নারীমুক্তিতে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অবদান / ড. শাহনাজ পারভীন

নারীমুক্তিতে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অবদান

নারীমুক্তিতে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অবদান

নারীমুক্তিতে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অবদান / ড. শাহনাজ পারভীন

 

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (১৮২০ খ্রি. -১৮৯১ খ্রি.) উনবিংশ শতাব্দীর এক বিচক্ষণ পন্ডিত ও মহান সমাজ-সংস্কারক ছিলেন। তিনি ২৬ সেপ্টেম্বর, ১৮২০ খ্রি. ব্রিটিশ ভারতের হুগলি জেলার বীরসিংহ গ্রামে মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ করেন। মায়ের নাম ভগবতা দেবী। তাঁর বাবা ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায় একজন চাকরিজীবী ছিলেন। পাঁচ বছর বয়সে  গ্রামের পাঠশালায় তাঁর পড়ালেখার হাতেখড়ি হয়। শিক্ষার্থী হিসেবে ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী এবং তুখোড়। নয় বছর বয়সে কলকাতায় এসে ভর্তি হন কলকাতা সংস্কৃত কলেজে। প্রতিভাবান ঈশ্বচন্দ্র ছাত্রজীবনে বরাবর বৃত্তি পেয়েছেন। ১৯৩৯ সালে ১৯ বছরের তরুণ ঈশ্বরচন্দ্র এক বিশেষ পরীক্ষায় প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে ‘বিদ্যাসাগর’ উপাধি লাভ করেন। ১৮৪১ সালে কলেজের প্রশংসাপত্রেও তাকে বিদ্যাসাগর হিসবে ভূষিত করা হয়। ১৮৪৯ সালে তাঁর ছাত্রজীবন শেষ হয়। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের প্রধান পন্ডিত ছিলেন তিনি। ১৮৫১ সালে সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ হন। তিনি একাধারে  একজন লেখক, দার্শনিক, পন্ডিত, শিক্ষাবিদ, অনুবাদক, প্রকাশক এবং একজন সমাজ সংস্কারক ছিলেন। 

 

উনিশ শতকের সামাজিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক জীবনের ক্ষয়িষ্ণুতার বিরুদ্ধে রেঁনেসা বা নবজাগরণের প্রয়োজন অত্যাবশ্যকীয় হয়ে উঠেছিলো। রেঁনেসার মানবকল্যাণমুখী জাগরণের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে নারী জাগরণ। নারীরা এতটাই দূর্বল, অধিকারহীন ও অক্ষম ছিলো যে, নিপীড়িত হয়েও তারা নিজেদের মুক্তির কথা ভাবতেও পারে নি। এই সময়ে সমাজের সার্বিক প্রগতির জন্য যাঁরা এগিয়ে আসেন, তাদের মধ্যে রাজা রামমোহন রায় (১৭৭২- ১৮৩৩ খ্রি.), ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (১৮২০-১৮৯১ খ্রি.), মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮১৭-১৯০৫ খ্রি.), বেগম রোকেয়া (১৮৮০- ১৯৩২ খ্রি.) প্রমুখ সামগ্রিকভাবে সমাজ পরিবর্তনের জন্য সংগ্রাম করে গেছেন। ঐ সময়ে বাংলার হিন্দু নারীরা যেমন বাঁচার অধিকার পেয়েছিলো রাজা রামমোহন রায়ের কাছ থেকে, তেমনি শিক্ষা, সম্মানও ব্যক্তিগত স্বাধীনতা নিয়ে বাঁচার পথ খুঁজে পেলো ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের চেষ্টায়। তেমনি মুসলিম মেয়েদের শিক্ষার অধিকার দিয়েছিলেন বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ছিলেন বিত্তহীন কিন্তু সামাজিক মানমর্যাদা সম্পন্ন পন্ডিত পরিবারের সন্তান। তাঁর অভীষ্ঠ লক্ষ্যে পৌঁছাতে তিনি নানামুখী বাঁধার সম্মুখীন হন। কিন্তু তিনি কোন অবস্থাতেই থেমে যান নি। তাঁর পথ থেকে সরে আসেন নি। তিনি কৃতিত্বের সাথে ন্যায়শাস্ত্র, জ্যোতিষশাস্ত্র, বেদান্ত-সংস্কৃত বিষয়ে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করেন। একান্ত চেষ্টা, একাগ্রতা, তার মানবতাধর্মী কাজের স্বীকৃতি হিসেবে  তিনি দরিদ্র বাবার দরিদ্র সন্তান হয়েও ‘দয়ার সাগর’ নামে বাংলার মানুষের মনে চিরদিনের জন্য স্থান করে নিয়েছেন।

 

নারীশিক্ষায় বিদ্যাসাগরের অবদান ছিল অসামান্য। স্বয়ং বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন: “বিধাতা বিদ্যাসাগরের প্রতি বঙ্গভূমিকে মানুষ করিবার ভার দিয়াছিলেন”। 

স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন:

 “রামকৃষ্ণের পর, আমি বিদ্যাসাগরকে অনুসরণ করি।” তিনিই ছিলেন বাংলার নবজাগরণের এক উজ্জ্বল পথিকৃৎ। তিনি বাল্য বিবাহের দোষ ও বিধবার পুনঃবিবাহ বিষয়ে বহু লেখালেখি, তর্ক উত্থাপন ও কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়ার জন্য আইন প্রণয়নের চেষ্টা করে সফল হয়েছেন। এর শুরু তাঁর মায়ের প্রেরণায়। যার একটি নিপুণ ইতিহাস আছে। যার বর্ণনা এই ছোট্ট লেখায় সম্ভব নয়। আমার নারী অধিকার ও অবস্থান শীর্ষক অভিসন্দর্ভে তা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বর্ণনা করেছি। 

 

পড়ালেখায় বিদ্যাসাগর অদম্য ছিলেন তো বটেই, লেখার হাতও ছিল অনন্য। তিনিই প্রথম বাংলা গল্পে বিরাম চিহ্নের সঠিক ব্যবহার করেন। বাংলা গদ্যের প্রাঞ্জল লেখা, শব্দের চৌকস ব্যবহার, সহজবোধ্য বাক্য প্রয়োগের কারণে বাংলা গদ্যে নিজেকে নিয়ে গিয়েছেন অনন্য উচ্চতায়। বলা হয়ে থাকে, তিনি বাংলা গদ্যের অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলার আবিষ্কারক। তাই তার আরেক উপাধি, বাংলা গদ্যের জনক। বাংলা বর্ণকে সুন্দরভাবে সাজিয়ে বর্ণমালার প্রথম সার্থক গ্রন্থ ‘বর্ণ পরিচয়’ তাঁরই রচনা। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অসংখ্য গ্রন্থের মধ্যে বর্ণপরিচয়, কথামালা, বোধোদয়, আখ্যানমঞ্জরী, ব্যাকরণ কৌমুদী, বেতাল পঞ্চবিংশতি, শকুন্তলা, বিধবা বিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব দ্বিতীয় খন্ড, বহুবিবাহ রহিত হওয়া উচিত কিনা এত দ্বিষয়ক প্রস্তাব দ্বিতীয় খন্ড, অতি অল্প হইল ১৮৭৩ খ্রি., আবার অতি অল্প হইল ১৮৭৩ খ্রি., ব্রজবিলাশ ১৮৮৪ খ্রি. উল্লেখযোগ্য। 

 

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সমাজ-সংস্কারের সঙ্গে ধর্মকে সংযুক্ত না করে মানবতাবাদের ওপর ভিত্তি করে একান্ত নিজস্ব উদ্যোগে সমাজ-সংস্কার আন্দোলনে ব্রতী হন। বিদ্যাসাগর ছিলেন একক সংগ্রামী। তিনি কোনো গোষ্ঠী বা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সমাজ-সংস্কার আন্দোলনে প্রয়াসী হন নি। রাজা রামমোহনের মতো ব্রাহ্মসমাজ অথবা ডিরোজিও’র নব্যবঙ্গ গোষ্ঠীর মতো কোনো প্রতিষ্ঠান তিনি গড়ে তোলেন নি। তিনি বাংলায় নারীশিক্ষার প্রসারে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেন। তিনি ছিলেন নারীশিক্ষার বিস্তারের পথিকৃৎ। তিনি উপলব্ধি করেন যে, নারীজাতির উন্নতি না ঘটলে বাংলার সমাজ ও সংস্কৃতির প্রকৃত উন্নতি সম্ভব নয়। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও ড্রিংকওয়াটার বিটন উদ্যোগী হয়ে কলকাতায় হিন্দু বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। এটিই ভারতের প্রথম ভারতীয় বালিকা বিদ্যালয়। বিদ্যাসাগর ছিলেন এই বিদ্যালয়ের সম্পাদক। এটি বর্তমানে বেথুন স্কুল নামে পরিচিত। ১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দে বর্ধমান জেলায় মেয়েদের জন্য তিনি একটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। গ্রামাঞ্চলে নারীদের মধ্যে শিক্ষার প্রসারের উদ্দেশ্যে তিনি বাংলার বিভিন্ন জেলায় স্ত্রীশিক্ষা বিধায়নী সম্মেলনী প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ব্যক্তিগত উদ্যোগ নিয়ে ১৮৫৮ খ্রিষ্টাব্দে মে মাসের মধ্যে নদীয়া, বর্ধমান, হুগলী ও মেদিনীপুর জেলায় ৩৫ টি বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। প্রায় ১৩০০ ছাত্রী এই স্কুলগুলিতে পড়াশোনা করত। পরবর্তীকালে তিনি সরকারের কাছে ধারাবাহিক তদবির করেন। তাঁর ধারাবাহিক তদবিরের ফলে সরকার এই স্কুলগুলোর কিছু আর্থিক ব্যয়ভার বহন করতে রাজি হয়। ১৮৬৪ খ্রিষ্টাব্দে বাংলায় বালিকা বিদ্যালয়ের সংখ্যা দাঁড়ায় ২৮৮ টি। এরপর কলকাতায় ১৮৭২ খ্রিষ্টাব্দে মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউশন (যা বর্তমানে বিদ্যাসাগর কলেজ নামে পরিচিত) এবং নিজের মায়ের স্মৃতি উদ্দেশ্যে নিজ গ্রাম বীরসিংহে ভগবতী বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। 

নারীশিক্ষা বিস্তারের ব্যাপারে তাঁর চেষ্টার কোনো ত্রুটি ছিল না। বিদ্যালয় পরিদর্শকের পদে থাকার সুযোগে তিনি বিভিন্ন জেলায় অসংখ্য বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন। এক্ষেত্রে তাঁর উল্লেখযোগ্য কৃতিত্ব হল ১৮৪৯ সালে বেথুন সাহেবের সহযোগিতায় ‘হিন্দু বালিকা বিদ্যালয়’ (বর্তমান বেথুন স্কুল) স্থাপন।

 

উনবিংশ শতকের প্রথমার্ধে পাশ্চাত্য শিক্ষা ও সংস্কৃতির প্রভাবে বাংলার সমাজ ও ধর্মসংস্কার আন্দোলনের সূচনা হয়। পন্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ছিলেন এই সংস্কার আন্দোলনের পথিকৃৎ। তাঁর পরিচালিত সংস্কার আন্দোলনে যুক্তিবাদী ও মানবতাবাদী চেতনার প্রতিফলন ঘটেছিল। প্রচলিত সামাজিক কুসংস্কার ও গোঁড়ামির অপসারণ করে তিনি সামাজ জীবনকে কলুষমুক্ত করতে চেয়েছিলেন। উনিশ শতকের সমাজ-সংস্কারের প্রধান দিকটি ছিল নারী জাতির কল্যাণসাধন। সারাজীবন ধরে তিনি সমাজ-সংস্কারে ব্রতী থাকেন। বিদ্যাসাগর বুঝেছিলেন, নারী জাতি অনগ্রসর ও কুসংস্কারচ্ছন্ন হয়ে থাকলে সমাজ পিছিয়ে থাকবে। বিদ্যাসাগর নারীমুক্তি আন্দোলনের  প্রবল সমর্থক ছিলেন। হিন্দুশাস্ত্র উদ্ধৃত করে বিদ্যাসাগর বিধবা-বিবাহের স্বপক্ষে জোর বক্তব্য রাখেন। বহুবিবাহ, বাল্য-বিবাহ প্রভৃতি কুসংস্কারের বিরুদ্ধে তিনি প্রবল জনমত গড়ে তোলেন। শেষ পর্যন্ত তাঁর আন্দোলন সফল হয় এবং ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে বিধবা-বিবাহ আইনসিদ্ধ হয়।

 

১৮৫০ খ্রিস্টাব্দে বিদ্যাসাগর বাল্য-বিবাহের বিরুদ্ধে জোর প্রচার শুরু করেন এবং ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে প্রায় পঞ্চাশ হাজার মানুষের স্বাক্ষর সম্বলিত এক আবেদন পত্র সরকারের কাছে পেশ করেন। ১৮৫৭ সালের নবজাগরণের পুরোধা ব্যক্তিত্ব হিসেবে তার নাম উল্লেখযোগ্য। বাল্যবিবাহ রোধ, বিধবা বিবাহের প্রচলন, বহুবিবাহ রোধসহ নারীর স্বার্থে বিভিন্ন কাজে তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। 

 

প্রধানত বিদ্যাসাগরের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ১৮৬০ খ্রিটাব্দে সরকারি আইন প্রণয়ন করে কন্যার বিবাহের বয়স সর্বনিম্ন দশ বছর নির্ধারিত করা হয়। তাঁর মানবহিতৈষী, নারীমুক্তি আন্দোলন ও সাহিত্য আন্দোলনে বাংলার নবজাগরণ উল্লেখযোগ্য। বিদ্যাসাগরের জীবন নানান গল্পে আর কীর্তিতে ভরপুর। মায়ের সেবায় অবিচল এই পন্ডিতের জীবনে রয়েছে অসংখ্য গল্প।  অসুস্থ মাকে দেখতে যাওয়ার জন্য ছুটি চেয়ে আবেদন নাকচ হওয়ায় চাকরি ছেড়ে দেন তিনি। মায়ের প্রতি ভালোবাসার আজ্ঞায় প্রচন্ড বর্ষার রাতে উত্তাল দামোদর নদী সাঁতরে মাকে দেখতে যাওয়াসহ মায়ের আজ্ঞার নানান গল্প এ সমাজকে আজও উজ্জীবিত করে। অধুনা ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায় ২৯ জুলাই ১৮৯১ খ্রিষ্টাব্দে ৭০ বছর বয়সে তিনি মৃত্যূবরণ করেন। 

সাহিত্য রচনার পাশাপাশি, সমাজ সংস্কার ও শিক্ষাবিস্তারেও বিদ্যাসাগরের অবদান রয়েছে। তিনি আমৃত্যু ছড়িয়ে গিয়েছেন সভ্যতার আলো।  ২৬ সেপ্টম্বর ছিল তাঁর দুইশত দুইতম জন্মবাষিকী। তাঁর দুইশত দুইতম জন্মবার্ষিকীতে তাঁর স্মরণই বলে দেয় তিনি এখনও তেমনি প্রাসঙ্গিক।

ড. শাহনাজ পারভীন

%d bloggers like this: