জীবনের মোহনায় বাউল বাতাস (পর্ব-৯) / বেগম জাহান আরা

জীবনের মোহনায় বাউল বাতাস ৮/ বেগম জাহান আরা

জীবনের মোহনায় বাউল বাতাস

পর্ব-৯

গত পরশু থেকে লেখা হয়নি কিছু। আজকাল যতোটা লিখতে চাই, যতক্ষণ লিখতে চাই, সেটা পারি না। চিরকালই সময়ের আকালে ভুগেছি আমি। চব্বিশ ঘন্টা রাত দিন না হয়ে ছত্রিশ ঘন্টা হলে কি হতো? এই কথা কতোবার ভেবেছি। এখন তো কুলোয় না শরীরে। কি যে দুঃখ সে জন্য! সারা জীবন কাজও তো কম করিনি। রকমারি কাজ করেছি। মানে করতে হয়েছে। এখনও মনে হয় রাত দিন যদি ছত্রিশ ঘন্টায় ঘুরতো, তাহলে কিছু ঘুমিয়ে, কিছু বেড়িয়ে আবার বসে বসে লিখতাম। মানে লেখার সময়টা পেতাম বেশি।

 

অয়নাংশ চতুর্থ খন্ড যখন লিখি তখন কখনও রাত প্রায় শেষ হয়ে যেতো। কেমন একটা ডিভিনিটি ভর করতো কলমের আগায়। সে থামতে চাইতো না। লেখতেই হতো আমাকে। আমার এক বন্ধু ছিলো, সে মাঝে মাঝে রাত বারোটার দিকে ফোন করতো। আমি যে বেশি রাতে ঘুমাই এই কথা আমার ঘনিষ্ঠজনেরা জানে। ফোনে জানতে চাইলো, ঘুমিয়েছি কি না?

বলি, ফোন ধরলো তাহলে কে?

– কি করছো?

– এই একটু লেখালেখি করি।

– কি লিখছো এখন?

– অয়নাংশের চতুর্থ খন্ডের লেখা।

– অয়নাংশের তৃতীয় খন্ড পড়ে আমি অভিভূত হয়েছিলাম। মেয়েরা যে এতো অসাধারণ লিখতে পারে, তা আমার ধারণার বাইরে ছিলো।

– তোমার এই জেন্ডার ইগো আমার একটুও ভাল লাগে না।

– মানছি। সেটা একটু আছে আমার। মেয়েদের লেখা দেখলে মনে হয়, কি আর লিখবে ওরা?

– তাই কখনো পড়োই নি। এই তো? হাইলি আনফেয়ার।

হেসে বললো, ওয়েল সেড, ওয়েল সেড। মানছি।

– পড়েই দেখতে দু চারটা। আশালতা, মহাশ্বেতা দেবী এদের বই পড়লে দেখবে কি চমৎকার লেখেন ওঁরা।

– পড়েছি দু একটা, চারটা নয়। ভাল লাগে নি। না গল্প, না ভাষা। তুমি যাঁদের নাম বললে তাঁদের বই পড়ি নি। কিন্তু তোমার ভাষার তুলনা হয় না। এতো ঝরঝরে আর গতিশীল ভাষা আমি আগে কখনো পড়েছি বলে মনে হয় না। আমি তো বইটা গাড়িতে রাখতাম। ট্র্যাফিক জ্যামের সময় তো পড়তামই, অন্য সময়েও পড়তাম।

– আজ এতো বেশি বেশি বলছো কেনো সাবির?

– যা সত্যি তাই বলেছি। অসাধারণ ভাষা তোমার জান।

– মানা করেছি না, জান বলবে না?

– সরি, হঠাৎ বলে ফেলেছি। তবে তুমি আমাকে সাবির না বলে সাবু বলতে পারো। আমি তাহলে খুশি হবো। যাক, এবার তাহলে শুয়ে পড়েন ম্যাডাম।

– আবার ম্যাডাম? আমার নাম নেই? আমার নাম জাহান।

– আমিতো সেই নামেরই সংক্ষেপ করতে চাই। তাহলে হয় ‘জান’।

– সাবির প্লিজ, আজ এই অধ্যায়টা আমি শেষ করবো। আর কথা নয়, কেমন?

– ওককে। বাই।

সাবির আমার খুব ভালো বন্ধু। আমাকে কাজে উৎসাহ দেয়। প্রশংসা করে আমার কাজের। আমরা প্রায় প্রতিদিন ফোনে কথা বলি। একদিন অফিস যাওয়ার পথে সাবির ফোন করে বললো, আমি একা একা হাসছি দেখে আমার ড্রাইভার পেছন ফিরে চকিতে একবার তাকালো।

– তা হাসছিলে কেন?

– তোমার নায়িকা বাসে ওঠার সময় একজন তাকে দরজায় ধাক্কা দিয়েছিলো, আর সে বাসে উঠেই তার পিঠে দুম দুম করে দুটো কিল বসিয়ে দিলো। ইন্টারেস্টিং। জোরে জোরে হাসে সাবির।

– কেনো মেয়েরা মারতে পারে না বেয়াদব মানুষকে?

– সত্যি করেছিলে নাকি এমন?

– মনে হচ্ছে কি যে ওটা আমি?

– হান্ড্রেড পারসেন্ট।

ফোনের দু’প্রান্ত থেকে দুজন খুব হাসলাম। বললাম, কবার পড়বে বইটা?

– এটা তো বই পড়া নয়, প্রতিটা লাইনে আমি তোমাকে দেখতে পাই জান।

কেটে দিই ফোন। আবার লাইন লাগায় সাবির। বলে, কি হলো?

– কেটে দিলাম।

– কারণ?

– আবার জান বলেছো।

– ক্ষতি কি বলো?

– দ্রুত প্রিয়সঙ্গের পথ সুগম করার জন্য ওগুলো ভাষার কালভার্ট।

– মানেটা কি হলো?

– খুব সহজ। বোঝোনি এটা বিশ্বাস করা যায় না সাবির।

– ভাষার রানি, তোমার সাথে কথায় পারি এমন যোগ্যতা আমার নেই। 

– পারতে হবে না। শুধু ঐ নামে ডেকো না, তাহলেই হবে।

– আমি নিরুপায় ভাই।

– সেটা তোমার সমস্যা সাবির।

– সমস্যা তো আমারই বটে। কাছে বসতে দেবে না, হাত ধরতে দেবে না। চুমু খেতে দেবে না, এমন কি জান-ও বলতে দেবে না। দীর্ঘনিশ্বাস ছাড়ে সাবির।

– এবার কথা বলাও বন্ধ করে দেবো।

– তাহলে মরে যাবো স্লিপিং পিলস খেয়ে।

আমি হেসে কাহিল হয়ে যাই। বলি, তুমি এমন কেনো? আস্ত অসভ্য।

– বেশি সভ্য হলে ঠকতে হয়।

– এমন কথা তো শুনিনি কখনও।

– সারা জীবন যাকে খুঁজেছি, সে রইলো পরের ঘরে। কেমন করে সহ্য হয় বলো? এর কোনো মানে হয়?

– সেই তো ওপরওয়ালার দাবা খেলা। কোথায় কেনো কোন চাল দেবেন তিনি, কেউ জানে না। বাজিমাত শুধু তাঁর হাতে ভাই।

– আমাকে তুমি পছন্দ করো না? সত্যি করে বলো তো জান।

– আবার?

– তুমি যতোই রাগ করো না কেনো, আমি ঐ নামেই ডাকবো তোমাকে।

– আমি ঢাকা ছেড়ে পালিয়ে যাবো।

– কোথায় যাবে? সেখানেই যাবো আমি।

– বাড়ির বউ জানলে ঝাঁটা পেটা করবে। গাল দেবে বুড়ো ভাম বলে।

– করলে করবে। আমি তোমাকে ছাড়বো না জান। কিছুতেই না।

কথা রাখেনি সাবির। আসলে কেউ কথা রাখে না। এটাই সত্যি। আমাকে ছেড়ে হঠাৎ করেই চলে গেলো অচিন দেশে। কোনো ঠিকানাও দিয়ে গেলো না যে চিঠি লিখবো। ফোনের নতুন নম্বরও দিয়ে গেলো না। অসহ্য মনে হলে পুরনো নম্বরেই ফোন করি। মনকে ঠকাই। ফোন বাজে কিন্তু সাবির ধরে না। অচেনা কেউ ধরে, যাকে আমি চাই না। ফেস বুকে এতো মানুষ ঘোরে ফেরে, ওকে দেখিনা কোথাও। ও তো কখনো কথার বরখেলাপ করতো না। কেনো ছেড়ে গেলো আমাকে? দুদিন কথা না বললে আমরা হাঁফিয়ে উঠতাম। এখন বছর ঘুরে আসে, কথা হয় না। ওর খারাপ লাগে না? আর ‘জান’ বলে ডাকতে ইচ্ছে হয় না? অথচ এখন আমার ‘জান’ ডাকটা খুব শুনতে ইচ্ছে করে যে!

বুক খালি করে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। পাশ ফিরে শুই। জীবন তো এরকমই। ছেলে মেয়ে নাতি নাতনি পুতি পুতিন আত্মীয় স্বজন থাকার পরও একান্ত মনের মানুষ কেউ থাকলে ভালো লাগে। যার সঙ্গে খুনসুটি করা যায়। দুচারটে একান্ত ভালোলাগার কথা বলা যায়। অনেকরাতে ফোন করে খাজুরে গল্প করা যায়। কোনো কথা নিয়ে রহস্য করা যায়। যার সঙ্গে মতান্তর হবে, কিন্তু রাগারাগি হবে না। যার সঙ্গে দেয়া নেয়া থাকবে না, কিন্তু নিরন্তর মনের লেনা দেনা হবে। হয়তো এসবের কোনো মানে নেই, কিন্তু অব্যক্ত একটা ভালোলাগা আছে। একেবারে নিজস্ব একটা আরামের অনুভব আছে। আধুনিক বিশ্বে বা উন্নত বিশ্বে যাকে বন্ধু বলে। সেই বন্ধুত্বের সম্পর্ক সম্বন্ধে আমাদের কোনো কনসেপ্টই নেই। সমস্যা সেইটে। আর বন্ধু পাওয়াটা কি সহজ ভাগ্য?

বাইরে ছেলে মেয়েরা খুব জোরে হেসে উঠলো। জীবন পাত্র উছলে ওঠা হাসি। কি ভালো লাগলো শুনতে। আগামি কাল রবিবার। তাই শনিবারের রাতে সময়ের হিসেব করে না ওরা। বুঝে শুনেই পার্টির দিন তারিখ ঠিক করে। কাজ করে যেমন মেশিনের মতো, আনন্দ করে তেমনি ঝর্নাধারার মতো। জীবনটাকে এরা হিসেবের কড়ি করে নিয়েছে। একটু বেসামাল শুধু সপ্তাহান্তে। 

 

ওদের উচ্ছল হাসি শুনে মনে পড়লো মেয়ে রঞ্জনার কথা। প্রাণ খুলে হাসতো ও। অনেকেই বলতো, ওর কখনও হার্ট এটাক হবে না। সেদিনও রংকুর ‘বেন স্ট্রাসের’ বাসায় ভালো মন্দ রান্না হয়েছিলো। আমরা আর তিন দিন পরে চলে যাবো বাংলাদেশে। প্রকাশ তখন ‘বাড জোডেনে’ নতুন চাকরি পেয়েছে। উইকেন্ডে উইকেন্ডে আসে। কখনো আমরাও যাই। কদিন আগে রঞ্জনা একাই ঘুরে এসেছে প্রকাশের বাসা থেকে। আলটোনা থেকে সরাসরি ট্রেন ফ্রাঙ্কফুর্ট পর্যন্ত। তারপর একটা লোকাল ট্রেনে বেশ কটা স্টেশন পর বাড জোডেন। সাহস ছিলো খুব। একাই যাওয়া আসা করতে পারতো। কথা আছে দু দিন পর প্রকাশ আসবে। খুব আনন্দে আমাদের হামসফর শেষ হবে।

রঞ্জনা ছেলের ওখানে বুটের হালুয়া বানিয়ে আসার গল্প করলো। শুনে রংকু বললো, আমরা কেউ না? তো বানাতেই হয় হালুয়া। একবার বললো, শরীরটা কদিন থেকেই ভালো লাগছে না। আমি ডাক্তারের কাছে যাওয়ার কথা বললাম। বললো, এখন থাক মা, দেশে গিয়েই ডাক্তার দেখাবো। রংকু সেদিন তাড়াতাড়ি কাজ থেকে বাসায় ফিরেছে। ইন্দ্রা তো সবার নয়নের মনি। কি মিষ্টি করে ডাকতো, রঞ্জনা ফুপু বলে। সেই ডাক শুনে রঞ্জনা তো আত্মহারা হয়ে যেতো আনন্দে। 

আমরা সবাই বসার ঘরে আছি। সোফার ওপর ইন্দ্রা শুয়ে বলছে, ফুপু, ‘ঘুঘু সই পুতু কই’ খেলো। রঞ্জনা শুকনো কাপড় ভাঁজ করছিলো। বললো, দাঁড়াও বাবা, কাপড়গুলো রেখে আসি, তারপরে খেলবো। দেখলাম, কাজ করছে বসে বসে, আর একটু খুক খুক করে কাশছে।

আমি বললাম, ঠান্ডা লেগেছে কখন? ও পাত্তা দিলো না। এলগিন ওকে কামিলিয়েন চা বানিয়ে এনে দিলো। এক কাপ চা খেলো। কিন্তু কাশি কমলো না। ওর একবার এই রকম হয়েছিলো। ভেন্টোলিন ইনহেল করতে হয়েছিলো তখন। বললাম, আমি বরং আলটোনা গিয়ে একটা ভেন্টোলিন নিয়েই আসি। রাতে কাশি বাড়লে ঝামেলা লাগবে।

একটু বিরক্ত হলো রঞ্জনা। বললো, তোমরা একটুতেই এতো ব্যস্ত হয়ে পড়ো কেনো? ভাঁজ করা কাপড় রেখে দিয়ে এসে ও ইন্দ্রার সাথে ‘ঘুঘু সই’ খেলতে লাগলো। এই খেলাটা ইন্দ্রার কাছে খুব মজার ছিলো। দুজনেই খুব হাসছে। কাশি একটু একটু করে বাড়তেই থাকলো। ও উঠে গেলো রান্না ঘরে। এলগিন তখন রান্না ঘরে কি যেনো করছিলো। রঞ্জনা তখন কাশতে কাশতে ঘেমে গেছে। এলগিন রংকুকে ডাকলো। বললো, রঞ্জনা কাশতে কাশতে ঘামছে। আমার ভালো লাগছে না। এখনি ওকে হসপিটালে নিতে হবে।

রংকু রান্না ঘরে গিয়ে রঞ্জনাকে দেখে বললো, এখনি ডাক্তার কল করো। বাড়িতেই ডাক্তার আসুক।

রঞ্জনাকে ধরে ধরে নিয়ে এলো রংকু বসার ঘরে। পরে রংকু বলেছে, তখন আমার মাটা বলেছিলো, আমি অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছি বোধ হয় রে। আমি শুনিনি সে কথা। উঠে ওকে ধরলাম। বললাম, কি হয়েছে মা, কোথায় কষ্ট?

ও বললো, দম নিয়ে পারছিনা মা। রংকু ওকে সোফায় বসিয়েছে। আমি সঙ্গে সঙ্গে ওর মুখের মধ্যে মুখ দিয়ে ফুঁ দিতে লাগলাম। নরম বাচ্চাদের মতো ঠোঁট। চোখ টল টল করছে। আহা বাছা আমার! কোথায় যে কষ্ট হয়েছিলো, কিছুই বলতে পারে নি।

দু মিনিটের মধ্যে ডাক্তার এসে গেলো। আমাকে বললো, সরে যান, অক্সিজেন দেবো আমরা। আমার কলিজার টুকরোটা তখন টলটলে চোখে আমার দিকে তাকালো। বলতে চাইলো, আমাকে ছেড়ে যেও না। আমি বুঝলাম। বললাম, আমি আছি তোমার কাছেই মা।

ডাক্তারেরা আমাকে একরকম জোর করেই অন্য ঘরে পাঠাতে চাইলো। আমি তাকালাম রঞ্জনার দিকে। ও তখন চোখ বন্ধ করে ফেলেছে। নাকে দেয়া হয়েছে অক্সিজেন পাইপ।

আমি অন্য ঘরে গেলাম। কেয়ামত কাকে বলে আমি হয়তো দেখতে পাবো না। কিন্তু আমার জীবনে সেদিন কেয়ামত হয়ে গেলো। জীবনের ভরা জলসা ফেলে দিয়ে, মা ভাই ভাইঝি ভাই বউ-এর সামনেই সে চলে গেলো। অপেক্ষা করলো না জানের টুকরো ছেলেটার জন্য। কিছুই বলে গেলো না। নিজে জানতেও পারলো না যে সে চলে যাচ্ছে চিরদিনের মতো। এই সুন্দর পৃথিবীকে আলবিদাও বলা হলো না।

এতো কিসের তাগাদা পড়ে গেলো ওপরওয়ালার? এক ছোঁ মেরে নিয়ে গেলো আমার পুতুলকে? আমার কলিজাটা ফেটে গেলো। এতোই সে ব্যথার তীব্রতা, যা আমার ভেতরের রক্তকে শুকিয়ে দিলো। বাজপড়া গাছের মতো পোড়া কাঠ হয়ে গেলাম। এক ফোঁটা পানিও পড়লো না চোখ থেকে। অথচ এখন ওকে মনে পড়লে চোখ থেকে পানি পড়ে আপনা আপনি। কলিজার কাটা জায়গা থেকে যেনো রক্ত ঝরে চোখের ভেতর দিয়ে।

ছেলে আসবে দুদিন পরে। অথচ তাকে এখনি জানাতে হবে। কি বলা হবে তাকে? এক ঘন্টা আগেই আমরা দুজন তার সাথে কথা বলেছি। অনেক ভেবে চিন্তে এলগিনকে দিয়ে ফোনে প্রকাশকে বলা হলো, মায়ের হার্ট এটাক হয়েছে। হাসপাতালে আছে। রংকু আর আমিও সেখানে আছি।

প্রকাশ হাসপাতালের নাম এবং ফোন নম্বর জানতে চাইলো। এলগিন জানালো, ওখানে ফোন করা যাবে না। তুমি কালই সকালের ট্রেনে চলে এসো।

তার আর পর নেই। কফিনে বাক্স বন্দি হয়ে ও এলো বাংলাদেশে। মিরপুর বুদ্ধিজীবি গোরস্থানে শুইয়ে দিলাম ঘুমন্ত মেয়েটাকে। তবে যে লোকে বলতো, ও যে রকম হা হা করে প্রাণখুলে হাসে, ওর কোনোদিন হার্ট-এটাক হবে না? আর ও নিজে বলতো, জার্মানি একটা দেশ মা, এখানে মানুষ মরে না। এরা মরা মানুষকেও বাঁচিয়ে তোলে।

 

কারো কথাই সত্যি হলো না। রঞ্জনাই প্রমাণ করে দিলো যে, জার্মানিতেও হার্ট এটাকে মানুষ মারা যায়। প্রাণ খুলে হা হা করে হাসলেও হার্ট থেমে যায়। তিনটে মাস কোথা দিয়ে গেলো, আমি জানি না। গলার স্বর বসে থাকলো। খাওয়ার স্বাদ পেতাম না। যা খেতাম তাই মনে হতো ঘাস। ওর কবরের কাছে যাই। কিছুই বলতে পারি না। দোয়া পড়া ভুল হয়ে যায়। বার বার মনে হতো, ওপরের মাটির চাঁই তুলে একবার যদি ওকে দেখতে পেতাম।

আমার বন্ধু শেফালি সান্ত্বনা দিতো। বলতো, তুমি কাঁদো তো জোরে জোরে। বলে ও নিজেই কেঁদে ভাসাতো। আমি কাঁদতে পারতাম না।

এক সময় মনে সান্ত্বনা এলো। ভাবলাম, ও তো আমার জঠরেই আছে, যেমন এক সময় ছিলো। সারাদিন যাকে মনে করি, সারা বাড়িতে যার অস্তিত্ব দেখতে পাই, রান্না ঘরে প্রতিটা বাসন পত্রে যার হাতের ছোঁয়া পাই, ওর ঘরে গেলে গায়ের গন্ধ পাই, নিশুতি রাতে বাড়িটা যখন নীরব হয়ে যায়, তখন সেই নৈঃশব্দের স্তব্ধতাকে ও ধারণ করে রাখে। আবার ঊষার আলোর সঙ্গে সে ঝাঁপিয়ে পড়ে বাড়িটার আনাচে কানাচে। হেঁটে বেড়ায় আমার ছায়া হয়ে। তাহলে সে তো কোথাও যায় নি। সে মারা যায় নি। সে আছে আমার চেতনায়। আমার অস্তিত্বের সাথে। আমার হৃদয়ের সঙ্গে মিশে। আমি যেদিন মারা যাবো, সেদিন হবে ওর সত্যিকার মরণ। এসব কথা বলেছি অয়নাংশ উপন্যাসে। আবার বলছি। কি করবো? ভোলা যে যায় না কিছুতে। দশ বছর পার হয়ে গেলো একই রকম দগ দগে ঘা। দৃষ্টি পড়লেই রক্ত ঝরে। ছুঁতে হয় না। 

ড. বেগম জাহান আরা
বেগম জাহান আরা
%d bloggers like this: