মেডুসা – মাস্টার ডেভিট

মেডুসা - মাস্টার ডেভিট

গ্রীক পৌরাণিক কাহিনীর সবচেয়ে আলোচিত চরিত্রগুলোর একটি মেডুসা। যিনি কোনো ঈশ্বরী নয় বরং একজন অভিশপ্ত নারী ছিলেন। মেডুসার কাহিনী গ্রিক দেবতাদের নিষ্ঠুরতার কথা বর্ণনা করে। অভিশপ্ত মেডুসার মাথায় চুলের পরিবর্তে ছিল বিষাক্ত সাপ এবং তার দৃষ্টিতে ছিল পাথরে পরিণত করার ক্ষমতা। কিন্তু ভয়ংকর এই দানবীয় দানবে পরিণত হবার ঘটনাটি হৃদয়বিদারক।

মেডুসার পরিচয়

তিন দৈত্য বোনের মধ্যে মেডুসা ছিলেন সবচেয়ে বিখ্যাত। তিন বোন স্টেনো, ইরিয়ালে এবং মেডুসা। পিতামাতা ছিলেন ফর্সি এবং সিটো। পুরাণ অনুযায়ী তাদের পিতামাতাও ছিলেন দানব। আবার অন্য সূত্র অনুযায়ী তারা ছিলেন সমুদ্রের দেবতা। তারা দুনিয়ার শেষ প্রান্তে এক সাগরে থাকতেন। মেডুসার অন্য বোনেরা অমর হলেও তিনি ছিলেন সাধারণ একজন নারী। অন্য বোনেরা দানবী হয়ে জন্ম নিলেও মেডুসা ছিলেন অসাধারণ সুন্দরী।

কেন মেডুসা অভিশপ্ত হয়েছিলেন?

মেডুসা প্রজ্ঞা ও যুদ্ধের কুমারী দেবী এথেনার একজন ভক্ত ছিলেন। সারা জীবন এথেনার আরাধনায় কাটিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। মেডুসা এতোটাই রূপসী ছিলেন যে তাকে দেবী এথেনার রূপের সাথে তুলনা করা হতো। তাকে সবাই বিয়ে করার জন্য ব্যাকুল ছিল। কিন্তু কুমারী দেবী এথেনার ভক্ত হওয়ার শর্ত ছিল ভক্তকে অবশ্যই কুমারী হতে হবে এবং দেবীর জন্য তার জীবন বিসর্জন দিতে হবে।

একদিন সমুদ্রের দেবতা এবং এথেনার প্রতিদ্বন্দ্বী পোসেইডন মেডুসাকে দেখে তার প্রেমে পড়ে যায়। বারবার প্রস্তাব দেওয়ার পর প্রত্যাখ্যাত হয়ে পোসেইডন রেগে গিয়ে মেডুসাকে ধর্ষণ করে মন্দিরের সিঁড়িতেই। এভাবে মন্দির অপবিত্র করে এথেনাকে অপমান করাও হয় আবার তার অভিসন্ধিও পূরণ হয়। কার্যসিদ্ধির পর সমুদ্র দেবতা পোসেইডন মেডুসাকে মন্দিরে ফেলে রেখে চলে যায়।

এ ঘটনায় দেবী এথেনা প্রচণ্ড রেগে যায়। কিন্তু সমুদ্র দেবতা পোসেইডনকে শাস্তি দেওয়ার ক্ষমতা তার ছিল না। তাই তিনি মেডুসাকে শাস্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। মেডুসা দেবীর কাছে ক্ষমা ভিক্ষা করে। মেডুসা তখন অন্তঃসত্ত্বা। এথেনা রাগে অন্ধ হয়ে মেডুসাকে অভিশাপ দিলেন।

তার কোমল গায়ের চামড়া হয়ে গেল সাপের মতো। কোমর থেকে নিচ পর্যন্ত হয়ে গেল সাপের মতো। মেডুসার সবচেয়ে আকর্ষণীয় ছিল তার চুল। দেবী এথেনার অভিশাপে মাথায় চুলের পরিবর্তে বিষাক্ত সাপে ভরে যায়। আর তার মায়াবী চোখে ভয়াবহ শীতলতা এসে ভর করে। শুধু তাই নয় কেউ মেডুসার চোখের দিকে তাকালে তৎক্ষণাৎ পাথরে পরিণত হয়ে যেত যে কেউ।

অভিশপ্ত মেডুসা একটি দ্বীপে নির্বাসিত হন। যেখানে তিনি একা থাকতন এবং যারা সেখানে যেত তারা যেতো শুধু মেডুসাকে হত্যা করার জন্য। মেডুসা ভয় নিয়ে তাদের দিকে তাকাতেন এবং পাথরে পরিণত হতে দেখতেন। তার ক্ষমতা নিয়ে তিনি ভীত ছিলেন এবং তাকে অভিশপ্ত করার জন্য দেবতাদের উপর রুষ্ট ছিলেন। যে ঐ দ্বীপে পা রাখতো তাকেই ক্রোধান্বিত মেডুসা পাথরে পরিণত করতেন।

মেডুসা এবং পার্সিয়াসের কিংবদন্তী

পার্সিয়াস ছিল আর্গোসের রাজা অ্যাকিসিয়াস কন্যা দানিয়া ও জিউসের পুত্র। অর্থাৎ পার্সিয়াস ছিল অর্ধ দেবতা। অ্যাকিসিয়াস জানতে পেরেছিল তার দৌহিত্রের হাতে তার মৃত্যু হবে। তাই কন্যাকে আটকে রেখেছিলেন তিনি। কিন্তু দানিয়া স্বয়ং জিউসের মাধ্যমে পুত্র লাভ করে। অ্যাকিসিয়াস জিউসের ভয়ে হত্যা না করে শিশুপুত্রসহ  দানিয়াকে সমুদ্রে ভাসিয়ে দেয়।

ডিক্টিস তাদের উদ্ধার করে।সেরিফাস দ্বীপে নিয়ে গিয়ে পার্সিয়াসকে নিজ পুত্রের মতো বড় করে। সেরিপাসের রাজার মনে পার্সিয়াসের মাকে বিয়ে করার এক গোপন অভিসন্ধি ছিল। কিন্তু ছেলে পার্সিয়াস বাধা হয়ে দাড়ায়। তাই কৌশলে পার্সিয়াসকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য তাকে পাঠানো হয় মেডুসাকে হত্যা করে তার মাথা নিয়ে আসার জন্য।

পার্সিয়াসের জন্য এটি ছিল আত্মহত্যার সমতুল্য। কিন্তু জিউসের পুত্র হিসেবে পার্সিয়াস হাদিসের থেকে অদৃশ্য হওয়ার ক্যাপ, হার্মিসের থেকে উড়ন্ত জুতা, এথেনার থেকে ব্রোঞ্জের ঢাল এবং হেফাস্তাসের থেকে তরবারি লাভ করে মেডুসাকে হত্যা করার জন্য।

ব্রোঞ্জের ঢালে প্রতিবিম্ব দেখে ঘুমন্ত মেডুসার মাথা ধড় থেকে আলাদা করে হত্যা করে পার্সিয়াস। অন্তঃসত্তা মেডুসা মারা যাওয়ার সময় পাখাওয়ালা ঘোড়া পেগাসাসকে জন্ম দেয়। মেডুসাকে হত্যা করে পার্সিয়াস অদৃশ্য হওয়ার টুপি ও উড়ন্ত জুতার সাহায্যে পালিয়ে আসে।

লিবিয়ার সমভূমিতে মেডুসার রক্তের প্রতিটি ফোঁটা বিষাক্ত সাপে পরিণত হয়। মেডুসার মাথা ব্যবহার করে পার্সিয়াস রাজকুমারীকে উদ্ধার করতে সক্ষম হন, যিনি প্যাসিডনের প্রেরিত দানব থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য উৎসর্গিত হচ্ছিলেন। মেডুসার মাথা বিভিন্ন সময় যুদ্ধে ব্যবহার করেছে পার্সিয়াস। শেষমেশ পার্সিয়াস মেডুসার মাথা এথেনাকে উপহার দেন। যখনই তিনি যুদ্ধে যেতেন দুর্ভেদ্য ঢাল হিসেবে মেডুসার মাথা নিয়ে যেতেন সাথে।

মেডুসাকে সাধারণত দানবী হিসাবে গণ্য করা হলেও তার মাথা প্রায়শই প্রতিরক্ষার জন্য ব্যবহার করা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে, মেডুসা নামটি একটি প্রাচীন গ্রিক শব্দ যার অর্থ ‘সুরক্ষা বা রক্ষা করা’। মেডুসা এমন একজন নারী চরিত্র যিনি দুর্ভাগ্যের শিকার হয়ে ভয়ংকর দানবে পরিণত হয়েছিলেন। দুর্বল নারী লালসার শিকার হয়েও দেবী এথেনার রোষের শিকার হন, পরিণত হন দানবীতে। মৃত্যুর পরও রক্ষার ধর্ম পালন করেছেন নারীর স্বভাবজাত নিয়মে।

মেডুসা কিছুদিন আফ্রিকাতেও বিচরণ করেছিলেন। অনেকের মতে, মেডুসা যখন সেখানে ছিলেন তখন তাঁর মাথা থেকে বাচ্চা সাপ পড়ে যায় এবং সেজন্যই মিথ আছে আফ্রিকা পৃথিবীর অন্যতম ভয়ানক বিষধর সাপের আখড়া।

অনেক শিল্পী মেডুসাকে নিয়ে তাদের শিল্পকর্ম তৈরি করেছেন।

মেডুসাকে নিয়ে বিখ্যাত শিল্পী লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি ক্যানভাসে একটি অয়েল পেইন্টিং করেছিলেন।

মার্বেল এবং ব্রোঞ্জের ভাস্কর্য রয়েছে মেডুসার।

পম্পেইস হাউজ অফ দ্য ফন-এ আলেকজান্ডার মোজাইকে আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট-এর একটি বুকের বর্ম পাওয়া যায় যেখানে মেডুসার প্রতিকৃতি দেখা যায়।

চেক প্রজাতন্ত্রের দোহালিস গ্রামের পরিচায়ক চিহ্নে মেডুসার মাথা চিত্রিত ছিলো।

সিসিলি’র পতাকা এবং প্রতীকেও মেডুসার মাথার বৈশিষ্ট্য ছিলো।

সাপের দুইটি প্রজাতি তাঁর নামে রাখা হয়েছে। যথাঃ ভেনমাস পিটভাইপার বোথ্রিওপসিস মেডুসা এবং অ্যাট্রাকটাস মেডুসা।

মেডুসা দর্শন, সৌন্দর্য এবং শিল্পের প্রতিনিধিত্ব করে।

প্রাচীন পুরাণ রচনা থেকে শুরু করে আধুনিক সাহিত্য রচনায় মেডুসা ছিলেন কবি সাহিত্যিকদের এক প্রেরণার নাম।

অনেক স্থাপত্য আর প্রাচীন মুদ্রায় স্থান পেয়েছেন মেডুসা।

ইতালির ফ্লোরেন্স শহরের প্রধান নগরচত্বরে পার্সিউস এবং মেডুসার বিখ্যাত স্থাপত্য কর্মটি দেখা যায়।

ইতালির বিখ্যাত ফ্যাশনব্র্যান্ড ভার্সাচি-এর লোগোতেও ব্যবহৃত হয়েছে মেডুসার মাথা।

মেডুসা মিথ নিয়ে আলাদা আলাদা সংস্করণ শোনা যায়।

মেডুসা মিথের প্রায় প্রত্যেকটা সংস্করণে পাওয়া যায় যে, সেরিফাস দ্বীপের রাজা পলিডেক্টেস গ্রীক ডেমি-গড পার্সিয়াসকে পাঠিয়েছিলো তাঁর মাথা নিয়ে ফেরত আসার জন্য।

মেডুসাকে বিনাশ করার জন্য পার্সিয়াসকে হার্মিস দিয়েছিলো ডানাযুক্ত জুতা আর তরবারি, অ্যাথেনা দিয়েছিলো আয়নাযুক্ত বর্ম।

পার্সিয়াস ডানাযুক্ত জুতায় উড়ে অ্যাথেনার দেওয়া বর্মে মেডুসার প্রতিকৃতি দেখতে দেখতে হার্মিসের তরবারি দিয়ে মেডুসার গলা কেটে ফেলে।

তারপর উপহার পাওয়া ওয়ালেটে মেডুসার মাথা ঢুকিয়ে জাদুর টুপি পড়লেন য্যানো অন্য দুই বোন তাকে দেখতে না পায়।

রিক রোর্ডানের বেস্ট সেলিং পার্সি জ্যাকসন সিরিজটি আসলে পার্সিয়াসের থেকে অনুপ্রাণিত। প্রথম বইটি তো পুরোপুরিই পার্সিয়াসের মিথের ছায়া, মেডুসাও আছে সেখানে। এই গল্প নিয়ে একটা সিনেমাও আছে, “percy jackson and the lightning thief” ।

নারীবাদে উল্লেখ আছে, মেডুসা ক্রোধের প্রতীক হলেও তিনি অতীব সুন্দরী ছিলেন।

দ্বিতীয় অথবা তৃতীয় শতকে একটি রোমান ক্যামেওতে তাঁর মাথার প্রতিকৃতি দেখা যায়।

পসাইডনের সাথে যখন মন্দিরের ভেতর সঙ্গম করেছিল মেডুসা, তখন সে হয়ে পড়েছিল অন্তঃসত্ত্বা।

পার্সিয়াস যখন সমুদ্রের ওপর দিয়ে মেডুসার কাটা মাথা নিয়ে উড়ে আসতে থাকে, তখন সেখান থেকে দু’ফোটা রক্ত পড়ে সমুদ্রের পানিতে। সেখান থেকে জন্ম হয় পেগাসাস নামক এক আশ্চর্য পাখাওয়ালা ঘোড়ার।

পেগাসাসের সঙ্গে আরও একজনের জন্ম হয় তখন, তার নাম ক্রাইসেওর।

মেডুসা গ্রিক পুরাণের সবচেয়ে বিখ্যাত চরিত্রগুলির মধ্যে একটি। এটি প্রমাণিত হয়েছে কারণ মেডুসা পপ সংস্কৃতিতে চিত্রিত হচ্ছে। তিনি কেবল গল্পেই নয় বরং ইতিহাসেও অমর।

মাস্টার ডেভিট
মাস্টার ডেভিট
%d bloggers like this: