কাজী নজরুলের রচনা/ লিয়াকত হোসেন খোকন

কাজী নজরুলের রচনা/ লিয়াকত হোসেন খোকন

কাজী নজরুল ইসলামের নাটিকা অবলম্বনে বিদ্যাপতি নির্মিত

১৯৩৮ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ” বিদ্যাপতি ” ছবির উল্লেখযোগ্য গান: 

সজল নয়ন করি পিয়া পথ হেরি হেরি 

তিল এক হয় যুগচারি। 

যেন শত যুগ মনে হয়। 

তারে এক তিল না হেরিলে 

শত যুগ মনে হয় 

যেন শত যুগ মনে হয়। 

পর অনুরাগে পিয়া দূর দেশ গেলা।

পিয়া বিনা পাঁজর ঝাঁঝর ভেলা 

নারীর দীরঘ-শ্বাস পড়ুক তাহার পাশ 

মোর পিয়া যার পাশে বৈঠে।

ওরপাখী যদি হউ পিয়া পাশে উড়ি যাউ 

সব দুঃখ কহঁ তার পাশে।। 

কন্ঠ :কানন দেবী।।

 

দেবকী কুমার বসু পরিচালিত ” বিদ্যাপতি ” ছবিটি মুক্তি পেয়েছিল ১৯৩৮ সালের ২ রা এপ্রিল চিত্রা সিনেমাহলে। 

চিত্রনাট্য ও সংলাপ রচয়িতা : দেবকী কুমার বসু। 

 

কাজী নজরুল ইসলামের নাটিকা বিদ্যাপতি অবলম্বনে এই ছবিটি চিত্রায়িত হয়েছিল। 

সুরকার : রাইচাঁদ বড়াল। 

আলোকচিত্র: ইউসুফ মুলজী।

শিল্পনির্দেশক: পি এন রায় ও সৌরেন সেন। 

শব্দযন্ত্রী: লোকেন বসু। 

সম্পাদনা: সুবোধ মিত্র। 

 

নিউ থিয়েটার্সের ব্যানারে নির্মিত ” বিদ্যাপতি ” ছবিতে অভিনয় করেছিলেন :

পাহাড়ী সান্যাল : বিদ্যাপতি।

কানন দেবী : অনুরাধা। 

ছায়া দেবী : রাণী লছমী। 

লীলা দেশাই ঃ দেবদাসী। 

দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায় : রাজা শিবসিংহ। 

কৃষ্ণচন্দ্র দে : মধুসূদন দাদা । 

এছাড়া অভিনয় করেছিলেন: 

অমর মল্লিক, দেববালা, প্রফুল্ল মুখোপাধ্যায়, ব্রজবল্লভ পাল এবং আরও অনেকে।

 

কাহিনী:

মিথিলার রাজা শিবসিংহের প্রমোদোদ্যানে বসন্তোৎসব। এই উৎসবে মহারাজ শিবসিংহ তার একান্ত অন্তরঙ্গ বন্ধু বিদ্যাপতির সঙ্গে মহারাণী লছমীর পরিচয় করিয়ে দিলো।

উৎসব শেষে মহারাজ শিবসিংহ কবি বিদ্যাপতিকে তার রাজসভার রাজ কবির আসন গ্রহণ করার জন্য বিশেষ ভাবে অনুরোধ জানালো। 

কবি চমকে উঠলো, কিন্তু তবু রাজার আদেশ অমান্য করতে পারলো না। 

বিশপী গ্রামে কবির আপনজন বলতে ছিল অন্ধ অনুগত ভৃত্য মধুসূদন আর তাদের গ্রামেরই এক পরমাসুন্দরী যুবতী অনুরাধা। মধুসূদন বিদ্যাপতি ঠাকুরের মন্দিরে থাকে, ঠাকুরের পূজা – অর্চনা করে। 

অনুরাধা ঠাকুরের জন্য ফুল তুলে আনে, 

আর বিদ্যাপতি রচিত গানগুলি গেয়ে এদিকে ওদিকে ঘুরে বেড়ায়। 

মধুসূদনের ওপর ঠাকুরের পূজার ভার অর্পণ করে মিথিলা যাবার জন্য রাজার প্রেরিত রথে গিয়ে আরোহন করলো। রথ ছেড়ে দিতেই অনুরাধা তা দেখে গাইতে শুরু করলো – 

” সজল নয়ন করি প্রিয় পথ হেরি হেরি….. “। 

 

