কবি কাজী নজরুল ইসলামের সংগ্রামমুখর জীবন/ শারমিনা পারভিন
কবি কাজী নজরুল ইসলামের সংগ্রামমুখর জীবন/ শারমিনা পারভিন
কাজী নজরুল ইসলামের আগমনের পূর্বে বাংলা সাহিত্যের মুসলিম লেখকরা ছিল দূর্বল, কোণঠাসা, অবহেলিত। নজরুলের আগমন তাদেরকে করে তুললো আত্মবিশ্বাসী।
হ্যাঁ, বাংলা সাহিত্যে ধূমকেতুর মতোই আগমন ঘটে কাজী নজরুল ইসলামের। মানুষের জন্যই কাজী নজরুল ইসলামের লেখা। তাঁর লেখা অন্যায়, জুলুম, বঞ্চনা,কুটিলতার বিরুদ্ধে সংগ্রামী চেতনার জন্ম দিয়েছে। তাঁর লেখা, তাঁর উদ্দীপনা জাগরনী কবিতামালা মানবের শিরা উপ শিরায় ধ্বনিত হয়েছে।
তিনি বাংলা সাহিত্যাঙ্গনে এক বিস্ময়কর নাম!
তিনি জাতীয় কবি, বিদ্রোহী কবি, প্রেমের কবি,বাঙালির শক্তির কবি।
ব্যক্তিগত জীবনে ‘দুখু মিয়া; নামে পরিচিত এই মানুষ,নিজের নামের সাথে জড়িয়ে থাকা সকল দুঃখ কষ্ট, দূর্দশার তাড়নাকে ত্যাগ করে, সাহিত্য, কবিতায় জড়িয়ে দিয়েছেন সত্য সুন্দরকে জয় করে নেওয়ার বাণ।
তাঁর কবিতাগুলো ছিল চির যৌবনের জয়ধ্বনি। তাঁর সাহিত্য রবীন্দ্র বলয় থেকে বের করে এনে দিয়েছে এক নতুন সুরের সন্ধান।
স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যে তিনি ছিলেন সমুজ্জ্বল। সেই সুরের ঝংকারে মানুষের মনকে প্লাবিত করতে গিয়ে তিনি কারাবরণ করেন বহুবার। কিন্তু তিনি থেমে যাননি, একবারও। অদম্য অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে গেছেন। কেউ থামাতে পারেনি তাঁকে । মহামানবেরা এমনই হন।
আজ বলবো কাজী নজরুল ইসলামের দুর্বার জীবনের গল্প।
১৮৯৯ খ্রীস্টাব্দ ২৪ মে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে জন্মছিলেন এই কবি। কবিরা ছিলেন ছয় ভাইবোন। নজরুলের ডাক নাম দুখু মিয়া। ১৯০৮ সালে বাবা মারা যান। তখন তাঁর বয়স মাএ ১০ বছর। এই ১০ বছর বয়সে তিনি মক্তবে কুরআন, ধর্ম, দর্শন শিক্ষা লাভ করেন।
সংসারের প্রচন্ড অভাব অনটনে লেখাপড়া বাধাগ্রস্ত হয়। তিনি যে মক্তবে পড়তেন সেখানে পড়াশোনার পাশাপাশি শিক্ষকতা শুরু করেন অতি অল্প বয়সে।
পরে তিনি মসজিদের ইমাম ও মুয়াজ্জিনের দায়িত্ব পালন করেন। এ সময়ে তিনি ধর্মচর্চায় আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। কিন্তু সংসারের দায়িত্ব তাঁর উপর এসে পড়ে। ফলে সংসারের জোয়াল টানতে হয় তাঁকে।
বাল্যবয়সে লোকশিল্পের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে লেটো দলে যোগ দেন। চাচা বজলে করীম লেটো দলের ওস্তাদ ছিলেন। লেটো দলে তিনি সাহিত্য সংস্কৃতির চর্চা শুরু করেন। লেটো দলে তিনি গান করতেন, কবিতা লিখতেন।
কিন্তু বেশি দিন থাকতে পারেননি।
আর্থিক সমস্যা ছিল মারাত্মক। পরে,একজনের সাহায্য রেলওয়েতে খানসামার চাকুরি পান। এর পরে আসানসোলে রুটির দোকানে রুটি বানানোর কাজ নেন।।একজন দারোগা নজরুল ইসলামের কবিতা, ছড়া লেখা দেখে আকৃষ্ট হয়ে তাঁকে ত্রিশালের দরিরামপুর স্কুল ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি করে দেন। এখানে তিনি দশম শ্রেণিতে থাকা অবস্থায় সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন। ১৯১৭ সালে সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়ে শুরুতে ফোর্ট উইলিয়ামে, পরবর্তীতে সীমান্ত প্রদেশে, এরপর করাচীতে প্রায় আড়াই বছর কাটান। সেনাবাহিনীতে থাকাকালীন ফার্সি ভাষা শেখেন। গান শেখেন,বাদ্যযন্ত্র বাজানো শেখেন।
এ সময় তিনি শরৎচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, ইরানের কবি হাফিজের কিছু বই সংগ্রহ করেন। তিনি প্রথম বিশ্বযুদ্বে অংশ গ্রহণ করেন। পরে,৪৯ রেজিমেন্ট ভেঙ্গে দেয়া হয়।
তখন তিনি সেনাবাহিনী ছেড়ে চলে আসেন।
যুদ্ধ শেষে কলকাতায় কলেজ ষ্ট্রীটে থাকা শুরু করেন কবি । তার সংগে থাকতেন মুজাফফর আহমদ।
এই সময় কবির লেখা বঙ্গীয় সাহিত্য মুসলিম পএিকায় নিয়মিত প্রকাশ হতো। কবির কাছে নিয়মিত
আসতেন কাজী মোতাহার হোসেন, ড. মোহাম্মদ শহীদুল্লাহার। তাছাড়া গজানদার আড্ডা ও ভারতীয় আড্ডায় অংশগ্রহণের সুবাদে অতুলপ্রসাদ সেন, শিশির ভাদুড়ি, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, ধুর্জটি প্রসাদ, হেমেন্দ্র কুমার,সতোন্দ্রনাথ দত্ত প্রমুখের সাথে আলাপ হয়।
১৯২১ সালে তিনি শান্তি নিকেতনে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে দেখা করেন। এরপর আমৃত্যু কবিগুরুর সাথে নজরুলের সম্পর্ক ছিল।
ইতোমধ্যে আলী আকবর খানের সাথে কবির পরিচয় হয়। তিনি আলী আকবর খানের সাথে কুমিল্লায় বিরজাসুন্দরী দেবীর বাড়ী আসেন। এখানে কবির প্রমীলার সাথে দেখা হয়। আলী আকবর খানের ভাগ্নী নার্গিস আসার খানমের সাথে কবির বিয়ে হয় বলে জনশ্রুতি আছে । কিন্তু বিয়ের আসরে কাবিনে ঘরজামাই থাকার শর্ত ছিল। তিনি এই শর্তে অসম্মত হয়ে ঐ রাতেই বিরজাসুন্দরীর বাড়িতে চলে আসেন। তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন।এ সময়ে প্রমীলা দেবী কবিকে সেবা করে সুস্থ করে তোলেন।পরবর্তীতে ওনারা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।
বিদ্রোহী কবি:
তখন দেশ জুড়ে অসহযোগ আন্দোলন চলছিল। চারপাশে বিপুল উদ্দীপনা। কবি পুরোদস্তুর রাজনৈতিক কর্মী বনে যান। ১৯জুন শোভাযাত্রা করেন। রাস্তায় রাস্তায় গান করেন,পথে নামেন,
গানের কথা ছিলো এমন,
ভিক্ষা দাও! ভিক্ষা দাও!
ফিরে চাও ওগো পূরবাসী।
১৯২২ খ্রীষ্টাব্দে তিনি বিদ্রোহী কবিতাটি রচনা করেন। বিদ্রোহী কবিতার জন্য কবির সমগ্র ভারতবর্ষে নাম ছড়িয়ে পড়ে।
কবিতা লেখার জন্য কারারুদ্ধ হতে হয়েছে নজরুলকে। নজরুল যখন কারারুদ্ধ ছিলেন তখন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ তাঁর বসন্ত গীতিনাট্য নজরুলকে উৎসর্গ করেন। কবি নজরুল এতই খুশি হন যে জেলে বসেই লিখে ফেলেন আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে কবিতাটি। বন্দী অবস্থায় কবি নজরুল লেখেন রাজবন্দীর জবানবন্দি।
কবি নজরুল ইসলামের সম্পাদনায় বের হয় ‘নবযুগ’ পএিকা। পরে তিনি‘ ‘ধূমকেতু’ পত্রিকাটি প্রকাশ করেন। ‘ধূমকেতু’ সম্পর্কে কবিগুরু লিখেছেন,
কাজী নজরুল ইসলাম কল্যাণয়েষু,
আয় চলে আয়রে ধূূমকেতু
আধারে বাঁধ অগ্নিসেতু
দুর্দিনে এই দূর্গশিরে
উড়িয়ে দে
তোর বিজয় কেতন
এই পএিকাটি পরে নিষিদ্ধ হয়। এর জন্য কবি নজরুল গ্রেফতার হন।
কবি নজরুল ইসলামের সাহিত্য:
তিনি ২৬০০ গান রচনা করেছেন। তিনটি নামকরা উপন্যাস রয়েছে। কুহেলিকা,বাঁধনহারা মৃত্যুক্ষুধা।
৫১ টি গল্পগ্রন্থ, ইসলামি গ্রন্থ রয়েছে অনেক। শিউলিমালা, রিক্তের বেদন,ব্যথার দান, গানমালা,ঝিলিমিলি তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ।
গান বিষয়ক গ্রন্থ রাঙ্গাজবা, বুলবুল, সুরসাকী, গানেরমালা,চোখের চাতক,গানের মালা,
পুতুলের বিয়ে, আলেয়া।
কবি নজরুল ধূপছায়া নামে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। তাছাড়া তিনি ধ্রুব চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন।
কবির অন্যতম শ্রেষ্ঠ কাব্যগ্রন্থ হলো, অগ্নিবীণা,দোলনচাঁপা,সন্ধ্যা,সিন্ধু হিন্ধোল,সাম্যবাদ, ফনিমনসা।
রবীন্দ্রনাথকে সঞ্চিতা গ্রন্থটি তিনি উৎসর্গ করেন।
কবি নজরুলের প্রথম প্রকাশিত কবিতার নাম মুক্তি।
প্রথম প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ অগ্নিবীণা।
কবির ৫টিগ্রন্থ বাজেয়াপ্ত করা হয়।
কবি কাজী নজরুল ইসলাম আমাদের রণসঙ্গীতের রচয়িতা। সন্ধ্যা কাব্যগ্রন্থে রয়েছে এ কবিতাটি। কবিতাটির প্রথম ২১ চরণ আমাদের রণসঙ্গীত।
কবি নজরুল চার সন্তানের জনক। ১৯৪২ সালে তিনি দূরারোগ্য রোগে আক্রান্ত হন।রোগটির নাম পিকস ডিজিজ। তিনি কথা বলার শক্তি ও স্মৃতি শক্তি হারিয়ে ফেলেন। তখন তিনি স্ত্রীসহ ভারতে নিঃসঙ্গ জীবন যাপন করতেন। পরে কবিকে চিকিৎসার জন্য ভিয়েনা ও লন্ডনে পাঠান হয়। ওখানকার চিকিৎসকরা রোগটি অনিরাময়যোগ্য বলে জানান।মেডিকেল সায়েন্স ফেল করে। ১৯৬২ সালে কবির স্ত্রী মারা যায়। তখন তিনি হয়ে পড়েন আরও একাকী।
১৯৭২ সালে ভারত সরকারের অনুমতি নিয়ে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যথাযোগ্য মর্যাদায় কবিকে সপরিবারে বাংলাদেশে নিয়ে আসেন
১৯৭৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কবিকে ডি-লিট উপাধি প্রদান করে।
১৯৭৬ সালে কবিকে দেয়া হয় একুশে পদক। ভারত সরকার প্রদান করে জগত্তারিণী সনপদক।
১৯৬০ সালে পান পদ্মভূষণ পদক। ১৯৫৯সালে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ডি-লিট উপাধি পান কবি। বাংলা একাডেমিতে কবি নজরুল ও কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নামে দুটো গাছের নামকরণ করা হয়েছে।
কবি নজরুল ছিলেন অসাম্প্রদায়িক । তাই তিনি গেয়েছেন সাম্যের গান। তাঁর সন্তানের নাম রেখেছেন,কৃষ্ণমোহাম্মদ।
কবির জীবনের শেষ দিনগুলো বড় কষ্টে কেটেছে। শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থেকেছেন। বলতে চেয়েছেন অনেক কিছু। পারেননি।
ফুলের ও জলসায় নীরব থেকেছেন কবি। জীবনের শেষ দিনগুলো কেটেছে পি,জি হাসপাতালের বিছানায়।
কবির একটি অন্তিম ইচ্ছে ছিল।
মসজিদের পাশে আমায় কবর দিও ভাই
যেন গোরের থেকে মোয়াজিনের আজান শুনতে পাই।
তাঁর এই অন্তিম ইচ্ছা অনুযায়ী কবিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে কবর দেয়া হয়েছে।
ঘুমিয়ে আছেন কবি নজরুল ইসলাম । জাতীয় কবি, দ্রোহের কবি,প্রেমের কবি, সাম্যের কবি, মানবতার কবি।
Facebook Comments Sync