নারী শিক্ষার ইতিকথা – সাবেরা সুলতানা

নারী শিক্ষার ইতিকথা - সাবেরা সুলতানা

অতীতে ভারতীয় সমাজে নারী শিক্ষার কোন ধারনা ছিল না। যখন এ শিক্ষা শুরু হলো, প্রাথমিক পর্বে এটাকে স্ত্রী শিক্ষা হিসেবে অভিহিত করা হয়েছিল। এখানে নারী শিক্ষা বলতে আমি প্রাতিষ্ঠানিক নারী শিক্ষাকেই বুঝাতে চেয়েছি। মানব সমাজে বংশ পরম্পরায় প্রাকৃতিক শিক্ষা প্রচলিত থাকে। ভারতের নারীরাও এর ব্যতিক্রম ছিল না। ভারতে হাজার বছর ধরে বদ্ধ সমাজে নারীদের বিশেষ কিছু বিষয়ে পারদর্শিতা ছিল। সন্তান লালন-পালন, খাদ্য সংরক্ষণ, রান্না-বান্না এবং গৃহ আঙিনায় সবজি চাষ নারীরাই করতো। নিজের সৌন্দর্যচর্চাও করতো। চুল বাঁধা, সাজগোজ সবই ছিল। এমনকি বস্ত্রে ফুল তোলার মতো নান্দনিক কাজগুলোও নারীর একক কাজ হিসেবে বিবেচিত হতো।  এতদসত্ত্বেও সমাজের কোনো শ্রেণিতে স্ত্রী শিক্ষার কোন ব্যবস্থা ছিল না। ধনী-গরীব হিন্দু মুসলিম বা অন্য কোন ধর্ম বা শ্রেণিতে স্ত্রী শিক্ষার প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

 

শত শত বছর ধরে ভারতে যারা দখলদার জাতি হিসেবে আগমণ করেছিল, ভারত শোষণ করেছিল তাদের মধ্যেও কেউ স্ত্রী শিক্ষা বিষয়টি সাথে করে নিয়ে আসেনি। বৃটিশদের পূর্বে যারা ভারত দখল করেছিল, ভারত শাসন করেছিল তাদের কারো শিক্ষা ও সংস্কৃতি ভারত থেকে উন্নত ছিল না। তাই স্ত্রী শিক্ষার সাথে পরিচিত হতে ভারতীয় নারীদের বৃটিশ আগমণ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছিল।

 

ভারতে বৃটিশ শাসনের মধ্যভাগেই সমাজে এক ধরনের তোলপাড় সৃষ্টি হয়। তারই অভিঘাতে স্ত্রী শিক্ষা বিষয়টি সামনে এসে পড়ে। সমাজে স্ত্রী শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হতে থাকে। এই অভিঘাতের ঢেউ আছড়ে পড়ে হিন্দু-মুসলিম উভয় সমাজেই। মুসলিমরা অধিক রক্ষণশীল হওয়ার কারণে মুসলিম নারীদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার হাতে খড়ি হয় হিন্দু নারীদের আরো কিছুটা পরে।

 

হিন্দু রমণদের শিক্ষার হাতেখড়ি হয় তাদের উচ্চশিক্ষিত স্বামীদের একান্ত প্রচেষ্টায়। বাঙালি মুসলিম নারীদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শুরু হয় বেগম রোকেয়া সাখাওয়াতের নেতৃত্বেই। তিনিই প্রথম মুসলিম নারীদের জন্য বিদ্যালয় স্থাপন করেন এবং নারীদের প্রাথমিক প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সূচনা করেন। এই পর্বটির সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেওয়া খুব কষ্টকর, কেননা ধর্মীয় সংকীর্ণতার জন্যে বেগম রোকেয়াকে অপরিসীম কষ্ট পোহাতে হয়েছিল।

 

হিন্দু নারীদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা মুসলমান রমণীদের শিক্ষার তুলনায় ষাট সত্তুর বছর আগে শুরু হলেও কতক বিষয়ে হিন্দু এবং মুসলিম নারীদের কোন পার্থক্য ছিল না। আর সেটা হলো উভয় সম্প্রদায়ের রমণীগণ সম্পূর্ণরূপে অবরোধবাসিনী ছিলেন। সত্যিকার অর্থে তখন নারীদের পুরুষ অভিভাবকের অনুমতি ব্যতিরেকে বাহিরে যাওয়া নিষিদ্ধ ছিল। এক অর্থে নারীর প্রাথমিক প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শুরু হয়েছিল গৃহের অভ্যন্তরে অবরোধবাসিনী রূপেই স্বামী বা ভাইয়ের উৎসাহে। আরো কিছুকাল পরে ধনীদের মধ্যে কেউ কেউ বাড়িতে শিক্ষক রেখে নারীদের শিক্ষা দিতে শুরু করেন। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল বাড়ির মেয়েরা যেন ভালোভাবে সন্তান লালন-পালন করতে পারে। এদের মধ্যে যারা অধিক অভিজাত ছিলেন তারা ভাবতেন মেয়েদের উপযুক্ত জীবনসঙ্গিনী রূপে পেতে হলে সামান্য লেখাপড়া জানার দরকার আছে। সার্বিক বিবেচনায় সমাজের  মনোভাব পরিবর্তনে ভারতে নারী শিক্ষার পথিকৃৎ বলা চলে তৎকালীন ইংরেজি শিক্ষিত তরুণদেরকে। তারাই প্রথমে তাদের বিবাহিত স্ত্রীদেরকে শিক্ষিত করার প্রয়াস নিয়েছিলেন।

 

আজকে বাংলাদেশে স্কুলের ছাত্র ছাত্রীদের নিকট এসব কথা প্রায় অবিশ্বস্য মনে হবে। বাংলাদেশে শহর এলাকায় এবং গ্রাম এলাকায় ছাত্র ছাত্রীদের অংশগ্রহণের হার দেখলে পিছনের ইতিহাস বিশ্বস করা কঠিন বটে। আজকের বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের প্রতিটি পরিবার তাদের মেয়েদের স্কুলে পাঠানো অবশ্যই কর্তব্য কাজ মনে করে থাকেন।

 

স্বাধীনতা যুদ্ধ আমাদের নারী শিক্ষার কাজটি অনেকখানি সহজ করে দিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের আর্থ-সামাজিক পরিবর্তনের অনিবার্য অভিঘাতের ফলাফল হিসেবে দেখতে পারি নারী শিক্ষার প্রাতিষ্ঠানিক বিপুল অংশ গ্রহণকে। সে কথা বলবার জন্যে এতো সুদীর্ঘ ভূমিকার অবতারণা করলাম তা হলো আজকের বাংলাদেশের নারী সমাজ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সুফল পাচ্ছে। সন্তান লালন-পালন, স্বামীর যোগ্য হয়ে ওঠার জন্যের যে শিক্ষার শুরু আজ সে শিক্ষা জিডিপি’তে সরাসরি অবদান রাখছে। দেশ ও সমাজ নির্মাণে নারী শিক্ষার গুরুত্ব আজ অনেক বেশি। এখানেই থেমে থাকলে হবে না।  আমাদের যেতে হবে আরো অনেক দূর, অনেক সামনে।