জীবনের মোহনায় বাউল বাতাস ৪/ বেগম জাহান আরা

ড. বেগম জাহান আরা

চার

আকাশের শোক আর থামছেই না। দুদিন থেকে ঝরছে তো ঝরছেই। হামবুর্গে বেশ বৃষ্টি হয়। তখন গরম কালেও ঠান্ডা লাগে। শীতকালেও মাফ নেই। মনের আনন্দে ঝরে  বৃষ্টি। এদের লিভিংরুমের দরজা খুলে দিয়ে বৃষ্টি দেখছি। ওরা কফি খেয়ে মেশিন অন করেই রেখে যায়। যখনই উঠি, গরম কফি পাই। আমি তো আর ওদের মতো কফি খাই না। প্রথমে প্রায় পোনে এক কাপ ফুটোনো পানি নিই, তার মধ্যে একটুখানি কফি আর দুধ মেশাই। বলতে গেলে গরম পানি খাই। সকালে একটু গরম কিছু খাওয়া আর কি। নানা ব্র্যান্ডের চা এবং অনেক রকম নামের টি ব্যাগ আছে ঘরে। মাঝে মাঝে কোনো একটা টি ব্যাগও ডুবিয়ে নিই গরম পানিতে। দেশ থেকে ইস্পাহানি চা আনি। এবার আনি নি। আসলে কাজ থাকে না তো। তাই মাঝে মাঝে নানা রকম চা খাওয়ার এক্সপেরিমেন্ট করি।

 

ল্যাপটপে রোজ বাংলাদেশের খবরের কাগজ পড়ি। আজকের খবরে বলছে, দেশের উত্তরাঞ্চলে বন্যার সম্ভাবনা আছে। সিলেট কুমিল্লা বৃহত্তর ময়মনসিং এবং নোয়াখালিতে প্রবল বন্যা হয়েছে। অসংখ্য ঘর বাড়ি ভেঙেছে, গাছ পালা পড়ে গেছে। পাহাড় ধসে কয়েকশো মানুষমারা গেছে পার্বত্য চট্টগ্রামে। অনেক গ্রামের কাঁচা রাস্তা, হাট বাজার, ঘাট সাঁকো চলে গেছে পানির নিচে। পুকুর বিল হাওড়ে পানি উপচে উঠে মাছের চাষ ভেস্তে গেছে। গ্রামকে গ্রাম নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে  নদীর ভাঙনে। দাম বেড়েছে চাল ডাল, মাছ, শাক সবজির। বিপর্যস্ত হয়ে গেছে জনজীবন। অসহায় মানুষগুলো কি খায়, কোথায় মাথা গুঁজে থাকে, তার ঠিক ঠিকানা নেই। 

 

বন্যা প্লাবিত অঞ্চলে ডায়রিয়া দেখা দিয়েছে। তার  ওপর আবার অবিরাম বৃষ্টি। আবার বন্যা হবে নতুন নতুন এলাকায়। ভাবাই যায় না। আমার খুব মন খারাপ হয়ে যায় বন্যা দেখলে। তার একাধিক কারণও আছে। বন্যার সঙ্গে বহু ব্যথার স্মৃতি জড়িয়ে আছে। মনে না করতে চাইলেও মনে পড়ে যায়। জবর দখল করে নেয় ওরা মনের আয়না। সেখানে নাচানাচি করে স্মৃতিগুলো নির্বিকার নিরাসক্ত মুদ্রায়।

 

বাবা ওপারের ডাকে চলে গেলেন মে মাসের চব্বিশ তারিখে। প্রায় পাঁচ যুগ আগের কথা।কিন্তু আজো মনে পড়লে জীবন্ত হয়ে ওঠে সব। বাবাকে আমাদের বাড়ির বাগানে দাফন করা হয়। তাঁরই ইচ্ছে ছিলো। বলেছিলেন পাশে মায়ের কবরের জন্য জায়গা রাখতে। তো সেদিন সে কি মুষল ধারায় বৃষ্টি! সারারাত প্রবল দাপটে অবিরাম ঝরলো। বুক ফেটে যাচ্ছিলো আমার। নিশ্চয় পানিতে ভরে গেছে কবরের ছোটো ঘর। বাবা কি ভেসে উঠেছেন? ওপরেও তো বাঁশ চাপা দেয়া। তার ওপর মাটি দেয়া আছে উঁচু করে। নিশ্চয় নাকে মুখে কানে কাদাপানি ঢুকেছে। আহ! ভাবা যায় না। দুহাতে মুখ ঢেকে আমি হু হু করে কেঁদেছিলাম। কেঁদেছিলো নান্নুও হাউ মাউ করে। আত্মীয় পরিজনে বাড়ি ভরা। কে যেনো বললো, দাফনের পরে বৃষ্টি হওয়া ভালো। মনে হয়েছিলো, কি বোকা বোকা কথা? এতো মোটা দাগের সান্ত্বনার কোনো মানেই হয় না। এর চেয়ে কথা না বলাই উত্তম।

 

বন্যা তো কম দেখলাম না আমি। বন্যার অভিজ্ঞতা সব সময়ই বাজে মনে হয়েছে আমার। মুক্তিযুদ্ধের বছরেও খুব বৃষ্টি হয়েছিলো। সেবার বর্ষা শুরু হলো চৈত্র মাসেই। দাদার বাড়ি যাওয়ার সময় নৌকোয় যেতে হয়েছে অনেক পথ। রাস্তার দুপাশে ধানখেত। পানিতে টই টম্বুর দুপাশের খেত। ধান খেতের মধ্যে দিয়েই নৌকাকে পথ করে যেতে হবে। যাওয়ার সময় সে কি ভয় বাচ্চাদের! স্বচ্ছ পানির নিচে মাটি দেখা গেলেও ভয়ে কাঠ হয়েছিলো সকলে। রাক্ষুসে বর্ষা কারোই কি ভালো লাগে? কিন্তু একাত্তরের বর্ষাকে মনে হয়েছিলো আশীর্বাদ। হানাদারেরা নাকি পানিকে খুব ভয় পেতো। মনে মনে বলেছি হাজার বার, মর মর, মর তোরা পানিতে ডুবে। মর তোরা ঝাঁকে ঝাঁকে কুকুর বেড়ালের মতো। শেয়াল শকুনে খাক তোদেরকে।

 

দেখতে দেখতে মুক্তিযুদ্ধের বয়স হলো পয়ঁতাল্লিশ বছর। দেশে কতো কিছু ঘটে গেলো এই কয় বছরে। মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে আমরা পদ্মা নদী পার হয়ে যেতে বাধ্য হয়েছিলাম বহরমপুর। সেখান থেকে কোলকাতা। তারপর বিহার। মুজাফফরপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রফেসরের চাকরি পেয়েছিলো আমার স্বামী। সঙ্গে ছিলো চার ছেলে মেয়ে। দুমাস পরে আবার ফিরে আসি রাজশাহী। দেশ তখন ছত্রখান হয়ে গেছে। নিজের বাড়ি ফিরে দেখি কিছুই নেই। সব লুট হয়ে গেছে। জানালা দরজা খোলা। ধুলো বালিতে ভরে আছে ঘর বারান্দা। হা হা করছে শূন্য বাড়ি। ঠিক পোড়ো বাড়ির মতো। শুধু আমাদের নয়। অন্য অনেকের একই অবস্থা। নিজের বাড়িকে অচেনা লাগছিলো আমার। মনে হচ্ছে, ভুল করে অন্যের বাড়িতে ঢুকে পড়েছি আমরা। কিন্তু তাও তো না। এটাই তো আমাদের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসরস কোয়ার্টার। দেশে ফেরার পর প্রাসাদোপম সে বাড়িতে আমি বেশি দিন থাকিনি। চলে যাই মেজো ভাইয়ের বাসায়, ঢাকায়। বাহাত্তরের মে মাসে। সে অনেক কথা। যারা আমার মুক্তিযুদ্ধের ওপর লেখা চার খন্ডের সাগা “অয়নাংশ” উপন্যাস পড়েছে তারা জানে। এখানে সে কথা খুব কমই বলবো।

 

জীবনের প্রান্তিকে এসে খুব ভালো করে বুঝতে পারছি, জীবন বড্ড ছোটো, কিন্তু পথ অনেক লম্বা। একটা দিন মানে তো একটা দিন নয়। চব্বিশটা ঘন্টা। চব্বিশ রকম করে কেটে যায়। আর চব্বিশ ঘন্টায় হয় ১৪৪০ মিনিট। সেকেন্ডের হিসেব করলে হয় ৮৬,৪০০ সেকেন্ড। খন্ডিত সময়ের কোনোটাই কারো মতো নয়। এক একটা দিনে সৃষ্টি হয়ে যায় মহাভারত। সময়ের সাথে ঘটনা বয়ে যায় নদীর স্রোতের মতো। মনে রাখা যায় না। একটা দিনে দুবার জোয়ার দুবার ভাটা হয়। সাগরে কোটি কোটি তরঙ্গ ভাঙে গড়ে। মহাসাগরে ওঠে উথাল পাথাল ঝড় ঝঞ্ঝা। ঢেউয়ের হিসেব করে সাধ্য কি মানুষের? তাই যখন হিশেব করি আমার বয়স, তখন মোটা দাগে গুনি শুধু বছর। সময়ের একটা মাপ। কতোগুলো সংখ্যা। প্রতিটা ভাঁজে ভাঁজে পরতে পরতে কোনায় চিপায় বিশ্রি সুশ্রি মোটা মিহি কতো ঘটনার যে ছবি লেগে থাকে, সেটা কি কেউ মনে করে করে বলতে পারে? আর পারে না বলেই বাঁচোয়া। 

 

দূর প্রবাসে মনে পড়লো কাজলার ফাতিমার কথা। বাহাত্তর সালে ওরা আমাদের আগেই দেশে ফিরে এসেছিলো। আরও খারাপ ছিলো তাদের অবস্থা। আসে পাশের কেউ ছিলো না বেশ কদিন। ভয়ে ভয়ে দিন কাটাতো। আমাদের খবর পেয়ে পরদিন সকালেই এলো। কি হাল হয়েছে মহিলার? কাউকে কিছু বলতে না পেরে ফাতিমার বুক ফেটে যাচ্ছিলো। ও যা বললো তার কোনো সান্ত্বনা নেই। ওর স্বামী সুরাজ চিরকালই বেহুদা কিসিমের। তাই বলে বিপদ আপদ কিছু বুঝবে না? কেমন করে যে সুরাজের মতো মানুষ রাশেদের পছন্দের লোক হতে পারে সেটা আমি কিছুতেই বুঝতে পারি না। একটা তুলনাই শুধু মনে হতো, শেয়ানে শেয়ানে মিলেছে, বন্ধুত্ব তো হবেই। যাক সে কথা।

 

ফাতিমা বললো, দলছুট হয়ে মানুষটা সেই যে কোথায় গেলো, আর কোনো পাত্তা নেই। কান কথায় সে কোনোদিন কিছু বিশ্বাস করে না। সে প্রমাণ চায় কথার। কিন্তু প্রতিবেশিরা কোনো প্রমাণ দিতে পারে না। দিন তো বসে থাকে না। সূর্য কি বসে থাকার বান্দা? না কি নিজের অক্ষ পথে পৃথিবীটার ঘোরা থামিয়ে দেয়ার কথা? ফাতিমারও দিন বসে থাকে না। বেশ ঠান্ডা পড়েছে রাজশাহীতে। জানুয়ারি মাসে ঠান্ডা তো পড়বেই। শুধু মেঝেতে শোয়া যায় না বিছানাও কিছু লাগে। গায়ের সাল আর পরনের কাপড় জড়িয়ে এবং চিড়ে মুড়ি খেয়ে দুদিন কোনোমতে গেলো। কিন্তু এভাবে তো চলবে না। কিছু একটা করতে হবে। কি সেটা? কি করবে সে এখন? যুদ্ধ তাদের এতোটা নিঃস্ব করে দেবে সেটা ভাবতেও পারেনি। 

 

সিদ্ধান্ত নিলো ফাতিমা। বড় ছেলে মন্টুকে বাজারে ফলের দোকান দিতে বলবে। হাতের বালা জোড়া বিক্রি করে কিছু টাকা দিতে হবে ওকে। যেমন ভাবা তেমন কাজ। বালা বিক্রি করে ভালোই টাকা পেলো। সাহেব বাজার থেকে চট কিনে আনলো মেঝেতে বিছানোর জন্য। সামান্য বাজারও করলো। না খেয়েও তো থাকা যাবে না। কি ঘোর আঁধার চারদিকে। দিশেহারা হয়ে গেছে ফাতিমা। তালাইমারির বাসাটা কি ভাড়া দেয়া যায় মেসের জন্য? কিন্তু তারা থাকবে কোথায় তাহলে? বস্তিতে গিয়ে উঠবে? নাকি বিশ্ববিদ্যালয়ের উত্তরে মেহেরচন্ডিপুর গ্রামে যাবে? মাথা গোঁজার ঠাঁই হিসেবে একটা খড়ের ঘর হলেই এখন তাদের চলে। যুদ্ধের সময় দেখা হয়েছিলো আকলিমা খালার সাথে। সে থাকলে একটা ঘর ঠিকই জোগাড় করে দিতো। কিন্তু সে কোথায় আছে কে জানে? তারপর? মেয়ে তিনটে ছোটো। মিষ্টি, বৃষ্টি, সৃষ্টির বয়স যথাক্রমে দশ, আট, পাঁচ। ওরা কি ভাবে থাকবে গ্রামে? কে ওদের খাওয়াবে পরাবে? ফাতিমার সব রাগ গিয়ে পড়ে তার অপদার্থ মানুষটার ওপর।

 

পাড়ার জোয়ান ছেলেরা যেনো কেমন হয়ে গেছে। ফ্যা ফ্যা করে ঘুরে বেড়ায়। ঢোপ মার্কা দোকানের সামনে নড়বড়ে কাঠের বেঞ্চে বসে ছোটো কাঁচের গ্লাস বা কাপে সুরুত সুরুত করে চা খায় আর আড্ডা মারে। কেউ বলে ওরা রাজাকার। ওরা বলে, ওরা মুক্তিযোদ্ধা। অবাক কথা, পাড়ার কেউ ওদেরকে চেনে না। ওরা নাকি অন্য এলাকার ছেলে। কে তাহলে ওরা? করে কি? খায় দায় কেমন করে? এখানে কেনো? টাকা পয়সা পায় কোথা থেকে? ওরাই তো মেস করে থাকার জন্য ফাতিমাদের বাসা ভাড়া চেয়েছে। 

 

প্রতিবেশিরা বললো, একবার বাসার দখল ছাড়লে আর তা পাওয়া যাবে না। এখন নাকি জোর যার মুল্লুক তার। শুনে ভয় পায় ফাতিমা। ভাবে এ আবার কেমন স্বাধীন দেশ? তবু লোকজনের কথায় একটা ভয় ঢুকে যায় মনের ভেতর। কিসের ভয়, কেনো ভয়, তা বুঝতেও পারে না।

 

ঢাকায় ফাতিমার এক পাড়াতো চাচা আছেন। গাড়ি বাড়ি নিয়ে শান শওকতে থাকতেন। লোকে বলে আদম ব্যবসা করে তিনি কোটিপতি হয়েছেন। সংসারে একটা মাত্র ছেলে। সে বুদ্ধি প্রতিবন্ধি। অনেকে বলে, পাপের টাকায় কেনা এই সন্তান। ওপরওয়ালার শাস্তি। আলিশান জীবনে বুকের ভেতরে সেই এক বিশাক্ত গোখরো সাপ নিরন্তর দংশন করে। চাচি খুব দান ধ্যান করেন। দেশে এলে দুহাতে টাকা পয়সা কাপড় চোপড় দিয়ে যান অভাবী পাড়া পড়শিদের। কিন্তু যুদ্ধ বিপর্যস্ত দেশে তিনি কোথায় আছেন, কেমন আছেন তাও তো জানে না ফাতিমা। সে কোনোদিন ঢাকাতে যায়ও নি। তার মানুষটা গল্প করতো, সে নাকি বিরাট এক ঝামেলার পথ। আরিচা ঘাট থেকে জগন্নাথগঞ্জ ঘাটে যাওয়ার বড্ড বেশি ঝক্কি। কুলি নেয়া, জাহাজে যমুনা নদী পার হওয়া, ওপারে আবার কুলি নিয়ে অন্ধকার রাতে হেঁটে ট্রেনে ওঠা, সহজ কাজ নয়।

 

ধীরে ধীরে পলাতক পরিবারগুলো ফিরে আসছে কাজলাতে। দুচারজন হিন্দু পরিবারও দেখা গেলো। সেই দেশভাগের পরে নাকি ওপারে চলে গিয়েছিলো। এখন তো আর পাকিস্তান নেই। তাই তারা ফিরে এসেছে নিজেদের জন্মভিটায়। এই পৃথিবীতে কোনো শূন্যস্থান কি শুন্য থাকে কখনও? ওদের বাড়ি ঘর কবেই দখল হয়ে গেছে। নকল দলিলপত্র করে লোকেরা পাকা বন্দোবস্ত করে দিব্যি বাস করছিলো। প্রায় চব্বিশ বছর পর কি উৎপাত শুরু হলো? আর দাপট কতো? বলে, ভারতে যেতে না পারলে তো কচুকাটা হয়ে মরতি সকলে। নাহয় গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যেতো সারা শরীর। বের হয়ে যেতো দখলদারি। ফাতিমা শুনে অবাক হয়ে যায়। এতো তেজ কোথা থেকে হলো ওদের?

শরণার্থীদের রাখলো খাওয়ালো ভারত সরকার, আর ওরা করছে শিনাজুরি?

 

দ্বিজাতিতত্বের ভিত্তিতে দেশ ভাগ হলো বলে যারা হায় আফসোস করতো, সেই সব প্রবীণেরাও অবাক হলো এমন কথা বার্তা শুনে। হিন্দুরা তাদের ফেলে যাওয়া সম্পত্তির দখল নিতে চায় ভালো কথা। তার তো একটা নিয়ম  নীতি পদ্ধতি আছে! সাক্ষি সাবুদ প্রমাণ কোর্ট কাচারি উকি্ল মোকতার শুনানি জজের রায়, সবই লাগবে। দুচার দিনে হবে না কিছুই। ওদের ধৈর্য ধরতে হবে। 

 

অন্য দিকে বিহারিদের বাড়ি দখলেরও খবর পাওয়া যায়। অসত এবং দাপুটে লোকেরা সব সময় সুযোগের অপেক্ষায় থাকে। রাজশাহী রেলস্টেশন পার হয়ে নওহাটা যাওয়ার পথে কিছু বিহারির বাড়ি ছিলো। ওরা নাকি হানাদার বাহিনীর পক্ষে কাজ করেছে। রাজাকারও ছিলো ঐ পাড়ার কিছু যুবক। দেশ স্বাধীনের পরেই উধাও হয়েছে ওরা। জীবনের সব সঞ্চয় ফেলে প্রাণটুকু নিয়ে দালালরা পালিয়েছে।  তাদের বাড়ি দখলেরও কোনো যুক্তি নেই। তারও কিছু নিয়ম নীতি পদ্ধতি  তৈরি হবে, তবে তো! কেউ শোনে কি কারও কথা? 

 

রাজশাহীর মানুষ এমনিতে শান্ত। সহজ সরল। তাই তো বলে লোকে। কেউ কেউ বলে বোকা। হবেও বা। মাছে ভাতে আয়েসী জীবন কাটায়। বেশি কাজ না করেও জীবন কেটে যায়। খরা আছে বটে তবে বন্যা নেই বললেই চলে। ফল ফলাদি শস্য শাক সবজি যথেষ্ট হয়। এবং খুব ভালো হয়। হাসি তামাশা গান খেলা নাটক ঘুড়ি ওড়ানো, ছিপ ফেলে পুকুরের পোষা মাছ মারা, এই-ই তো দেখেছে ফাতিমা। খুব সাধারণ ঘরের মেয়ে ফাতিমা। তাদের বাড়ি জায়গির থেকে যে ছেলেটা লেখা পড়া করতো, তারই হাতে তুলে দিয়েছিলো বাবা মা। দুনিয়ার কতোটুকুই বা দেখেছিলো সে? কিন্তু যা দেখেছে, তার সাথে কিছুই মিলছেনা আর। দেশ স্বাধীনের পরে কেমন যেনো হয়ে গেছে মানুষগুলো। রিকশাওয়ালারা যাত্রী সিটে বসে সাইকেলের সিটের ওপর পা তুলে বসে থাকে। যাত্রী দেখলেও পা না নামিয়ে কথা বলে। এমন তো ছিলো না। একটা যুদ্ধ কি মানুষকে এতোটাই বদলে দেয়?

 

সত্যি বোধহয় তাই। কিন্তু ফাতিমারা তো বদলায় নি। বদলে গেছে তাদের জীবন। বেঁচে থাকার স্বপ্নগুলো বদলে গেছে। কিছুই নেই সামনে। আঁধারে ডুবে গেছে ভবিষ্যত। মানুষটাকে ওপারেই কেমন যেনো মনে হয়েছিলো। বহরমপুরে যে বাসায় তারা কয়েকদিন ছিলো, তখনই বাঙলাদেশের ছেলে বাবলা বলেছিলো, সুরাজ চাচা শরণার্থী শিবিরের এক মেয়ের সাথে খুব মাখামাখি করে। একবার ট্রেনিং-এর ছেলেরা মেরেওছে। ফাতিমা সুরাজের কাছে জানতে চেয়েছিলো, সত্যিটা কি? তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়েছিলো সুরাজ। বলেছিলো, মানুষের কথায় কান দিও না ফাতিমা। নানা জায়গায় কাজ করতে হয়, তবে দুটো পয়সা আসে। আশ্রয় শিবিরের খাওয়া আর কদিন?

 

এই সুরাজ তার স্বামী। অপদার্থ একটা লোক। আই এ, পাস করার পরে তার বিয়ে হয়। পিটি আই ট্রেনিংটা যদি করতো, তাহলে যে কোনো একটা স্কুলে হয়তো চাকরি হতো। কিন্তু পড়বে কি করে? ঘন ঘন বাচ্চা আর সংসার নিয়ে হাবুডুবু খেতে হয়েছে। তার ওপর সুরাজের বেতাল চালচলন। একটা ছেলেদের হলের সিনিয়র কেরানি সুরাজ। সকাল সন্ধে কাজ থাকার কথা। কিন্তু সে বাড়ি আসতো বেশ রাত করে। বলতো, প্রভোস্ট স্যারের অনেক কাজ থাকে। সেই হলের প্রভোস্ট আবার রাশেদ। এসব শুনে আমার বলার কিছু থাকতো না।

 

ফাতিমার সঙ্গে আমার আত্মীয়তার কোনো সম্পর্ক নেই। বন্ধুত্বের সম্পর্ক নেই। বৈবাহিক সুত্রেরও কোনো সম্পর্ক নেই। নেই প্রতিবেশি সুলভ মেলামশার সম্পর্ক। যুদ্ধের আগে পরিচয়ের সম্পর্কও ছিলো না। তবু হলো মানবিক সম্পর্ক। দাদার গ্রামে থাকার সময় ওকে প্রথম দেখেছি। আমাদেরই এক ফুপাতো ভাই ওকে ধর্ম মেয়ে বানিয়েছিলো। সেইবার প্রথম দেখলাম ধর্ম বোন, ধর্ম ভাই, ধর্ম মেয়ে, এসব সম্পর্কের আত্মীয়তা। সেই সুবাদে ফাতিমা আমাকে ফুপু বলতে শুরু করলো গ্রামে। তখন ঘোর যুদ্ধ। নিজেদের ছেলে মেয়ে নিয়েই ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। কথায় কথায় তখনই আমি জানতে পারলাম যে, ওর স্বামী সুরাজ রাজশাহীরই ছেলে। কাজ করে রাশেদের হলে। অতএব, সম্পর্ক আর একটা হলো রাশেদের সুবাদে।

 

ফাতিমার ছোটো তিন মেয়েকে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুলে দিতে চায়। ধরে বসলো আমাকে। ও কি জানতো, ভাঙা মন আর নড়বড়ে সংসারে আমি কোন বিপদে আছি? রাশেদ তো ঢাকা থেকেই পালিয়েছিলো ওপারে। বৌ বাচ্চার কথা ভাবে নি। আমি নিজেই তখন স্রোতের শ্যাওলার মতো ভাসছি। মনে মনে কতো স্বপ্ন দেখছি, এইবার হয়তো আমাদের সব সমস্যা মিটে যাবে। বদলে যাবে রাশেদ। দেশ তো স্বাধীন হবেই। নতুন জীবন হবে আমাদের। যে দিন গেছে তা যাক। কষ্ট ডেকে এনে লাভ নেই কারো। বাচ্চাগুলো বড়ো হোক বাবার ছায়ায়। এই সমাজ ঐটাকেই সব চেয়ে বেশি দাম দেয়। যাই হোক, ফাতিমাকে আমি আশ্বাস দিলাম, ওর মেয়েদেরকে স্কুলে ভর্তি করানোর ব্যবস্থা করবো।

 

বাহাত্তর সালে আমি হালহীন পালহীন নৌকো, ভাসালাম অকুল দরিয়ায়। কোথা দিয়ে দিন গেছে, রাত গেছে তা আজ আর বলতেই পারবো না। আমি ভুলেই গিয়েছিলাম ফাতিমার কথা। বাহাত্তর সালে ঢাকায় এসেছি। চুয়াত্তরে এম এ-তে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়ে পাশ করে পঁচাত্তর সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইন্সটিটিউটে চাকরি হয়েছে। প্রায় পাঁচ বছর একটানা প্রাণান্ত যুদ্ধের পর আমি একটু নিশ্বাস নিতে পারছি। মাথার ওপরে ছাদ হয়েছে একটা। মোহাম্মদপুরের রাজিয়া সুলতানা রোডের খুবই ছোট্ট বাসায় যখন থাকি, তখন একদিন যেনো আসমান থেকে এসে হাজির হলো ফাতিমা। মনে হয় আর জন্মে ও বেড়াল ছিলো। নইলে আমাকে খুঁজে পেলো কি ভাবে?

 

জানলাম নানা কথা। ও বললো, সুরাজ নতুন বৌ নিয়ে দেশে ফিরেছিলো আমি ঢাকায় চলে আসার পর পরই। জানতে চাইলাম, তুমি এতোদিন কোথায় ছিলে?

-সতিনের সংসারেই ছিলাম ফুপু।

– স্বামীর বাড়ি ছেড়ে চলে যাওনি কেনো?

– কোথায় যাবো ফুপু? ঝর ঝর করে কেঁদে ফেলে ফাতিমা।

বোবা হয়ে যাই আমি। সত্যি তো! কোথায় যাবে ফাতিমা? ও তো বললো, রাজাকারেরা ওর বাবা মার ঘর বাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে। একমাত্র ভাইকে ধরে নিয়ে যায়। আর ফেরেনি সে। মা বাবারই করুণ অবস্থা।

– তুমি কি করছো এখন ফাতিমা?

– মন্নুজান হলের মেট্রনের চাকরিটা পেলাম রাশেদ ফুপার দয়ায়।

যাক একটা ভালো কাজ তো করেছে রাশেদ। বলি, তোমাকে সুরাজ চাকরি করতে দেয়?

– দেয় নিজের গরজেই।

– তার মানে?

– চাকরি করলে কি হবে ফুপু? বেতনের টাকা সব ঐ তো লিয়ে ল্যায়।

– তুমি দাও কেনো?

– না দিলে বাড়ি থেকে বের করে দিতে চায়। গায়ে হাত দেয়।

– এতো ছোটোলোক সুরাজ?

– সতিনের বুদ্ধি শুনে চলে যে।

– কি সতিন সতিন করছো? ওর নাম নেই?

– ওর নাম মুন্নি।

– মুন্নি কিছু করে?

– গতো বছর একটা এনজিও-তে কাজ লিয়েছে।

– ওর কি এটা প্রথম বিয়ে?

– না। প্রথম স্বামীর একটা মেয়ে আছে।

– সে কোথায়?

– আমাদের সাথেই থাকে।

– কতো বড়ো?

-আট বছরের। স্কুলে যায়।

– বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুলে?

– না, পিএন উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ে।

– সে তো কাজলা থেকে অনেক দূর।

– রিকশাতে যায় আসে। মুন্নির ইচ্ছা ওকে ভালো স্কুলে পড়াবে।

– মানে? বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল কি ভালো নয়?

– জানি না ফুপু।

– মন্নুজান হলে মেট্রনের থাকার ঘর দেয় না?

– চাইলে দিবে ফুপু।

– তো চাও না কেনো?

– সুরাজ যেতে দিবে না।

– এখনো হুকুমদারি খাটায়?

– আমি হলের দেয়া ঘরে গেলে বাড়ির কাজ কাম করবে কেডা ফুপু?

– আর তুমি সেটা মেনে নিয়েছো?

– যদি কুনোদিন চাকরি চলে যায়, তখন থাকবো কোথায়, এই কথা ভেবে আমি বাড়ি ছাড়িনা গো ফুপু।

চুপ করে থাকি কিছুক্ষণ। একটা পাখিও নিরাপত্তা বোঝে। ফাতিমা তো বুঝবেই। আমি বুঝতে পারছিলাম, ফাতিমা কিছু একটা বলতেই এসেছে। মনে মনে গুটিয়ে নিই নিজেকে। বিপদের আঁচ সহজেই বুঝি এখন।

– ফুপু, একটা কথা বলবো?

– বলো।

– আমার বড়ো মেয়ে মিষ্টিকে যদি আপনি রাখেন, তাহলে ওর জীবনটা বাঁচতো।

– দেখছো তো কি ছোটো বাড়িতে থাকি।

– অখে মাটিতে একটুখানি জায়গা দিবেন শুতে ফুপু।

– তোমার সমস্যা কোথায়?

– সুরাজ ওর বিহ্যা দিতে চায় বৌ মরা এক বুঢ়ার সাথে। বুঢ়া অখে নাকি টাকা দিতে চ্যাহাছে।

– কি বলছো? মিষ্টির বয়স কতো হলো?

– তেরো পার হলো। কেবল হাতে পায়ে একটু লম্বা হয়া উঠ্যাছে।

– কোন ক্লাসে পড়ছে?

– ক্লাস সেবেনে।

চুপ করে থাকি। একটা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলি আমি। কি বলবো ওকে? বুদ্ধি করে একাই এসেছে ফাতিমা। ঢাকা আসা যাওয়ার খরচ আছে তো। এদেশের মেয়েদের সমস্যা কেউ মেটাতে পারবে না। ঘরে ঘরে সুরাজের মতো হায়েনারা বসে আছে। এরা মাংসাশী। পেলে নিজের বাচ্চা কাচ্চার মাংসও খেতে পারে অনায়াসে।

 

আমি ওকে রাতে থাকতে বললাম। কি ভাবে কোন ভাষায় যে আমার অসহায়ত্বের কথা ফাতিমাকে বলেছিলাম, সেটা আর মনে নেই। ফাতিমা চোখের পানি মুছতে মুছতে চলে গেলো। আর জানি না কি হলো তাদের? মাঝে মাঝে এখনো মনে পড়ে ওর কথা। তীব্র অনুতাপ হয়। বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে ওঠে। ব্যস, ঐ পর্যন্তই। মনের ওপর পাথর চাপা দিই।

 

আমি নিজের সাথে প্রচন্ড যুদ্ধ করে আত্মপর হয়েছি অনেক আগেই। নইলে বাঁচতে পারতাম না। সাঁতারু মানুষও জীবনের শঙ্কা থাকলে ডুবন্ত কাউকে বাঁচানোর ঝুঁকি নিতে চায় না। তা সে যতো আপন জনই হোক। আমি তো শক্ত সাঁতারুও ছিলাম না। অন্যকে কাঁধে নেবো কেমন করে? আঁচলে বেঁধে কোনোমতে  নিজের বাচ্চা তিনটেকে নিয়ে ভেসে থাকতে পেরেছি মাত্র। 

 

এই একই প্রস্তাব নিয়ে এসেছিলো রাশে দের প্রথম বৌ-এর ছেলে মালেক। বাবার সাথে চরম মতান্তর নিয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছিলো যুদ্ধের আগেই। হুট হাট করে বিয়েও করেছিলো। যুদ্ধের বছরেই একটা ছেলে হয় তাদের। আমার সাথে যোগাযোগ ছিলো। কিন্তু আমি তো রাশেদের অধীন প্রজা মাত্র ছিলাম। তাই বউ আর নাতিকে বাড়িতে আসতে বলতে পারি নি। মেনে নেয় নি রাশেদ ওর বিয়ে। তবু ওপারে আমরা একসাথে ছিলাম। পরে ওর আরও একটা ছেলে হয়।

 

যাই হোক বাহাত্তর সালে রাজসাহী ছাড়ার পর ওর সাথে যোগাযোগ কমিয়ে দিই। মালেক তো আলাদা সংসার করতো যুদ্ধের আগে থেকেই। যুদ্ধের সময় আমরা, মানে আমি এবং আমার তিন ছেলে মেয়ে ওর গ্রামের বাসায় মাস খানেক ছিলাম। মাটির একখানা ঘর আর একটুখানি মাটির বারান্দা। ঘরে একটা  খাট। অন্য পাশে একটা চৌকি। তার ওপর সংসারের রাজ্যের জিনিস। বলা যায় ভাঁড়ার ঘর। মাঝখানে স্যাঁতসেঁতে মাটির মেঝে। ওখানে খেজুর পাতার পাটি বিছিয়ে আমরা শুতাম। মালেক আর ওর বউ অনেক জোরাজুরি করেছে খাটে শোয়ার জন্য। কিছুতে রাজি হই নি আমরা। তখন খেজুর পাতার পাটি বুনতে শিখি। তাছাড়া সারাদিন বসে থাকা ছাড়া আর কোনো কাজ ছিলো না।

 

খুব তাড়াতাড়ি তিনটে পাটি বুনে ফেললাম। ভালোই লাগতো। সেগুলোই মাটিতে বিছিয়ে শুতাম। হঠাৎ একদিন কয়েকটা রাজাকার এলো গ্রামে। কালো রোগা কদাকার চেহারার কয়েকটা যুবক হাতে একটা করে রাইফেল নিয়ে এসেছিলো। রাস্তার নেংটি কুত্তার মতো লাগছিলো ওদের দেখতে। কি আর করা? হাসছিলো খেঁকি কুত্তার মতো করেই। ওরা আমাদের ঘরে ঢুকে বিছানা বালিশ চাদর হাঁড়ি কড়াই পরনের কাপড়, ঘড়ি কলম সব চোখের সামনে দিয়ে নিয়ে গেলো। এর পর থেকে খেজুর পাতার পাটির নিচে আস্ত ইঁট দিয়ে বালিশের কাজ চালাতাম। 

 

সবচেয়ে ঝামেলা মনে হতো পুকুরে গোসল করাটা। চোখের একটা অসুখ তখন ছড়িয়ে পড়েছিলো। পুকুরে গোসল করার জন্য আমাদের সবার অসুখটা হয়েছিল। আর সমস্যা ছিলো বাথরুমের। সে যে কি একটা ভয়াবহ ব্যাবস্থা! সন্ধের আগেই বাথরুমের কাজ শেষ করতে হতো। কোনো দিন যদি রাতে যেতে হতো, তাহলে রীতিমতো কাঁদতো মেয়েরা। মনে হলে এখনো গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে।

 

এক মাস পর আমি রাজশাহি শহরে বাবার বাসায় চলে গেলাম। কিন্তু থাকতে পারলাম না কুকুর রাজাকারদের জ্বালায়। আবার গ্রামে। সেবারই তো দাদার গ্রামের বাসায় গেলাম। আর সেখানেই দেখা হলো ফাতিমার সঙ্গে। চার মাস পর আবার রাজশাহী শহরে বাবার বাসায় এলাম। আবার গ্রামে মালেকের ওখানে গেলাম। পাগলা কুকুরের মতো এদিক ওদিক ছোটাছুটি করেছি একটু নিরাপদ জায়গার জন্য। ওখান থেকেই অক্টোবরের তৃতীয় সপ্তায়  আমরা গিয়েছিলাম ওপারে পলাতক হয়ে। ঠিক তার আগ দিয়ে যোগাযোগ হয়েছিলো রাশেদের সাথে।

 

চরম বিপদের সময় মালেকের ওখানে ছিলাম সে কথা আমি ভুলিনি। আমি তখন সামান্য টাকা পয়সা দিয়ে সবার খাওয়া দাওয়ার খরচ মেটাতাম। মালেকের তাতে সাশ্রয় হতো। ওর হাতেও টাকা পয়সা ছিলো না। ব্যবসা করতো। সেটা লোপাট হয়ে গিয়েছিলো যুদ্ধের সময়। আমরা মিলেমিশে  খুব ভালোই ছিলাম। তখন গ্রামে এক টাকায় দশটা ডিম পাওয়া যেতো। কদাচিৎ মাছও পাওয়া যেতো খুব সস্তায়। এধার ওধার থেকে কচুর শাক, পুঁই শাক, লাউ কুমড়োর শাক জোগাড় হয়েই যেতো। তিনদিকে পাটখড়ির বেড়া এবং ছাউনি দেয়া এক চিলতে রান্না ঘর। জ্বালানির জন্য কিছু কাঠ কিনতে হতো। এছাড়া লতা পাতা খড় কুটো কাগজ যা পেতাম তাই জ্বালাতাম। সন্ধের আগে সেরে নিতে হতো রান্না। কেরোসিন পাওয়া যেতো না। তাই খুব সামলে চলতে হতো। ঘরে দিয়াশলাই আর মোমবাতি রাখতাম হাতের কাছে। শোয়ার ঘরের বারান্দায় খেজুর পাতার পাটি বিছিয়ে একসাথে খেতাম সবাই।

 

ওপার থেকে এসে আবার ভেঙে গেলো আমাদের পরিবার। মালেকের তো সংসার ছিলোই। ও চলে গেলো নিজের সংসারে। রাশেদ নতুন সংসার করবে এবং বউ এনে তুলবে প্রফেসরস কোয়ার্টারে। সামনে কিছুই ছিলো না কেবল আমাদের। শুধু জানি, ঢাকায় মেজো ভাইয়ের বাসায় উঠবো। তিনি দুই বছর আমাদের খাওয়াবেন পরাবেন। এই সময়ের মধ্যে আমাকে লেখাপড়া করে যোগ্য হয়ে উঠতে হবে। দাঁড়াতে হবে নিজের পায়ে। প্রথমে তিনি রাশেদের তিন ছেলে মেয়েকে গ্রহণ করতে চান নি। বলেছিলেন, ওর সন্তান ও মানুষ করবে। আমি বলেছিলাম, তাহলে আমরা চারজন বিশ খেয়ে আত্মহত্যা করবো। বাচ্চাদের ছেড়ে আমি কোথাও যাবো না। দয়া হলো ভাইয়ের। আমরা সবাই এলাম ঢাকায়।

 

শুরু হলো আমার সাধনা। বাচ্চাদের স্কুলে দিলাম। আমি ভর্তি হলাম বিএড-এ। এক একটা দিন তো নয়, যেনো একশো দিন। তখন রাশেদ-এর ভাই বোনেরা কেউ খোঁজ খবর নেয় নি। মালেকও না। ওর কথা ছেড়েই দিলাম। কিন্তু বাচ্চাদের চাচা ফুপুরা? তাদের ভাই বিয়ে করলে কি ভাইপো ভাইঝিদের সাথে রক্তের সম্পর্ক ঘুচে যায়? কিন্তু তাই তো দেখলাম। এমন কি বাচ্চাদের দাদিও কোনোদিন কারো মধ্যমে খোঁজ নেননি পৌত্র পৌত্রিদের। ওদের এই পাষন্ড আচরণই হয়তো আমাকে আত্মপর হতে শিক্ষা দিয়েছিলো।

 

আমি ধ্যানের মতো মগ্ন রেখে নিজেকে যোগ্য করে তুলতে চেষ্টা করেছি। রাশেদের ভাই বোনেরা খোঁজ নেয় নি, সে একরকম ভালোই ছিলো। বিরক্ত করেছে রাশেদ। কাঁটা ঝোপের মধ্যে বসে থেকেও রক্ষা নেই। সে আবারও কাঁটা দিয়ে খোচা দিতে চেষ্টা করেছিলো। অল্প সল্প নয়, ভয়ানক জ্বালাতন করেছে। আমার ভাই ,ভাবি আর মাকে বুঝিয়েছিলো, মুসলমানের ঘরে সতিনের ঘর করাটা নিন্দার কথা নয়। কেমন করে, কোন মন্ত্রে সে মোহিত করে ছিলো আমারই  রক্তের আত্মীয়দের, সেটা আমি আজো বুঝতে পারি না। শধু এইটুকু তো নয়, আমাকে যখন মেজো ভাই রাশেদের কথাগুলো বোঝাতো, তখন মনে হতো, মেজো ভাই, মানে দাদা, বাইরের অনাত্মীয় কোনো একজন পুরুষ মাত্র। কথা বলার সময় ভাইয়ের চেহারাটাও কেমন অপরিচিত মনে হতো। আর মা যখন রাশেদের হয়ে ঐ কথাগুলো বলতেন, তখন মনে হতো, পাশের বাড়ির কোনো বয়সী প্রতিবেশি মহিলা আমাকে একটা অসম্ভব কাজ করার জন্য প্ররোচিত করছেন।

 

মাঝে মাঝে কেমন পাগল পাগল লাগতো আমার। কেউ কি আমাকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে দিতে চায় না? কিন্তু কেনো? আমি বিএড কলেজ থেকে বাড়ি এসে একদিন রাশেদকে মেজো ভাইয়ের বাসায় দেখলাম। একটা ঘাউয়া কুৎসিত কুকুর দেখলে যতোটা ঘেন্না লাগে তার চেয়েও বেশি ঘেন্না লাগলো। পরে জানলাম, ও নাকি মিষ্টি  নিয়ে এসেছে শাশুড়ির সাথে দেখা করতে। এতোবড়ো অসম্ভব কাজ করতে পারলো রাশেদের মতো নিপাট কৃপণ?

 

সেদিন রাতে মা বললেন, ভুল তো মানুষই করে। রাশেদ তার ভুল স্বীকার করেছে। বলছে, ঐ বউকে তালাক দেবে। তাহলে ওর সংসার করতে তোর আর তো আপত্তি থাকার কথা নয়। আরো বললেন, তোর মেজোভাবিও তাই বলছে।

 

আমি মার মুখের দিকে তাকালাম।মনে হলো, তাঁকে আমি চিনি না। কখনো চিনতাম না। বলতেই পারলাম না কোনো কথা। মা আরো বললেন, তোর ছেলে মেয়েরাও খুব বেয়াদব হয়েছে। বাপের সাথে একটা কথাও বললো না। এই কথাটা শুনে একটা নরোম আরামের হাওয়া বয়ে গেলো গায়ের ওপর দিয়ে। যাক, ওরাও তাহলে ফিরে যেতে চায় না রাজশাহীতে। এতে আমার মনোবল বাড়লো।

 

কেবল আমার বিএড-এর প্রথম ত্রৈমাসিক পরীক্ষার ফল বের হয়েছে। আর দুদিন আগেই এম এ প্রথম পর্বের ফল বের হয়েছে। প্রাইভেট প্রার্থী হিসেবে পরীক্ষা দিয়েছিলাম। বিএড-এ সব বিষয়ে উচ্চতম নম্বর পেয়েও প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হতে পারিনি  কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা ছাত্রের জন্য। সে আর এক কাহিনি। দ্বিতীয় হলাম। এম এ-তে দ্বিতীয় শ্রেণিতে প্রথম। প্রথম শ্রেণি কেউ পায় নি। শকুনটা সে খবরও পেয়েছে। মা বললেন, রাশেদ খুব খুশি হয়েছে তোর রেজাল্ট শুনে।

 

এইবার আমার মাথার ব্রহ্মতালু জলে উঠলো। যে আমাকে লেখাপড়াই করতে দেয়নি, সেও আজ খুশি হয়েছে। মুনাফেক শয়তান। বললাম, আপনাকে দুটো কথা বলবো মা। এক, রাশেদের সংসারে আমি আর ফিরে যাবো না কোনোদিন। দুই, ও একুশ বছর আমার ওপর যে জ্বালাতন করেছে সেটা আমি কোনোদিন ক্ষমা করবো না।

 

– মেয়েদের এতো জেদ ভালো না রে। তোর বয়স কম। সারা জীবন কাটাবি কেমন করে? 

– আগে তিনটে বাচ্চা মানুষ করি, তারপর ও কথা ভাবা যাবে।

– এখানে যদি ওরা তোদেরকে থাকতে না দেয়?

সঙ্গে সঙ্গে বুঝে ফেললাম, আমার অনুপস্থিতিতে সে রকম কথা বার্তা নিশ্চয় হয়েছে বাড়িতে। বললাম, তাহলে চলে যাবো।

– কোথায় যাবি?

– জানি না।

বুঝতে পারলাম, এই বাড়ির ভাত আমার শেষ হয়েছে। তখন মনে হয়ছিলো রাশেদের কোনো আত্মীয় যদি সাহায্য করতো তাহলে সেটা নিতে পারতাম। কিন্তু সেদিন কোথাও কেউ ছিলো না আশে পাশে। আত্মপর না হয়ে আমার অন্য কি আর উপায় ছিলো? সব চিন্তা আমাদের চারজনকে নিয়ে করতে লাগলাম। মন থেকে মালেক-কে পর করে দিলাম। এতোকাল পর সে আজ তার বড়ো ছেলেকে আমার কাছে রাখতে চায় কোন সুবাদে? মাত্র দাঁড়িয়েছি শক্ত হয়ে। ওকেও সরাসরি জানালাম আমার অপারগতা। হয়তো কিছুটা নিষ্ঠুরতাই হয়েছে। পরিস্থিতির বাস্তবতাকে মানতেই হলো সেদিন। তবু একটা কথা মাঝে মাঝে মনে হয় আজও। কষ্ট করে মালেকের ছেলেটাকে হয়তো কাছে রাখতে পারতাম। ভাবের ঘরে তো আর চুরি করা যায় না। কিন্তু চাই নি আমি। দায় বোধ করনি। বাচ্চারাও চায়নি। ওরা আমার কষ্ট দেখছে। বুঝতে শিখেছে, বাড়তি টাকা নেই আমার। পুরনো কাপড় সেলাই করে পরতে হয়।

 

ফোন বেজে উঠলো। বারান্দা থেকে উঠে গিয়ে ধরলাম। ছেলের ফোন। বললো, মা বাসায় আসবো খেতে। খুশি হলাম। কালকের বিরিয়ানি আছে অনেক। ভালোই হলো। হাতের ঘড়ি দেখলাম। বাব্বাহ! দুটো বেজে গেছে! এতোক্ষণ বসে ছিলাম থেরাসে? বড়ো ছাতা মেলে দিয়ে গেছে বাবাটা। আরাম করে বসে বসে কতো কিছু যে ভাবলাম। তাই তো বার বার বলি, একা থাকতে আমার বেশ ভালো লাগে। ডুব দেয়া যায় মনের গহনে। এরও দরকার আছে জীবনে। তবে সবার কাছে একা থাকার কনসেপ্ট একরকম নয়।

 

%d bloggers like this: