোন। জেলখানার মতো উঁচু প্রাচীর দিয়ে পুরো বাড়ি ঘেরা। পুব দিকের প্রাচীর কেটে একটা বড়ো সদর দরজা। বড়ো বড়ো কাঠের পাল্লা। আমরা বলতাম গেটের দরজা। তারপর অনেকটা জায়গা ছেড়ে উঠোনের পুব-উত্তর কোনায় পাকা বড়ো ইঁদারা। চারপাশ গোল করে সিমেন্ট দিয়ে বাঁধানো। উত্তর দিকের প্রাচীর ঘেঁষে চুন সুড়কির গাঁথুনি দিয়ে হাঁস মুরগির দুটো বেশ বড়ো নিচু ঘর। ছাদে টাইলস দেয়া। মানে ঘরটা আর একটু বড় হলে মানুষও থাকতে পারতো। আবার কিছুটা জায়গা ছেড়ে পশ্চিম দিকে পাকা পায়খানা, তার পাশে পেসাবখানা আর গোসলখানা। তখনও রাজশাহী শহরে দালান বাড়ি থাকলেও বড়ো ইঁদারা, পাকা পায়খানা, পাকা গোসলখানা, একটা আভিজাত্যের বিষয় ছিলো। রান্নাঘরের শেষ মাথায় বারান্দা যেখানে শেষ হয়েছে, সেখানে দেয়ালের গায়ে উঁচুতে একটা বিদ্যুত বাতি জ্বলতো  সন্ধেবেলায়। আলো থাকতো  সারারাত উঠোনে।

 

বিশাল উঠোন জুড়ে আমরা কতো খেলেছি। বারান্দা থেকে উঠোনটাও বেশ নিচু। পাঁচটা সিঁড়ি নেমে ড্রেন পার হয়ে তবে উঠোনে পা দেয়া যায়। ছোটোবেলায় ঐটুকু সিঁড়ি নামার সময় মনে হতো পাহাড় থেকে নামছি। আর ড্রেনকে মনে হতো একটা সরু খাল। একটু বড়ো হবার পর প্রথম সিঁড়ি থেকে একলাফে উঠোনে পড়াটা ছিলো সাহসী খেলা। এই খেলার আবিষ্কর্তা ছিলো নান্নু। মা কতো বকতেন।পরে আমিও ঐ খেলা আয়ত্ব করলাম। মানে ও যা করবে তা আমাকেও করতে হবে। এটা নান্নুর চাওয়া। তাই করতাম।পড়েও গেছি কতোবার। মার একটা গাল ছিলো, বলতেন, ‘বুগদি’। মানে, বোকা থেকে বুকি তো সাধারণ নিয়মেই বলা হতো। বেশি রাগ হলে বুকি থেকে বুগদি। মানে জব্বর বোকা। বলতেন, ও ছেলে, ও যা পারে তা তুই পারবি বুগদি? আসলেও ব্যাপারটা আমি বুঝতাম না। নান্নু পারলে আমিও পারবো, এই ছিলো আমার বিশ্বাস।

 

উঠোনের দুই পাশে দুটো ভালো লিচুর গাছ ছিলো। থোকা থোকা লিচু ধরতো মৌসুমে। নান্নু তর তর করে গাছে উঠে লিচু পেড়ে খেতো। নিচে থেকে আমি চাতক পাখির মত তাকিয়ে থাকতাম।ও দিলে তবে তো খাবো! দুষ্টু ছিলো। বেশ কিছুক্ষণ একা একা লিচু খেয়ে তারপরে নিচে ফেলতো আমার জন্য। সব শেষে দাঁতে ধরে নিয়ে আসতো এক থোকা লিচু অন্যদের জন্য। এই গাছে ওঠা নিয়ে মার ভয়ের অন্ত ছিলো না। ও আমাকে ডাকতো গাছে ওঠার জন্য। এই একটা কাজ আমি কোনোদিন করতে পারিনি। ভয় পেতাম।

 

বাড়ির সামনে মোটামুটি বড়ো লন। বাঁশের বাতার জাফরি কাটা  বেড়া দিয়ে ঘেরা। ইঁটের গাথুনি দেয়া দুটো চৌকোনা গেটের থাম্বা। তার সাথে হাল্কা লোহার গ্রিলের গেট। ওপরে বাঁশের বাতা দিয়ে তৈরি গোল অর্ধচন্দ্রাকার খিলান। তাতে ঝুমকো লতার গাছ।  মৌসুমের সময় ফুলে ঝুম ঝুম করতো। কখনো বা কুঞ্জলতার লাল টুক টুকে লবঙ্গের মতো ফুল খিলানটা আলো করে রাখতো। গেট দিয়ে ঢুকলে দুই পাশের লনে মৌসুমি ফুলের কেয়ারি করা সাজানো বাগান। মাঝখান দিয়ে হেঁটে গিয়ে বারান্দায় ওঠা। আহা, ছবির মতো ছিলো  বড়িটা।

 

লনের পশ্চিম পাশে রাস্তা ঘেঁষে একটা জোড়া কাঁঠাল গাছ। মোটা মোটা দুই গাছ গোড়ার দিকে জোড়া থাকলেও পরে আলাদা হয়ে গেছে। দুই গাছে দুই রকম কাঁঠাল হতো। একটা গাছের কাঁঠাল এতো বড়ো হতো যে কেটে নামানোই কষ্টকর ছিলো। এটা ছিলো খাজা কাঁঠাল। পাড়তে দেরি হলে অনেক সময় ফেটে যেতো গাছেই। অন্য গাছেরগুলো রসালো কাঁঠাল।

 

রাস্তার সমতল থেকে বাড়িটা আমাদের বেশ উঁচু। আগেই বলেছি সিঁড়ি ভেঙে বারান্দায় উঠতে হতো। বাবা বলতেন, প্ল্যান করেই এমন বাড়ি করেছেন তিনি। পদ্মার বাঁধ ভেঙে শহর ডুবলেও যেনো না ডোবে আমাদের বাড়ি। সে জন্য ইঁট লেগেছে বেশি। তখন এক নম্বর ইঁটের হাজার ছিলো সাত বা নয় টাকা। রাজমিস্ত্রির দৈনিক মজুরি ছিলো ছয় আনা। আর জোগালদারের মজুরি ছিলো ছয় পয়সা। বাবার মুখ থেকে শোনা এই সব গল্প। এখন রূপকথা মনে হয়। আসলে বাবা ছিলেন জ্ঞানী মানুষ। ছিলেন সৌখিন এবং খুব উদারও। স্নেহপ্রবণ  এবং বন্ধুভাবাপন্ন। প্রতিবেশী বান্ধব। চারপাশের মানুষের চেয়ে অন্যরকম। ছেলে মেয়ে পৌত্র পৌত্রিদের লেখাপড়ার ব্যাপারে অতি যত্নশীল। একান্নবর্তী পরিবারের আদর্শ কর্তা। সবার প্রতি দৃষ্টি রাখতেন।

 

বাড়ির পেছনেও মস্ত এলাকা। আমরা বলতাম বাগান। সেখানে   মস্ত দুটো বড়ো বড়ো ফজলি আমের গাছ। আর একটা কুঁয়ো পাহাড়ি আমের গাছ। অনেকটা পুনের সেই তোতাপুরি আমের মতো দেখতে। অবশ্য অনেক পরে এই সাদৃশ্য বুঝতে পেরেছি। এই গাছে ফজলি আমের মতোই বড়ো বড়ো আম হতো। পুশট হলে লালচে রঙ ধরতো বোঁটার কাছে। আমরা বলতাম সিঁদুরে আম এটা। এই গাছটা পেছনের পায়খানা ঘেঁষা ছিলো। বাইরের লোকজন এলে তারা ঐ বাইরের পায়খানা ব্যাবহার করতো। তিনটে আম গাছে আম ধরতো প্রচুর। আমাদের বাগানের পরে পেছনে একটা পুকুর। পুকুরের ঢালের কিছু জমি আমাদের জমির অংশ। ঢালের শুরুতে একটা বড়ো কড়ই আর একটা কাঁঠাল গাছ ছিলো। কাঁঠাল গাছটাতে খুব সুস্বাদু রসালো কাঁঠাল ধরতো। অনেক পরে সেটাকে মেজো ভাই-এর ঢাকার বাড়ির আসবাবের জন্য বেচারা গাছটাকে  কতল করা হয়। কাঠগুলো চলে যায় ঢাকায়।

 

কড়ই গাছটা ছিলো বেশ মোটা। সেটা হেলে গিয়ে পুকুরের ওপর ঝুলে থাকতো। আমাদের ভারি মজার খেলার উপকরণ ছিলো। গাছের মোটা কান্ডে আমরা পা ঝুলিয়ে বসে বসে গরম কালের শত শত বিকেল কাটাতাম। গল্প করতাম। গাছের ফুলগুলো যে কি সুন্দর ছিলো! মিহি ঝিরি ঝিরি পাঁপাড়ির বর্ণালি ফুলে গাছ ভরে যেতো। দু একবার গাছ থেকে আমি পড়েও গেছি পুকুরের ধারের হাঁটু পানিতে। বন্ধুদের সে কি হাসি! আশ্চর্য! কষ্ট পেতে দেখলে মানুষ হাসে কেনো? রাগ করতাম ওদের ওপর। কত্তো পরে জেনেছি, এটাই নাকি মানুষের জন্মগত স্বভাব। তবে আমি একটু অধম কিসিমের ছিলাম, সেটাও ঠিক। গেছো মেয়ে হতে পারিনি কোনোদিন।

%d bloggers like this: