নজরুলের অনুবাদ: হাফিজ ও খৈয়াম / আফরোজা পারভীন

 নজরুলের অনুবাদ: হাফিজ ও খৈয়াম

 নজরুলের অনুবাদ: হাফিজ ও খৈয়াম

নজরুল জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে বিশেষ রচনা

 নজরুলের অনুবাদ: হাফিজ ও খৈয়াম / আফরোজা পারভীন

 

নজরুল ছিলেন স্বল্পায়ু। তাছাড়া আয়ুকালের মাত্র চব্বিশ বছর, ১৯১৯ থেকে ১৯৪২ সাল পর্যন্ত ছিল তাঁর সৃজনকাল  । জীবনের একটা দীর্ঘকাল মূক হয়ে ছিলেন তিনি। স্বল্পকালীন সাহিত্য জীবনে তাঁর অর্জন অনেক। আর এ থেকেই ধারণা করা যায় পূর্ণ সময়কাল বেঁচে থাকলে তিনি কী অসাধারণ সৃষ্টি রেখে যেতে পারতেন! তবে যা রেখে গেছেন তাও অমূল্য। এই অতি অল্পকালে তিনি রচনা করেছিলেন অসাধারণ সব কবিতা, গান, নাটক, প্রবন্ধ, ছোট গল্প, অনুবাদ সাহিত্য । 

নজরুলের প্রথম কবিতা “মুক্তি” । প্রকাশিত হয় ১৩২৬ বঙ্গাব্দে “বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য -পত্রিকা”র শ্রাবণ সংখ্যায় । দ্বিতীয় কবিতা “কবিতা-সমাধি” প্রকাশিত হয় একই বছর অর্থাৎ ১৩২৬ বঙ্গাব্দে সওগাত পত্রিকার আশ্বিন সংখ্যার । তৃতীয় কবিতা “আশায়” প্রকাশিত হয় একই বছর “প্রবাসী” পত্রিকার পৌষ সংখ্যায়।  নজরুলের “আশায়” কবিতাটি ছিলো পারস্য কবি হাফিজের একটি গজলের অংশবিশেষের অনুবাদ। নজরুলের পঞ্চম কবিতা “ বোধন” প্রকাশিত হয় ১৩২৭ বঙ্গাব্দে মোসলেম ভারত পত্রিকার  জৈষ্ঠ সংখ্যায়। এই কবিতাটিও ছিলো পারস্য কবি হাফিজের “য়ূসোফে গুম্ গশতা বাজ আয়েদ ব- কিনান গম মখোর” নামক গজলের অনুবাদ। ১৩২৭ বঙ্গাব্দের কার্তিক সংখ্যায় “বঙ্গনূর” পত্রিকায় নজরুল “রুমী” অবলম্বনে লেখেন “বাঁশীর ব্যথা”। 

নজরুল তাঁর সাহিত্য জীবনের শুরু থেকেই মৌলিক রচনার পাশাপাশি ফারসী সাহিত্য থেকে অনুবাদে আগ্রহ দেখান। সেই আগ্রহ থেকেই তাঁর ফার্সি সাহিত্যের অনুবাদের সূত্রপাত। সাহিত্য সাধনার প্রথম দিকে  তিনি  কিছু ইংরেজি থেকেও অনুবাদ করেছিলেন । তার কয়েকটি ১৩২৭ বঙ্গাব্দে ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকায়” “জননীদের প্রতি”, “শিশুর খুঁটিনাটি বিশেষত্ব” ও “জীবন বিজ্ঞান” শিরোনামে প্রকাশিত হয়।

সাহিত্যের সব শাখাতেই নজরুলের স্বচ্ছন্দ  পদচারণা ছিলো। জীবনের বিভিন্নমুখীতায় নজরুল মাতৃভাষা ছাড়াও অন্য ভাষা কম-বেশি জানতেন । বিশেষ করে ফার্সি সাহিত্যের প্রতি নজরুলের ছিলো ভীষণ দুর্বলতা। নজরুল ফার্সি ভাষা শিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন প্রথমত ছেলেবেলায় পিতৃব্যের কাছে, পরবর্তীতে  সৈনিক জীবনে। হাফিজের কবিতা তাঁকে মুগ্ধ করেছিল। সেই মুগ্ধতা থেকেই তিনি  ফার্সি সাহিত্য অনুবাদে হাত দিয়েছিলেন। নজরুল পল্টনে থাকাকালীন করাচি সেনানিবাসেই “দীওয়ান- ই- হাফিজ” থেকে কয়েকটি গজলের অনুবাদ  করেছিলেন। তিনি  তাঁর লেখা “রুবাইয়াৎ- ই-হাফিজ” গ্রন্থে লিখেছেন, “আমি তখন স্কুল পালিয়ে যুদ্ধে গেছি। সে আজ ইংরিজি ১৯১৭ সালের কথা। সেইখানেই আমার প্রথম হাফিজের সাথে পরিচয় হয়। আমাদের বাঙালী পল্টনে একজন পাঞ্জাবি মৌলভী সাহেব থাকতেন। তাঁর কাছে ক্রমেই আমি ফার্সি কবিদের প্রায় সমস্ত কাব্যই পড়ে ফেলি। ” এর কয়েক বছর পর থেকেই নজরুল হাফিজের বিখ্যাত গ্রন্থ “দীওয়ান” অনুবাদ করা শুরু করেছিলেন। আর “রুবাইয়াৎ ই  হাফিজ”  অনুবাদ শুরু করেন ১৩৩৭ বঙ্গাব্দের  বৈশাখ মাস থেকে।  নজরুলে অনুবাদকৃত ১০টি রুবাই তৎকালীন সময়ে “জয়তী” পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। উক্ত রুবাইগুলোর কবির নিজ হাতে  লেখা প্রতিলিপি “নজরুল- রচনা-সম্ভার” গ্রন্থে স্থান পেয়েছে। দু’একটি রুবাই এখানে উদ্ধৃত করা হলো: 

মদ্- লোভীরে মৌলভী কন্-

“পান করে এ শারাব যারা,

 যেমন মরে তেমনি ক’রে

 গোরের পারে উঠবে তা’রা! ”

তাই ত আমি সর্বদা রই

শারাব এবং প্রিয়ায় নিয়ে,

কবর থেকে উঠবে সাথে

এই শারাব এই দিল্- পিয়ারা।।

 

কলকাতার “শরৎচন্দ্র চক্রবর্তী এন্ড সন্স” ১৩৩৭ বঙ্গাব্দে নজরুলের “রুবাইয়াৎ- ই- হাফিজ” গ্রন্থটি প্রকাশ করেন। এই গ্রন্থের রুবাইগুলো মাসিক মোহাম্মদী পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। গ্রন্থটি প্রকাশিত হবার তিন বছর পর, ১৩৪০ বঙ্গাব্দে নজরুল অনুদিত পরপর ৫৯ টি ওমর  খৈয়ামের রুবাই প্রকাশ করে মোহাম্মদী পত্রিকা। কারণ ততদিনে নজরুলের ফার্সি ভাষা জ্ঞান ও দক্ষতার উপর সবার প্রতীতি জন্মেছে।

নজরুলের “রুবাইয়াৎ  ওমর   খৈয়াম” গ্রন্থটি প্রকাশিত হয় ১৩৬৬ বঙ্গাব্দের পৌষ মাসে। তাতে ১৯৭ টি রুবাই ছিলো। দু’একটি উদ্ধৃত করা হলো:

রাতের আঁচল দীর্ঘ ক’রে আসল শুভ ঐ প্রভাত,

জাগো সাকী! সকাল বেলার খোয়ারি ভাঙো আমার সাথ।

 ভোলো ভোলো বিষাদ- স্মৃতি! এমনি প্রভাত আসবে

ঢের,

খুঁজতে মোদের এইখানে ফের, করবে করুণ নয়নপাত।

 

এটিই ছিল ওই গ্রন্থের প্রথম রুবাই।

 

তবে মোহাম্মদীতে প্রথম  প্রকাশিত ১ নং রুবাইটি ছিলো এমন:

 

পূর্বাশার ঐ মিহির হানে তিমির- বিদার কিরন তীর।

কায়খসরুর লাল পিয়ালায় ঝরছে যেন মদ জ্যোতির।

 ভোরের শুভ্র বেদীমূলে ডাক দিয়ে কয় মুয়াজ্জিন 

জাগো জাগো, প্রাসাদ পেতে ঊষার ঘটের লাল পানির।

 

নজরুল পরবর্তীকালে রুবাইয়াৎটিতে কিছু বদল এনেছিলেন। এটা খুবই স্বাভাবিক। যে কোনো মৌলিক লেখার ক্ষেত্রেও এটা ঘটে। আর এ তো  এক ভাষা থেকে আরেকটি ভাষায়  রূপান্তর। মূলের কাছাকাছি আনার জন্য এই ধরণের রূপান্তর খুবই স্বাভাবিক। কারণ যে কোনো লেখকেরই চিন্তা থাকে মূলের যতটা সম্ভব কাছে যাওয়া । আর নজরুলের মতো বিশাল মাপের কবিতো সেটা করবেনই। 

ওমর  খৈয়াম এক অসাধারণ সাহিত্যিক। তাঁর সৃষ্টি মানুষের চিন্তার দোর খুলে দেয়। তিনি পারলৌকিক জীবনের  কথা বলেছেন। তাঁর লেখায় আধ্যাত্মবাদের সন্ধান মেলে। তাঁর দর্শন অনেকটা মারফতি ধাঁচের। গবেষক ফিডজেরাল্ডও  খৈয়ামের বেশকিছু রুবাই ইংরেজিতে অনুবাদ করেছিলেন।

ওমর  খৈয়াম মোটা দাগের সাধারণ সাহিত্যিক ছিলেন না। তিনি পারস্য সংস্কৃতি এবং সাহিত্যের কিছু জটিল বিষয় নিয়ে সাধনা করেছেন। তবে অনেক বড় মনীষির মতোই সমকালে ওমর  খৈয়ামকে মানুষ চিনতে পারেনি।  বিশ্বসাহিত্যে খৈয়াম অমূল্য রত্নরাজি রেখে গেছেন। ওমর   খৈয়াম ফার্সি ভাষায় বলেছেন,

খাইয়াম কে খিমাহায়ে হিকমৎ মিদোখ্ত্

দার কোরায়ে নাম ফেতাদ ও নাগাহ্ বসোখ্ত

 মেকরাজে আজল্ তানার ওমরাশ্ চুবুরাদ্

দাল্লাল কাজা বরায়গনাশ্ বফরোখত

 

খৈয়ামের এই রুবাইটি নজরুল অনুবাদ করেছেন  এভাবে:

 

 খৈয়াম যে জ্ঞানের তাঁবু করল সেলাই আজীবন,

অগ্নিকুন্ডে পঁড়ে সে আজ সইছে দহন অসহন।

তাঁর জীবনের সূত্রগুলি মৃত্যু কাঁচি কাটলো হায়,

ঘৃণার সাথে বিকায় তারে তাই নিয়তির দালালগণ।

 

 নজরুলের জন্মের প্রায় তিন দশক আগে ১৮৬৫ সালের পর অক্ষর কুমার বড়াল ওমরের ভাব ঠিক রেখে রুবাইগুলো বাংলায় অনুবাদ করেছিলেন যার প্রথমটা  এমন:

আর ঘুমায়ো না, পান্থ, মেলহ নয়ন।

প্রাচী- প্রান্তে ফুটে, প্রভাত- কিরণ।

এলোকেশী নিশীথিনী পলায় তরাসে

অঞ্চলে কুড়ায়ে তার ছড়ান রতন।।

নজরুলের সমসাময়িককালে কান্তিচন্ত্র ঘোষ ওমর   খৈয়ামের ৭৫ টি রুবাই বাংলায় অনুবাদ করে তাঁর ‘ রোবাইয়াৎ -ই – ওমর –  খৈয়াম’ প্রকাশ করেন। তাঁর অনুদিত ১ নং রুবাইটি এমন:

 

রাত পোহালো- শুনছ সখি, দীপ্ত ঊষার মাঙ্গলিক?

লাজুক তারা তাই শুনে কি পালিয়ে গেছে দিগ্বিদিক।

পূব-গগনের দেব্ শিকারীর স্বর্ণ উজল কিরণ – তীর

পড়ল সেথা রাজপ্রাসাদের মিনার যেথা উচ্চশির।

 ওমর    খৈয়ামের রুবাই অনেক কবি  এ পর্যন্ত বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদ করেছেন।  কিন্তু তার অনেক অনুবাদই   খৈয়ামের  লেখার আবেদন ও ভাব ফুটিয়ে তুলতে পারেনি। নজরুলের অনুবাদকৃত রুবাই অনেকটাই ওমর  খৈয়ামের ভাব বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছিলো। এর কারণ সম্ভবত নজরুলের ফার্সি ভাষায় বুৎপত্তি ও ওমর  খৈয়ামকে ভালো করে পাঠ করা।  আসলে যেকোনো বিদেশি সাহিত্য অনুবাদ করতে হলে উক্ত ভাষার ওপর ব্যাপক দখল থাকা প্রয়োজন। নাহলে অনুবাদ কাজ সহজ ও সাবলীল  হয় না। 

এক কবি অন্য কবি দ্বারা প্রভাবিত হবেন বা তাদের কবিতার ভক্ত হবেন এটা অতি সাধারণ ঘটনা। কবি কাজী নজরুল ইসলাম অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন ফারসি কবিদের দ্বারা।  নজরুল ওমর  খৈয়াম, জালালউদ্দীন রুমি এবং শামসুদ্দীন মুহম্মদ হাফিজের কবিতা অনুবাদ করেছেন ভালোবেসে।

এদেশের মানুষ কেন ফার্সি ভাষার প্রতি অনুরক্ত হলো বা অনেকেই ফার্সি শিখল সে ইতিহাস জানা প্রয়োজন। ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বখতিয়ার খিলজী বাংলায় পদার্পণ করেন হিজরীর পঞ্চম শতকের শেষভাগে। ১২০৪ খ্রিস্টাব্দে  বাংলায় মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। তখন থেকে এদেশে ফারসির প্রচলন শুরু হয়। মোঘল আমলে ফারসি রাজভাষার মর্যাদা পায়। এছাড়াও বাংলার সুলতান গিয়াস উদ্দিন আযম শাহ ফারসি ভাষা ও সাহিত্যের উন্নয়নে সর্বাধিক গুরুত্বারোপ করেন। সুলতান গিয়াস এসময় ইরানের মহাকবি হাফিজকে বাংলা ভ্রমণের আমন্ত্রণ জানান। গিয়াস উদ্দিন আযম শাহের আমন্ত্রণ পেয়ে মহাকবি হাফিজ বাংলায় আগমনের জন্য যাত্রা করেন। কিন্তু জাহাজে ওঠার আগে সমুদ্রে প্রবল ঝড় ওঠে। তিনি একে  দৈবের নির্দেশ ভেবে ফিরে যান। তাঁর আর বাংলা-ভারত সফর করা সম্ভব হয়নি। ইংরেজরা এদেশ দখলের কিছুদিন পর ফারসির পরিবর্তে ইংলিশকে রাজভাষা করলে ফারসির গুরুত্ব কমে যায়। তবে মাদ্রাসা-মক্তবগুলোতে ফারসি চর্চা চলতে থাকে। পারিবারিকভাবে নজরুল পরিবারের মসজিদ মাজারের সাথে সম্পর্ক ছিল। বড় বড় ধর্মীয় কিতাব ফারসিতে রচিত ছিলো। তাই নজরুলের বাবা মাজারের খাদেম থাকার ফলে পারিবারিকভাবে ও বাবার কর্মস্থলের কারণে ও পিতৃব্যের কারণে ছোটবেলায় ফারসির সাথে নজরুলের পরিচয় হয়েছিল।

 নজরুল  শৈশবে বেনেপাড়ার বিনোদ চাটুজ্জের পাঠশালায় কিছুদিন পড়াশুনা করেন। তারপর গ্রামের মক্তবে লেখাপড়া শুরু করেন। এখানে তিনি কোরআন পাঠ আয়ত্ত করেন। মক্তবে তিনি আরবি ও ফারসি ভাষার প্রথম পাঠ লাভ করেছিলেন মৌলবি কাজী ফজলে আলীর কাছে। পরে ফারসি শেখেন তাঁর চাচা কাজী বজলে করিমের  কাছে।

নজরুলের জীবনে বিষাদময় ঘটনা এটি যে, যে দিন তিনি হাফিজের দীওয়ান অনুবাদ শেষ করেন সেদিনই তাঁর পুত্র বুলবুলের মৃত্যু ঘটে।  নজরুল লিখেছেন, ‘আমার জীবনের যে ছিল প্রিয়তম, যা ছিল শ্রেয়তম তারই নজরানা দিয়ে শিরাজের বুলবুল কবিকে বাঙলায় আমন্ত্রণ করে আনলাম। . . . .  আমার আহ্বান উপেক্ষিত হয়নি। যে পথ দিয়ে আমার পুত্রের ‘জানাযা’ (শবযান) চলে গেল, সেই পথ দিয়ে আমার বন্ধু, আমার প্রিয়তম ইরানী কবি আমার দ্বারে এলেন। আমার চোখের জলে তাঁর চরণ অভিষিক্ত হল’।”

  দ্রোহ ও সাম্যের কবি নজরুল পুত্রের মৃত্যুশয্যায় বসে ‘রুবাইয়াৎ-ই-হাফিজ’এর অনুবাদ সম্পন্ন করেন। কতোটা শিষ্যত্ব অর্জন করলে, কতবড় ভক্ত হলে এরকম একটি চরম মুহূর্তে পুত্রের মৃত্যুশয্যা পাশে বসে হাফিজের অনুবাদ করা যায় তা সহজেই অনুমেয়।‘রুবাইয়াৎ-ই-হাফিজ’ অনুবাদ কাব্যের উৎসর্গপত্রে কবি লিখেছেন-

“বাবা বুলবুল!

 তোমার মৃত্যু-শিয়রে বসে ‘বুলবুল-ই-শিরাজ’

হাফিজের রুবাইয়াতের অনুবাদ আরম্ভ করি। যেদিন

অনুবাদ শেষ করে উঠলাম, সেদিন তুমি আমার

কাননের বুলবুলি উড়ে গেছ। যে দেশে গেছ তুমি,

 সে কি বুলবুলিস্তান ইরানের চেয়েও সুন্দর?

জানি না তুমি কোথায়! যে লোকেই থাক, তোমার

 শোক-সন্তপ্ত পিতার এই শেষ দান শেষ চুম্বন বলে গ্রহণ করো।

 তোমার চার বছরের কচি গলায় যে সুর শিখে গেলে,

তা ইরানের বুলবুলিকেও বিস্ময়ান্বিত করে তুলবে।

শিরাজের বুলবুল কবি হাফিজের কথাতেই

 তোমাকে স্মরণ করি,

‘ সোনার তাবিজ রূপার সেলেট

মানাত না বুকে রে যার,

পাথর চাপা দিল বিধি

হায়, কবরের শিয়রে তার।”

 ইরানের কবি হাফিজ আর ওমর  খৈয়ামের  অনুবাদ অনেকেই করেছেন। তাদের সাথে নজরুলের পার্থক্য নজরুল মূল ফারসী থেকে অনুবাদ করেছেন বাকীরা অধিকাংশ ইংরেজিথেকে।

‘রুবাইয়াৎ-ই হাফিজ’এ কবি হাফিজের পরিচয় দিয়েছেন নজরুল। তিনি লিখেছেন-

“শিরাজ ইরানের মদিনা, পারস্যের তীর্থভূমি। শিরাজেরই মোসল্লা নামক স্থানে বিশ্ববিশ্রুত কবি হাফিজ চতুর্দশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে জন্মগ্রহণ করেন।

ইরানের এক নীশাপুর (ওমর  খৈয়ামের জন্মভূমি) ছাড়া আর কোনো নগরই শিরাজের মত বিশ্বজোড়া খ্যাতি লাভ করে নাই। ইরানের প্রায় সমস্ত শ্রেষ্ঠ কবিরই লীলা নিকেতন এই শিরাজ।

ইরানীরা হাফিজকে আদর করিয়া ‘বুলবুল-ই-শিরাজ’ বা শিরাজের বুলবুলি বলিয়া সম্ভাষণ করে।

হাফিজকে তাহারা শুধু কবি বলিয়াই ভালোবাসে না। তাহারা হাফিজকে ‘লিসান-উল্-গায়েব (অজ্ঞাতের বাণী), ‘তর্জমান্-উল-আস্রার’ (রহস্যের মর্মসন্ধানী) বলিয়াই অধিকতর শ্রদ্ধা করে। হাফিজের কবর আজ ইরানের শুধু জ্ঞানী-গুণীজনের শ্রদ্ধার স্থান নয়, সর্ব সাধারণের কাছে ‘দরগা’, পীরের আস্তানা।”

“হাফিজের আসল নাম শামসুদ্দিন মোহাম্মদ। ‘হাফিজ’ তাঁহার ‘তখল্লুস’, অর্থাৎ কবিতার ভণিতায় ব্যবহৃত উপ-নাম। যাঁহারা সম্পূর্ণ কোরান কণ্ঠস্থ করিতে পারেন, তাঁহাদিগকে মুসলমানেরা ‘হাফিজ’ বলেন। তাঁহার জীবনী লেখকগণও বলেন, হাফিজ তাঁহার পাঠ্যাবস্থায় কোরান কণ্ঠস্থ করিয়া ছিলেন।”

“হাফিজের গান অতল গভীর সমুদ্রের মত। কুলের পথিক যেমন তাহার বিশালতা, তরঙ্গ লীলা দেখিয়া অবাক বিস্ময়ে চাহিয়া থাকে, অতল-তলের সন্ধানী ডুবুরী তেমনি তাহার তলদেশে অজস্র মণিমুক্তার সন্ধান পায়। তাহার উপরে যেমন ছন্দ-নর্তন, বিপুল বিশালতা; নিম্নে তেমনি অতল গভীর প্রশান্তি, মহিমা।”

“হাফিজের সমস্ত কাব্য ‘শাখ্-ই-নবাত্’ নামক কোনো ইরানী সুন্দরীর স্তবগানে মুখরিত। অনেকে বলেন, ‘শাখ্-ই-নবাত্’ হাফিজের দেওয়া আদরের নাম। উহার আসল নাম হাফিজ গোপন করিয়া গিয়াছেন। কোন ভাগ্যবতী এই কবির প্রিয়া ছিলেন, কোথায় ছিল তাঁর কুটির, ইহা লইয়া অনেকে অনেক জল্পনা-কল্পনা করিয়াছেন। রহস্য-সন্ধানীদের কাছে এই হরিণ – আঁখি সুন্দরী আজো রহস্যের অন্তরালেই রহিয়া গিয়াছেন।”

“তাঁহার মৃত্যু সম্বন্ধে একটি বিস্ময়কর গল্প শুনা যায়। শিবলী নোমানী, ব্রাউন সাহেব প্রভৃতি পারস্য-সাহিত্যের সকল অভিজ্ঞ সমালোচকই এই ঘটনার উল্লেখ করিয়াছেন।

হাফিজের মৃত্যুর পর একদল লোক তাঁহার ‘জানাজা’ পড়িতে (মুসলমানী মতে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া করিতে) ও কবর দিতে অসম্মত হয়। হাফিজের ভক্তদলের সহিত ইহা লইয়া বিসম্বাদের সৃষ্টি হইলে কয়েকজনের মধ্যস্থতায় উভয় দলের মধ্যে এই শর্তে রফা হয় যে, হাফিজের সমস্ত কবিতা একত্র করিয়া একজন লোক তাহার যে কোনো স্থান খুলিয়া দিবে; সেই পৃষ্ঠার প্রথম দুই লাইন কবিতা পড়িয়া হাফিজের কি ধর্ম ছিল তাহা ধরিয়া লওয়া হইবে।

আশ্চর্যের বিষয়, এইরূপে নিম্নলিখিত দুই লাইন কবিতা পাওয়া গিয়াছিল। 

“কদমে দরিগ মদার আজ জানাজায়ে হাফিজ,

 কে র্গচে গর কে গোনাহস্ত মি রওদ বেহেস্ত।”

“হাফিজের এই শব হ’তে গো তু’লো না কো চরণ প্রভু

যদিও সে মগ্ন পাপে বেহেশতে সে যাবে তবু।”

এরপর বিস্মিত সম্মত অসম্মত উভয় দল। তারা মহাসমারোহে হাফিজকে এক আঙুর-বাগানে সমাহিত করেন। সে স্থান ‘হাফিজিয়া’ নামে প্রসিদ্ধ। দেশ বিদেশ থেকে আগত অসংখ্য লোক হাফিজের কবরে শ্রদ্ধাঞ্জলি জ্ঞাপন, অর্পন করে।’

দীওয়ান এর মুখবন্ধে নজরুল উল্লেখ করেন-

    “সত্যকার হাফিজকে চিনতে হলে তাঁর গজল-গান-প্রায় পঞ্চশতাধিক পড়তে হয়। তাঁর রুবাইয়াৎ বা চতুষ্পদী কবিতাগুলি পড়ে মনে হয়, এ যেন তাঁর অবসর সময় কাটানোর জন্যই লেখা। অবশ্য এতেও তাঁর সেই দর্শন, সেই প্রেম, সেই শারাব-সাকি তেমনিভাবেই জড়িয়ে আছে।

    এ যেন তাঁর অতল সমুদ্রের বুদবুদ-কণা। তবে এ ক্ষুদ্র বিশ্ব হলেও এতে সারা আকাশের গ্রহ-তারার প্রতিবিম্ব পড়ে একে রামধনুর কণার মত রাঙিয়ে তুলেছে। হয়ত ছোট বলেই এ এত সুন্দর।

    আমি অরিজিন্যাল (মূল) ফার্সি হতেই এর অনুবাদ করেছি। আমার কাছে যে কয়টি ফার্সি ‘দীওয়ান-ই-হাফিজ’ আছে, তার প্রায় সব কয়টাতেই পঁচাত্তরটি রুবাইয়াৎ দেখতে পাই। অথচ ফার্সি সাহিত্যের বিশ্ববিখ্যাত সমালোচক ব্রাউন সাহেব তাঁর History of Persian Literature এ এবং মৌলানা নৌমানী তার ‘ শেয়রুল-আজম’-এ মাত্র উনসত্তরটি রুবাইয়াতের উল্লেখ করেছেন; এবং এই দুইজনই ফার্সি কবি ও কাব্য সম্বন্ধে Authority, বিশেষজ্ঞ। আমার নিজেরও মনে হয়, ওদের ধারণাই ঠিক। … হাফিজকে আমরা কাব্য-রস পিপাসুর দল- কবি বলেই সম্মান করি, কবি-রূপেই দেখি। তিনি হয়তবা সুফি দরবেশও ছিলেন। তাঁর কবিতাতেও সে আভাষ পাওয়া যায় সত্য। শুনেছি, আমাদের দেশেও মহর্ষি দেবেন্দ্র নাথ ঠাকুর, কেশব সেন প্রভৃতি হাফিজের কবিতা উপাসনা-মন্দিরে আবৃত্তি করতেন। তবু তাঁর কবিতা শুধু কবিতাই। তাঁর দর্শন আর ওমর  খৈয়ামের দর্শন প্রায় এক।’

গবেষক মুজতাহিদ ফারুকী নজরুলের উপর হাফিজের প্রভাব সম্পর্কে লিখেছেন,

‘নজরুল গীতিকা’তে তো ‘ওমর  খৈয়াম-গীতি’ ও ‘দীওয়ান-ই-হাফিজ-গীতি’ নামে আটটি করে কবিতা গান অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এ থেকেই প্রতীয়মান হয় যে, ফারসি সাহিত্য তথা পারস্যের মহাকবি হাফিজ দ্বারা নজরুল কতটা অনুপ্রাণিত ছিলেন!

 মহাকবি হাফিজ প্রেমিক ছিলেন।  প্রেমের  ব্যাপারে  বেহিসেবি ছিলেন! প্রিয়ার ঠোঁটের কালো তিলের বিনিময়ে সামারকান্দ ও বোখারা নগরী বিলিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। সেই কবিতার অনুবাদ করেছেন কাজী নজরুল এভাবে,

“প্রাণ যদি মোর ফিরে দেয় সেই তুর্কী চাওয়ার মনচোরা,

একটি কালো তিলের লাগি বিলিয়ে দেব সমরকান্দ ও বোখারা।”

হাফিজের মতোই প্রেমের কবিকায় নজরুল ছিলেন অনবদ্য। তাঁর কালজয়ী একটি প্রেমের নমুনা:

“ মোর প্রিয়া হবে এস রানী

 দেব খোপায় তাঁরার ফুল

কর্ণে দোলাবো তৃতীয়া তিথি

 চৈতী চাঁদের দুল।।”

 

‘তারিখে আদাবিয়্যাতে ফারসি’ গ্রন্থে হাফিজের দীওয়ান সম্পর্কে মন্তব্য করা হয়েছে যে, হাফিজ তাঁর কবিতায় ও গজলে সঙ্গীত কাঠামো প্রয়োগ করেছেন যার সামষ্টিক উদ্দেশ্য হলো সৃষ্টিকর্তা ও ধর্ম সম্পর্কিত।  আর আমাদের অনেকের কাছে নজরুল তাঁর সঙ্গীতের কারণেই পরিচিত। তাঁর অনেক সঙ্গীতই ধর্মীয়। যেমনটি ‘ও মন রমজানেরই রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ।’

 হাফিজ আর নজরুলের জীবনে সাদৃশ্যও অনেক। হাফিজও  ছেলেবেলায় পিতৃহীন। মা’কে নিয়ে দারিদ্রে দিনাতিপাত করেছেন, রুটির দোকানে কাজ নিয়েছেন। নিজ উদ্যোগে পড়াশুনা করেছেন। ঠিক একই জীবন নজরুলের।

 আর  লেখার ক্ষেত্রে হাফিজ  “ভন্ড-তাপস ও জালিম বাদশাহদের বিরুদ্ধে কবিতার খড়গ চালিয়েছেন।” নজরুলও খড়গ চালিয়েছেন অত্যাচারীর বিরুদ্ধে। তাঁর কবিতা,

“যবে উৎপিড়ীতের ক্রন্দন-রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না-

অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না-

বিদ্রোহী রণক্লান্ত

আমি সেই দিন হব শান্ত!”

‘রুবাইয়াৎ-ই-হাফিজে’ মোট ৭৩টি রুবাই মুদ্রিত হয়েছে। গ্রন্থের মুখবন্ধে রয়েছে আরো ২টি রুবাইর অনুবাদ। এই ৭৫টি রুবাইর মধ্যে বিষয় নির্দেশক প্রতিনিধিত্ব করে এরকম ২টি রুবাই উপস্থাপন করা হলো। 

১ নং রুবাই

‘ তোমার ছবির ধ্যানে, প্রিয়

দৃষ্টি আমার পলক-হারা।

 তোমার ঘরে যাওয়ার যে-পথ

পা চলে না সে-পথ ছাড়া।

হায়, দুনিয়ায় সবার চোখে

নিদ্রা নামে দিব্য সুখে,

আমার চোখেই নেই কি গো ঘুম,

দ্বগ্ধ হ’ল নয়ন-তারা।।’

 

৫ নং রুবাই

‘আনতে বল পেয়ালা শারাব

পার্শ্বে বসে পরান-বঁধুর।

নিঙাড়ি লও পুষ্প-তনু

তন্বঙ্গীর অধর-আঙুর।

আহত যে-ক্ষত-ব্যথায়

 সোয়াস্তি চায়, চায় সে আরাম;

বিষম তোমার হৃদয়-ক্ষত,

ডাকো হাকিম কপট চতুর।।’

 কবি ওমর  খৈয়ামের নানান উক্তি আমাদের জীবনযাপনের অংশ হয়ে গেছে।  তাঁর বলা প্রচলিত একটি কথা আছে, ‘যদি তুমি এক জীবনে হাজার জীবন বাঁচতে চাও, তাহলে পড়ো। আর এক জীবনে হাজার জীবন বাঁচতে চাও, তাহলে লেখো।’ কিন্তু  সব  লেখা স্থায়িত্ব পায় না, টিকেও থাকে না।নিজের অনুদিত রুবাইয়াৎ-ই-ওমর  খৈয়াম-এর ভূমিকায় নজরুল লিখেছেন, ‘ওমরের রুবাইয়াৎ বা চতুষ্পদী কবিতা চতুষ্পদী হলেও তার চারটি পদই ছুটেছে আরবি ঘোড়ার মতো দৃপ্ত তেজে সম-তালে-ভন্ডামি, মিথ্যা বিশ্বাস, সংস্কার, বিধি-নিষেধের পথে ধূলি উড়িয়ে তাদের বুক চূর্ণ করে।’

সৈয়দ মুজতবা আলী ১৯৫৯ সালে প্রকাশিত এবং কাজী নজরুল ইসলাম অনুদিত রুবাইয়াৎ-ই-ওমর  খৈয়াম-এর ভূমিকা লিখেছিলেন।  খৈয়ামের প্রায় এক হাজার রুবাই থেকে মোট ১৯৭টি রুবাই অনুবাদ করেছিলেন তিনি। তাঁর অনূদিত ১ থেকে ৩১ রুবাই ১৩৪০ কার্তিকের, ৩২ থেকে ৪৬– সংখ্যক রুবাই ১৩৪০ অগ্রহায়ণের এবং ৪৭ থেকে ৫৯ –সংখ্যক রুবাই পৌষের মাসিক মোহাম্মদীতে প্রকাশিত হয়।

নজরুল ও খৈয়াম দুজনেরই লড়াই ছিল সামাজিক অনাচার-অবিচারের বিরুদ্ধে। ওমর লড়েছেন তাঁর সময়ের মোল্লাতন্ত্রের বিরুদ্ধে। নজরুল ভন্ড অত্যাচারী ছাড়াও লড়েছেন বিদেশি সরকারের বিরুদ্ধে।  মোল্লা-পুরুততন্ত্র জাতপাতের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন সোচ্চার।

 ওমর খৈয়ামের রুবাইয়াৎ-এর অনুবাদ সম্পর্কে নজরুলের নিজস্ব ভাষ্য হলো, ‘ওমর  খৈয়ামের ভাবে অনুপ্রাণিত ফিটসজেরাল্ডের কবিতার যাঁরা অনুবাদ করেছেন, তাঁরা সকলেই আমার চেয়ে শক্তিশালী ও বড় কবি। কাজেই তাঁদের মতো মিষ্টি শোনাবে না হয়তো আমার এ অনুবাদ। যদি না শোনায়, সে আমার শক্তির অভাব-সাধনার অভাব, কেননা কাব্য-লোকের গুলিস্তান থেকে সঙ্গীতলোকের রাগিণী-দ্বীপে আমার দীপান্তর হয়ে গেছে। সঙ্গীত-লক্ষ্মী ও কাব্য-লক্ষ্মী দুই বোন বলেই বুঝি ওদের মধ্যেই এত রেষারেষি। একজনকে পেয়ে গেলে আরেক জন বাপের বাড়ি চলে যান। দুই জনকে খুশি করে রাখার শক্তি রবীন্দ্রনাথের মতো লোকেরই আছে। আমার সেই সম্বলও নেই, শক্তিও নেই। কাজেই আমার অক্ষমতার দরুন কেউ যেন পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি ওমরের উপর চটে না যান।’ 

এ এক অসাধারণ ভাষ্য! এতে একদিকে রয়েছে বিদ্রোহী কবির বিনয়ের প্রকাশ, কবিতা ও সংগীত নিয়ে নিজের মত, সেই সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের প্রতি বিপুল আস্থা। আর  খৈয়ামের প্রশস্তি তো আছেই।

রুবাইয়াৎ-ই-ওমর  খৈয়াম-এর ভূমিকায় নজরুল লিখেছেন:

 ‘ওমরের কাব্যে শারাব-সাকির ছড়াছড়ি থাকলেও তিনি জীবনে ছিলেন আশ্চর্য রকমের সংযমী। তাঁর কবিতায় যেমন ভাবের প্রগাঢ়তা, অথচ সংযমের আঁটসাঁট বাঁধুনী, তাঁর জীবনও ছিল তেমন।…তিনি মদ্যপ লম্পটের জীবন (ইচ্ছা থাকলেও) যাপন করতে পারেননি। তাছাড়া ও-ভাবে জীবনযাপন করলে গোঁড়ার দল তা লিখে রাখতেও ভুলে যেতেন না। অথচ, তাঁর সবচেয়ে বড় শত্রুও তা লিখে যাননি।’

ওমর কবিতা লিখেছেন।  সে কবিতা পড়ে নজরুলেরও রস-পিপাসা মিটেছে।  খৈয়াম সুরা, সাকি, শারাবসহ আরও যেসব শব্দ ব্যবহার করেছেন, প্রচলিত অর্থে করেননি তিনি। তাঁর কবিতার সরল অর্থ করা বাতুলতা। ‘নগদ যা পাও হাত পেতে নাও/ বাকির খাতা শূন্য থাক/ দূরের বাদ্য লাভ কি শুনে/ মাঝখানে যে বেজায় ফাঁক।’ 

মহাকবি হাফিজসহ পারস্যের কবিদের জীবন দর্শন পর্যালোচনা করতে গিয়ে নজরুল আরো উল্লেখ করেন,

“এঁরা সকলেই আনন্দ-বিলাসী। ভোগের আনন্দকেই এঁরা জীবনের চরম আনন্দ বলে স্বীকার করেছেন। ইরানের অধিকাংশ কবিই যে শারাব-সাকি নিয়ে দিন কাটাতেন, এও মিথ্যা নয়।

তবে এও মিথ্যা নয় যে, মদিরাকে এঁরা জীবনে না হোক কাব্যে প্রেমের আনন্দের প্রতীকরূপেই গ্রহণ করে ছিলেন।

শারাব বলতে এঁরা বোঝেন-ঈশ্বর প্রেম যা মদিরার মতই মানুষকে উন্মত্ত করে তোলে। ‘সাকি’ অর্থাৎ যিনি সেই শারাব পান করান। যিনি সেই ঐশ্বরিক প্রেমের দিশারী, দেয়াসিনী। পানশালা- সেই ঐশ্বরিক প্রেমের লীলা-নিকেতন।

কাজী নজরুল ইসলাম শুধু বাংলা সাহিত্যেরই সম্পদ নয়, বিশ্ব সাহিত্যেরও অমূল্য সম্পদ।  অন্যান্য দেশের পাঠকের মতো ইরানীদের আবেগ-অনুভূতির কমতি নেই তাঁকে নিয়ে। বরং অনেকটা বেশি। কারণ ইরানের তিন অমর কবি হাফিজ রুমি খৈয়ামের অনুবাদ করে তিনি বিশ্বপাঠকের হাতে তুলে দিয়েছেন।

 

তথ্যসূত্র :

১. কাজী নজরুল ইসলাম, ‘রুবাইয়াৎ-ই-হাফিজ’। মুখবন্ধ। নজরুল রচনাবলী, নতুন সংস্করণ, দ্বিতীয় খন্ড। ২৫ মে ১৯৯৩। বাংলা একাডেমি, ঢাকা।

২. নজরুল রচনাবলী, তৃতীয় খন্ড, বাংলা একাডেমী, সম্পাদক : আবদুল কাদির।

৩. নজরুল কাব্যে আরবী ফারসী শব্দ, আব্দুস সাত্তার, নজরুল ইন্সটিটিউট, ঢাকা।

৪. মহাকবি হাফিজের জীবন ও কর্ম (প্রবন্ধ)- মোঃ নূরে আলম।

৫. বিদ্রোহী কবি নজরুল ও মহাকবি হাফিজ (প্রবন্ধ)- ড. আবুল আজাদ।

আফরোজা পারভীন
আফরোজা পারভীন
%d bloggers like this: