মেলবন্ধনে রবীন্দ্র- সত্যজিৎ/ আফরোজা পারভীন
(রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ৭ই মে, ১৮৬১ – ৭ই আগস্ট, ১৯৪১, ২৫ বৈশাখ, ১২৬৮ – ২২ শ্রাবণ, ১৩৪৮ বঙ্গাব্দ, বাঙালি কবি, ঔপন্যাসিক, সংগীতস্রষ্টা, নাট্যকার, চিত্রকর, ছোটগল্পকার, প্রাবন্ধিক, অভিনেতা, কণ্ঠশিল্পী ও দার্শনিক। রবীন্দ্রনাথকে গুরুদেব, কবিগুরু ও বিশ্বকবি অভিধায় ভূষিত করা হয়। ১৯১৩ সালে গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থের ইংরেজি অনুবাদের জন্য তিনি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন)।
(সত্যজিৎ রায় , ২ মে, ১৯২১ – ২৩ এপ্রিল, ১৯৯২, একজন ভারতীয় চলচ্চিত্র নির্মাতা ও বিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র পরিচালক)।
সত্যজিৎ রায়ের জন্ম ১৯২১ সালের ২ মে, মৃত্যু ১৯৯২ সালের ২৩ এপ্রিল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মৃত্যুবরণ করেন ১৯৪১ সালে । সেই হিসেবে তিনি যখন মারা যান সতজিৎ রায় তখন ১৯ বছরের যুবক। তবে সত্যজিৎ রায়ের পরিবারের সাথে রবীন্দ্রনাথের নিবিড় যোগাযোগ ছিল। সত্যজিৎ-এর পিতা ও পিতামহ দুজনই নামকরা শিল্পি ছিলেন। পিতামহের একটি ছাপাখানাও ছিল। সেখানে তিনি মুদ্রাকরের কাজ করতেন। তিনি ছোটদের জন্য একটা পত্রিকা প্রকাশ করেছিলেন। সত্যজিৎ-এর লেখা ও ছবি সে কাগজে বের হত। সত্যজিৎ- এর বাবা সুকুমার রায় একজন বিখ্যাত শিশুসাহিত্যিক। তাঁর মজার ছড়া পড়েনি সেকালে এমন কোন শিশু খুঁজে পাওয়া যাবে না । সত্যজিৎ- এর বয়স তখন দুই বছর, তাঁর পিতা সুকুমার রায় গুরুতর অসুস্থ ছিলেন। তাঁর মৃত্যুর অল্প কিছুদিন আগে রবীন্দ্রনাথ তাঁকে দেখতে গিয়েছিলেন। তখন তিনি রবীন্দ্রনাথকে তাঁর নিজের লেখা গান গেয়ে শুনাতে অনুরোধ জানালে রবীন্দ্রনাথ কয়েকটি গান গেয়ে শুনিয়েছিলেন। সত্যজিৎ- এর মা খুব ভাল রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতেন। বাবা একবার সত্যজিৎ রায়কে রবীন্দ্রনাথের সাথে দেখা করাতে নিয়ে গিয়েছিলেন। কবিগুরু তখন সত্যজিৎ-এর হাতে একটি কবিতা লিখে দিয়েছিলেন। কাজেই শৈশব থেকেই সত্যজিৎ পরিবারের সাথে রবীন্দ্র পরিবারের আন্তরিক যোগাযোগ ছিল। ১৯ বছর বয়সে মায়ের এবং কবিগুরুর আগ্রহে সত্যজিৎ শান্তিনিকেতনে যোগ দেন চিত্রকলা শিখতে । কবিগুরুর বয়স তখন প্রায় আশি। সত্যজিৎ চিত্রকলা শেখার পাশাপাশি কবিগুরুর উপন্যাসগুলি পড়েন, তাঁর নাটকের অভিনয় দেখেন, রবীন্দ্রনাথকে নানা দিক থেকে জানার চেষ্টা করেন। ১৯৪১ সালে কবিগুরুর মৃত্যুর অল্প কিছুদিন পরই সত্যজিৎ রায় শান্তিনিকেতন ছেড়ে চলে যান নিজেকে তৈরি করার মানসে , নিজের শেকড়ের সন্ধানে। তিনি ঘুরতে থাকেন পুরো ভারতবর্ষ।
একজন মানুষ একসাথে কত রকমের প্রতিভা ধারন করতে পারে, এবং সে প্রতিভাকে পূর্ণরূপে বিকশিত করতে পারে রবীন্দ্রনাথ তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। রবীন্দ্র উত্তরকালে আর এক মানুষ জন্ম নিলেন তাঁর নাম সত্যজিৎ। রবীন্দ্রনাথের মতোই সত্যজিৎ রায় ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। তিনি ছিলেন একাধারে চিত্রকলা , সঙ্গীত চলচ্চিত্র বিশেষজ্ঞ। শেষ জীবনে তিনি পিতামহ প্রতিষ্ঠিত ‘সন্দেশ’ পত্রিকার সম্পাদক হিসেবেও কাজ করেছেন। ছিলেন জনপ্রিয় লেখক। প্রতিবছর পুজো সংখ্যায় তার কোন না কোন উপন্যাস প্রকাশ হত। তিনি বেশ কয়েকটি বই-এর মলাটের নকশাও একেছেন। তার সৃষ্ট দুটি মুদ্রাক্ষরের আদল ( টাইপ ফেস) ১৯৭১ সালে আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছে। এই ফেস দুটির নামকরণ করা হয়েছে ‘রে রোমান’ ও ‘রে বিজারে। ’ মজার ব্যাপার হচ্ছে , সত্যজিৎ রায় কখনই আনুষ্ঠানিকভাবে কোন চলচ্চিত্র শিক্ষার প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়ন করেননি অথচ তিনি নিজেই চলচ্চিত্রের এক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছেন। চলচ্চিত্র নির্মাণের সাথে সংশ্লিষ্ট সব প্রক্রিয়া তিনি নিজে হাতে করতেন। যেমন চিত্রনাট্য , চিত্রগ্রহণ , সম্পাদনা , সঙ্গীত, দৃশ্যসজ্জা ও পরিচালনা। একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ হয় অনেক মানুষের যৌথ প্রচেষ্টায়। তাদের সবার সব বিষয়ে সমান পারদর্শিতা থাকে না। তাই কোন একটি জায়গাতে কিছু ঘাটতি থাকলে সার্বিক নির্মাণ কাজে ঘাটতি থেকে যায় । এ বিষয়ে বিখ্যাত চলচ্চিত্রকার , ১৯২০ সালে ফ্রান্সে জন্ম নেয়া ‘আভা গার্দ ’মতবাদের অনত্যম পুরোধা আবেল গাঁস এর উক্তি ( যা বাংলা করলে দাঁড়ায়) , ‘ মনে একটা চলচ্চিত্র রূপ নেয়া আর তার বাস্তব রূপায়ণের মধ্যে যেন ভোলটেজ শতকরা কুড়ি ভাগ কমে যায়। ’ তাই সত্যজিৎ প্রায় সমুদয় কাজ নিজেই করতেন। তাঁর অর্থবল কম ছিল, টিম ছিল ছোট কিন্তু স্থায়ী। তিনি তাঁর ছায়াছবির প্রতিটি খুঁটিনাটি নিজেই দেখতেন।
১৯৪৫ সালে সত্যজিৎ রবীন্দ্রনাথের ‘ঘরে বাইরে’ উপন্যাসের চলচ্চিত্ররূপ লেখেন। কিন্তু তখন ছবিটি নির্মাণ করা সম্ভব হয়নি। এর প্রায় ৪০ বছর পর তিনি নতুন করে চলচ্চিত্ররূপ লিখে ছবিটি তৈরি করেন। ১৯৬১ সালে রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবর্ষে তিনি কবিগুরুর তিনটি ছোটগল্প অবলম্বনে তৈরি করেন চলচ্চিত্র ‘তিনকন্যা।’ একই বছর তিনি নির্মাণ করেন রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে তথ্যচিত্র ‘ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ’ ১৯৬৪ সালে তিনি রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পের কাহিনি অবলম্বনে তৈরি করেন ‘চারুলতা ।’ তবে এই ছবি তৈরি করতে গিয়ে তিনি নিজের দৃষ্টিভঙ্গি ও স্বাতন্ত্র বজায় রাখেন ।
সত্যজিৎ রায়ের চলচ্চিত্রের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য সততা , নান্দনিকতা আর নৈতিকতা। যা রবীন্দ্রনাথের লেখারও প্রধান বৈশিষ্ট্য। এ বিষয়গুলি সত্যজিৎ তার চলচ্চিত্রে রোপন করেছেন গভীর নিষ্ঠায়। হেনরি মিকলি ১৯৮১ সালে সত্যজিৎ-এর চলচ্চিত্র সম্পর্কে লিখেছিলেন , ‘ তাঁর ছায়াছবিগুলির চিত্রভাষা থেকেই বোঝা যায় , তাঁর কাছে চলচ্চিত্র নৈতিকতার বিষয়। তারা প্রকাশ করে হারানো পবিত্রতার জন্য স্মৃতিমেদুর ব্যাকুলতা , যে পবিত্রতা শিল্প প্রকাশের মুহূর্তেই ফিরিয়ে আনতে পারে কলকাতাবাসী । এই মহান শিল্পী যে প্রাথমিকভাবে একজন মহান নীতিবাদী , এ সত্য নজর এড়াবে কি করে?’ রবীন্দ্রনাথের মতো সত্যজিৎও বিশ্বাস করতেন, শিল্পির কাজ হয় তার শিল্পের মাধ্যমে। গান্ধীজী একবার রবীন্দ্রনাথকে রাজনৈতিক আন্দোলনে যোগ দিতে বললে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘ আপনি সুতো কাটেন, আমি কথার জাল বুনি। যার যা কাজ।’ রবীন্দ্রনাথ আমৃত্যু তাঁর নিজের কাজ নিয়ে থেকেছেন । অন্যের দ্বারা প্রভাবিত হননি। সত্যজিৎও গভীর নিষ্ঠায় তাঁর কাজটি করে গেছেন। কেউ তাকে প্রলোভিত করতে পারেনি।
রবীন্দ্রনাথ ছিলেন গভীর মানবতাবাদী। তাঁর প্রতিটি লেখা সে গল্প , উপন্যাস, কবিতা , গান সবকিছুতেই প্রকাশ পেয়েছে মানবপ্রেম। সত্যজিৎও তাই। তিনি ছিলেন গভীর মানবদরদী। তাঁর এই দরদ ছিল ভালবাসায় সিক্ত। এ প্রসঙ্গে ‘পথের পাঁচালি’র কথা বলা যায়। ‘পথের পাঁচালি’তে দুর্গার বিরুদ্ধে একটি পুঁতির হার চুরির অভিযোগ আনা হয়েছিল। অপু সেই হারটা দেখতে পেল । দুর্গা তখন মৃত। অপু হারটা তাদের বাড়ি সংলগ্ন পুকুরে ফেলে দিল । পুকুরটি ছিল পানায় ভর্তি। হার ফেলায় পানা সরে গিয়ে টুপ করে হারটি পড়ে গেল। পানা এসে আবার জায়গাটা ভরে দিল। পুকুরে ঠাঁই পেল অপুর গোপন কথা। অপু বিষযটা কাউকে জানালো না, আলোচনা করল না, দোষী সাব্যস্ত করল না, নিন্দা করল না। । সে ক্ষমা ভালবাসা আর দরদের সাথে হারটা ছুঁড়ে দিল পুকুরে। সত্যজিৎ- এর ভাষায় আনুগত্য , ক্ষমা আর ভালবাসা জীবনকে একসূত্রে গেঁথে রাখে।
আগেই বলেছি ছবির সব কাজ সত্যজিৎ নিজেই করতেন। ‘তিন কন্যা’ থেকে সত্যজিৎ তাঁর চলচ্চিত্রের সঙ্গীত নিজেই রচনা করতেন। ‘চারুলতা’র পর থেকে তিনি প্রায়ই ক্যামেরার কাজ নিজেই করতেন। সিনেমার স্ত্রিপ্ট নিজেই লিখতেন। অনেক চিত্রনাট্য তাঁর মৌলিক সৃষ্টি । এর মধ্যে রয়েছে ছয়টি কাহিনিচিত্র , পাঁচটি তথ্যচিত্র এবং দুটি ছোট ছায়াছবি।
সত্যজিৎ রাযের চলচ্চিত্র জীবন ছিল ব্যতক্রমী। সত্যজিৎ তাঁর প্রথম চলচ্চিত্রের জন্য কান ফিল্ম উৎসব থেকে বিশেষ পুরস্কার পান। সেটা ১৯৫২ সালের কথা। ফরাসিরা তাঁকে দিয়েছিল ‘লিজন ডি অনার’ সম্মান আর ১৯৯২ সালে হলিউড তাঁকে দিয়েছিল ‘অস্কার’। এ ছাড়াও তিনি পেয়েছেন অসংখ্য পুরস্কার। এ ক্ষেত্রেও রবীন্দ্রনাথের সাথে তাঁর মিল । রবীন্দ্রনাথ নোবেল পেয়েছিলেন ১৯৩৯ সালে তাঁর জীবনের শেষাংশে। আর সত্যজিৎ অস্কার পেলেন তাঁর একেবারে মুমূর্ষু আবস্থায়। এই পুরস্কারটি তাঁর পাবার কথা ছিল অনেক আগে।
তবে কোন নোবেল বা অস্কার দিয়ে রবীন্দ্রনাথ বা সত্যজিৎকে মূল্যায়ন করা যায় না। তাঁদের যে কীর্তি সে কীর্তির মূল্যায়ন কোন পুরস্কারে হয় না। সে মূল্যায়ন হয মানুষের ভালবাসায়। সে ভালবাসা তাঁরা পেয়েছেন।
রবীন্দ্রনাথের প্রতি সত্যজিৎ-এর ছিল গভীর শ্রদ্ধাবোধ। এই শ্রদ্ধার প্রমাণ পাওয়া যায় সত্যজিৎ নির্মিত তথ্যচিত্র ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের’ প্রারম্ভিক মন্তব্যে। ‘ ১৯৪১ সালের ৭ আগস্ট তারিখে কলকাতা শহরে একজন মানুষের মৃত্যু ঘটেছিল। তাঁর মরদেহ ভস্মীভূত হয়েছে কিন্তু তাঁর উত্তরাধিকার কোন আগুনে পুড়বে না। সে উত্তরাধিকার শব্দের, সঙ্গীতের , কবিতার , মননের , আদর্শের। তাঁর শক্তি আমাদের বর্তমানে এবং ভবিষ্যতে অভিভূত করবে, অনুপ্রাণিত করবে। আমরা তাঁর কাছে বহু ঋণে ঋণী । তাঁর স্মৃতির উদ্দেশ্যে প্রণাম জানাই।’
সত্যজিৎএর অনুরাগী ভক্ত চলচ্চিত্র বোদ্ধা গাস্তঁ রোবের্জ তার ‘সত্যজিৎ রায়’ গ্রন্থের প্রস্তাবনায় সত্যজিৎ রবীন্দ্রনাথের উদ্দেশ্যে যা লিখেছিলেন সেই একই কথা লেখেন । তবে তারিখটি লেখেন ১৯৪১ এর ৭ আগস্টের স্থলে ১৯৯২ এর ২৩ এপ্রিল। তিনি পুরো মন্তব্যটি তুলে দিয়ে পরিশেষে লেখেন, ‘এই কথা কটি ( তারিখটি ছাড়া) সত্যজিৎ রায়ের লেখা , তাঁর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়ে নির্মিত চলচ্চিত্রের প্রস্তাবনা হিসেবে। আশা করি, তারিখটি বদলে কথাগুলি যদি আমি সত্যজিৎ রায় সম্বন্ধে আমার গ্রন্থের প্রস্তাবনায় ব্যবহার করি , তা ধৃষ্টতা বলে গণ্য হবে না । তিনি তাঁর চলচ্চিত্রের নাম দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। আমি আমার বইয়ের নাম দিলাম, – ‘সত্যজিৎ রায়।’ তাঁর ঋদ্ধ ব্যক্তিত্বের সব দিক নিয়ে চর্চা করতে আমার অক্ষমতা বিষয়ে আমি অবহিত।’
এই হল সাহিত্য আর চলচ্চিত্রের দুই বিজয়ী নাবিক সম্পর্কে সামান্য দু’টি কথা , যারা বিশ্ব দরবারে পৌঁছে দিয়েছেন বাংলা সাহিত্য আর চলচ্চিত্রকে।
তথ্যসূত্র:
১.গাস্তঁ রোবের্জ – সত্যজিৎ রায়
২.সত্যজিৎ রায়- বিষয় চলচ্চিত্র
Facebook Comments Sync