নজরুলের জীবনে কুমিল্লা অধ্যায়/ কাজী মুজাহিদুর রহমান

নজরুলের জীবনে কুমিল্লা অধ্যায়

নজরুলের জীবনে কুমিল্লা অধ্যায়

নজরুলের জীবনে কুমিল্লা অধ্যায়/ কাজী মুজাহিদুর রহমান

প্রত্যেক বছর আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্ম অথবা মৃত্যূ দিবস আসলে আমাদের প্রচার মাধ্যমগুলো একটা ভুল বার্তা বাংলা  ভাষা-ভাষী জনগণকে দেয় তা হলো, নজরুল তাঁর জীবনে একবার কুমিল্লা গিয়েছিলেন এবং সেখানে নার্গিস নামে এক মহিলাকে বিয়ে করেছিলেন।  কিন্তু কোন এক অজ্ঞাত কারণে তাঁর সাথে সংসার করেননি।  বিয়ের পরদিনই নজরুল কুমিল্লা ত্যাগ করেন। জেলার মুরাদনগর উপজেলার দৌলতপুর গ্রামের কিছু সাংস্কৃতিক সংগঠনও নজরুলকে নিয়ে প্রতি বৎসর অনুষ্ঠানাদি পালন করে। একটা ভুল তথ্য বারবার বললে যেমন সেটা গ্রহণযোগ্যতা পায়, তেমনি কথাটা অনেকের মতো আমিও বিশ্বাস করতাম। তবে ঘটনাটি মোটেও সঠিক নয়। কবির সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও তাঁর একান্ত আপনজন কমরেড মুজফ্ফর আহমদের ‘কাজী নজরুল ইসলাম স্মৃতিকথা’ বইটা পড়ে এ বিষয় সম্পর্কে আমার পূর্বেকার ধারণা একদম পাল্টে যায়। 

প্রথম মহাযুদ্ধ শেষে ১৯২০ সালের মার্চ মাসে করাচিতে ৪৯ বাঙালি পল্টন ভেঙ্গে দিলে নজরুল কলকাতায় ফিরে আসেন এবং স্কুলের সহপাঠী ও বন্ধু শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়ের মেসে ওঠেন। সেখানে তিন-চার দিন থাকার পর কবি বাক্স-বেডিংসহ বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির অফিস ৩২, কলেজ স্ট্রীটের যে কক্ষে কমরেড মুজফ্ফর থাকতেন সেখানেই ওঠেন। নজরুল তখন একুশ বছরের যুবক ও একজন উদীয়মান সাহিত্যিক। তবে কমরেড মুজফ্ফর তাঁর থেকে বয়সে দশ বছরের বড় ছিলেন। তিনি ভারতীয় কমুনিস্ট পার্টির সার্বক্ষণিক কর্মী এবং সাহিত্য পত্রিকার সহকারী সম্পাদক ছিলেন। তবুও উভয়ের মধ্যে সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে যা দীর্ঘকাল বজায় ছিল। কমরেড মুজফ্ফর ছোট বড় নির্বিশেষে সকলকে আপনি বলে সম্বোধন করলেও নজরুলকে তিনি তুমি বলে সম্বোধন করতেন।

কমরেড মুজফ্ফরের সাথে পরিচয়ের সূত্র ধরে কুমিল্লার আলী আকবর খান সাহিত্য সমিতির অফিসে আসা যাওয়া শুরু করলেন এবং নজরুলের সাথে ঘনিষ্ঠ হবার সুযোগ পেলেন। একদিন তিনি কাউকে কিছু না জানিয়ে সাহিত্য সমিতির অফিসে অসুস্থ অবস্থায় বিছানাপত্র নিয়ে এসে ওঠেন। সমিতির সবাই অস্বস্তি প্রকাশ করলেও তিনি খুব দ্রুত নজরুলের সাথে ভাল সম্পর্ক তৈরি করে নেন। আলী আকবর খান নিজেকে প্রকাশনার সাথে জড়িত বলে পরিচয় দিলেও প্রকৃতপক্ষে তিনি ছিলেন একজন ধান্ধাবাজ। মিথ্যা কথা বলায় খুব পারদর্শী। এর মধ্যে তিনি নজরুলকে দিয়ে ‘লিচু চোর’ পদ্যটি লিখিয়ে নিয়েছিলেন নিজে প্রাইমারী ক্লাসের টেক্সট বই সম্পাদনা করবেন এই বলে। প্রথম থেকেই কমরেড মুজফ্ফর তাঁকে অপছন্দ করতেন। তার ওপর নজরুল একদিন জানালেন যে আলী আকবর খান তাঁকে খুব করে অনুরোধ করেছেন তাঁদের গ্রামের বাড়ি কুমিল্লায় যাওয়ার জন্য। মুজফ্ফর তাঁকে নিষেধ করলেন এই বলে যে,  সে অকারণে মিথ্যা কথা বলে। কী মতলবে সে নিয়ে যেতে চাইছে তা কেউ জানে না। হয়ত কোন বিপদের মধ্যে তাঁকে ফেলে দিতে পারে। তা’সত্ত্বেও একদিন সকালে রেলগাড়িতে করে দুইজন রওনা হলেন। সেটা ছিল ১৯২১ সালের মার্চ মাস। নজরুলের বয়স তখন মাত্র বাইশ বৎসর। 

কোলকাতা থেকে চাঁদপুর হয়ে আসাম মেইল ধরে দুই জন কুমিল্লা পৌঁছালেন। উঠলেন শহরের কান্দিরপাড়ে প্রমিলা সেনগুপ্তার (যার সাথে নজরুল পরে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন) খুড়ার বাসায়। প্রমিলা সেনগুপ্তার খুড়াতো ভাই বিরেন্দ্রকুমার সেনগুপ্ত ছিলেন আলী আকবর খানের স্কুল জীবনের বন্ধু। সেই সুবাদে তাঁদের বাসায় আগে থেকে তাঁর যাতায়াত, থাকা, খাওয়ার সম্পর্ক ছিল এবং বিরেন্দ্রকুমারের মা বিরজাসুন্দরী দেবীকে তিনি মা বলে ডাকতেন। তাই বন্ধুকে নিয়ে সেখানে ওঠেন। কবি ও গায়ক হিসাবে ইতিমধ্যেই নজরুলের নাম-ডাক ছড়িয়ে পড়েছিল। শহরের সংস্কৃতিমনা লোকজনের ভীড়ে গান গেয়ে ও কবিতা আবৃত্তি করে তাঁদের ৪-৫ দিন কেটে যায়। এরপর তাঁরা কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার দৌলতপুরে আলী আকবর খানের গ্রামের বাড়িতে যান। 

কমরেড মুজফ্ফরের বর্ণনায় টানা দুই মাস নজরুল ইসলামের কোন খবর ছিল না। হঠাৎ করে তিনি কবির একটা পত্র পান যাতে তিনি আলী আকবর খানের ভাগ্নী সৈয়দা খাতুনকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলে জানান। কমরেড মুজফ্ফর এই বিয়েতে অসম্মতি জানিয়ে তীব্র ভাষায় কবিকে ভৎর্সনা করে পত্রের উত্তর দেন। কয়েক দিন পরে ডাকযোগে বিয়ের ছাপানো নিমন্ত্রণপত্র কোলকাতার কবির বন্ধু মহলে অনেকেই পান, কিন্তু কেউ যোগ দেননি। বিয়ের তারিখটা ছিল তেসরা আষাঢ়। কিন্তু এর দিন দশেক পরে কবির লেখা একটা পোষ্ট কার্ড পান কমরেড মুজফ্ফর। এতে কবি জানিয়েছিলেন তিনি আলী আকবর খানের দ্বারা প্রতারিত ও অপমানিত হয়ে বর্তমানে অসুস্থ হয়ে কান্দিরপাড়ে ইন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের বাসায় আছেন। জরুরীভাবে কিছু টাকার প্রয়োজন। কুড়ি টাকা মানি অর্ডার করে পাঠানোর পর নজরুলের শুভাকাঙক্ষীরা সাহিত্য সমিতির অফিসে আলোচনায় বসলেন। সিন্ধান্ত হয় যে, কমরেড মুজফ্ফর দ্রুত কুমিল্লায় যাবেন এবং নজরুলকে নিয়ে কোলকাতায় ফিরে আসবেন। মাত্র ত্রিশ টাকা যোগাড় করে তিনি কুমিল্লার উদ্দেশ্যে রওনা হন। 

কুমিল্লা পৌঁছে তিনি এই বিয়ের আদ্যপান্ত সকল বিষয়ে জানতে পারলেন। দৌলতপুর গ্রামে পৌঁছানোর পর আলী আকবর খান তাঁর পূর্ব পরিকল্পনামাফিক কাজ শুরু করেন। তাঁর বিধবা বোনের মেয়ে সৈয়দা খাতুনকে তিনি এগিয়ে দেন নজরুলের দেখভাল, খাবার পরিবেশনের জন্য। সৈয়দা খাতুন অশিক্ষিত ছিলেন তবে নিরক্ষর নয়। তিনি নজরুলের মোহন বাঁশী শুনে তাঁর কাছে প্রেম নিবেদন করেন। আর নজরুল তাতে মোহগ্রস্ত হন। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, সৈয়দা খাতুন আসল নাম হলেও নজরুল তাঁর নাম দিয়েছিলেন নার্গিস যেটা ফার্সী শব্দ এবং একটা সুগন্ধি ফুলের  নাম। উক্ত বিয়ের অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রিত হয়ে প্রমিলাদের বাসার সবাই নৌকাযোগে দৌলতপুরে গিয়েছিলেন। পূর্ব নির্ধারিত তারিখে অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়েছিল। সন্ধ্যার পরে বিয়ের চুক্তিনামা মুসলিম পরিভাষায় যাকে কাবিননামা বা নিকাহনামা বলা হয় (তখন রেজিষ্ট্রি বিয়ের আইন হয়নি) তা লেখার সময় আলী আকবর খান তাঁর পরিকল্পনা অনুযায়ী শর্ত দেন যে, বিয়ের পর নজরুল ইসলামকে বাকী জীবন কনের মাতৃগৃহ দৌলতপুরে অবস্থান করতে হবে। অর্থাৎ ঘরজামাই করে কবিকে হাতের মধ্যে রেখে নিজে তার ফায়দা লুটবেন। কিন্তু নজরুলের কাছে এই শর্ত অত্যন্ত অপমানজনক হওয়ায় তিনি বিয়ে না করেই আসর থেকে ওঠে পড়েন এবং তখনই কুমিল্লার উদ্দেশ্যে হাটাপথে দৌলতপুর ত্যাগ করেন। একে তো বর্ষা কালের রাত তার ওপরে পথঘাট অচেনা তাই বিরজাসুন্দরী দেবী তাঁর ছেলে বিরেন্দ্রকুমারকে নজরুলের সাথে দেন। পরে নিজেরা ঐ রাতেই নজরুলের ব্যবহার্য জিনিসপত্রসহ নৌকায় রওনা হন। সারা রাত হেঁটে নজরুল ভোরবেলায় প্রমিলাদের বাসায় পৌঁছান। 

এই হলো নজরুলের কুমিল্লার বিয়ের ঘটনা যা বিয়ে বলে চালানো হয়। অথচ সেখানে মুসলিম বিবাহের অন্যতম শর্ত মোহরনা আদায় হয়নি, কলেমা পাঠ ও নিকাহ নামাও সম্পন্ন হয়নি। 

শোনা যায় এই ঘটনার ১৫ বৎসর পর নার্গিস বেগম নজরুল ইসলামকে একটি পত্র দিয়েছিলেন। নজরুল তার উত্তরে লিখেছিলেন “যারে হাত দিয়ে মালা দিতে পার নাই কেন মনে রাখ তারে”। তবে অনেক পরে মাঝবয়সী একজনের সাথে নার্গিস বেগমের বিয়ে হয়েছিল যার নাম ছিল কবি আজীজুল হাকীম। নজরুলের জীবনের এই ঘটনা আজ থেকে একশ বছর আগের। পরবর্তীতে এর কুশিলবরা বিশেষ করে আলী আকবর খানের দ্বারা গল্পের ডালপালা গজানো হয়েছে। তাই আমার মতো অনেক মানুষ নজরুলকে নিয়ে লেখাপড়া করেও বিভ্রান্ত।

 

কাজী মুজাহিদুর রহমান
কাজী মুজাহিদুর রহমান