নামকরণের নেপথ্য ইতিহাস / শফিক হাসান

নামকরণের নেপথ্য ইতিহাস

নামকরণের নেপথ্য ইতিহাস

রম্য

নামকরণের নেপথ্য ইতিহাস / শফিক হাসান

 

এটা-ওটা নিয়ে সারা দেশে প্রতিদিনই বিতর্ক লেগে থাকে! ব্যক্তি, দল ও প্রতিষ্ঠানের ভালো-মন্দ নিয়ে চুলচেরা গবেষণাও কম হয় না! কিন্তু যে ইতিহাস নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই সেটা হচ্ছে ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকার নামকরণের ইতিহাস! জেনে নিই ঢাকার কয়েকটি জায়গার নামকরণের `নেপথ্য ইতিহাস’। 

 

স্বামীবাগ

স্বামীবাগ যেহেতু আছে, স্ত্রীবাগও থাকার কথা- সহজ সূত্র এটাই বলে! কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। স্ত্রীদের হাতেই যেহেতু সমুদয় কর্তৃত্ব, তাবত ক্ষমতার উৎস তারাই- বেচারা স্বামীর স্থান সেখানে কোথায়! নিপীড়িত, নির্যাতিত স্বামীরা অতিষ্ঠ হয়ে একসময় স্ত্রীদের অত্যাচারে আন্দোলনের ডাক দেয়। বলাবাহুল্য, আন্দোলনে তারা চরমভাবে ব্যর্থ হয়। স্ত্রীরা গুঁড়িয়ে দেয় সকল ‘ষড়যন্ত্রের’ নীলনকশা! পরবর্তীকালে আন্দোলন সংঘটিত স্থানটিই স্বামীবাগ নামে পরিচিত হয়ে ওঠে!

 

ভূতের গলি 

অজ্ঞাত কারণেই পেত্নির চেয়ে ভূতেরাই সংখ্যায় বেশি, তারাই সকল কাজে এগিয়ে! যে কারণে ভূতের গলি আছে, পেত্নির গলির নামনিশানাও নেই! দেশে সবসময়ই ভূতদের আধিপত্য বজায় ছিল। এখনো আছে। ছাপাখানায় গিয়ে দায়িত্ব পালন, সরকারি-বেসরকারি অফিসের ফাইলের ওপর আছর করা, কারও কারও ঘাড়ের ওপর চেপে থাকা,  সব মিলিয়ে ভূতদের জন্য দরকার হয়ে পড়েছিল নিজেদের জন্য স্বতন্ত্র একটি পল্লি গড়ে তোলার! সেটা তারা করতে সমর্থও হয়েছিল শেষপর্যন্ত। বর্তমানে পল্লিটি মানুষ কর্তৃক দখল হয়ে গেছে। উপরন্তু ভূতদের কাজগুলোও মানব সম্প্রদায়ই করে দিচ্ছে!

 

কল্যাণপুর 

কল্যাণপুরেই কল্যাণ, আর সবখানে অকল্যাণ। হিসাবটা মোটেও এমন নয়! এখনকার যে কল্যাণপুর অতীতে সেখানে থাকতেন কল্যাণ রায়, তার ছিল আবার মানুষের উপকার করার বাতিক! সমস্যাগ্রস্ত যে কারওর জন্যই তিনি উদারহস্ত। নিজের সর্বস্ব দিয়ে হলেও জনকল্যাণ করেন! নিজেদের কল্যাণ সাধনের জন্য দূরদূরান্ত থেকেও মানুষজন ছুটে আসতে শুরু করল। জায়গাটার নাম হয়ে গেল কল্যাণপুর। শেষ দিকে ধার-দেনা করেও কল্যাণ রায় জনকল্যাণ করে যাচ্ছিলেন, কিন্তু ব্যাংকের খেলাপি ঋণ, ব্যক্তিগত ধারের টাকা, এনজিওর কিস্তি সময়মতো না মেটানোয় তার নামে মামলা হয়ে যায়! মামলার ভয়ে তিনি সেই যে গা ঢাকা দিয়েছেন অদ্যাবধি কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। কল্যাণপুর পলাতক এক আসামির পরিচয় বহন করে চলেছে!

 

যাত্রাবাড়ি

সব যাত্রা আদতে বাড়ি থেকেই শুরু হয়, সে হিসেবে সব যাত্রার নামই দেওয়া যায় যাত্রাবাড়ি। কিন্তু যাত্রাবাড়ি নামক জায়গার ইতিহাস একেবারেই ভিন্ন। বর্তমানের লোকাল বাসগুলো বিভিন্ন স্টপেজে এত বেশি দেরি করে, বাধ্য হয়ে কন্ডাক্টরের উদ্দেশ্যে যাত্রীদের চড়া গলায় বলতে হয় ‘যা, বাড়ি থেকে যাত্রী ডেকে নিয়ে আয়’!

যাত্রিবাড়ীর কাহিনি ছিলো আক্ষরিক অর্থেই এমনই। বাস যখন কিছুতেই ভর্তি হয় না, কন্ডাক্টররা শুরু করল বাড়ি বাড়ি যাওয়া! সাধারণ মানুষদের বিভিন্ন জায়গায় যেতে প্রলুব্ধ করতে লাগল। কন্ডাক্টরদের কাছ থেকেই যাত্রীরা বুঝতে শিখল, সময়মতো কোথায় তাদের যেতে হবে, কখন কোথায় গেলে কী রকম ফায়দা হাসিল হবে!

 

আলুবাজার 

আলু হচ্ছে সর্বজনীন তরকারি। মাছে যেমন লাগে, মাংসেও! ভর্তা বানানো যায়, ভাজিতেও অনন্য! আলুর এমন গুণাগুণ আবিষ্কার করে বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীরা ভাবলেন, তারা আলুর মতো জীবন গড়বেন; সবার কাজে লাগবেন! এমন ভাবনার পর বুদ্ধিজীবীরা পুরান ঢাকায় একটি অফিস ভাড়া নিলেন, সময়ে অসময়ে সে অফিস থেকে জাতিকে উদ্ধার করার নানা রকম বুদ্ধির জোগান দিতে থাকলেন! বুদ্ধির ভেতরে কখনো-সখনো কুবুদ্ধিও ঢুকে পড়ত। একটা সময় অফিসটা আর থাকল না, বুদ্ধিজীবীরা ছড়িয়ে পড়লেন আওয়ামী লীগে, বিএনপি ও অন্যান্য রাজনৈতিক এবং অরাজনৈতিক দলে; সারা বাংলাদেশের ‘সুবিধা’জনক স্থানে!

 

ফকিরাপুল

সাঁকোও এক ধরনের পুল। নিম্ন আয়ের মানুষরাই সাঁকোতে বেশি চড়ে বলে এর নাম দেওয়া হয়েছে ফকিরাপুল! এই পুলে ইট-সিমেন্ট-বালি কিছুই লাগে না। লাগে শুধু বাঁশ! দরিদ্র মানুষরা সুযোগ পেয়ে ধনীদের অকাতরে ‘বাঁশ’ দিতে শুরু করল! অনেক দরিদ্রের সন্তান হয়ে উঠল চাঁদাবাজ, দখলদার, মাস্তান। এরা অর্থবিত্তশালীদের চরমপত্র পাঠাতে শুরু করল। ‘চাঁদা রেডি, রাখবি’! যারা চাঁদাবাজি-মাস্তানি পারে না, তাদের একটা অংশ নেমে পড়ল ভিক্ষাবৃত্তিতে। এটাও ধনীদের চোখে সইল না। সুযোগ বুঝে ধনীরা বহির্বিশ্বে বাণী দেন, বাংলাদেশে কোনো ভিক্ষুক নেই, দেশ উন্নত হচ্ছে… ইত্যাদি। সব দেখে ত্যক্তবিরক্ত হয়ে তারা একসময় অবজ্ঞাভরে দুর্বৃত্ত কবলিত স্থানটির নাম দেন ফকিরাপুল। এই ফকিরাপুলেই রয়েছে গরম পানির গলি। গরম পানি দিয়ে একসময় এলাকার লোকজন প্রতিপক্ষকে সাইজ করত!

 

নীলখেত  

চাষের খেত কখনো নীল হয় না, কিন্তু কিছু খেত একসময় ঠিকই নীল হয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে! বেদনার রং নীল। বেদনা প্রকাশ করতে গিয়েই ক্ষেত নীল রং ধারণ করেছে। মানুষের যেমন বিশ্রাম লাগে, তেমনি জমিরও। এটাই বুঝতে চাইল না জমির লোভী মালিকরা। তারা একের পর এক জমিতে ফসল লাগিয়েই যাচ্ছিল। জমি কতভাবে আর্তনাদ করল, আর ফসল দিতে পারছে না, পারবে না; উর্বরতাশক্তি ফিরুক, প্রয়োজনীয় পুষ্টি আসুক, তারপর আবার…। মালিকপক্ষের সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায় একসময় অত্যাচারিত জমিগুলো নীল বর্ণ ধারণ করল, প্রতিবাদস্বরূপ বন্ধ করল ফসল ফলানো। কালক্রমে সেই নীল খেত পরিণত হয়েছে বাণিজ্যকেন্দ্রে!

 

তালতলা

ন্যাড়া একবারই বেলতলায় যায়। জনশ্রুতি আছে। কিছু ন্যাড়া অতিশয় চালাক, এরা বেলতলা দূরে থাকুক তালতলায়ও যায় না! যদিও তাল বেলের মতো অতটা ক্ষতিকারক নয়! অবাধ্য ন্যাড়াদের শায়েস্তা করার জন্য পথের দুই পাশে লাগিয়ে দেওয়া হল সারি সারি তালগাছ, যে গাছের তলায় না হেঁটে উপায়ও নেই। ফলে অবস্থা এমন হয়েছে, ন্যাড়ারা তো তালতলায় যায়ই, সাধারণ মানুষেরও না গিয়ে উপায় রইল না। তালতলায় গিয়েই বাসে উঠতে হয়; বাসের ড্রাইভার-কন্ডাক্টর মিলে যাত্রীদের তালের আঁটির মতো দোহন করে!

শফিক হাসান
শফিক হাসান
%d bloggers like this: