মেহেরুন্নেসা: বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামে প্রথম নারী শহিদ কবি / আফরোজা পারভীন
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রথম নারী শহিদ কবি মেহেরুন্নেসা (১৯৪২-১৯৭১)।
মেহেরুন্নেসা আমাদের ইতিহাসের একটি মহান অংশ। স্বাধীনতা সংগ্রামের কথা বললেই মেহেরুন্নেসার কথা চলে আসে। তিনি আমাদের অস্তিত্বের সঙ্গে মিশে আছেন। মেহেরুন্নেসা আমাদের নতুন প্রজন্মকে একটি সুন্দর দেশ ও জীবন দান করে গেছেন।
মেহেরুন্নেসা যুগে যুগে নতুন প্রজন্মের কাছে প্রেরণা হয়ে থাকবেন।
মেহেরুন্নেসা যে সময় আন্দোলন-সংগ্রাম করেছেন, সে সময় একজন নারীর জন্য বিপ্লবী হওয়া, বিপ্লবী কবিতা লেখা খুব সহজ ছিল না। বিপ্লবীরা কখনো মরে না, মেহেরুন্নেসাও মরেননি। তিনি চিরভাস্মর হয়ে থাকবেন আমাদের মাঝে।
মেহেরুন্নেসা ১৯৪২ সালের ২০ আগস্ট পশ্চিমবঙ্গের খিদিরপুরে এক মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা আবদুর রাজ্জাক, মা নূরুন নেসার চার সন্তানের মধ্যে মেহেরুন্নেসা (রানু) দ্বিতীয়। তাঁরা ছিলেন চার ভাইবোন।
তখন অন্য শিশুদের মতো তাঁর স্কুলে যাওয়া হয়নি। মুসলমান মেয়েদের লেখাপড়ার কোন সুযোগ ছিল না তখন। স্কুলে ভর্তি হলেও মুসলমান বলে কয়েক স্কুল থেকে তাঁকে বের করে দেয়া হয়। তাঁর বড় বোন মোমেনা বেগম বিভিন্ন স্কুলে সামান্য পড়াশুনার সুযোগ পেয়েছিলেন। ফলে বাবা এবং বড় বোনের উৎসাহে ঘরে বসে তিনি লেখাপড়া শুরু করেন। স্বশিক্ষায় শিক্ষিত হন তিনি।
মেহেরুন্নেসাদের (কলকাতার) কালিবাজারে কাপড় ও ভবানীপুরে বড় জুতোর দোকান ছিল। দোকানের আয়ে তাঁদের সংসার ভালই চলছিল। সাতচল্লিশের দাঙ্গায় পুড়িয়ে দেয়া হয় দোকান এবং লুট হয়ে যায় বাড়ি। নিঃস্ব হয়ে পড়েন তাঁরা। এসময় জীবিকার জন্য কয়লার দোকানে বাবার সাথে কাজ করতেন শিশু মেহেরুন্নেসা।
বাঙালি মুসলিম পরিবারের মেয়েরা দোকানে কাজ করছে এ দৃশ্যে অভ্যস্ত ছিল না তখন সমাজ। ফলে পাশের দোকানদারসহ অনেকে অবাক হয় মেহেরুন্নেসার এ কাজে। তাঁরা বিরোধীতাও করে। তবে আবদুর রাজ্জাক ছিলেন আধুনিক ও উদার মনের। এটাকে খুব সহজভাবে গ্রহণ করেছিলেন তিনি। তখন থেকেই পেশা, জাতি-ধর্ম-বিত্ত নির্বিশেষে মেহেরুন্নেসা মানবিকতার ঔদার্যে বড় হতে থাকেন। তবে অভাব আর দুর্ভাগ্যের সঙ্গে লড়াই তাঁর শুরু হয় শৈশবে থেকে।
১৯৪৭ সালে বিভক্ত ভারতে সা¤প্রদায়িক দাঙ্গায় সব হারিয়ে নামমাত্র মূল্যে বাড়ি বিক্রি করে সপরিবারে ১৯৫০ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান চলে আসেন মেহেরুন্নেসার পরিবার।
বাংলাদেশে প্রথমে তাঁরা পরিবার পুরানো ঢাকার তাঁতিবাজার এলাকায় একটি ছোট্ট ভাড়া বাসায় ওঠেন। দূর সম্পর্কের এক আত্মীয়ের সহায়তায় আবদুর রাজ্জাক শুরু করেন কাগজের ব্যবসা। এতে সুবিধা না হওয়ায় তিনি নাবিস্কো কোম্পানিতে এবং পরে হক কোম্পানিতে সামান্য বেতনে চাকরি করেন। ১৯৫৪ সালে বড় বোন মোমেনা বেগমের বিয়ের পর মেহেরুন্নেসা বাবাকে সাহায্য করার জন্য শুরু করেন কঠোর পরিশ্রম। সংসার পরিচালনার জন্য তিনি বাংলা একাডেমীতে অনুলিখনের কাজ করতেন। অনেকে ভাল জায়গা থেকে বিবাহের প্রস্তাব এলেও তিনি ফিরিয়ে দেন পরিবারের কথা ভেবে। সাথে ছিল তাঁর কবি প্রতিভা বিকাশের স্বপ্ন । তিনি সাংসারিক দায়িত্বের মধ্যে থেকেই চালিয়ে গিয়েছিলেন কাব্যচর্চা ।
মেহেরুন্নেসার কবি প্রতিভার প্রকাশ ঘটে খুব ছোট বেলায়। কবিতা লেখার ঝোঁক ছিল শৈশব থেকেই। ১৯৫২ সালে মাত্র দশ বছর বয়স থেকেই অসাধারণ প্রতিভার পরিচয় দেন তিনি। ১৯৫৪ সালে খেলাঘরের পাতায় তাঁর প্রথম কবিতা ‘চাষী’ প্রকাশিত হয়। তিনি বড়দের জন্য লেখা শুরু করেন ১৯৫৪ সালে। ‘কাফেলা’ পত্রিকায় প্রকাশিত কবিতায় আমরা অন্য এক মেহেরুন্নেসাকে পাই। ‘রাজবন্দী’ শিরোনামের কবিতায় ‘আমাদের দাবি মানতে হবে, রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’-এর মতো বক্তব্যে জ্বলে ওঠেন তিনি। এর জেরে গোয়েন্দাদের নজরে পড়েন। এ সময় থেকেই তাঁর কবিতা প্রকাশিত হতে শুরু করে ইত্তেফাক, দৈনিক পাকিস্তান, মাসিক মোহাম্মদী, কৃষিকথা, ললনাসহ মূলধারার পত্রপত্রিকায়। এই কবিতা ছাপা হওয়ার পরে পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করতে আসেন। কিন্তু ছোট মেহেরুন্নেসাকে দেখে চলে যান। ওর বাবাকে বলে যান, ওকে লেখা বন্ধ করার জন্য।
মেহেরুন্নেসার রুচি আর ব্যক্তিত্ব ছিল অনুসরণীয়। ছিলেন সুন্দরী। তাঁর কর্ম আর বিশ্বাসের প্রতিফলনই তাঁর কবিতা। প্রথমে তাঁর কবিতায় ফররুখ আহমদ-এর প্রভাব, ইসলামী ভাবধারা, আরবি-ফার্সি শব্দের ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। ‘জাগে মখলুখ জাগে ফুল পাখী জেগেছে স্বর্ণ সুরুজ’ ইত্যাদি। তাঁর বেশিরভাগ কবিতা প্রকাশিত হয় ‘বেগম’ পত্রিকায়। বেগম পত্রিকার সম্পাদক নূরজাহান বেগমের পরামর্শে তিনি স্বদেশ, প্রেম ও প্রকৃতি বিষয়ে আরবি-ফার্সি শব্দের ব্যবহার বর্জন করে কবিতা লিখতে শুরু করেন। ধানের কান্না শুনেছো কখনো তুমি/ ভয়াল প্লাবনে পল্লবিত হয়েছে শত শস্যের ভূমি/ সেই দুর্যোগ দিনেরা যখন একে একে আসে নামি/আমার দেশের জনতা তখন দুর্বার সংগ্রামী।
তিনি রানু আপা নামে ‘পাকিস্তানী খবর’-এর মহিলা মহল পাতা সম্পাদনা করতেন।
১৯৬১ সালে যোগ দেন ফিলিপ্স রেডিও কোম্পানিতে। এছাড়া তিনি ইউএসআইএস লাইব্রেরিতেও অনুলিখনের কাজ নিয়েছিলেন। উল্লেখ্য যে, সে সময় ফিলিপস ইংরেজি ও উর্দুতে মুখপত্র ছাপাতো। কবি মেহেরুননেসার চেষ্টায় বাংলা ভাষায় রচিত পত্রিকাও প্রকাশে বাধ্য হয় ফিলিপস কর্তৃপক্ষ। সে আন্দোলনে শরিক হয়েছিলেন বহু কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, কলামিস্ট, অধ্যাপকসহ হাজারো সামাজিক সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব।
নিজের চেষ্টায় তিনি মিরপুরের ৬ নং সেকশনে, ডি ব্লকের ৮ নং বাড়িটি বাবার নামে বরাদ্দ পান। ১৯৬৩ সালে কবি মেহেরুন্নেসা সপরিবারে বসবাসের জন্য ওই বাড়িতে ওঠেন। ১৯৬৫ সাল থেকে তাঁরা থাকতে শুরু করেন মিরপুরে। সেসময় মিরপুর বিহারী অধ্যুষিত এলাকা। বাঙালি পরিবার বিহারীদের তুলনায় নগণ্য। এর কিছু দিনের মধ্যে তাঁর বাবা অসুখে পড়েন। তখন তাঁকে আরো বেশি পরিশ্রম করতে হয় পরিবারের জন্য। দীর্ঘদিন অসুখে ভুগে ১৯৬৯ সালে পিতা আবদুর রাজ্জাক ক্যান্সারে মৃত্যুবরণ করেন। মা ও দুই ভাইয়ের দায়িত্ব এসে পড়ে তাঁর কাঁধে। কবিতার প্রতি ভালোবাসা, বাংলা সাহিত্যের প্রতি অকৃত্রিম আকর্ষণে রানু আপা ছদ্মনামে রাজনৈতিক প্রবন্ধ লিখেছেন ’৬৯ এর আইয়ুব বিরোধী উত্তাল গণআন্দোলনে। ১৯৬৯ সালে বাঙালিদের উদ্যোগে ‘অ্যাকশন কমিটি’ গঠিত হলে তিনি এই কমিটির সভা-মিছিলে অংশগ্রহণ করতেন। ৭ মার্চ ১৯৭১, রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণের সময়ও তিনি উপস্থিত ছিলেন। ১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ। বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে লেখক সংগ্রাম শিবির আয়োজিত বিপ্লবী কবিতা পাঠের আসরে হাসান হাফিজুর রহমান, আহসান হাবীব, শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হক, আলাউদ্দিন আল আজাদ, হুমায়ুন কবিরসহ অন্যান্য কবিদের সঙ্গে স্বরচিত কবিতাপাঠে অংশ নেন মেহেরুন্নেসা। এ আসরে সভাপতিত্ব করেছিলেন ড. আহমদ শরীফ। সেই অনুষ্ঠানে তিনি জনতা জেগেছে কবিতাটি আবৃত্তি করেন। বিহারী অধ্যুষিত মিরপুরে তিনি ও তাঁর পরিবার অনেক আগে থেকেই চিহ্নিত ছিলেন মুক্তিকামী বাঙালি হিসেবে। ২৭ মার্চ এলো, ২৫ মার্চেই ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় তখন একতরফা গণহত্যা শুরু হয়ে গিয়েছিল।
কবি মেহেরুন্নেসা বিহারিদের হুঁশিয়ারি উপেক্ষা করে, তাঁর দুই ভাই মিরপুর ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সদস্য রফিক ও টুটুলকে নিয়ে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ডাকা কর্মসূচির অংশ হিসেবে ২৩ মার্চ সকাল ১০ ঘটিকায় মিরপুরের ৬ নম্বর সেকশনের ডি-ব্লক, ১২ নম্বর রোডে নিজ বাড়িতে বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত পতাকা উত্তোলন করেন। তাঁকে হত্যা করার মাত্র তিন দিন পূর্বে বেগম পত্রিকায় প্রকাশিত হয় তাঁর লেখা শেষ কবিতা:
জনতা জেগেছে
মুক্তি শপথে দীপ্ত আমরা দুরন্ত দুর্বার,
সাত কোটি বীর জনতা জেগেছে এই জয়-বাংলার।
পাহাড় সাগর নদী প্রান্তর জুড়ে-
আমরা জেগেছি নব চেতনার ন্যায্য নবাঙ্কুরে
বাঁচবার আর বাঁচাবার দাবী দীপ্ত শপথে জলি-
আমরা দিয়েছি সব-ভীরুতাকে পূর্ণ জলাঞ্জলী-
