কথোপকথন/  নাসরীন মুস্তাফা

kothopokothon

kothopokothon

কথোপকথন/  নাসরীন মুস্তাফা

 

টিভিতে খবর পড়ছেন সুকণ্ঠি পাঠিকা।

আরেকটি বহুতল গার্মেন্টস ভবনের ধ্বসে পড়ার খবর পাওয়া গেছে। আমাদের প্রতিনিধি জানিয়েছেন, গত কাল রাতে রাজধানীর ব্যস্ততম আবাসিক এলাকা বকুলতলীতে অবস্থিত ভাই ভাই গার্মেন্টস ফ্যাক্টরির সাততলা ভবনটি বিকট শব্দে ধ্বসে পড়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, রাতের শিফট-এ কর্মরত প্রায় সাড়ে তিনশ‘ শ্রমিক এই ধ্বসে পড়া ভবনটির ভেতর আটকা পড়েছে। তবে কি কারণে দুর্ঘটনাটি ঘটল, তা জানা যায়নি। বিস্তারিত শুনুন তপন শাহ্-র কাছ থেকে।

সুকণ্ঠি পাঠিকা দারুণ রুপসীও বটে। শাড়ির সাথে চমৎকার ম্যাচিং মালা। নিখুঁত গড়নের ম্যানেকুইনের মতো এক ঠাঁই বসে থেকে ঘাড়টা সামান্য নিচু করে তাকালেন সামনের দিকে। সম্ভবতঃ তপন শাহ্ কি তথ্য জানাবেন, সেটা তিনিও জানতে চান। ঠোঁটের কোণে লেগে আছে এক টুকরো হাসি, অনেকটা পাউরুটি খাওয়ার সময় জেলি লেগে থাকার মতো। দেখলেই যেন ইচ্ছে করে, রুমাল দিয়ে জেলিটুকু মুছে দিই যত্ন করে।

টিভির শব্দ যে কোথেকে ভেসে আসছে! সোলায়মান শুয়ে শুয়ে শুনছে রিপোর্টিং। চোখ বন্ধ করলেই পাঠিকার মুখখানা মনে করতে পারছে। দু‘ দিন আগেই সম্ভবতঃ দু‘ দিন আগে-ই তো …দু‘ দিন না হোক, তিন দিন হতে পারে…শিফট ইনর্চাজ মোস্তাফাকে বলছিল, মাইয়াডা এক্কেরে সুচন্দার কাটিং। মোস্তাফা প্রতিবাদ করে বলল, বেডি এক্কেরে জানি শাবনুর। দু‘ জন তারপর গবেষণায় মেতেছিল, সুচন্দা আর শাবনুরের চেহারায় এত মিল কেন, সে বিষয়ে। শাবনুর কি সুচন্দার মাইয়া হইবার পারে? সোলায়মান এখন শুয়ে শুয়ে অবসন্ন মগজের ভেতর খুঁজে পেল সেই প্রশ্নটাই, শাবনুর কি সুচন্দার মাইয়া?

তিন পাশে এ্যাপার্টমেন্ট। মাঝখানে ভাই ভাই গার্মেন্টস সাততলার সুবিশাল দেহ নিয়ে বিরাট শব্দে ভেঙ্গে পড়েছে। হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে যাওয়া তিন পাশে এ্যাপার্টমেন্ট সব ক‘টা ফ্ল্যাটের মানুষজন কাঁদতে কাঁদতে নিচে নেমে আসার জন্য ছোটাছুটি শুরু করছিল। তাতে আহতও হয়েছিল বেশ কয়েকজন। ক্রমশঃ অস্থিরতা কমেছে। আস্তে আস্তে ফিরে আসছে মানুষ-জন। সকালের আলো ফুটতেই প্রতিটি ফ্ল্যাটের বারান্দায় ভিড় জমেছে। সবাই ঝুঁকে দেখছে ধ্বংসস্তূপের ভেতর থেকে ক্ষতবিক্ষত মানুষ টেনে বের করে আনার দৃশ্য। অত উপর থেকে বোঝা যাচ্ছে না, বের করে আনা মানুষটা জীবিত না মৃত। ডিটেইল জানার জন্য অগত্যা টিভি ছেড়ে দেওয়া। তপন শাহ্, রিনা মালেক, অনুপ রায়দের ক্যামেরার চোখ দিয়ে খুঁটে খুঁটে সবকিছু দেখার চেষ্টা।

ঘাড়ের ব্যথায় সোলায়মান কাহিল। তীক্ষন কিছু একটা মনে হয় ঘাড়ের মাংসে ফুটে গেছে। রক্ত-টক্ত পড়েছে কি না,  দেখার উপায় নেই। ঘুটঘুইট্টা আন্ধার চারিদিকে। জ্ঞান ফিরে পাওয়ার পর সোলায়মান মোটেও বুঝতে পারেনি, ও বেঁচে থেকেই জ্ঞানটাকে ফিরে পেয়েছে। ও ভাবছিল, মরে যাওয়ার পর অদ্ভুত আঁধারের ভেতর প্রশ্নকারী ফেরেশতার মুখোমুখি হতে হবে বলেই আল্লাপাক ওকে প্রস্তুত করছেন। বিড়বিড় করে বলে ফেলেছিল, এই তাইলে মরণ ! তারপর ঘাড়ের ব্যথাটা তীব্রতর হতে থাকায় আল্লাকে বলেছিল, মরণের পরও ব্যথা থাকে ক্যামনে? ব্যথায় কাতরালে প্রশ্নগুলোর ঠিক ঠিক জবাব দেবে কীভাবে? আর প্রশ্নগুলো ভুল হলেই তো দোজখের আগুনে পুড়তে হবে। সামান্য সময়ের জন্য দ্বিধায় পড়ে যায় সোলায়মান। ব্যথাটা কি আগুনে পোড়ার জন্য টের পাচ্ছে, নাকি….? নিজের ভেতরের তাগিদে মনের জোরে ঘাড়ের রগটাকে টান টান করতে গিয়ে ভেতরে ঢুকে যাওয়া রডের খোঁচা খেয়ে মাকে ডাকতে শুর করে আর ক্রমশঃ ফিরে আসে জীবনে।

….এখন সামান্য সময়ের বিরতি। আশা করছি আমাদের সাথেই থাকবেন।

….ট্যা ট্যা ট্যা…(মিউজিক)

স্বার্থপর জীবন বেঁচে থাকার অবিরাম উৎসব করছে। এত কিছুর মাঝখান দিয়ে চারিদিক থেকে ভেসে আসা কান্না আর গোঙানির শব্দ চাপা পড়া মানুষেরাই ঠিক মতো শুনতে পাচ্ছে না। মন্টু যেমন জ্ঞান ফিরে পেয়েই প্রায় থেঁতলে  যাওয়া  কানে অল্প অল্প শুনতে পেয়েছিল প্যান্টের পকেটে ঢুকে থাকা মোবাইলটায় বাজতে থাকা ওরে নীল দরিয়া। ওটাকে বের করার চেষ্টা করবে কীভাবে? ছাদ ভেঙ্গে পড়া বিশাল এক স্ন্যাব ওর দু‘হাত আর বুকের উপর আড়াআড়িভাবে পড়ে আছে।

…..বিরতির পরে আরো থাকছে, ইরাক আবারো গেরিলা হামলা।

….ট্যা ট্যা ট্যা…

অসাড় হাত খুঁজে ফিরছে মন। মনে মনেই হাতটাকে কাজে লাঘিয়ে মন্টু মোবাইলটাকে প্যান্টের পকেট থেকে টেনে বের করে আনে। তারপর মনের চোখ দিয়ে দেখে স্ক্রিনে ভেসে উঠেছে ডাক্তারবাজারে ফোনের দোকানদারি করা বেলায়েতের নাম্বার। ও সুইচ টিপে কানে ধরে ফোন। ওপাশ থেকে শেফালি চিৎকার করে ওঠে, মেভাই ! আমার মেভাই গো ! তুমি বাঁইচা আছ?

রাশিয়া সফররত কন্ডোলিৎসা রাইস বলেছেন, বিশ্বশান্তির জন্য আমেরিকা কাজ করে যাবে।

শেফালি কাঁদতে কাঁদতে আল্লাকে ধন্যবাদ দেয়। বলে, মেভাই, তুমার কিছু হয় নাই তো? তুমার হাত-পাও ঠিক আছে তো?

….ট্যা ট্যা ট্যা…

মন্টু দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, হাত-পাওর কুন সাড়া পাইতাছি নারে বইন। বুকের উপর আজদাহা পইড়া আছে। য্যান দশমুনি পাথর। কিয়ামতের দিন মিথ্যুকগো বকের উপর যিমুন পাথর দিব আল্ল। পায়ের তলায় রড ফুইটা গেছে।

প্রিন্স চার্লস নববিবাহিতা স্ত্রীকে নিয়ে হানিমুনে গেছেন। ওদিকে এক জরিপে জানা গেছে, বৃটেনে বেশির ভাগ জনগণ রাজা হিসেবে প্রিন্স চার্লসকে নয়,  উইলিয়ামকে চায়।

শেফালি ভয়ার্ত কন্ঠে জানতে চায়, দুই পাও দিয়ে হাঁটতে পারবা তো মেভাই?

….ট্যা ট্যা ট্যা…

দুই হাত দিয়ে আমগো সংসারডা টানতে পারবা তো মেভাই?

….ট্যা ট্যা ট্যা…

তুমার কিছু হইলে আমগো কি হইব মেভাই? আমরা না খাইয়া তো মইরা যামু। ও মেভাই গো….শেফালি কাঁদছে। ট্যা ট্যা ট্যা সুরে কাঁদছে মন্টুর কলিজার টুকরা শেফালি। কান্নার দমকে শেফালির দুই বেনী কাঁপছে। কত দিন ঐ বেনী ধরে টেনেছে মন্টু। ব্যথা পেয়ে মা-র কাছে নালিশ করেছে শেফালি। ঠোঁট ফুলিয়ে কেদেছে। হাট থেকে বাতাসা নিয়ে এলে তবে মেভাই- এর উপর রাগটা পড়ত ওর।

নরসিংদীতে একটি আমগাছের গোঁড়ায় কাঁঠাল ধরেছে। উৎসুক জনতা ঠেকাতে র‌্যাব মোতায়েন। 

….ট্যা ট্যা ট্যা…

….তোমার জন্য মরতে পারি, ও সুন্দরী, তুমি গলার মালা…বৃত্তাকার কন্ডোমের জন্য বর্গাকার ফয়েল প্যাকই নিরাপদ….ঝাঁঝমাখা নতুন স্বাদের মজা…নিশিতে কল কইরো আমার ফোনে…ক্রিং ক্রিং….

মন্টুর মোবাইল বেজেই যাচ্ছে। শেফালির গলাটা মাঝে মাঝে শোনার জন্য কত কষ্ট করে মোবাইলটা কিনেছিল ও। বেলায়েতের দোকান থেকে ফোন দেয় শেফালি, মন্টুর মোবাইলের ওরে নীল দরিয়া তখন আর বাজতেই পারে না। মন্টু কিভাবে যেন টের পেয়ে যায়, শেফালি ফোন করেছে। সাথে সাথে ধরে বসে। অথচ এখন, ও টের পাচ্ছে, শেফালি পাগলের মতো ছুটতে ছুটতে এসেছে ওর সাথে কথা বলার জন্য। ও থ্যাতা ইঁদুরের মতো শুয়ে শুয়ে শুনছে আর পাগল হয়ে যাচ্ছে ফোন ধরার জন্য।

মন্টু নিদারুণ কষ্টে হাউ মাউ করে কান্না শুরু করে। তখন অনেক দূর থেকে ভেসে আসে সোলায়মানের গলা। তরুণ ছেলেটাকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য সোলায়মান বলে, কান্দিস না। কাইন্দা কিছু হইব? খামাখা কষ্ট বাড়ব।

কি করুম? কি করনের আছে?

আল্লা আল্লা ক ।আল্লা চাইলে বাঁচবি।

অন্ধকারে কিচ্ছু দেখা যাচ্ছে না। ঘুটঘুটে কাল-র চেয়েও ঘুটঘুটে কাল এই অন্ধকার। কবরের অন্ধকার। বিশাল এই কবরে শুয়ে আল্লাকে ডাকছে আড়াইশ, আদম সন্তান। আল্লার সৃষ্টি। আশরাফুল মাখলুকাত। সৃষ্টির সেরা জীব। কবরের বাইরে যে দুনিয়া, সেখানকার আশরাফুল মাখলুকাতেরা তখন তমুল বিতর্কে মশগুল। কেন এই দুর্ঘটনা ঘটল? কার পাপে?  ভাই ভাই গার্মেন্টস-এর  দুই মালিক চৌধুরী শাফকাত খান এবং বরকত খান কেমন লোক? শোনা যায় চৌধুরীদের জন্মদাতা পিতা সরকারী দলের প্রভাবশালী মন্ত্রী হওয়ায় ভাই ভাই-এর যৌথ প্রচেষ্টায় জনৈকা সুফিয়া খাতুনের পুরনো বাড়িটাকে দখল করে সেটাকে ভেঙ্গে-চুরে ভাই ভাই গার্মেন্টস দাঁড় করিয়েছে। এ নিয়ে বেশ হৈ চৈ হয়েছিল কয়েকটা পত্রিকাতে। দু‘দিন পর সেই পত্রিকাগুলো থেকেই জানা গেল, সাড়ে পাঁচ কাঠা জমির উপর দাঁড়িয়ে থাকা বাড়িটা নাকি পরিত্যক্ত সম্পত্তি, সরকারের কাছ থেকে নিয়ামনুযায়ী লিজ নিয়ে ভাই ভাই গার্মেন্টস তৈরির পরিকল্পনা করেছেন ভাই-এরা। উন্নয়নের জোয়ারে ভাসা দেশের অর্থনীতিতে আরো বেগ সঞ্চারের মহৎ উদ্দেশ্যে এগিয়ে এসেছেন ভাই শাফকাত ও ভাই বরকাত।

সুফিয়া খাতুন সাংবাদিক সম্মেলন করে সবাইকে জানাল, পাকিস্তান আমলে তার বাবা কত কষ্ট করে বাড়িটা তৈরি করেছিলন। এই বাড়িতে ছেলে- পুলে-নাতি-পুতি নিয়ে গড়ে তোলা তার জমজমাট সংসার, বাড়ির গা ঘেঁষে একটা পেয়ারা গাছ, তিনটে মেহেদি গাছ—সব কিছুর জন্য তিনি কাঁদতে থাকেন। চোখের পানিতে ভিজে যাওয়া গালসমেত সুফিয়া খাতুনের বয়সী মুখখানার ফটো তুলতে দেখা গেছে কয়েকজনকে, কিন্তু পরদিন কোন পত্রিকায় খবরটি আসেনি। বরং জানা গেছে, কোন ফটোগ্রাফার নাকি জাপানি এক এক্সিবিশনে ছবিটা পাঠিয়ে পুরস্কার জোগাড় করেছে। ছবির নাম ক্রাইং বিউটি।

লোকজন কেউ কেউ নিচু স্বরে বলছে, সুফিয়া খাতুনের দীর্ঘশ্বাস সইতে পারেনি ভাই ভাই গার্মেন্টস। ভেঙ্গে পড়েছে। যেমন চার বছর আগে ভেঙ্গে চুরে মাটিতে লুটিয়ে পড়ছিল সুফিয়া খাতুনের বাড়িটা।

পাশ থেকে আরেকজন প্রতিবাদ জানিয়ে বলে, দীর্ঘশ্বাসে গার্মেন্টস ভাঙ্গল ভাল কথা। এ্যাত্তগুলো নিরাপরাধ মানুষ মরল কেন? ওরা কি দোষ করেছে? চৌধুরী শরাফত আর চৌধরী বরকতের কি হবে? কিচ্ছু না। বরং বীমার টাকা পেয়ে বগল বাজাতে বাজাতে আবার দেশের অর্থনীতিতে যুৎসই অবদান রাখতে সোচ্চার হবে। ভাই ভাই গার্মেন্টস-এর উদ্বোধনীর দিনে স্বয়ং অর্থমন্ত্রী-ই তো আশাবাদ করেছিলেন। আবার যদি তিনি নতুন অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হন, তাহলে আবারও যে একইরকম আশার কথা শোনাবেন, সেটা নেশ্চিত। তিনি না আসলে অন্যজন আসবেন। এই অন্যজন কিন্তু অন্য কথা বলবেন না। আশাবাদী কথা বলার সুযোগ পেলে কে ছাড়ে? আফটার অল, দে আর অল পজিটিভ থিংকারস। দে হ্যাভ ভেরি পজিটিভ এ্যাটিচ্যুড।

পজিটিভ রেজাল্ট এসেছে কমলার প্রেগনেন্সি টেস্টের। গতকাল টেস্টের রিপোর্টটা নিয়ে ম্যানেজারের রুমে ঢোকার পায়তারা করেছে বহুবার। কাজের ফাঁকে ফাঁকে যতবার গেছে, শুনেছে মিটিং হচ্ছে, মিটিং। পিএ-কে বার বার বলেছে, ভেতরে গিয়ে স্যারকে ওর নামটা শুধু জানাতে। আগে তো ওর চেহারা দেখলেই পিএ হারামজাদাটা দাঁড়িয়ে যেত, তাজিমের সাথে ম্যানেজারের রুমের দরজা খুলে ওকে ভেতরে যাওয়ার ইঙ্গিত দিত। দিন পনের হারামজাদাটা কিছুতেই ওকে ভেতরে যেতে দিচ্ছে না। গেলেই বলবে, স্যার তো মিটিং-এ। গত রাতে শিফট শেষ হওয়ার পরও ও বাড়ি যেতে পারেনি। জেদ চেপেছিল খুব। মিটিং কি সারা রাত হবে? যখনি বেরোবে, তখনি পিছু নেবে।

ম্যানেজার ওকে চিনতেই পারেননি। ব্লেজারের বোতাম লাগাতে লাগাতে পিএ-কে ধমকান, লেবাররা কীভাবে ভিড় করে এখানে? পিএ ওকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিয়ে স্যারের চলার পথ পরিষ্কার করে। ম্যানেজারের মোবাইলে তখন কল এসেছে। তিনি কথা বলতে বলতে যাচ্ছেন,….ছেলেপক্ষ আমার বুবলি সোনাকে পছন্দ করেছে? মাশাল্লা মাশাল্লা। সবই আল্লা পাকের রহমত।…..ডেট যখন কনফার্ম তখন লিস্ট কমপ্লিট করে ফেল।…না না, কেনাকাটা সব সিঙ্গাপুর থেকে হবে। দূর.. দূর..ইন্ডিয়ায় যাব, মেয়ে আমার ফকিরনি নাকি? 

কমলার কানে যাচ্ছে না কোন কিছু। মিনিট বিশেক ও স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল টয়লেটের দেয়াল ধরে। ওর চারপাশে তখন ম্যানেজারের দু‘হাত দেবি দুর্গার দশ হাতে পরিণত হয়েছে। দেবি দুর্গা হয়ে ওকে বানিয়েছে দ্রৌপদী , টেনে টেনে ওর শাড়ি খুলছে আর গদগদ স্বরে বলছে, কমলা রানী তো জিনিস একখান। একেবারে কমলার কোয়ার মতো টসটসে। এক হাত ওর মুখ ছোয়,  এক হাত কোমরে, এক হাত বুকে, এক হাত নিতম্বে, এক হাত ওর চুলে বিলি কাটছে….শ্রীমতি কমলা রানীকে দেখে ম্যানেজারের নিরামিষ জীবনে নাকি বছর দশেক পরে জোয়ার এসেছে। এই জোয়ার দেখে সে পুলকিত, কমলা রানী শংকিত। সেই শংকা দেখে ম্যানেজার আল্লা-খোদার কসম কেটে বলেছে, দ্বিতীয়বার বিয়ের পিঁড়িতে বসার জন্য সে কতখানি দেওয়ানা। কমলা রানী নিজেও চরম মুহূর্তে শিৎকারের সাথে আল্লাকে ডেকেছে পরম ভক্তিভরে। সেই কমলা রানী টয়লেটের দেয়াল ধ্বসে পড়ায় নিজেও ধ্বসেছে। মাথাটা থেতলে গেছে, ঘিলু থেকে ছড়িয়ে পড়া রক্তের ধারা বালি-সিমেন্ট ভিজিয়ে কোন ফাঁকে যে প্রেগনেন্সি টেস্টের রিপোর্টটাও ভিজিয়ে দিয়েছে, কে জানে!

টিভি পর্দায় ম্যানেজারের চেহারাটা দেখা যাচ্ছে। স্যুট-টাই-ব্লেজারের সাথে মেহেদি মাখানো চাপদাড়ি আর সাদা সফের টুপি। ভাই ভাই গার্মেন্টেস-এর পক্ষ থেকে তিনি সবাইকে এই অনাকাঙক্ষত দুর্ঘটনার শান্ত থাকার জন্য অনুরোধ জানাচ্ছেন। কারোর চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই। ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে, পর্যাপ্ত চিকিৎসা সেবা দেওয়া হবে, ভয়ের কিছু নেই। আল্লা আমাদের সাথে আছেন।

চ্যানেল বাংলাদেশ-এর তরুণী রিপোর্টার রিনা সালেক প্রশ্ন করেন, দুর্ঘটনা ঘটার কারণ কি বলে আপনি মনে করেন?

কোন কারণ তো নাই। সব নিয়ম মেনেই অত্যন্ত দক্ষ ইঞ্জিনিয়ার দিয়ে সবচেয়ে খাঁটি মাল দিয়ে বিল্ডিংটা তৈরি করা হয়েছিল। কেন যে এমন হ‘ল, তা আল্লা পাক ভাল বলতে পারবেন। তাঁর হুকুম ছাড়া তো গাছের পাতাও নড়ে না।

রীনা সালেক নাছোড়বান্দার মতো আবারো জানতে চায়, বিল্ডিংটা তৈরির সময় রাজউকের অনুমতি নেওয়া হয়েছিল কি? শোনা যাচ্ছে, স্ট্র্যাকচারাল ডিজাইন অনুযায়ী পুরো বিল্ডিংটা তৈরি করা হয়নি?

রীনা সালেকের গোলগাল মুখটায় তেঁড়ামির ছাপ স্পষ্ট। সেদিকে তেরছা চোখে তাকিয়ে ম্যানেজার উম্মার সাথে বলেন, টাইটনিকও তো নিয়ম মেনে অনুমতি নিয়ে তৈরি করা হয়েছিল। কেউ ভেবেছিল, টাইটনিক ডুববে? আল্লা ডুবাইতে চাইলে আপনি আমি কি করতে পারি? রীনা এরপরও প্রশ্ন করে, তার মানে আপনি কি বলতে চাইছেন, এতগুলো মানুষ মরে গেল স্রেফ আল্লার ইচ্ছে হয়েছিল বলেই? কারোর কিছু করার ছিল না? এখনো কিছু করার নেই?

মর জ্বালা! আল্লার ইচ্ছা ছাড়া মানুষ মরতে পারে? মারে আল্লা রাখে কে!

রীনা মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে ফিরে তাকিয়েছে ক্যামেরার দিকে। দুর্ঘটনার কারণ ও পরবর্তী পদক্ষেপ সম্বন্ধে কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা বিষয়ক জোরালো রিপোর্টিং করা শুরু করে। পেছন দিকে ক্যামেরার ফ্রেমের বাইরে দাঁড়ানো ম্যানেজার তখন আল্লার হুকুম বিষয়ক দু‘টি হাদিস বলছেন চৌধুরী শাফকাত খানের পার্সোনাল অফিসার মোজাম্মেলকে। হাদিস শুনে মোজাম্মেলও বলে, সব-ই আল্লার ইচ্ছা। মারে আল্লা রাখে কে !

ম্যানেজার মোজাম্মেলকে হাত ধরিয়ে সরিয়ে নিতে নিতে নিচু গলায় বলেন, স্যারেরা ভাল আছেন তো?

মোজাম্মেল ফিসফিস করে বলেন, আছেন। প্রাইম মিনিস্টারের অফিস থেকে ফোন করে নিয়মিত খোঁজখবর রাখা হচ্ছে। মন্ত্রী মহোদয় প্রাইম মিনিস্টারকে বলেছেন, ছেলেদের কিছু হলে রেজিগনেশন লেটার রেডি থাকবে। তার মানে বুঝছেন তো, একটা সিট নিয়ে টানাটানি পড়ে যাবে। আর ঐ এলাকায় তারা ছাড়া আর কোন বাপের ব্যাটা আছে, এমপি ইলেকশনে স্যারের আব্বাকে ডিফিট দেয়? দল নিশ্চয় চাইবে না সিটটা হাতছাড়া হোক। শ‘ দুয়েক কুলি-কামিন-লেবার মরে গেল বলে এরকম বোকামি করবেন প্রাইম মিনিস্টার? কভি নেহি।

রিপোর্টার শালা-শালিরা বড় বকছে। পত্রিকার পাতায় পাতায় মরা মানুষের ছবি। মানুষ পড়ছেও মজা করে। আর টিভি খুলে বসে আছে হা করে, মরা মানুষের ভাঙ্গাচোরা শরীর না দেখলে ভাল্লাগছে না যেন। যত্তোসব!

আহা, ওদেরও তো কিছু করে খেতে হবে।

তা ঠিক।

মোজাম্মেল ম্যানেজারের সাথে অতঃপর আরো কিছু নিবিড় আলোচনায় মত্ত হয়। বাতাসে লাশ পচা দুর্গন্ধ। আতর মাখা রুমাল নাকে দিয়ে দাঁড়ানো ম্যানেজার পকেট থেকে আতরের শিশি বের করে মোজাম্মেলের রুমালে কয়েক ফোঁটা ছিটিয়ে দেয়। নামে সুগন্ধী রুমাল চেপে হাসে মোজাম্মেল, নিজেকে কেমন বর বর লাগছে।

বর বর ! হা হা হা ! বরবর…মানে বর্বর নয় তো? হা হা হা।

ম্যানেজারের সেন্স অব হিউমার হাদিয়ে তোলে মোজাম্মেলকেও। হা হা হা।

চাপা পড়া ধ্বংসস্তুপের উপর দাঁড়ানো উদ্ধারকর্মীরাও জীবনের নানান কথা ভেবে কখনো কখনো ফুচকি কিংবা মিচকি হাসি হেসে উঠছে। টিভি থেকে ভেসে আসছে হাসির নাটকের ব্যাকগ্রাউন্ডে ব্যবহৃত হা হা হাসির শব্দ। রেডিও তো বাজছে গান, আহা কি আনন্দ আকাশে বাতাসে !

চাপা পড়া ধ্বংসস্তূপের নিচের জগতটা তখন কান্না আর কোঁকানিতে ভরা। ঘুটঘুটে অন্ধকারে ওরা কেঁদে ওঠে। একটু থামে, তারপর আবার কাঁদে। যখন থামে, তখন আরো কেউ কেঁদে উঠল কি না, সে শব্দ শুনতে চায়। অতল অন্ধকারের শরীর ফুঁড়ে এদিক ওদিক থেকে ভেসে আসছে কান্না।

সোলায়মান কাঁদছে, মউতের ফেরেস্তা আসে না ক্যান্ ?

মন্টু কাঁদছে, সওয়াল-জবাবের ফেরেস্তা আসনের এ্যাত দেরি হইতেছে ক্যান্?

জোহরা কাঁদছে, মউতের ফেরেস্তা কখন আইব?

হালিমা কাঁদছে , আর তো দেরি সহ্য হয় না।

যারা মরে গিয়েছিল, তাদের সাথে সওয়াল-জবাবে ব্যস্ত থাকা ফেরেস্তা হাই ছাড়েন। কেউ চাইলেই তো হলো না,আল্রা হুকুম না দিলে তিনি তো কারো সওয়াল-জবাব করতে পারেন না।

ধ্বংসস্তূপের অন্ধকারে কাল কেউটের মতো চুপচাপ শুয়ে মউতের ফেরেস্তা অপেক্ষায় আছেন। আল্লার হুকুম হলেই আরো কিছু জান কবজ করতে হবে। যতক্ষণ হুকুম হবে না, ততক্ষণ এরা শরীরিক কষ্ট সহ্য করতেই থাকবে।

মানুষগুলো আল্লাকে ডাকছে। ও আল্লা, তুমি শুধু আমাদের মারো, আর ওদেরকে রাখো। তুমি এরকম ইচ্ছা করো কেন, জবাব দাও। নিজে না পার, মউতের ফেরেস্তারে বল এসে জবাব দিতে। যেমন করে এক ফেরেস্তা হেরা গুহায় গিয়ে বলেছিল, ইক্রা। সওয়াল-জবাবের ফেরেস্তারে বল, সে এসে বলে যাক্ । যেমন করে সে সওয়াল জানতে চায়, তেমনি করে জবাব দিক্ এই প্রশ্নের। তুমি কেন শুধু আমাদেরকেই  মার? আমাদের সন্তানদের না খাইয়ে মার। আমাদের স্ত্রীদের বেশ্যা বানিয়ে মার। আমাদের মা-বাবা-ভাই-বোনদের অপঘাতে মার। শয়ে শয়ে হাজারে হাজারে সারা পৃথিবী জুড়ে তুমি শুধু আমাদেরকেই মার। বুশ-ব্লেয়ার-চৌধুরী-খান-মন্ত্রী-মিনিস্টার-বড়লোক-আমলাদের তুমি মার না। কেন ? এরা কি তোমার দলের লোক? আমরা কি বিরোধী পার্টি করি? হে আল্লা, রাব্বুল আলামীন, তুমিও কি পলিটিক্স কর?

মউতের ফেরেস্তা আর সওয়াল-জবাবের ফেরেস্তাও আল্লাকে ডাকছেন। এসব প্রশ্নের জবাব দেওয়ার জন্য আল্লা যেন আবার তাদেরকে নির্বাচন না করেন। কাজের চাপে এমনিতেই দম ফেলার ফুরসত নেই। কত কত ফেরেস্তা আছেন, তাদের ভেতর থেকে অন্যদেরকে পাঠানো হোক্ । প্রয়োজনে আলাদা অধিদপ্তর খোলা যেতে পারে, সেখানকার ফেরেস্তারা শুধুমাত্র এসব প্রশ্নের জবাব দিতেই ব্যস্ত থাকবেন।

আল্লাহুম্মা আমীন।

নাসরীন মুস্তাফা
নাসরীন মুস্তাফা