রথ ছেড়ে দিল। অনুরাধা বললো, সেও যাবে মিথিলায়।

তাই বিদ্যাপতির সঙ্গে অনুরাধাও এলো মিথিলায়।

কবি বিদ্যাপতি মিথিলায় এসে শিব সিংহের সভা কবি হলো।

কবি বিদ্যাপতির প্রভাবে রাণী লছমী দেবীর অন্তরের আলোক জ্বলে উঠলো। কিন্তু আলো যে জ্বলছে রাণীর মন পুড়লো তারই উপর। 

 

রাণী লছমী বিদ্যাপতিকে একদিন মন্দিরে দেখে নিজেকে আর চেপে রাখতে পারলো না –

রাণী বললো, ” পূজার বেদীর উপর ওই যে ঠাকুরের মূর্তি, আর আমার এই চোখের সুমুখে তুমি, এই দুইয়ের মধ্যে কোন প্রভেদ – পার্থক্যই যে আমি আর দেখতে পাচ্ছি না, কবি। ঠাকুর, এ কি পাপ? বলো – বলো, ঠাকুর….. “। 

বিদ্যাপতি বললো, ” হ্যাঁ সমাজে থেকে সমাজের বিধি লঙ্ঘন করা পাপ – এ পাপ মহাপাপ। “

 

রাণী লছমী দেবী পূজার মন্দিরে যাচ্ছে, সন্মুখে বিদ্যাপতিকে আসতে দেখে হঠাৎ একটা গাছের আড়ালে লুকিয়ে দাঁড়ালো। 

রাণী লছমী ভাবলো, মন্দিরের দেবতা সন্মুখেই এসেছে। 

বিদ্যাপতি চলে যেতেই, অত্যন্ত সন্তর্পণে রাণী সেই পথের ধূলো মাথায় নিলো।

সেই সময় রাজা শিবসিংহ রাণীর কাছে আসছিল। তার হাতে ছিল রাণীকে দেয়ার জন্য এক গোছা ফুল। এই দৃশ্য দেখে সে থমকিয়ে দাঁড়ালো, হাত হতে তৎক্ষনাৎ ফুলের গোছা মাটিতে পড়ে গেল। 

কাছাকাছি কোথাও ছিল অনুরাধা, হঠাৎ সেই  ফুলের গোছা তুলে নিয়ে ছুটলো সে মন্দিরের দিকে। 

 

ফুলগুলি দেবতার পদপ্রান্তে নামিয়ে সে বললো, 

” তোমারই পায়ের তলায় মানুষের সকল দ্বন্দ্ব, সকল কলহের অবসান হয় – আমি জানি ঠাকুর! তাই ওদের পরিত্যক্ত  ফুল আমি তোমারই চরণে এনে দিলাম। “

 

অনুরাধার কাছে রাণী লছমী তার মনের সমস্ত বেদনা নিবেদন করে বললো যে,

 তার মরণই শ্রেয়ঃ। যে প্রেমের পুষ্পাঞ্জলি সে কবির চরণে অর্পণ করেছে, সাধক তা শুধু দেবতার চরণেই অর্পণ করে। কিন্তু জনসাধারণ বা নাগরিকদের হীন কল্পনায় তা আজ লালসা – লিপ্ত কামনার চিত্র। 

 

অনুরাধাও বিদ্যাপতিকে ভালবেসেছিল এবং যে প্রেমের সাধনায় অনুরাধা সিদ্ধিলাভ করেছিল, সে প্রেম ছিল হিংসা – বিদ্বেষ বিবর্জিত। তাই অনুরাধা রাণীকে বলতে পারলো –

” সমাজের অনুশাসন যতই সংকীর্ণ হোক না কেন, পবিত্র প্রেমের গতি রোধ করার সাধ্য আমার নেই। “

এদিকে অন্তরের আঘাতে রাজা শয্যা নিয়েছে। আর ভাবছে –

রাণীর প্রতি তার প্রেম কি ব্যর্থ হবে, এর কি কোন মূল্য নেই ?  রাজা অনুরাধাকে বললো,

 ” অনুরাধা, বলো তো আমার কি দোষ? “

অনুরাধা কেঁদে কেঁদে বললো, ” মহারাজ, যে ভালবেসে সুখী, সে – ই সুখী। আর যে ভালবাসা পেয়ে সুখী হতে চায়, তার দুঃখ কোনদিনই ঘুচবে না। “

এমনই দিনে সেনাপতি সীমান্ত হতে ছুটে এসে মহা – অমাত্যকে বললো, শত্রু মিথিলার সন্নিকটে এসে পড়েছে। 

 

মন্ত্রী ছুটে গেল অসুস্থ রাজার কাছে। মন্ত্রী ও সেনাপতি কোনদিনই বিদ্যাপতির কাব্য ও তার প্রচারিত প্রেমধর্মকে ভাল চোখে দেখতে পারে নাই। 

তাই ক্রুদ্ধ মন্ত্রী বললো, মহারাজ, তুমি যদি তোমার রাণীকে ছেড়ে যুদ্ধে না যাও, তাহলে মিথিলার প্রজারা বিদ্রোহী হয়ে উঠবে।

 

রাজা বললো, প্রজারা বিদ্রোহী হবে না – বিদ্রোহ করেছ তোমরা। জগতে যারা ভালবাসে তারা কোন ক্ষতি করে না – যারা সে ভালবাসাকে নষ্ট করতে চায় তারাই ক্ষতি করে, তারাই বিদ্রোহ করে। তোমরা যাও।

 

রাজার কাছে লাঞ্ছিত হয়ে মন্ত্রীর অন্তরের প্রতিবাদ প্রতিহিংসায় পরিণত হলো। 

মন্দিরে দেবতার আরাধনায় নিমগ্না লছমীর কাছে গিয়ে

মন্ত্রী গিয়ে  বললো, 

” মহারাণী, মিথিলার সমস্ত প্রজা ও মিথিলার রাজা আজ নিশ্চিত ধ্বংসের পথে ছুটে চলেছে – তাদের বাঁচাতে পারেন শুধু আপনি। “

 

এই বলে মন্ত্রী রাণীর হাতে তুলে দিল বিষের পাত্র।

রাণী লছমী হাসলো, বললো : 

” মহা অমাত্য, মিথিলার মঙ্গল হোক। “

 

তারপর দেবতার পানে চেয়ে হাসিমুখে বিষপান করলো মিথিলার রাণী লছমী। 

এবার সত্যই পূজা শুরু হল। 

মন্দিরে দেবদাসী নৃত্য করছে আর মধুসূদন দাদা গান করছে। 

রাজা, কবি ও অনুরাধা পূজায় যোগ দিলো।

তখন রাণী লছমী প্রস্তরমূর্তির মত পাথরের ঠাকুরের সুমুখে দাঁড়িয়ে আছে। 

গীত নৃত্যে সেই পূজার পূর্ণাহুতি হওয়ার পর রাজা ডাকলো – লছমী – লছমী ! 

 

লছমী সাড়া দিলো না – তার দেহ ততক্ষণে লুটিয়ে পড়লো বিষ্ণুমূর্তির পদতলে। 

কি আর করা, রাণী লছমীর হয়ে উত্তর দিল যেন মন্দিরের দেবতা। 

রাজা দেখলো, পাথরের ঠাকুরে চোখে অশ্রু।। 

 

হিন্দি ” বিদ্যাপতি “

হিন্দি ভাষায় নির্মিত ” বিদ্যাপতি ” ছবিটি মুক্তি পেয়েছিল ১৯৩৮ সালে। 

পরিচালক :দেবকী কুমার বসু। 

অভিনয়ে :

পাহাড়ী সান্যাল, পৃথ্বীরাজ কাপুর, কৃষ্ণচন্দ্র দে, নিমু, ছায়া দেবী, কানন দেবী, লীলা দেশাই, রামদুলারী, মোহাম্মদ ইসহাক – প্রমুখ। 

বিদ্যাপতি ছবির উল্লেখযোগ্য গান: 

১.

অব মথুরাপুরে মাধব গেল। 

গোকুল-মাণিক কে হরি নিল। 

হরি নিল কে, 

আমার হরি হরিয়া নিল কে। 

গোকুলে উছলিল করুণার রোল। 

নয়নে সলিলে বহরে হিল্লোল। 

শূন্য ভেল মন্দির , শূন্য ভেল নগরী।

শূন্য ভেল দশদিশি, শূন্য ভেল সগরী।

কৈছে হম যাওব যমুনা -তীর। 

কৈসে নেহারব কুঞ্জ -কুটীর। 

নয়নকি নিদ গেল বয়ানকি হাস। 

সুখ গেল পিয়া সাথ, দুঃখ হাম পাস। 

পাপ পরাণ মম আন নাহি জানত 

কানু কানু কৃষ্ণ হে কহি ঝুরে, 

আর বিদ্যাপতি কহু নিকরুণ মাধব – 

রাধারে কাঁদায়ে গেল দূরে। 

কন্ঠ :কৃষ্ণচন্দ্র দে। 

২.

সখী কে বলে পীরিতি ভালো, 

হাসিতে হাসিতে পীরিতি করিয়া কাঁদিতে জনম গেল। 

কূল বঁধু হোয়ে কূলে দাঁড়াবে, যে ধনি পীরিতি করে 

তুষের অনল যেন সাজাইয়া এমতি পুড়িয়া মরে। 

কন্ঠ: কানন দেবী। 

৩.

আমার বাহির -দুয়ারে কপাট লেগেছে 

ভিতর -দুয়ার খোলা –

কাঁটার আড়ালে ফুলের বসতি 

আঁধার পেরিলে আলো। 

কন্ঠ: কৃষ্ণচন্দ্র দে। 

৪.

অঙ্গনে আওব যব রসিয়া। 

পলটি চলব হম ইষত হাসিয়া 

আবেশে আঁচরে পিয়া ধরবে। 

যাওব হম যতন বহ করব। 

কঁচুয়া ধরবে যব হঠিয়া।

করে কর বাঁধব কুটিল আধ দিঠিয়া।

রভস মাগব পিয়া যবহি।

মুখ মোড়ি বিহুসি বোলব নাহি নাহি। 

কন্ঠ:কানন দেবী। 

৫.

মধুঋতু মধুকর -গাঁতি। 

মধুর কুসুম -মধু – মাতি।

মধুর বৃন্দাবন -মাঝ। 

মধুর মধুর রসরাজ। 

মধুর যুবতীগণ -সঙ্গ। 

মধুর মধুর -রসরঙ্গ। 

মধুর যন্ত্র-রসাল। 

মধুর মধুর -করতাল। 

মধুর নটন- গতিভঙ্গ। 

মধুর নটিনী -নটরঙ্গ। 

কন্ঠ :পাহাড়ী সান্যাল। 

৬.

পূর্ণ আমি, ধন্য আমি, ভূবন মোহনশ্যাম,

আমার তনু মনের ছন্দে জাগে তোমার মধুনাম।

ধন্য জনম মম, ধন্য মরণ মম, 

তোমার পায়েই শরণ নিয়ে, ধন্য, ধন্য আমি, 

ধন্য হে প্রিয়তম। 

আমার আমি আজকে বঁধু শুধুই তুমি -ময়

আমি শুধুই তুমি -ময়। 

কন্ঠ: কানন দেবী ও কৃষ্ণচন্দ্র দে। 

৭.

রাই বিনোদিনী, দোলো, দোলো ঝুলন দোলায়। 

একা লাগে না ভালো, সাথে এসে দোলো শ্যামরায়। 

রাঙ্গা চরণ দেখিতে পাবো ব’লে 

দাঁড়াইয়া এই তরুতলে –

শ্যাম, বাঁধিয়া বাহুডোরে, আশ্রয় দাও মোরে। 

একা বড় ভয় পায়।

৮.

সফল হবে সফল পূজা 

তাঁরি রাঙ্গা চরণ তলে। 

ভুলের কথা ভুলে যা’রে 

তোর ভোলাতে সেই চির -ভোলা নাহি ভোলে। 

ঐ যে কিশোর বাজায় বেণু 

ঐ যে রাখাল চরায় ধেনু, 

নদীর তীরে যাত্রীরা ঐ – 

সবাই পাবে চরণ রেণু। 

আয়রে ছুটে আয়রে জেগে, 

ঘরের বাঁধন আয়রে ভেঙ্গে আয়, 

পথের কাঁটা, ও তুই, পথের কাঁটা পায়ে দ’লে চল। 

তখন ফুটবে জীবন -শতদলে-

প্রেম বিরহের নয়ন জলে 

প্রেমের ঠাকুর, ঠাকুর আসবে নেমে হৃদয় – তলে। 

কন্ঠ: কৃষ্ণচন্দ্র দে। 

৯.

ও তোর অভিসারের লগ্ন এলো 

এলো রে সময় 

এবার বঁধূর পায়ে লুটিয়ে দে প্রাণ 

কর জীবন মধুময়। 

তোর দেহের গরব প্রেমের ধূপে

জ্বালিয়ে দে ও তুই জ্বালিয়ে দে আজ 

চুপে চুপে 

তোর সব আবরণ, সব আভরণ যা কিছু সঞ্চয় 

তাঁর চরণ ঘায়ে চূর্ণ হোরে যেন আপনি 

ধূলি হয়।

তোর চরণ কেন অচল হল 

কেন রে সংশয়।

কেন নয়ন চলে সমুখ পানে 

পরাণ পিছে রয়! 

জাগ আনন্দে জাগ রে আজ

নাইরে ভয় নাইরে লাজ। 

কন্ঠ’ কৃষ্ণচন্দ্র দে ও কানন দেবী।