কায়েমি স্বার্থবাদীর চেতনা আমরা দিয়েছি নাড়া
জয় বাঙলার সাত কোটি বীর, মুক্তি সড়কে খাড়া।
গণতন্ত্রের দীপ্ত শপথ কন্ঠে কন্ঠে সাধা-
আমরা ভেঙ্গেছি জয় বাঙলার বিজয়ের যত বাধা।
কায়েমি স্বার্থবাদী হে মহল কান পেতে শুধু শোন
সাত কোটি জয় বাংলার বীর ভয় করিনাকো কোন।
বেয়নেট আর বুলেটের ঝড় ঠেলে-
চির বিজয়ের পতাকাকে দেবো, সপ্ত আকাশে মেলে।
আনো দেখি আনো সাত কোটি এই দাবীর মৃত্যু তুমি,
চির বিজয়ের অটল শপথ “জয় এ বাংলা ভুমি”।
পতাকা উত্তোলন আর স্বাধীসতা সংগ্রামে তাঁর অংগ্রহণের কারণে ২৭ মার্চ তাঁর বাড়িতে পাকিস্তানি আলবদররা অতর্কিতে আক্রমণ করে। দুই ভাই রফিক, টুটুল ও তাঁর মাসহ মেহেরুন্নেসাকে তাঁরা নারকীয়ভাবে হত্যা করে।
হত্যার সময় তাঁর বয়স হয়েছিল ঊনত্রিশ বছর। মেহেরুন্নেসার ছোট দুই ভাইয়ের কাটা মাথা দিয়ে ফুটবল খেলা হয়। প্রত্যক্ষদর্শী মিরপুরের আলী আহাম্মদের ভাষ্যমতে কবি মেহেরুননেসাকে চুলের মুঠি ধরে উঠানে এনে রামদায়ের এক কোঁপে গলা কেটে ফেলে। মেহেরুন্নেসার কাটা মাথার বেণি করা চুল ফ্যানের সাথে ঝুঁলিয়ে ফ্যান ছেড়ে দেয়া হয় কাটা মস্তকের রক্ত ছিটিয়ে উল্লাস করা হয়। এই ভাবেই কবি মেহেরুন্নেসা হন স্বাধীনতা সংগ্রামে বাংলাদেশের প্রথম শহিদ মহিলা কবি।
স্বাধীনতা সংগ্রামী হিসাবে তাঁর নাম চিরকাল উজ্জ্বল হয়ে থাকবে। এই মহান কবির বাংলাদেশে এক বোন ছাড়া কোন আত্মীয় নেই। বোন মোমেনা রক্ষণশীল পরিবারের গৃহবধু হওয়ায় মেহেরুন্নেসাকে নিয়ে আমাদের দেশে উল্লেখযোগ্য কিছুই করা হয়নি এটা গভীর পরিতাপের বিষয়।
১৯৯৫ সালের ১৪ ডিসেম্বর বাংলাদেশ ডাকঘর তাঁর ছবি দিয়ে স্মারক ডাকটিকিট প্রকাশ করে।
দশম শ্রেণির বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় বইয়ে কবি মেহেরুন্নেসার কথা উল্লেখ আছে।
মেহেরুন্নেসা ছিলেন সত্যিকার কবিতাকর্মী। তাঁর কবি প্রতিভা আদায় করে নিয়েছিল কবি সুফিয়া কামালের স্নেহ, আনুকূল্য। যা মেহেরুন্নেসার মৃত্যুর পর তিনি তাঁর কবিতায় প্রকাশ করেন……..
কুমারী কিশোরী শাহানা রঙের মেহেদী লাগেনি হাতে
জালিম কাফের পিশাচেরা সেই হাতে অসহায়া মেয়ে মোর।
শানিত ছুরিকা হানিয়া কণ্ঠে তোর।
তান্ডবলীলা শুরু করেছিল, রক্ত বসনা তুই
পুত পবিত্র এক মুঠি ফুুল; শেফালী-চামেলী-জুঁই!
ভালোবেসেছিলি এই ধরণীরে, ভালোবেসেছিলে দেশ
তাই বুঝি তোর কুমারী তনুতে জড়ায়ে রক্ত বেশ
প্রথম শহীদ বাংলাদেশের মেয়ে
দু’টি ভাই আর মায়ের তপ্ত বক্ষরক্তে নেয়ে
দেশের মাটির’ পরে
গান গাওয়া পাখি, নীড় হারা হয়ে
লুটালি প্রবল ঝড়ে।
ঝড় থেমে গেছে বাংলাদেশের কেটেছে অন্ধকারে।
সোনা ঝরা এই রোদের আলোকে তুই ফিরবি না আর।
কবি মেহেরুন্নেসা বেঁচে থাকবেন তাঁর কবিতায়, বেঁচে থাকবেন প্রতিবাদে সংগ্রামে। গভীর শ্রদ্ধা জানাই তাঁর প্রতি।
Facebook Comments Sync