লেখক বঙ্গবন্ধু শেখ

লেখক বঙ্গবন্ধু শেখ

লেখক বঙ্গবন্ধু / আফরোজা পারভীন

 

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক, সংগ্রামী, দেশপ্রেমিক সত্তার কথা আমরা জানি। জানি আরও নানাবিধ গুণাবলীর কথা। কিন্তু তিনি যে একজন অনন্য লেখক  সে পরিচয় আমাদের জানা ছিল না। সে পরিচয় আমরা জানলাম তাঁর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ প্রকাশের পর। একে একে প্রকাশ হলো ‘কারাগারের রোজনামচা’ ও ‘আমার দেখা নয়াচীন’। আমরা পেলাম জীবনঘেঁষা সংবেদী মাটিলগ্ন এক লেখককে।

এ বছরের ১৭ মার্চ ছিল জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের (১৭ মার্চ ১৯২০- ১৫ আগস্ট ১৯৭৫) জন্মশতবর্ষ। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে ঘাতকদের হাতে আকস্মিকভাবে নিহত হন বঙ্গবন্ধু। জার্মানিতে থাকায় বেঁচে গিয়েছিলেন দুই কন্যা  শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। দীর্ঘ প্রবাসবাসের পর  ১৯৮১ সালে শেখ হাসিনা দেশে ফিরে এসেছিলেন। তাঁর অনুপস্থিতিতে আওয়ামী লীগের পূর্ববর্তী কাউন্সিলে সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি। শুরু হয় এক কন্যার পিতার জন্য সংগ্রাম।  ইতিহাস  থেকে বিস্মৃতপ্রায় এক মহানায়ককে তাঁর স্থানটিতে প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম। তিনি পেরেছেন। পিতার যোগ্য কন্যা তিনি।

বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব, রাজনীতি, বাগ্মিতা, দূরদর্শিতা, অসাম্প্রায়িকতা আমাদের বারবার মুগ্ধ করেছে। কিন্তু তাঁর লেখক সত্তা বিমোহিত করলো আমাদের। কন্যার কারণে উন্মোচিত হলো পিতার লেখক সত্তা।

অবশ্য বঙ্গবন্ধু ‘রাজনীতির কবি’ তো ছিলেনই। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ তাঁকে কবি খ্যাতি দিয়েছে। ভাষণের যদি সাহিত্যমূল্য থাকে, তবে ৭ মার্চের ভাষণের সাহিত্যমূল্য অমূল্য । সেই ভাষণকে বলা যায় ‘দীর্ঘ কবিতা’। আর এ ভাষণদাতা একজন রাজনীতির কবি।

 সেই কবি আর ভাষণকে নিয়ে রচিত হচ্ছে অনেক কবিতা। রচিত হচ্ছে অনেক সাহিত্য। আঠারো মিনিট স্থায়ী সেই ভাষণ এ পর্যন্ত বারোটি ভাষায় অনূদিত হয়েছে।

কিন্তু ভাষণেই থামেননি এ জাতির পিতা। হাতে তুলে নিয়েছেন কলম। পৃথিবীর প্রায়  সব স্মরণীয় রাষ্ট্রনায়কই লেখক, দার্শনিক, চিন্তক ছিলেন । ছিলেন ভাবুক। তাদের সকলেরই প্রকৃতিপ্রেম, ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতিলগ্নতা ছিল । এসবের সমন্বয়েই বিকশিত হয়েছিল তাদের ব্যক্তিত্ব। প্রাচীন এথেন্সের রাষ্ট্রনায়ক পেরিক্লিস থেকে শুরু করে জর্জ ওয়াশিংটন, টমাস জেফারসন, আব্রাহাম লিংকন, উইনস্টন চার্চিল, মহাত্মা গান্ধী, পন্ডিত জওহরলাল নেহরু, ইন্দিরা গান্ধী, নেলসন ম্যান্ডেলাসহ বিখ্যাত রাষ্ট্রনায়কদের অনেকেই  লেখক-বুদ্ধিজীবী ছিলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও তাঁদের ব্যতিক্রম নন।  দেশ আর দেশের মানুষকে ভালোবাসা, আন্দোলন, আপসহীনতা, দীর্ঘ কারাবরণ ও নির্যাতন, দেশান্তর তাঁর অভিজ্ঞতাকে ঋদ্ধ করেছে । তাঁর রয়েছে শত নির্যাতন  সহ্য করে দেশকে স্বাধীন করার গৌরবময় ইতিহাস। 

বঙ্গবন্ধুর জীবনকাল ৫৪ বছরের । এই সময়ের এক চতুর্থাংশ তিনি কাটিয়েছেন কারাগারে। ব্রিটিশ শাসনামলে স্কুলের ছাত্র অবস্থায় সাতদিন কারাভোগ করেন।  একটা দীর্ঘ সময় কারাগারে কাটে পাকিস্তান আমলে। বঙ্গবন্ধু জেলে থাকার সময় স্ত্রী শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব কয়েকটি খাতা কিনে দিয়েছিলেন জেলখানায় আত্মজীবনী লেখার জন্য। তিনি আত্মজীবনী লেখায় উৎসাহী ছিলেন না। খাতা দেওয়ার সময়  স্ত্রীকে বলেছিলেনও  সে কথা। তবে বঙ্গবন্ধু কখনও তাঁর স্ত্রীর অনুরোধ উপেক্ষা করেননি। তাই একসময় লিখতে শুরু করেন। আর সে কারণেই আজ জাতি পেয়েছে  তাঁর  লেখা অমূল্য তিনটি গ্রন্থ। দীর্ঘ কারাবাসের দিনগুলোকে কাজে লাগিয়েছেন বঙ্গবন্ধু। খাতার পাতায় ধরে রেখেছেন প্রতিটি মুহূর্ত। আর আজ তা ইতিহাসের সাক্ষী হয়েছে।  নিষ্ঠা, দক্ষতা আর  আন্তরিকতা নিয়ে লিখেছেন অসমাপ্ত আত্মজীবনী (২০১২), কারাগারের রোজনামচা (২০১৭) ও  ‘আমার দেখা নয়াচীন’ (২০২০)। বই তিনটি প্রকাশিত হয়ে বেস্ট সেলার স্থান দখল করেছ। দেশবাসী খুঁজে পেয়েছে শেখ মুজিবুর রহমান নামে একজন অনন্যসাধারণ লেখককে। 

বইগুলি খুঁজে পাওয়া ও প্রকাশের পেছনে একটা লম্বা কষ্টকর অধ্যায় আছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী   শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর লেখা খাতাগুলি সংগ্রহ করেছেন।  তিনটি বইয়ের ভূমিকা লিখেছেন তিনি। ভূমিকায় বঙ্গবন্ধুর লেখার খাতাগুলো সংগ্রহ করা,  সেগুলির পাঠ উদ্ধার ও প্রকাশের পেছনের কাহিনি সম্পর্কে বিস্তারিত উল্লেখ করেছেন। সে ভূমিকা পড়লে বোঝা যায় কী অসাধ্য সাধন করেছেন তিনি এবং তাঁর টিম। ১৯৮১ সালে দেশে ফিরে শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বর বাড়িতে তাঁর লেখা স্মৃতিকথা, ডায়েরি ও চীন ভ্রমণের খাতাগুলো পান। আত্মজীবনীর খাতাগুলো পাননি। বঙ্গবন্ধু জেলমুক্ত হওয়ার পর সম্ভবত তাঁর আত্মজীবনীর চারটি খাতা শেখ ফজলুল হক মনিকে দিয়েছিলেন টাইপ করার জন্য। ’৭৫ ঘটনায় শেখ মনিও শহিদ হন।  পরবর্তীতে শেখ মনির অফিস থেকে আত্মজীবনীটি উদ্ধার হয়। আর আমরা পাই তাঁর অমর সৃষ্টি ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’।

২১ আগস্ট ২০০৪ শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টার ঘটনার পরপর এই এই চারটি খাতা পান তিনি । খাতাগুলি ছিল খুবই পুরাতন, জীর্ণ, লেখা অস্পষ্ট। খাতা হাতে আসার পর সেই সময়ক্ষণ সম্পর্কে তিনি লিখেছেন, ‘খাতাগুলো হাতে পেয়ে আমি প্রায় বাকরুদ্ধ। এই হাতের লেখা আমার অতি চেনা। ছোট বোন শেখ রেহানাকে ডাকলাম। দুই বোন চোখের পানিতে ভাসলাম। হাত দিয়ে ছুঁয়ে ছুঁয়ে পিতার স্পর্শ অনুভব করার চেষ্টা করলাম। মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছি; তারপরই এই প্রাপ্তি। মনে হলো যেন পিতার আশীর্বাদের পরশ পাচ্ছি। আমার যে এখনও দেশের মানুষের জন্য,  সেই মানুষ যারা পিতার ভাষায় বাংলার ‘দুঃখী মানুষ’  সেই দুঃখী মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের কাজ বাকি, তাঁর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার কাজ বাকি, সেই বার্তাই যেন আমাকে পৌঁছে দিচ্ছেন। যখন খাতাগুলোর পাতা উল্টাচ্ছিলাম আর হাতের লেখাগুলো ছুঁয়ে যাচ্ছিলাম আমার কেবল মনে হচ্ছিল আব্বা আমাকে যেন বলছেন, ভয় নেই মা, আমি আছি, তুই এগিয়ে যা, সাহস রাখ। আমার মনে হচ্ছিল, আল্লাহর তরফ থেকে ঐশ্বরিক অভয়বাণী এসে পৌঁছালো আমার কাছে। এত দুঃখ-কষ্ট-বেদনার মাঝে যেন আলোর দিশা পেলাম।’

‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে বঙ্গবন্ধু তাঁর বংশ পরিচয়, জন্ম,  শৈশব, শিক্ষা জীবন, সামাজিক ও রাজনৈতিক কর্মকান্ড, দুর্ভিক্ষ, বিহার এবং কলকাতায় হিন্দু মুসলিম দাঙ্গা, দেশভাগ, মুসলিম লীগের রাজনীতি, ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠা, যুক্তফ্রন্ট গঠন ও নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন, দেশ বিভাগ পরবর্তী সময় থেকে ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত পূর্ব বাংলার রাজনীতি, কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক মুসলিম লীগ সরকারের অপশাসন, ভাষা আন্দোলন,  আদমজীর দাঙ্গা, পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকারের  বৈষম্যমূলক শাসন ও প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের বিস্তৃত বিবরণ এবং এসব বিষয়ে লেখকের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়েছেন।  একইসঙ্গে লেখকের চীন, ভারত ও পশ্চিম পাকিস্তান ভ্রমণের বর্ণনাও বইটিকে বিশেষ মাত্রা দিয়েছে। তুলে ধরেছেন তাঁর কারাজীবন, পিতামাতা, সন্তান-সন্ততি, সহধর্মিণীর কথা। যিনি তাঁর রাজনৈতিক জীবনে সহায়ক শক্তি হিসেবে সকল দুঃসময়ে তাঁর পাশে অবিচল ছিলেন।

 টুঙ্গিপাড়ার সম্ভ্রান্ত শেখ বংশে জন্মেছিলেন বঙ্গবন্ধু। তাঁর ছোট দাদা ইংরেজের দেওয়া ‘খান সাহেব’ উপাধি পান। তার ছেলেকেও খান সাহেব উপাধি দেওয়া হয়। বঙ্গবন্ধুর স্ত্রীর ডাক নাম রেণু। তিন বছর বয়সে বঙ্গবন্ধুর সাথে বিয়ে হয় তাঁর। বঙ্গবন্ধুর বয়স তখন বারো বা তের। অভিভাবকদের ইচ্ছাতেই এই বিয়ে হয়েছিল। আত্মজীবনীতে তিনি সন্তানদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি উল্লেখ করেছেন শেখ হাসিনার কথা। রোজনামচায় সবচেয়ে বেশি বলেছেন রাসেলের কথা।  শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ আর শেখ রাসেল কনিষ্ঠ পুত্র। তাই একটু বেশি উল্লেখ করাই স্বাভাবিক।

বঙ্গবন্ধু ১৯৬৭ থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত কারাগারে বন্দি অবস্থায় এই অমূল্য জীবনী রচনা করেন। তাঁর লিখিত স্মৃতিকথা ২০১২ সালের ১৮ জুন বাংলায় ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ নামে প্রকাশিত হয়। বইটির প্রথম প্রকাশনার সার্বিক দায়িত্বপালন, তত্ত্বাবধান ও কার্যক্রম পরিচালনা করেন বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। বইটি প্রকাশ করে ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড (ইউপিএল)। বাংলার পাশাপাশি ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’র ইংরেজি অনুবাদ ‘আন ফিনিসড মেমোরিজ’ শিরোনামে প্রকাশিত হয়। বইটির ইংরেজি অনুবাদ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক ড. ফকরুল আলম।

ইংরেজি ভাষায় ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ প্রকাশের পর প্যারিস থেকে বইটি ফরাসি ভাষায় প্রকাশিত হয়। অনুবাদ করেন প্রফেসর ফ্রান্স ভট্টাচারিয়া। পাদটীকা লিখেছেন ইনালকোতে বাংলা ভাষা ও সভ্যতার শিক্ষক জেরেমি কদ্রন। চীনা ভাষাতেও অনূদিত হয়েছে ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’। চীনের সাবেক রাষ্ট্রদূত চাই শি বইটির অনুবাদ করেন। হিন্দি ভাষাতেও অনূদিত অসমাপ্ত আত্মজীবনী। ২০১৬ সালের ১১ ডিসেম্বর আরবি ভাষায় অনূদিত বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে তুলে দেন ফিলিস্তিনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. রিয়াদ এন.এ. মালকি। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’র জাপানি অনুবাদ করেন জাপান ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশনের (এনএইচকে) বাংলা বিভাগের কাজুহিরো ওয়াতানাবে। জাপানের প্রকাশনা সংস্থা আশাহি সোতেন বইটি প্রকাশ করে। এছাড়া স্প্যানিশ এবং উর্দু ভাষায়ও বইটি অনূদিত হয়েছে।

বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনী অসমাপ্ত, পরিপূর্ণ নয়।  বিভিন্ন রাষ্ট্রনায়ক আত্মজীবনী লিখেছেন। মহাত্মা গান্ধীর আত্মজীবনীর নাম ‘দ্য স্টোরি অফ মাই এক্সপেরিমেন্টস উইথ ট্রুথ।’  জিন্নাহ, গান্ধী, নেহরু, সোহরাওয়ার্দী এসব নেতাদের বিলেতি ডিগ্রি ছিল। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কোনও বিলেতি ডিগ্রি ছিল না। কিন্তু সবার  লেখা আত্মজীবনী ছাপিয়ে উঠেছে বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী। ঘটনার একেবারে গভীরে গেছেন তিনি, তুলে এনেছেন খুঁটিনাটি বিষয়। ভবিষ্যৎ দেখার চোখ ছিল অবারিত।  লেখার দক্ষতা, সক্ষমতা আর কুশলীপণায় অনন্য মাত্রা পেয়েছে তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনী। বইটি গভীর মনোযোগ এবং সময় নিয়ে পড়া উচিত। বইটিকে বাংলাদেশের রাজনীতির বিশ্বকোষ বললেও অত্যুক্তি হবে না। তিনি যেভাবে লিখেছেন তাতে মনে হয়েছে, তিনি যেন আগাগোড়াই লেখক। কোনোদিনই অন্য কিছু করেননি। এমনই তাঁর লেখার হাত ও পরিপক্কতা। লেখার প্রয়োজনে অনেক রাজনৈতিকের নাম এসেছে। খন্দকার মোশতাকের সম্পর্কেও কথা বলা আছে! আছে তাঁর রাজনৈতিক গুরু সোহরাওয়ার্দি সাহেবের কথা। প্রাণের আবেগ দিয়ে  তাঁর কথা  লিখেছেন বঙ্গবন্ধু। ভাষা আন্দোলনের সময় তাঁর নিজের ভূমিকা কথাও স্পষ্ট করে লেখা আছে । 

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৯৭তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে বাংলা একাডেমি প্রকাশ করে তাঁর দ্বিতীয় গ্রন্থ ‘কারাগারের রোজনামচা’। ১৯৬৬ থেকে ১৯৬৮ কালপর্বের কারাস্মৃতি এ বইটিতে স্থান পেয়েছে। ১৯৬৯ সালে বঙ্গবন্ধুকে কারাগার থেকে মুক্তি দেয় পাকিস্তান সরকার। মুক্তি দেবার সময় শাসকরা কারাগারে লেখা তাঁর দুটি এক্সারসাইজ খাতা জব্দ করে। ২০০৯ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগে এবং পুলিশের বিশেষ শাখার সহায়তায় খাতা দুটি উদ্ধার করা হয়। তার একটি খাতার গ্রন্থরূপ প্রকাশিত হয় বাংলা একাডেমী কর্তৃক। নাম ‘কারাগারের রোজনামচা’।

‘কারাগারের রোজনামচা’ ডায়েরির মতো করে লেখা। তাই নাম দেয়া হয়েছে রোজনামচা। তবে ডায়েরিটা তথাকথিত ডাইরির মতো করে লেখা নয়। যেন একটি  উপন্যাস । জেলখানার জীবনের নিখুঁত বর্ণনা  আছে বইটিতে। এত নিখুঁত বর্ণনা কোনও রিপোর্টারের পক্ষেও  দেয়া সম্ভব না। বঙ্গবন্ধু  অবশ্য তাঁর রাজনৈতিক জীবনের শুরুতে সাংবাদিকতাও করেছেন। ১৯৪৫-৪৬ সালের দিকে মুসলিম লীগের প্রগতিশীল অংশের কাগজ ‘সাপ্তাহিক মিল্লাাত’-এ লিখতেন তিনি। ইত্তেহাদ এবং ইত্তেফাকে অনিয়মিতভাবে লিখেছেন । ১৯৫৬ বা ১৯৫৭ সালের দিকে সাপ্তাহিক ‘নতুন দিন’ নামে একটি পত্রিকাও বের করেছিলেন । তিনি ছিলেন প্রধান সম্পাদক এবং কবি জুলফিকার ছিলেন সম্পাদক। কাজেই লেখালিখি বঙ্গবন্ধুর জীবনে নতুন নয়।

 ১৯৬৬ সালে ঐতিহাসিক ছয় দফা উত্থাপনের পর বারবার গ্রেফতার হন তিনি। কারান্তরীণ  অবস্থায়  নিয়মিত ডায়েরি লেখা শুরু করেন। বঙ্গবন্ধুর জেল-জীবন, জেল-যন্ত্রণা, কয়েদীদের অজানা কথা, অপরাধীদের কথা, কেন তারা এই অপরাধ জগতে পা দিয়েছিল- সেসব বিষয় কারাগারের রোজনামচায় যেমন উঠে এসেছে একই সাথে আছে তখনকার রাজনৈতিক পরিস্থিতি, কারাগারে আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের দুঃখ-দুর্দশা, গণমাধ্যমের অবস্থা, শাসকগোষ্ঠীর নির্মম নির্যাতন, ৬ দফাকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা, ষড়যন্ত্র, বিশ্বাসঘাতকতার কথা। লিখতে লিখতে তিনি ফিরে গেছেন ভাষা আন্দোলনের শুরুতে, কখনো রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে গড়ে ওঠা সেই মহৎ সংগ্রামের দিনটিতে। বর্ণনা করেছেন সেই সংগ্রামে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগের বীরত্বব্যঞ্জক ভূমিকার কথা। রাজনীতি সংগ্রামের কথা যেমন আছে তেমনি আছে প্রকৃতিপ্রেম, পিতৃ-মাতৃভক্তি, কারাগারে পাগলদের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না সংবেদনশীলতার কথা।  

বইটিতে বঙ্গবন্ধুর বিভিন্ন স্মৃতিচারণে  বার বার এ কথাই উঠে এসেছে যে, তিনি দেশ ও জনগণের স্বার্থে রাজনীতি করেছেন। বাঙালির চরিত্র বিশ্লেষণ করতে গিয়ে কখনো তাদের ‘বীরের জাত’ আবার কখনো ‘পরশ্রীকাতর’ বলেছেন। বাঙালি অন্যের দুঃখে ব্যথিত হয়, আবার অন্যের ভালো দেখতে পারে না। কিছু বাঙালি ছিল সবসময়ই বিশ্বাসঘাতক। বাঙালি জাতির স্বার্থ ভুলে নিজেদের ক্ষতি করেছে, ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য ভিনদেশিদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিল।

অন্ধকার কারাগারের একদিকে উঁচু প্রাচীর। পাশের সেলে থাকেন সত্তর জন পাগল। শাসকগোষ্ঠীর মানসিক নির্যাতন, পরিবার-পরিজন ছাড়া একাকী জীবনে তাঁর সাথী ছিল ‘প্রকৃতি’ আর ‘বই’। কারাগারে বসে শহীদুল্লা কায়সারের ‘সংশপ্তক’ পড়েছিলেন।  বন্দী অবস্থায় বঙ্গবন্ধু নিঃসর্গের অপরূপ বর্ণনা দিয়েছেন তাঁর রোজনামচায়। একজোড়া হলুদ পাখির জন্য তাঁর ব্যাকুলতা আমাদেরও ব্যাকুল করে।

বঙ্গবন্ধু ছিলেন একজন মানবিক নেতা । তাঁর সংস্পর্শে এসে একজন কুখ্যাত ‘চোর’  তার জীবন বদলে ফেলেছিল। জেলে  থেকেও তিনি মানুষের জন্য কাজ করেছেন ক্লান্তিহীন। একজন চোরের জীবন বদল, আলোর পথে ফেরা সেকথাই বলে। লেখার ব্যাপারে আন্তরিক ও দায়িত্বশীল ছিলেন বঙ্গবন্ধু। বইটি পড়তে গিয়ে পাঠক যেন কোন রকম শব্দ-বিভ্রান্তিতে না পড়ে সেদিকে  তাঁর খেয়াল ছিল। তিনি কারাগারের প্রচলিত শব্দগুলোর অর্থ ঘটনার বিবরণীর মধ্য দিয়ে তুলে ধরেছেন আগেই। তাঁর লেখার  মাধ্যমে জেলখানায় ব্যবহৃত নানাবিধ শব্দের সঙ্গে আমরা পরিচিত হতে পেরেছি। বিভিন্ন প্রবাদ-প্রবচনও ব্যবহার করেছেন তিনি।

দিনলিপিতে বাংলা বা বাঙালিত্বের প্রতি বঙ্গবন্ধুর প্রগাঢ় ভালোবাসার প্রকাশ ঘটেছে। দেশ সমাজের জন্য তাঁর ভাবনা, কান্না প্রকাশিত হয়েছে প্রতিটি চরণে। আমরা এক নিঃসঙ্গ বঙ্গবন্ধু, একাকী লেখককেও পেয়েছি দারুণভাবে।

 জেলখানার ভালো মন্দ নানা ঘটনা লিখেছেন তিনি। কারাগারের রোজনামচার ৪৩-৪৪ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, ‘দুপুর বেলা দেখা এক মওলানা সাহেবের সঙ্গে, কোরানে হাফেজ, তাঁর বাবাও খুব বড় পীর ছিলেন, কুমিল্লায় বাড়ি। হাজতিদের মধ্যে নামাজ পড়বার আগে বক্তৃতা করছেন, ওয়াজ করছেন, হাজতিরা বসে শুনছে। আমি দূরে দাঁড়াইয়া তাঁর বক্তৃতা শুনছি। তিনি বলছেন খুব জোরে ‘দরুদ শরীফ’ পড়। শয়তান দূর হয়ে যাবে। জোরে পড়। অনেকক্ষণ বক্তৃতা করলেন; সুন্দর চেহারা, অল্প বয়স, চমৎকার বলার কায়দা। তবে জামাটা খুব বড়। ওটা দেখেই মনে সন্দেহ হলো। একদম পা পর্যন্ত জামা। বোধহয় ছয় সাত গজ হবে কমপক্ষে। তসবি হাতেই আছে। মাঝে মাঝে চক্ষু বুজে কথা বলেন।’

জিজ্ঞাসা করলাম, ‘এই মওলানা সাহেব কি মামলায় এসেছেন।’ আমাকে এক ‘পাহারাদার’ বললো, ‘জানেন না, রেপ কেস’; একটা ছাত্রীকে পড়াতো, তার ওপর পাশবিক অত্যাচার করেছে, মসজিদের ভিতর। মেয়েটার ১২/১৩ বৎসর বয়স, চিৎকার করে উঠলে লোক এসে দেখে ফেলে। তারপর ধরে আচ্ছামতো মারধর করে। জেলে এসে কয়দিন তো হাসপাতালেই থাকতে হয়েছে। আমি বললাম, ‘হাজতে এসে ধর্ম প্রচার শুরু করেছে। ব্যাটা তো খুব ভন্ড। জমাইছে তো বেশ।’

 রোজনামচায় বঙ্গবন্ধুর রসবোধের পরিচয়ও মেলে। ‘ইন্দোনেশিয়াকে পাকিস্তানের আপন মায়ের পেটের ভাই’ বলে অভিহিত করেছেন তিনি।  জেলখানায় কঠোর নজরদারিতে থাকতেন। কিন্তু তাঁর কৌতুকপ্রিয়তাকে দমিয়ে রাখা যায়নি। তিনি লিখেছেন, ‘আমার অবস্থা হয়েছে, ‘পর্দানসিন জানানা’র মতো কেউ আমাকে দেখতেও পারবে না, আমিও কাউকে দেখতে পারব না। কেউ কথা বলতে পারবে না, আমিও পারব না।’

কারা-জীবনে সীমাহীন নির্যাতন, কষ্ট, অপমান, অবহেলা সহ্য করেছেন।  বাইরে তাঁর পিতা-মাতা, সন্তানেরা, স্ত্রী দুঃখ কষ্ট অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে সময় পার করেছেন। বঙ্গবন্ধুর পরিবারকে বিভিন্ন সময়ে আর্থিক সংকটে পড়তে হয়েছে। তবে সব সামলে নিয়েছেন তা যোগ্য সহধর্মিনী । তাই তাঁর পক্ষে অবিমিশ্র মনোযোগ  দেয়া সম্ভব হয়েছে রাজনীতিতে। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ ও ‘কারাগারের রোজনামচা’ বইয়ের পাতায় পাতায়   প্রকাশিত হয়েছে সহধর্মিনী ফজিলাতুন্নেসার প্রতি তাঁর গভীর ভালোবাসা, আস্থা, বিশ্বাস ও নির্ভরতার কথা।

এ বইটি পড়ে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনের বাধা-বিপত্তি, ঘাত-প্রতিঘাত, ষড়যন্ত্র, বিশ্বাসঘাতকতা, রক্তক্ষরণ সম্পর্কে জানা যায় হৃদয় দিয়ে।  আমাদের জন্য একটি স্বাধীন দেশ আনার সংগ্রামে নিজের জীবন- যৌবন উজাড় করে দিয়েছিলেন তিনি। তাঁর সে আত্মত্যাগের দলিল এই বই দুটি। তিনি নিজের ত্যাগের কথা বলেননি।  তবে ইতিহাসের মহানায়ককে বাদ দিয়ে ইতিহাস রচিত হয় না। তাই তাঁর ত্যাগী আর নিঃস্বার্থতার পরিচয়  উঠে এসেছে বইয়ের পাতায়-পাতায়, প্রতিটি শব্দে-বাক্যে। তিনি রোজনামচায় তারিখ এবং বার উল্লেখ করেছেন।

বঙ্গবন্ধুর তৃতীয় বই ‘আমার দেখা নয়াচীন’। বইটির প্রকাশক বাংলা একাডেমি। বঙ্গবন্ধু ১৯৫২ সালের অক্টোবর মাসে চীন ভ্রমণ করেছিলেন। সে কাহিনি তিনি লিখেছিলেন ১৯৫৪ সালে, তিনি যখন কারাগারে। তাঁর লেখা এ খাতার ওপর গোয়েন্দা সংস্থার সেন্সর ও কারাগার কর্তৃপক্ষের যে সিল দেওয়া আছে, তা দেখেই সময়কাল জানা  গেছে।

বইটি পড়লে বঙ্গবন্ধুর দূরদর্শীতার প্রমাণ পাওয়া যায়। বোঝা যায় তিনি যুগের তুলনায় কতটা অগ্রসর ছিলেন। তিনি পিকিংয়ে শান্তি সম্মেলনে কেন যোগ দিতে আগ্রহী হয়েছিলেন, সে যাত্রায় কতটা বাধা-বিপত্তির সম্মুখীন হয়েছিলেন তার বর্ণনা আছে আমার দেখা নয়াচীনে । বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘দুর্ভিক্ষ মহামারি সমস্ত দেশকে গ্রাস করবে। তাই মানুষের মঙ্গলের জন্য, পাকিস্তানের স্বার্থের জন্য- যুদ্ধ চাই না, শান্তি চাই। ঠিক করলাম শান্তি সম্মেলনে যোগদান করতে হবে। আমাদের পূর্ব বাংলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি, জনাব আতাউর রহমান খান, ইত্তেফাক সম্পাদক তফাজ্জল হোসেন, যাকে আমরা সকলে ‘মানিক ভাই’ বলি, বন্ধুবর খোন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস আর ইউসুফ হাসান এবং আমি, এই পাঁচজন যাবো ঠিক হলো।’

তখন চীনে কমিউনিস্ট পার্টির নতুন সরকার এসেছে।  সেসব অভিজ্ঞতার বর্ণনা আছে বইটিতে। নামে মনে হয় এটি একটি ভ্রমণকাহিনি। কিন্তু ভ্রমণের পাশাপাশি রাজনীতি, অর্থনীতি,  বৈষম্য,  চীনের সামাজিক  বৈচিত্র্য,  বৈদেশিক সম্পর্ক, বৈশ্বিক পরিবেশ সবই উঠে এসেছে।  এ বইটিতেও তাঁর প্রকৃতি প্রেমের পরিস্ফুটন ঘটেছে।  বর্ণনায় তিনি নিখুঁত। ব্যক্তির  ক্ষেত্রে নাম পরিচয়সহ কথাবার্তার নিখুঁত বর্ণনা মুগ্ধ হওয়ার মতো। চীন যাওয়ার পথে রেঙ্হুন এবং হংকংয়ের গিয়েছিলেন তিনি। সে বর্ণনা মনোমুগ্ধকর। 

 বার্মা  সম্পর্কে তিনি লিখেছেন, ‘ব্রহ্মদেশের অবস্থা খুবই খারাপ। বিপ্লবীরা বহু স্থান দখল করে আছে। আর মাঝে মাঝেই রেঙ্গুন শহরের পানি বন্ধ করে দেয়। আর একটা ভয়াবহ খবর পেলাম, ‘ব্যান্ডিটরা’ দিনে দুপুরে ডাকাতি করে। ভয়েতে দিনের বেলায়ও কেউ জানাশোনা মানুষ না হলে দরজা খোলে না।’  

তিনি রেঙ্গুনস্থ পাকিস্তানের বাঙালি এক  রাষ্ট্রদূতের বর্ণনা দিয়েছেন। এ রাষ্ট্রদূত আর তার আত্মম্ভরিতা, অহমিকাবোধ সিংহভাগ রাষ্ট্রদূতদের প্রতিমূর্তি।

বিনয়ী বঙ্গবন্ধু ‘আমার দেখা নয়াচীন’-এ বলেন, ‘আমি লেখক নই, আমার ভাষা নাই, তাই সৌন্দর্যটা অনুভব করতে পারছি, কিন্তু গোছাইয়া লেখতে পারি না। পাঠকবৃন্দ আমায় ক্ষমা করবেন।’ কিন্তু বঙ্গবন্ধুর মতো সহজ সরল ঝরঝরে ভাষার এমন বেগময় বর্ণনা খুব কমই পাওয়া যায়। লেখার মধ্যে রস মেশানোর অসাধারণ  কৌশলে তিনি অনেক প্রতিষ্ঠিত লেখককেও হার মানিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর সব লেখাতেই আঞ্চলিক শব্দের ব্যবহার এবং সাধু-চলিতের মিশ্রণ  আছে। কিন্তু  মজার ব্যাপার হচ্ছে, সে আঞ্চলিকতা বা মিশ্রণ কখনই পড়াকে বাধাগ্রস্ত করে না। মনে হয় এখানে যেন এমনটাই হবার কথা ছিল।

বঙ্গবন্ধুর রসবোধের কথা বার বার আলোচনায় আসছে। হংকং সফরসঙ্গী সাবেক প্রধানমন্ত্রী আতাউর রহমান খানের সঙ্গে একজন তরুণীর  ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘আতাউর রহমান সাহেব, মানিক ভাই, ইলিয়াস ও আমি রাস্তায় বেড়াতে বেরিয়েছি। হঠাৎ ১৬/১৭ বৎসরের একটা মেয়ে আতাউর রহমান সাহেবের কোটে একটা গোলাপ ফুল লাগাইয়া দিতে অগ্রসর হয়। মেয়েটি কলারে হাতও দিয়াছে, খান সাহেব হঠাৎ যেন চমকাইয়া উঠলেন। পরে ধাক্কা দিয়া ফুল ছুড়ে ফেলে রাগে ঘোঁত ঘোঁত করতে করতে এগিয়ে চললেন। মেয়েটা আশ্চর্য হয়ে দূরে দাঁড়িয়ে রইল। আমরা জিজ্ঞাসা করলাম, আমাদের মতো যুবকদের দিকে নজর না পড়ে আপনার ওপর পড়ার কারণ কী? আতাউর রহমান সাহেব তো রাগে অস্থির, আর মানিক ভাই তো তাঁর ‘রাজনৈতিক মঞ্চের’ মতো ঘুরাইয়া ফিরাইয়া ওনার পিছনে লাগলেন। আমরা খুব হাসাহাসি শুরু করলাম। বেচারা ভদ্রলোক রাগে শোকে দুঃখে কথা বলেই যেতে লাগলেন। হংকংয়ে ফুল দেওয়াটা হলো ‘প্রেম নিবেদন’। ফুলটা গ্রহণ করলে ওরা মনে করবে আপনি তার সাথে যেতে রাজি হয়েছেন। আপনাকে হাত ধরে সাথে করে ওদের জায়গায় নিয়ে যাবে।’

এই সফরকালে বিদেশিদের কাছে নিজের দেশকে খাটো না করার  বা মুসলিম লীগ সরকার সম্পর্কে কোনও বদনাম না করার নীতি গ্রহণ করেছিলেন বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর সফরসঙ্গীরা। যদিও বঙ্গবন্ধু তাঁর পাসপোর্ট পাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তার মধ্যে ছিলেন চীনযাত্রার শেষ দিন পর্যন্ত।

সাহিত্যিক হিসেবে জায়গা করে নেয়ার জন্য লেখেননি বঙ্গবন্ধু। সময়ের প্রয়োজনে লিখেছেন।  বাংলা ভাষার প্রতি তাঁর অকৃত্রিম ভালবাসার প্রকাশ পেয়েছে ‘আমার দেখা নয়াচীনে’।

বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘আমি বক্তৃতা করলাম বাংলায়, আর ভারত থেকে বক্তৃতা করলেন মনোজ বসু বাংলা ভাষায়। বাংলা আমার মাতৃভাষায় বক্তৃতা করাই উচিত। কারণ পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলনের কথা দুনিয়ার সকল দেশের লোকই কিছু কিছু জানে। মানিক ভাই, আতাউর রহমান খান ও ইলিয়াস বক্তৃতাটা ঠিক করে দিয়েছিল। দুনিয়ার সকল দেশের লোকই যার যার মাতৃভাষায় বক্তৃতা করে। শুধু আমরাই ইংরেজি ভাষায় বক্তৃতা করে নিজেদের গর্বিত মনে করি।’

‘আমার দেখা নয়াচীন’ বইয়ে অনেক  বিষয় এবং তার ব্যাখ্যা সহজ সরল ভাষায় দেয়া হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর শিশুদের নিয়ে ভাবনার কথা আছে বইটিতে। বইটি পড়লে তৎকালীন নয়াচীনের সার্বিক অবস্থা, মালিক-শ্রমিক সম্পর্ক, চীনের রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে বিশদ ধারণা পাওয়া যাবে।   

বই তিনটি ব্যতিক্রম। বইগুলি কল্পনাশ্রয়ী নয়। একজন মানুষের জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ের প্রতিচ্ছবি এ বইগুলি । বঙ্গবন্ধুর এ বইগুলি জাতির জন্য অমূল্য সম্পদ। বইগুলি বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের সঠিক উৎস। বাঙালির  জেগে ওঠার কালপর্বের দলিল। 

এমন একজন মহান সাহিত্যিকের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই।

আফরোজা পারভীন
আফরোজা পারভীন
%d bloggers like this: