খড়কি/ মালবিকা সরকার
করেনের বউ -এর পর পর তিনটা বাচ্চা মৃত হয়ে জন্মায়। আজ আবার করেনের বউ এর বাচ্চা হবে। সকাল থেকে বউটা প্রসব বেদনায় ছটফট করছে। করেন পাশের কালীবাড়ীতে ঢাক বাজায় আর দুর্গাপুজায় ঢাক বাজায় বাবুদের বাড়িতে। সে মনে মনে ভগবানের কাছে বলে, ” এইবারের বাচ্চাটা যেন বেঁচে থাকে। ” সে বাচ্চার কান্নার আওয়াজ পায়। এগিয়ে যায় ঘরের কাছে। ধাইকে বলে “ও মাসী বাচ্চাটা বেঁচে আছে তো “। ধাই বলে,” হ তোমার মাইয়ো হছে ভালো আছে । বউও ভালো আছে। ”
” কিন্তু? ”
করেন বলে,” কিসের কিন্তু! ”
ধাই বলে,” দাঁড়াও মাইয়ো আনি, তুমি নিজেই দেখ। ”
করেন মেয়েকে দেখে। দেখে ছোট চিকন কালো একটা মেয়ে। তাতে সমস্যা না। সমস্যা মেয়ের ডান হাতটা পুরা না।কনুই এর পর একটুখানি আংগুলের মতো কিন্তু পুরা হাত না। আর সব ঠিক ঠাক। করেন কিছু বলে না। মন খারাপ করে কালীমন্দিরের কাছে যায়। মন্দিরের পাশে একটা বেঞ্চে শোয় । একটু যেন ঘুম ঘুম পায়। ঘুমের ঘোরে হঠাৎ মনে হয় আমি বাপ হয়ে মেয়েকে দেখে মন খারাপ করলাম এটা কি করলাম! মেয়েটা একটা খুঁত নিয়ে জন্ম নিছে, আমি বাপ হয়ে যদি এই মেয়েরে বুকে তুলে না নেই তো দুনিয়ার সবাই তো এই মেয়েকে দূর দূর ছাই ছাই করবে! সে বাড়ি যায় মেয়েকে কোলে নেয় । বলে এই মাইয়ো তো খড়কীর নাগান চিকন আর লম্বা এর নাম ‘খড়কি ‘(গ্রাম অঞ্চলে ধানের খড় শুকানোর জন্য এক ধরনের চিকন লম্বা লাঠি থাকে যার একেবারে শেষ প্রান্তে একটা লম্বা ঠোঁটের মতো থাকে। এই টাকে খড়কি বলে)।
খড়কি বড় হতে থাকে অপুষ্টি হাড় জিরজিরে চেহারা নিয়ে। আর হাতেও সমস্যা। তাই সমবয়সীরা তাকে খেলতে ডাকে না।
খড়কির জন্মের পর তার পর পর দুই ভাই হয়েছে। ওর মা তাদের নিয়েই বেশী ব্যস্ত। কিন্তু খড়কি তার বাপের চোখের মনি। বাপ ছাড়া আর একজন তাকে খুব ভালোবাসে। করেন যে বাবুদের বাড়িতে ঢোল বাজায় সেই বাড়ীর বড়মা। বুড়ি মানুষ কিন্তু যেমন তার রূপ তেমন ব্যবহার। খড়কির বেশী ভাগ সময় কাটে এই বড়মার কাছে।
বড়মার কাছে খড়কি অনেক কিছু শেখে। বড়মা ধর্মীয় বই বা অন্য কোন বই পড়লে সে মন দিয়ে শোনে। একদিন বড়মা বলে, “লেখাপড়া শিখবি?”
খড়কি হ্যাঁ বলাতে বড়মা খাতা, পেন্সিল আর বই কিনে দেয়। নিজেই পড়ায় অবসরে । বড়মার বাড়ির ভালোখাবারের একটু খড়কির জন্য তোলা থাকে।
বড়মা ব্যস্ত থাকলে বা ঘুমাইলে খড়কির সময় কাটে তার বাড়ির পিছন দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীর ধারে। সে নদীর ধারে একা একা খেলে আবার নদীর সাথে গল্পও করে। যেন নদী তার একটা বন্ধু।
বড় হইতে থাকে খড়কি । গ্রাম অঞ্চলে যে বয়সে বিয়ে হয় সেই বয়স পার হয়ে যায়। কিন্তু করেন তার আদরের খড়কির জন্য বিয়ে ঠিক করতে পারে না। পাড়াপ্রতিবেশীরা বলে, “খড়কিকে কে বিয়ে করবে? করেনের বেটির বিয়ে হবে না কোনদিন। ” কিন্তু করেন মেয়ের বিয়ের জন্য ছেলে ঠিক করে। ছেলের বাপ মা বাড়ি ঘর নাই। মামার বাড়িতে বড় হয়েছে। ছেলে বাজনার দলের ( হিন্দু বিয়েতে যে বাজনা বাজার দল থাকে) বাঁশি বাজায়। যৌতুক নাই। কিন্তু ছেলের বউ নিয়ে থাকার একটা ঘর তোলার জায়গা লাগবে, এমন কথা বলে ছেলের মামা। করেন তার বাড়ির ভিটার সাথে লাগোয়া আড়াই কাঠা জমি মেয়ের নামে লিখে দিবে আর একটা ঘর তুলে দিবে প্রতিশ্রুতি দেয়। বিয়ে ঠিক হয়। করেনের বউ বলে,” এটা কি করলেন? এই ১০ কাঠার বাড়ি ভিটাই আমাদের সম্বল। দুইটা বেটা আছে আর আপনি বেটিক দিলেন?” করেন বউকে বলে” বউ সব চিন্তা করেই দিলাম বাড়ির কাছে মেয়েটা থাকবে। আমার এই পংগু মেয়েটারে দূরে কোথাও দিলে যদি জামাইয়ে মার ডাং করে? আমাদের কাছে থাকলে আর এই সাহস হবে না।আর আমার পংগু মাইয়াটাও চোখের সামনে থাকবে। ”
বিয়ে হয় খড়কির । খড়কির কাজ করার ক্ষমতা আর দশটা গ্রামের মেয়ের চেয়ে কম থাকলেও সে অনেক সংসারী ছিল। সে হাঁস মুরগী খুব ভালো করে পুষতো আর শাক সবজী লাউ কুমড়া এইগুলি লাগায় খুব যত্ন করে আর ভালো ফলন ফলাইতো। বিয়ের বর খড়কি দেখে তার স্বামী যাত্রাদলেও বাঁশি বাজায়। স্বামীর আয় আর তার হাঁস, মুরগী, ডিম আর সবজি বিক্রি করে মোটামুটি স্বচ্ছল ভাবে দিন কাটে খড়কির। সুখেই থাকে। মাঝে মাঝে ঘরের কাজ করে আর মনের সুখে গান গায়। ” শামুক থাকে হাটু জলোত, টোকরাই থাকে বিন্যার তলোত রে। আরে ও বন্ধু………। ”
একটা ছেলে হয় খড়কির। ছেলের বয়স যখন বছর দুয়েক তখন খড়কির বাবা করেন মারা যায়। ছেলেকে বুকে নিয়ে বাপ মরার দুঃখ ভোলার চেষ্টা করে খড়কি। দিন যায়। কিছু দিন পর খড়কির মনে হয় তার স্বামী যেনো অন্যরকম একটু। কানে নানা কথাও আসে, তার যাত্রাদলের কোন মেয়ের সাথে না কি সম্পর্ক তার স্বামীর। এই নিয়ে সংসারে অশান্তিও হয়। একদিন সকালে দেখে খড়কির জমানো টাকা নিয়ে তার স্বামী চলে গেছে। পরে শোনে যাত্রা গানের সেই মেয়েটাকে বিয়ে করেছে।
খড়কি মহাবিপদে পরে। যতো না স্বামীর বিরহ নিয়ে , তার চেয়ে বেশি ভাবায় কিভাবে কি খেয়ে ছেলে নিয়ে বাঁচবে? সে যায় বড়মার কাছে বলে, “বড়মা কি করি কিভাবে ছেলে নিয়ে বাঁচি!!”
বড়মার এখন অনেক বয়স হয়েছে। অসুস্থ, বিছানা থেকে উঠতে পারে না। বড়মা তাকে হাজার দুয়েক টাকা দেয় আর দেয় ৫ গা সুপারি ( গা মানে ১০ টায় এক গা হয়)। বলে “এই টাকা দিয়ে পান জর্দা কিনবি আর এই সুপারি নিয়ে আশে পাশের গ্রামে যাবি। গ্রামের মেয়েদের কাছে বিক্রি করবি। তারা টাকা নাও দিতে পারে। ধান চাল দিবে তা বিক্রি করবি এই দিয়ে ছোট ব্যবসা কর। সৎ থাকলে খেয়ে পরে বাঁচতে পারবি।”
খড়কি তারপর সুপারির ব্যবসা শুরু করে। গ্রাম্য ভাষায় বলে’ ‘গাঁ ‘করা। দেখে, ভালোই চলে আবার অনেকে ফিতা, চুড়ি, ক্লিপ ও চায়। অনেকে আবার নাড়ুু, মোয়াও চায়। সে ব্যবসা বাড়ায় । পান সুপারির সাথে কম দামী মালা ফিতা চুড়ি নিয়ে যায়। নাড়ু মোয়াও নেয়। আস্তে আস্তে সে শহরের দিকে যায়। শহরের দিকে চায় মুড়ি চিড়া খই মোয়া । সে নিয়ে যায়। আস্তে আস্তে তার স্বচ্ছলতা আসে। ছেলে বড় হয় স্কুলে যায়।
একদিন রাস্তায় তার স্বামীর সাথে দেখা। স্বামী তার কেঁদে কেঁদে বলে ” খড়কিরে, তোকে ছেড়ে গিয়ে আমি খুব ভুল করেছি রে। ওই মেয়ে আমারে খুব যন্ত্রণা দেয়। আমি আবার তোর কাছে চলে আসব। তুই আমাকে ক্ষমা করে দিস”। খড়কির মন একটু গলে। তার স্বামী কিছু টাকা চায়। সে দেয়। মাঝে মাঝেই রাস্তায় তার স্বামীর সাথে দেখা হয়। গল্প হয়। আর একদিন খড়কিকে স্বামী এসে বলে, “বউ কিছু টাকা দে খুব দরকার। অসুস্থ একটু ডাক্তার দেখাব। এবার সুস্থ হইলে তোর কাছে পাকাপাকি চলে আসব। ” খড়কি বেশ বড় অংকের টাকা দেয় । তার স্বামী চলে যায়। বিকালে খড়কি কিছু বাকীর টাকা তুলতে শহরে যায়। এক খদ্দেরের বাড়ি থেকে আসার পথে সিনেমা হল। খড়কি সিনেমা হলের পাশে দেখে তার স্বামী তার ছোট বউ নিয়ে চুড়ি কিনে দিচ্ছে। চুড়ি কেনা হইলে হাসতে হাসতে সিনেমা হলে ঢোকে। খড়কির গায়ে যেন কেউ আগুল লাগায় দিছে এমন মনে হয়। সে রাগে জ্বলতে জ্বলতে বাড়িতে আসে। বল সাবান নেয় আর ঘষা নেয়। নাদীতে যায়। বল সাবান আর ঘষা দিয়ে সে গা ঘষে আর বলে ” ওরে আমার সোয়ামী তুই আমার গায়ের ময়লা, এই বল সাবান আর ঘষানী দিয়ে তোকে আজ ধুয়ে ফেলাইলাম। ”
দুইদিন পর খড়কির স্বামী আবার রাস্তায় আসে বলে , “খড়কি, কেমন আছিস? তোর জন্য মন কাঁদে।” খড়কি চুপ করে থাকে। তার স্বামী বলে,” কয়টা টাকা দিবি পথ্যি খাব!” খড়কি তার ব্যাগ থেকে একটা বড় দা বের করে। দা তুলে বলে,” মিনসে আর কোনদিন যদি আমার সামনে আসিস তো এই দায়ের এক কোপে তোর মাথা নামাব।” খড়কির উগ্র মূর্তি দেখে পালায় যায় সে।৷
দিন যায়, খড়কির ছেলে খগেন বড় হয় মেট্রিক পাসও করে। মায়ের সাথে ব্যবসায় সাহায্য করে । মায়ের ব্যবসায় এখন সেই পরিশ্রম করে। বিবাহযোগ্য হয় খগেন। খড়কি ছেলের বিয়ে দেয়। খড়কির শরীর আর কুলায় না। সে আর আগের মতো পরিশ্রম করতে পারে না। ছেলেই সংসার চালায়।ছেলে ছেলের বউ নিয়ে সুখেই কাটে। একদিন কি নিয়ে যেন ছেলের বউ খড়কির সাথে রাগ দেখায়। খগেন বউকে বলে “বউ আমার মা একটা হাত দিয়ে আমাকে বড় করছে তুই যদি আমার ঘরে সুখে থাকতে চাস তো আমার মায়ের সাথে কোনদিন খারাপ ব্যবহার করবি না। ” খড়কি শুনে ভাবে বাপ তার মরে গেছে কিন্তু বাপের ভালোবাসাটা তার বেটা খগেনের মধ্যে রেখে গেছে। না বউ তার কোন দিন খারাপ ব্যবহার করে নাই। সেও বউরে আপন করে নিয়েছে। সুখেই দিন যাচ্ছিল।
একদিন খগেন এসে বলে “মা আগের দিন আর নাই। তোমার ব্যবসায় আর চলে না। ঢাকা যাই। গার্মেন্টসে অনেকেই চাকরী করে। আমিও করব । আমার এক বন্ধু চাকরি ঠিক করছে। লেখপড়া জানি বেতন ভালো। বউও চাকরি করবে। দুইজন মিলে কিছুদিন কাজ করে টাকা জমায় আবার গ্রামে আসব। পাশে মামারা আছে তোমাকে দেখবে। মাসে মাসে আমি টাকা পাঠাব। আর ছুটিতে তো আসবই। তুমি কিছুদিন একা থাকতে পারবা না মা? ” খড়কির কান্না পায় কষ্টে বুক ফেটে যায়। কিন্তু মুখে বলে “তোর যেটাতে ভালো হয় তাই কর। ”
খগেন ঢাকা যাবার তৈরী করে। ঢাকা যাবার দিন এসে যায়। খুব ভোরে উঠে খড়কি ছেলের খাবার রান্না করে। পছন্দের কিছু খাবার বানায় দেয় নিয়ে যাবে। ছেলে আর ছেলের বউ রওনা হয়। ছেলে বলে, “মা কান্দিও না আমি মামার মোবাইলে ফোন দিব প্রতিদিন। আর পূজায় আসব। প্রতি মাসে তোমাকে টাকা পাঠাব। কিছু টাকা জমলে এক্কেবারে চলে আসব। ”
ছেলে বউ চলে যাবার পর খড়কির অসম্ভব খারাপ লাগে। বাপ মারা গেছিল তখন ছেলেকে বুকে ধরে ধৈর্য ধরেছিল। স্বামী ফালায় গেছিল। তখন ছেলে নিয়ে কিভাবে বাঁচবে সেই চিন্তা বেশি ছিল। আর এখন ছেলেও ফালায় গেলো। এই কষ্ট তো সহ্য হয় না। সে বাড়ির পিছনে নদীর ধারে গিয়ে গাছে হেলান দিয়ে বসে থাকে। তার জীবনের কথা ভাবতে থাকে। তাকিয়ে দেখে তার একমাত্র বন্ধু সেই নদী আজ মৃতপ্রায়।
সে ভাবে আজ বড়মাও বেঁচে নাই যে গিয়ে কিছুক্ষণ তার কাছে বসে থেকে কষ্ট কমাবে।
দিন যায় সন্ধ্যা হয়। তার কোন দিকে খেয়াল নেই। বাড়ির কোনো কাজেও না। রাত হয় একটু। পাশে ভাইদের বাড়ি। ভাইয়ের মেয়ে লীলা আসে। ডাকে “ও পিসি ও পিসি তুই কই? খগেন দার ফোন আসছিল ওরা ভালো ভাবে ঢাকায় পৌছে। কাল আবার ফোন দিয়ে তোর সাথে কথা কবে। ” সে তার পিসিকে খুঁজতে খুঁজতে নদীর পাড়ে এসে দেখে পিসি গাছে হেলান দিয়ে বসে আছে। সে গায়ে হাত দিয়ে ডাকে, ” ও পিসি কথা কস না কেন? ” লীলার ধাক্কায় খড়কির প্রাণহীন দেহটা পড়ে যায়। লীলা চিৎকার দেয় “ও বাবা ও মা পিসি তো মরে গেছে। “
Facebook Comments Sync