মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাপর  / বেবী নাসরিন

মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাপর

মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাপর

মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাপর  / বেবী নাসরিন

নড়াইলের ভওখালী গ্রাম।

হিন্দু অধ্যুষিত এলাকা। অল্প কিছু মুসলিম পরিবারও আছে। সকলে মিলে মিশে চলে। কেউ কেউ বিনিময় করে এসেছে। আবার বাড়ি কিনেও এসেছে। মুক্তিযুদ্ধে সারাগ্রাম তছনছ। প্রাণের ভয়ে পালিয়েছে অনেকে। গোটা গ্রাম খাঁ খাঁ করছে। নিঝুম দ্বীপের মত।

দেশ এখন হানাদার মুক্ত,  স্বাধীন। বাড়ি  ফিরতে শুরু করেছে কেউ কেউ। একজন বলল,

:  ঠাকুমা, ভারত থেকে আসলেন কবে? 

: এইতো এলাম একটু আগে। বাস তো নয়, যেন মুড়ির টিন। কানায় কানায় পূর্ণ। সব বাড়ি ঘরে ফিরছে।  কিচ্ছু নেই সবই তো  রাজাকার আর পাকিস্তানী বাহিনীর পেটে। আমাগের গরু ছাগল, মিয়াগে গরু ছাগল, মুরগি সব শেষ। 

: কলকাতা কেমন দেখলেন? 

 ঠাকুমার কাছে জানতে চাইলো হিরু ।

: আর বলিস না,  গা পা খালি। ওড়না গায়ে দেয় না । সরম নাই মহিলাগের । ছ্যা ছ্যা! 

ও হিরু তোরা কৈ ছিলি? 

: চারিদিক ছড়ায়ে ছিটায় ছিলাম ঠাকুমা। আমাদের গোয়াল ঘর ফাঁকা। মাঠে কোন ফসল নাই। কিভাবে দিন চলবে  না খেয়ে

: মরতে হবে সবার। 

পাশে বামন ঠাকুরের বাড়ি ।ওদের কোথাও যাবার জায়গা নেই। মাটি কামড়ে পড়ে আছে। মাথার উপর দিয়ে অনেক ঝড়

বয়ে গেছে। বুড়ো ঠাকুর উপায় না দেখে ভিক্ষাবৃত্তি বেছে নিতে হয়েছে। সারা গ্রাম জনমানবশূন্য তখন। তরুণী মেয়েকে উঠিয়ে নিল। দেশ স্বাধীন হলে কঙ্কালসার অসুস্থ মেয়েকে ক্যাম্প থেকে এনেছে। প্রাণে  রক্ষা পেলেও অসুস্থ অবস্থায় পাকিস্তানি সেনাদের অত্যাচারে বিছানায় ধুঁকছে। চারিদিকে অত্যাচারের ক্ষত। তারওপরে অভাবের তাড়নায় পাগল! মানুষের মধ্যে অস্থিরতা। প্রত্যেক ঘরে ক্ষুধার্ত মানুষের হাহাকার। যারা জীবনেও অভাব দেখেনি তারাও অভাবের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। তাদের চোখে মুখে লজ্জা, পেটে ক্ষুধা। চিন্তায় ব্যাকুল মানুষেরা গম ,চাল,ডাল পেল।সেটা দিয়ে স্বপ্ন দেখা শুরু হোল। কিন্তু অত সহজে স্বপ্ন ধরা দেয়নি।  প্রচুর কষ্টের নদী সাঁতরে তবেই মিলেছে তল।

ছেলে মেয়েরা স্কুলে যাওয়া শুরু করেছে। স্কুলে বিদেশ থেকে উপহার সামগ্রী বিতরণ করা হোল। মানুষ তখন ভাতের বদলে রুটি খাওয়া শিখলো। লোকসংখ্যা বেশি তারা আটার জাউ খাওয়া শুরু করলো।

: কি করব দিদি। দশ,বারো জনের মুখে রুটিতে পুষবে না।তাই জাউ করে খাচ্ছি।

: আমিও দিদি কিছু বাদাম কিনেছি। ভেজে  ছেলেকে দিয়ে বেচতে পাঠাবো। এভাবে যদি সংসারের হাল ধরা যায়।

যুদ্ধের বিভীষিকায় যখন মানুষ দিশেহারা।

 গ্রামে যুদ্ধ শুরুর প্রাক্কালে  প্রামাণিক পাড়ায় বিয়ের বাদ্য বেজে উঠল। মাখনের বিয়ে।  আনন্দ আয়োজন ফুরাতে না ফুরাতে  হুড়োহুড়ি করে কে কোথায় পালাবে! চারিদিকে গোলাগুলির আওয়াজ।

এদিকে অসুস্থ মাকে হসপিটাল ভর্তি করাতে চলল রেজা। ভর্তি অপারেশন শেষ হলো। কিন্তু বাড়িতে আনার আগেই যুদ্ধ শুরু হোল।

ছিটকে পড়ল সকলে চারিদিক। কেউ ভারতে,  কেউ গ্রাম থেকে গ্রামে। কেউ শহর থেকে গ্রামে। পিছনে ফেলে এলো সাজানো সংসার।যুদ্ধে প্রাণ গেল অগুনিত মানুষের। খুলনার দৌলতপুর ডুমুরিয়ায় তুমুল যুদ্ধ শুরু হোল বিহারী বাঙালি। বিহারীরা পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর পক্ষ নিল।

ঢাকায় গণহত্যা চালাতে লাগলো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজারবাগ পুলিশ লাইন ছাড়া ও সারাদেশে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ল। ভওখালী গ্রামের ডা, রেজা হসপিটাল থেকে মাকে আনার জন্যে ব্যাতিব্যস্ত হয়ে পড়লেন। অবশেষে চিন্তার অবসান ঘটিয়ে মা’কে আনতে সক্ষম হলেন।মাকে নিয়ে গ্রামে চলে এলেন। গ্রামটি ছিল লোহাগড়ার শিয়রবর । রক্তশূন্য মায়ের সেবা শুশ্রূষা শুরু হোল। দ্রুত তিনি সেরে উঠতে শুরু করলেন। কেউ বুঝতে পারছে না এটা যুদ্ধের সময় । সপ্তাহখানেক পর টের পাইয়ে দিল এটা মুক্তিযুদ্ধের সময়। এটা চেয়ারম্যান বাড়ি। মুক্তিযোদ্ধারা মেহমান হোল । একদিন একটা গোয়ালের গরু, অন্যদিন পুকুরের বিশাল মাছ খাওয়ান হোল। তারপর দিন খবর রটে গেল,  লঞ্চভর্তি আর্মি এসে ভিড়ল নদীর তীরে।

লঞ্চভর্তি আর্মি এসেছে। এ খবর চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল। টিনএজ মেয়ে,বৌ নারীরা পাশের গ্রামের দিকে ছুটতে শুরু করলো। গোটা গ্রামের মানুষ শিয়রবর থেকে শালনগরের দিকে ছুটতে লাগলো। কিন্তু বৃদ্ধ মা কী করবেন। মেয়ে বৌ নারীরা অসুস্থ মাকে রেখে যেতে নারাজ। মা বললো, তোদের নিয়ে চিন্তা বেশি, তোরা পালা। আমি ঘোড়ার গাড়িতে করে যাব। হাঁটতে পারবো না।

খবর পাওয়া গেল,  আর্মি এসে খালি বাড়ীতে কাউকে না পেয়ে লুটপাট করেছে আবার আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। সামনে যাকে পেয়েছে তাকে গুলি করেছে। গ্রাম তছনছ করল। মানুষের আহাজারিতে আকাশ বাতাস ভারী হয়ে উঠল! জোয়ান ছেলে মেয়েদের ধরে নিল। এভাবে একটা বিভীষিকাময় দিন পার করল এ গাঁয়ের সাধারণ মানুষ। স্বজন হারানোর ব্যথায় তারা চিৎকার করে কাঁদতেও পারলো না। একে বলে মুক্তিযুদ্ধ!

সকালে ঘুম থেকে উঠে মনে হলো  এবার বড় বাঁচা বেঁচেছি। কিন্তু যাদের  ধরে নিয়েছে তাদের ভাগ্যে কি ঘটবে? এখনও চারিদিকে লুটপাট ঘরবাড়ি আগুন জ্বালিয়ে রাজাকার গুন্ডা বাহিনী তামাসায় মেতে রইল। গ্রামে ঢুকে গেল আর্মি। মানুষ ছুটল শহরে । গন্তব্য ঢাকা চাচাবাড়িতে। অল্প কিছু দিন পর শুরু হোল খানাতল্লাশি। শুরু হোল ভারত পাকিস্তান তুমুল যুদ্ধ। বোম্বিং আর এনটিএয়ারকাফট এর বিকট আওয়াজ। ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে সবাইকে আশ্রয় নিতে হলো করিডোরে । সেখানে কাটল নির্ঘুম সারারাত। এভাবে তিন দিন কাটার পর ঘরে তালা লাগিয়ে বেরিয়ে পড়তে হোল অজানার উদ্দেশ্যে। প্রথমে রিক্সা তারপর হেঁটে তারপর নৌকা। দীর্ঘ নদীপথ পাড়ি দিতে মাঝিকে সাহায্য করলেন চাচা। ক্লান্ত শ্রান্ত শরণার্থীদের মাঝরাতে খাওয়ান হোল। সকলে বুঝল কতটা ক্ষুধার্ত তারা!

সকালে চোখ মেলে স্বস্তির স্বাদ পেল সবাই। পাশের বাড়িতে মুক্তিবাহিনী এসেছে সকলে জানতে পেল। দলবেঁধে সকলে ভীড় জমাতে লাগলো। ডিসেম্বরের মাঝামাঝি। আমাদের মুক্তিবাহিনী লুঙ্গি কাছা করে মাথায় গামছা বাঁধা। গেরিলা ফাইটার হাতে স্টেনগান। কিভাবে  স্টেনগান চালাতে হয় দেখালেন । গ্রেনেড কিভাবে চাবি খুলে ছুঁড়তে হয় জানাল । যুদ্ধের গল্প বলল রোমহর্ষক। গল্পে নিরবতা নেমে এলো।

দুই বন্ধু যুদ্ধ করছি। হানাদার বাহিনীকে উড়িয়ে দিতে গোটা টিম প্রস্তুত।কমান্ডারের নির্দেশের অপেক্ষায়। নদীর তীরে অবস্থিত গ্রামটি। স্কুল মাঠে আর্মিদের আস্তানা। সারা গ্রাম দাপিয়ে ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়েছে। বেছে নেওয়া এমনি সময়। দুবন্ধুর জন্মভূমি। সারা দিনের পরিকল্পনা একটু পর বাস্তবায়িত হবে। জন্মভূমি হবে হানাদার মুক্ত। মুক্তির স্বাদ গ্রহণ করবে সবাই। একশন শুরু হোল। পাল্টাপাল্টি আক্রমণ। হঠাৎ গ্রেনেড ছোঁড়ার মুহূর্তে একটা বুলেট ছুটে এসে শাহিনের বুকের বাম পাশে বিঁধল। থামলে চলবে না। সর্বশক্তি দিয়ে যুদ্ধ চালিয়ে গেল। যুদ্ধে বিজয় এলো। কিন্তু আহত বন্ধুকে চাদরে মুড়ে। তাঁর বাড়িতে চলা শুরু হোল। রক্তের বন্যায় ভেসে গেল কাপড় আর মাতৃভূমির মাটি। কিছু পথ পেরোলে কলেমা পড়তে

পড়তে বন্ধু চিরবিদায় নিলো। বন্ধুকে সৎকার করে তার রক্ত মাখা পোশাক ব্যাগে পুরে বন্ধুর মায়ের

কাছে পৌঁছে দিতে গেল। জীবনের সবচেয়ে প্যাথেটিক আর দূঃখময় অধ্য্যায় ছিল এটা। পাশের গ্রাম জমির আইলে হাঁটা পথ। ভাবতে লাগলো বন্ধুর মাকে কিভাবে দেবে এই প্যাকেট!

বাড়িতে ঢুকে লতিফ ডাক দিল,

খালাম্মা , খালাম্মা

: এইতো বাবা

: কেমন আছেন খালাম্মা?

: সন্তানদের ছেড়ে মায়েরা কী ভালো থাকতে পারে! আমার বাবায় কৈ ?

: বাবা? ওতো আসেনি। আমি আসছি । আমিও তো আপনার সন্তান।

এটা বলে প্যাকেটটা রেখে ছুটে চলে এলো।

: ও আমার শাহিন —বলে গগনবিদারী চিৎকার করতে লাগলেন। দমবন্ধ পরিবেশ থেকে কাঁদতে কাঁদতে ছুটে পালিয়ে এলো।

তার কদিন পর দেশ স্বাধীন হোল। আকাশ বাতাস স্বাধীনতার খুশিতে আত্মহারা। 

এ শুধু গল্প নয়, ইতিহাস। বুকের রক্তে কেনা স্বাধীনতা।

বেবী নাসরিন
বেবী নাসরিন
%d bloggers like this: