নিষিদ্ধ অধ্যায়/ সাহানা খানম শিমু
হাঁপরের উঠা নামার শব্দ!
কাঁচা ঘুম ভেঙ্গে যায় রত্নার । আজকাল অবশ্য গভীর ঘুমের অতলে তলিয়ে যাওয়া হয় না, হওয়ার সুযোগও নেই। অপ্রাপ্ত বয়সের শরীরে মাতৃত্ব ! তার উপর একই সাথে জমজ দুটো সন্তান জন্ম দেবার ধকল সইবার ক্ষমতা এই রুগ্ন শরীরে নেই। তবুও চেষ্টা কম করছে না রত্না। ওর বাবা মা সন্তান জন্ম দেবার সময়টাতে মেয়েকে নিজেদের কাছে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। রাজী হয়নি রত্নার শ্বশুর শাশুড়ি । এলাকার প্রভবশালী তালুকদার পরিবারের প্রতিটি ছেলেকেই বিয়ে করিয়েছে অপেক্ষাকৃত কম অবস্থাপন্ন ঘরে। যাতে নিজেদের কর্তৃত্বটা বজায় থাকে। চোখে দেখার মতো দ্বন্দ্ব নেই কোন ছেলের শ্বশুরবাডীর সাথে । আসলে দ্বন্দ্বে জড়ানোর সামর্থ্য রাখে না নতুন আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ মানুষগুলো। আথির্ক,সামাজিক, লৌকিক সবদিকেই আকাশ পাতাল ফারাক ।
শব্দটা তার ক্রিয়া করে যাচ্ছে। তাতে যুক্ত হয়েছে আনুষঙ্গিক শব্দমালা। খুব কাছে, যেন ঘাড়ের উপর নিঃশ্বাসের উঠা নামার শব্দ। এতো পরিচিত শব্দ! স্বামীর বাহুবন্ধনে আবদ্ধ হয়ে ভালবাসার ঐক্যতানে পিষ্ট হবার চিরচেনা শব্দ! নিজেকে ধিক্কার দিতে ইচ্ছে হচ্ছে –এতো সময় লাগল কেন বুঝতে! না রত্নার দোষ কি, শব্দে হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে প্রথমে দু সন্তানের বিপদ আশংকাই বেজেছে মনে। অন্য কিছু নয়। শিশু দুটোর নির্বিঘ্ন ঘুম ঘুম মুখ দেখে নিশ্চিন্ত হবার পর নতুন করে শব্দের কারণ অনুসন্ধানে অনুসন্ধিৎসু হয়ে উঠে মন। লম্বাটে একটা রুমের মাঝামাঝি বড় খাটে দুই মেয়ে নিয়ে ঘুমায় রত্না। স্বামীর জন্য নতুন ব্যবস্থা। লম্বা ঘরের শেষ মাথায় একটা সিঙ্গেল খাট বিছিয়ে দিয়েছেন শাশুড়ি আম্মা। একটা টেবিল ফ্যানের ব্যবস্থাও করে দিয়েছেন ছেলের জন্য। শাশুড়ির নির্দেশেই চতুর্দশী কাজের মেয়েটি দরজার কাছে মাদুর বিছিয়ে শুয়ে থাকে।
দুই মেয়ে সামলাতে রত্নাকে সাহায্যের জন্য এই ব্যবস্থা দিয়েছেন শাশুড়ি আম্মা।
সত্য জেনে যাবার ভয়ে চোখ বন্ধ করে শব্দের উৎস খুঁজছিল রত্না। বুক ধুকপুক নিয়েই ধীরে ধীরে চোখের পাতা খুলে, বালিশ থেকে মাথাটা একটু উঁচু করে বন্ধ দরজার পাশে তাকিয়ে আঁতকে ওঠে। মাদুর শূন্য পড়ে আছে। মাথার উপর দিকে স্বামীর বিছানা দেখবার মতো মনের অবস্থা নেই। থম মেরে,দম বন্ধ করে পড়ে রইল। খানিক পর,বন্ধ হলো সবই,শব্দের উঠানামা,আনন্দধ্বনি,শিৎকার। নিস্তব্ধ পায়ে রত্নার পিছন দিয়ে নিজের জন্য নির্ধারিত মাদুরে শুয়ে পড়ল আসমা। অথৈ সাগরে হাবু ডুবু খায় রত্না, কূলের দেখা পায় না। স্বামীর বেহায়াপনায় সব ছেড়ে ছুড়ে বেরিয়ে পড়তে ইচ্ছে হচ্ছে। কিন্তু চোখ গেলো বাচ্চা দুটোর দিকে। এদেরকে ছেড়ে যাবে কি ভাবে? থাকবে কি ভাবে? না বাচ্চাদের ছেড়ে থাকতে পারবে না। আর এই বাচ্চা দুটোকে নিয়ে কোথায় যাবে, কার কাছে উঠবে? ওর বাবা মায়ের সংসারের অবস্থা ভালো না। সাত ভাইবোনের বিরাট সংসার। প্রতিদিনের অভাব সংসারকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে। বাবার বাসায় যাওয়ার চিন্তা আপাতত বাদ দিয়ে শাশুড়িকে বলে একটা বিহিত করা যায় কিনা ভাবতে যেয়েই রক্ত হিম হয়ে যাওয়া সেই চেহারাটা চোখের সামনে ভেসে উঠল। কেন জানি প্রথম দিন থেকেই শাশুড়িকে দেখলেই রত্নার কেমন ভয় ভয় লাগে। উনি কখনই রত্নাকে সরাসরি কিছু বলেন নাই। তবুও ওনার সমনে পড়তে চায় না রত্না।
শাশুড়ি নিজেও পাশের গ্রামের আরেক প্রভাবশালী তালুকদারের কন্যা। তিনি একাধারে তালুকদার কন্যা এবং তালুকদারের একমাত্র ছেলের বৌ। তার হাঁটাচলা, কথাবলা, প্রতিটি ক্ষেত্রেই তা তিনি পরিষ্কার করে বুঝিয়ে দেন। এই বাড়ির সবকিছু চলে তার হুকুম মতো। বিশাল দোতলা বাড়ি। উপর তলায় থাকেন শ্বশুর শাশুড়ি। তাদের রাজকীয় কক্ষে রয়েছে সিংহাসন সদৃশ্য দুটি চেয়ার। উনি দিনের বেশির ভাগ সময় সেই সিংহাসনে বসেই তার কার্যাদি সম্পন্ন করেন। রত্নার পক্ষে উপরতলার রূপ সৌন্দর্য বর্ণনা সম্ভব নয়। কারণ বড় বৌ চুমকি ছাড়া যখন তখন উপর তলায় উঠবার অনুমতি নেই নিচতলার বাসিন্দাদের। নীচতলায় রান্না খাওয়ার ঘর রয়েছে। এছাড়াও বড়, সেজ এবং পঞ্চম ছেলে তাদের বৌ সন্তান নিয়ে নীচতলায় থাকে। চতুর্থ এবং সবার ছোট ছেলে বৌ, ছেলে মেয়ে নিয়ে শাশুড়ি আম্মার সাথে দোতলায় থাকে। মেজ ছেলে ইরফান বৌ বাচ্চা নিয়ে বেশ কয়েক বছর আগে ডিবি পেয়ে আমেরিকা চলে গিয়েছে। ওখানেই থাকে। ইরফান পাঁচ ভাই থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। অন্যদের সাথে তার পার্থক্য উনিশ/বিশ নয়, একেবারে এক/একশ। সে যেন মানুষরূপী দেবদূত। এ বাড়ির মানুষগুলোর মধ্যে খারাপের ভাগ এতো বেশি, এর মাঝে যদি কেউ একটু ভালো হয়ে যেতো সেটা ভুল হলেও হতে পারত। কিন্তু মেজ‘দা এতো বেশি ভালো, এটা ভুল নয়। সত্যি, অবশ্যই সত্যি। মেজ‘দার বৌ চাঁদনী । চাঁদের আলোর মতো তার রূপ। তালুকদার বাড়ির বৌ হবার পূর্বশর্ত যদিও রূপ। তবে চাঁদনী শুধু রূপবতীই নয়,গুণেরও আধার। চাঁদনীর নিজস্ব আলো রয়েছে । এরসাথে যুক্ত হয়েছে মেজদার আলো । তাতে যেন নতুন মাত্রা পেয়েছে।
তালুকদার বাড়িতে হরহামেশাই ঘটে নির্মম, নৃশংস,অস্বাভাবিক ঘটনা। আর তা ধামাচাপা দিতে আরও নির্মম,অন্যায়,নির্দয়,খারাপ কিছু ঘটনা ঘটাতে হয়। মেজদা আর চাঁদনীবুর কারণে খারাপের সীমাটা অসীমে যেতে পারে না। তারা লাগাম টেনে ধরে। তারা দুজন এভাবে নীতি বিবর্জিত, আপোস করে চলতে চায়নি বলেই পাড়ি জমিয়েছে দূর দেশে, আমেরিকায়। একটা ভালো দিক হলো, মেজদার কথার গুরুত্ব দেয় আব্বা আম্মাসহ তালুকদার পরিবারের সকল সদস্য।
সেজ ছেলের পরিবার এবং পঞ্চম ছেলের পরিবারকে শাস্তিস্বরূপ নিচ তলায় থাকতে হচ্ছে এটা বোঝে রত্না। উপর তলার বৌদের সাথে শাশুড়ির ব্যবহারের পার্থক্য বুঝতে আলাদা ডিগ্রি করার দরকার পড়ে না। সাধারণ চোখেই ধরা পড়ে। তবে বড় ছেলের বৌ চুমকি পুরস্কার হিসাবে নিচতলায় থাকে। কারণ নিচতলার রাজত্বের সর্বময় ক্ষমতা বড় বৌ-এর। উপর নিচ সব তলার বৌদের উপর কতৃত্ব করা, কাকে দিয়ে কোন কাজ করাবে, কে কখন কোথায় যাবে, কিভাবে যাবে ইত্যাদি সব সিদ্ধান্ত বড় বৌ-এর। শাশুড়ি তাকে এই ক্ষমতা দিয়েছে। বড় বৌ হলো উপর এবং নিচতলার মধ্যে একটা সেতুবন্ধন। এই সেতুর সাহায্য ছাডা নিচতলার কারো পক্ষে কিছু করা সম্ভব না। তবে উপরতলার বৌদের কথা আলাদা। বড় বৌ-এর এই একছত্র ক্ষমতা তাকে কিছুটা স্বৈরশাসক করে তুলেছে। শাশুড়ির দেখাদেখি তারও একটা পানের বাটা রয়েছে। আকারে ছোট হলেও হাতল ওয়ালা চেয়ারে বসেই তার কর্মযজ্ঞ পরিচালনা করে।
উপর তলার বাসিন্দাদের জন্য আরাম আয়েশের ব্যবস্থার কোন কমতি নেই। আধুনিক স্নানঘর। বিশাল খাবার ঘর, রান্নাঘর। রান্নার সব সরঞ্জামও রয়েছে, তবে তারা রান্না বান্নায় তেমন আগ্রহী নয়। খাবার দাবার সব আসে নিচ থেকেই। উপরতলা ঝকঝকে তকতকে জিনিস দিয়ে সাজানো। কখনও কোন কিছু অকেজো হয়ে গেলে সারিয়ে ঠিক করা হলেও তা আর উপরে উঠে না। নিচের ঘরে কাজে লেগে যায়। উপরের জন্য নতুনের ব্যবস্থা হয়। শাশুড়ি আম্মা মাঝে মাঝে নিচে নেমে আসেন । তখন উপরের দুই বৌ এবং বড় বৌ তার আগে পিছে থাকে। কাজের লোকেরা নিরাপদ দূরত্ব রেখে চলে। এই রকম দাপুটে শাশুড়িকে সরাসরি কিছু বলার সাহস পঞ্চম বৌ রত্নার নেই। একটা মাধ্যম লাগবে….উপযুক্ত একটা মাধ্যম! বড়বুজি হতে পারে সেই মাধ্যম। এ বাড়ির বৌরা একে অপরকে ক্রমানুসারে বড়বুজি…মেঝবুজি…করে সম্বোধন করে।
বিয়ের পর রত্নার স্থানও দোতলায় হয়েছিল। তবে ওর আচরণ বিশ্লেষণ করে ওকে চিনতে ধূর্ত শাশুড়ির কষ্ট হয়নি। রত্নার মধ্যে প্রতিবাদী এবং আপোসহীন মনোভাবটা তার ভালো লাগেনি। তিনি বুঝে গিয়েছিলেন একে বাড়তে দিলে তার ঝামেলা হতে পারে। তাই অংকুরেই বিনষ্ট করে দেন। একটা উসিলা বের করে বিয়ের ছয় মাসের মাথায় রত্নাদের নিচ তলার বাসিন্দাতে পরিণত করেন। রত্নার বাসর হওয়া ঘরটি দু বছরের মতো খালি পড়ে ছিল। ছোট দেবর বিয়ে করার পর তাদের দখলে যায়। রত্না তার ছোট বুদ্ধিতে বুঝেছিল, শাশুড়ি আম্মা উপরতলায় তাদেরই জায়গা দেবেন যারা সত্যিকার অর্থেই মেরুদন্ডহীন, তোষামোদকারি এবং শর্তহীন অনুগত। এসব বুঝতে বুঝতে রত্নার স্থান উপর থেকে নিচে চলে আসে। আগে বুঝলেই কি রত্না পারত এই দুই বৌ চৈতী আর মেঘলার মত শাশুড়ির প্রিয় পাত্র হতে? না পারত না। কিছু মানুষ আছে পানির মতো তরল স্বভাবের যখন যে পাত্রে রাখা যায় সেই পাত্রের আকার নিতে দেরি করে না। উপরের দুই বৌ-এর স্বভাবও তাই।
যত খারাপই লাগুক সকালে স্বাভাবিকভাবেই বিছানা ছাড়ে রত্না। দুই বাচ্চার দেখভালে কাজের মেয়ের সাহায্যও নিতে হয়। স্বামীকে বুঝতে দেয় না কিছু। এই কয় বছরে তালুকদার পরিবারের ভিতরে থেকে এটা পরিষ্কার বুঝতে পেরেছে চিৎকার চেঁচামেচি করে লোক জানালে নিজের ক্ষতি ছাড়া আর কিছু হবে না। এই পরিবারটি যেন একটি একমুখী পথ। একবার কেউ এই পথে এসে পড়লে ফিরে যাবার কোন উপায় থাকে না। হইচই করে সবাইকে জানাতে গেলে শ্বশুর শাশুড়ি এবং ছেলেরা মিলে এমন একটা চক্রান্ত করবে যে, রত্নাকে দুধের বাচ্চা দুটো ফেলে খালি হাতে তবে খালি মাথায় নয়, কলংকের অপবাদ মাথায় নিয়ে বের হয়ে যেতে হবে। সুতরাং যা করতে হয় বুঝে শুনেই করতে হবে। ছেলেগুলো বাবা মায়ের বিশেষ করে মায়ের বাধ্যগত। এটাকে গুণ হিসাবে মানতে নারাজ রত্না। কারণ পাঁচটা ছেলেই সেই অর্থে কিছু করে না। বাবার বহুমুখী ব্যবসা আছে, সেগুলোও দেখভাল করে না। তালুকদার বাড়ির ছেলেদের রয়েছে কাজের প্রতি প্রচুর অনীহা। কাজ না করেই যখন সব কিছু হাতের কাছে পাওয়া যায়। তখন কে কাজ খুঁজতে যায়? এরা রাত করে ঘুমায় তাই ঘুম শেষ হতে হতে দুপুর হয়ে আসে। ঘুম থেকে উঠেই চারিদিকে হৈ চৈ ফেলে দেয়। এরপর তেল মেখে ব্যয়াম করে, নাস্তা খায় রাজকীয় চালে। তারপর চলে নিজের আদর যত্ন। দাডি মোছ কাটা ছাটা, চুলে রং দিয়ে পরিপাটি করা ইত্যাদি কাজ সেরে সন্ধ্যা নাগাদ সবাই সুগন্ধি মেখে ফুলবাবু সেজে বেডিয়ে পড়ে। কেউ যায় বন্ধুদের সাথে আড্ডায়, কেউবা রাজনৈতিক বচসা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। অন্যজন হয়তো হেলতে দুলতে বাবার ছড়ানো ছিটানো ব্যবস্যা ক্ষেত্রে যেয়ে হাজির হয়। গল্প গুজবে সময় পার করে। আরেকজন হয়তো এলাকার বিবাদ মিটাতে বসে যায়। যে যেখানেই থাক না কেন কোন ছেলেই রাত বারোটার আগে বাড়ি ফেরে না। সন্ধ্যা রাতে ঘরে ফিরে বৌ-এর কোলে এসে শুয়ে পড়বে! তাহলে কিসের পুরুষ!
দেশে থাকা পাঁচ ভাইয়ের একটা স্বভাবে দারুণ মিল । তা হলো, যে কোন জায়গায়,যে কোন সমস্যায়, যে কেউ পড়ুক না কেন এরা মুহূর্তের মধ্যে কর্তৃত্বটা নিজেদের হাতে নিয়ে নেয়। নিজেরা যেচে পড়ে কাজটা করে। এতে যে অর্থ কড়ির সমাগম হয় তা কিন্তু নয়। এলাকায় নিজেদের অধিপত্য,প্রভাব এবং নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্যই এসব করে। সব সময় যে সফল হয় তা নয়। মাঝে মাঝে সমস্যা সমাধানের দিকে না যেয়ে আরও ঘোট পাকিয়ে ফেলে। তখন তালুকদার সাহেব নিজে এসে সমাধানে বসেন। আর বড় বড় সমস্যা হলে তো এলাকার মুরুব্বীরা তালুকদার সাহেবেরই শরণাপন্ন হন। উনি সব সালিশ দরবারে মধ্যমনি হতে পছন্দ করেন। সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করেন। ছেলেরা ছোট থেকে এইসব সালিশ দরবার দেখে বড় হওয়াতে ওদের মধ্যেও এসবের প্রভাব পড়ে। ওরাও ভাবে সমস্যা সমাধান তাদেরকেই করতে হবে। তালুকদার সাহেবকে লোকে ডেকে নেয়। আর ছেলেরা যেচে যায়,পার্থক্য এটাই।
সন্ধ্যার দিকটাতে বাড়ি তখন পুরুষ শূন্য,বাচ্চাদুটোকে ঘুম পাডিয়ে বড় বুজির ঘরে গেলো রত্না। যদিও এটা তার ইন্ডিয়ান সিরিয়াল দেখার সময়। এসময় কেউ তাকে ডাকলে খুঁজলে সে খুব বিরক্ত হয়। কিন্তু রত্নার তো মহাবিপদ! এছাড়া সময় কই? রত্না ঘরে ঢুকেই বড় বুজির পায়ে আছড়ে পড়ে প্রবল বেগে কান্না…
: বুজি আমারে তুমি বাঁচাও..আমার কপালে এ কি হইল…আমারে বাঁচাও গো বুজি…
চুমকি বুঝল বিষয়টি জটিল। তাড়াতাড়ি নিজের ঘরের দরজার ছিটকিনি লাগিয়ে, টেলিভিশন বন্ধ করে রত্নাকে জড়িয়ে ধরে বলল,
: বল রাঙা বৌ বল, কি হয়েছে তোর? আর কাঁদিস না,
রত্নার হাতে সময় কম। বাচ্চাদুটো যে কোন সময় উঠে পড়তে পারে। অতি দ্রুত গতরাতের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে কাঁদতে লাগল….
: আমি এখন কি করব বুজি? আমারে তুমি বাঁচাও।
: কি বলিস আভাগী, একি সর্বনাশের কথা শুনালি ! লোক জানাজানি হবার ভয় আছে। ওই হারামজাদিরে কেন জায়গা দিলি?
: দুই বাচ্চা নিয়ে সারাদিন কাজ করে কুলাতে পারছিলাম না। কিন্তু রাতে দরকার পড়ে না। বাবুরা তো ঘুমািয়ে থাকে…
: তাহলে ঘরের ভিতর শোয়ালি কেন ?
: আম্মা বললেন,ছোট ছোট বাচ্চা নিয়ে থাকছো, রাত বিরাতে কখন কি লাগে। আসমা তোমাদের ঘরেই এক কোণে পড়ে থাকুক।
শাশুড়ির কথা তো কাজের মেয়েটাকে ওদের ঘরে শুতে দিয়েছে এটা ঠিক, তবে আম্মা এই সংসারের কোন বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে গেলে বড় বৌয়ের সাথে আলাপ না করে নেয় না। এটা অন্য সব বৌয়ের মতো রত্নাও জানে। এখন বড়বুজিকে ঘাটিয়ে কি লাভ! তাই চুপ করে রইল।
: বুজি তুমি ছাড়া আমার কেউ নাই। তুমি আমারে এই বিপদ থেকে উদ্ধার করো বুজি। নাহলে আমি বাঁচাবো না। আম্মারে বলে ওই হারামজাদিরে বাসা থেকে বের করে দাও। আমার ঘরে ওরে আর আমি থাকতে দিব না বুজি।
রত্নার গায়ে মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলে,
: আম্মার সাথে কথা বলে দেখি উনি কি বলেন। তুই ঘরে যা। চিন্তা করিস না। উপায়একটা বের হবে
রাত ঘনিয়ে আসছে, রাতটা কিভাবে পার করবে! হাত পা কাঁপছে, গলা শুকিয়ে আসছে। কাজের মেয়েটাকে বলবে নাকি–আজ থেকে তুমি তোমাদের ঘরে ঘুমাও…না সে সাহস রত্নার নেই। এই বাড়িতে থেকে বাস্তবে তো নয় কল্পনাতেও এদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে যাওয়া যাবে না। পরপর দুটো রাত পেরিয়ে গেলো। অসহ্যকর সেই শব্দ, চোখে না দেখেও দৃশ্যকল্প থেকে মুক্তি পাচ্ছে না। ক্রমাগত একটার পর একটা দৃশ্য এগিয়ে যাচ্ছে। চোখ বন্ধ রেখেও এড়াতে পারছে না। সারাদিনের অজস্র কাজের ভারে রত্না খুবই ক্লান্ত থাকলেও বিছানায় শুয়ে দু চোখের পাতা এক করতে পারে না। শুধু কেঁদেই যায়। একসময় রাত পোহায়,নতুন দিন আসে। কিন্তু রত্নার জীবন সেই কালো অন্ধকার বিবরেই আটকে থাকে।
তাগাদা এবাডির কর্তৃত্বকারিরা পছন্দ করেন না। তবুও রত্না আবার গেল বড়বুজির কাছে….
: বুজি আমাকে তুমি বাঁচাও, এভাবে থাকলে আমি পাগল হয়ে যাব…
: আম্মার শরীর ভালো ছিল না। গ্যাসের সমস্যা। খাবার হজম হচ্ছিল না। তবে কাল সন্ধ্যায় তোকে নিয়ে উপরে যেতে বলেছেন।
পরের সন্ধ্যা। বরাবরের মতো তালুকদার বাড়ির নিঝুম নীরবতা। স্বামী বিহীন প্রতিটি ঘরে ঘরে টেলিভিশনে ইন্ডিয়ান সিরিয়াল দেখে সময় পার করা। আর যাদের ঘরে ছোট বাচ্চা তাদের কথা কিছুটা আলাদা। রান্নার লোক রান্না সারছে, দুপুরেই বলা থাকে কে কি খাবে। সন্ধ্যাটা কেউ মাটি করতে চায় না। রত্না ভিরু পায়ে বড়বুজির সাথে দোতলার সিঁড়ি ভাংগে।
আম্মা সিংহাসনে বসে গভীর মনযোগ দিয়ে শুনছেন রত্নার কথা। প্রবল কান্নার বেগে রত্নার কথা আটকে যাচ্ছে। চুমকি রত্নার পিঠে হাত রেখে সান্ত্বনা দিচ্ছে। রত্নার কথা শেষ হলে আম্মা তার চশমা খুলে কাঁচ মোছায় ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। বেশ কতক্ষণ সময় নীরব পুরো ঘর। আম্মা একটু কেশে নরম সুরে বললেন,
: দেখ রাঙা বৌ, মেয়েমানুষ হয়ে যখন জন্মেছ তখন অনেক সহ্য করতে হবে, তা তো তুমি জানই। মেয়েমানুষের প্রতি পদেই বাঁধা, আটকা। কি করবে বল?
প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে উত্তরের অপেক্ষা না করে আবার শুরু করলেন,
: যখন তোমার পেটে বাচ্চা আসলো তখন থেকেই তো তুমি অসুস্থ হয়ে পড়লে, বমি আর বমি। মাথাই তুলতে পার নাই। শহরে নিয়ে গিয়ে বড় ডাক্তার দেখানো হলো,আলট্রাসনোগ্রাম করে দ্যাখে তোমার পেটে দুইটা বাচ্চা। তখন থেকেই তোমাকে পুরোপুরি শুয়ে থাকার পরামর্শ দিলেন। তুমি আর ঠিক হলে না। তারপর বাচ্চা হলো। চল্লিশ দিনও যায় নাই,কাঁচা শরীর। তোমার শরীরে ব্যথা,বেদনা,কষ্ট আছে,কিন্তু তোমার স্বামীর শরীরে তো কোন যন্ত্রণা নাই, তার চাহিদাও তো ফুরিয়ে যায় নাই। তুমি বুদ্ধিমতী মেয়ে, তোমাকে আর কি বলব। পুরুষ মানুষ এদের বশে রাখতে কতো কৌশলের আশ্রয় নিতে হয়।
রত্না শাশুড়ির কথায় কিংকর্তব্যবিমূঢ় ! এটা বুঝল তার প্রচ্ছন্ন সায় রয়েছে ছেলের কুকর্মে। রত্না আরো জোরে কেঁদে উঠলো–
: আল্লাহ আমারে রক্ষা করো, আমারে দয়া করো।
রত্না বুঝতে পারল পরিত্রাণের কোন আশা নাই। চুমকি এতক্ষণ চুপচাপই ছিল,কি মনে করে এবার মুখ খুলল,
: আম্মা, রাঙা বলছিল, রাতে বাবুদের কাজ রাঙা একাই সামলাতে পারবে। ঘরে আসমা না ঘুমালে….
আম্মার ধমকে চুমকির কথা বন্ধ হয়ে গেলো
:বড় বৌ তোমার বুদ্ধি কি দিন দিন লোপ পাচ্ছে? একবার যে বাঘ মানুষের রক্তের স্বাদ পায়, সে বার বার লোকালয়ে ছুটে ছুটে আসে। এখন আসমাকে ঘর থেকে বের করে দিলে সমস্যার সমাধান হবে এটা ভাবলে ভুল করবে। আসমা তো রহিমার মা,কাদেরের মাদের সাথে ঘুমাতো। তখন জানাজানি কোন পর্যায় পৌঁছাবে ভাবতে পারছ? নিজের লজ্জা নিজেকেই ঢেকে রাখতে হয়।
রত্না অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখছে শাশুড়িকে। ভয়ংকর পিশাচের মতো লাগছে। ঘৃণায় গা গুলিতে উঠছে। রত্না উঠে দাঁড়াল, এই ঘরে আর এক মুহূর্ত নয়। দ্রুত পায়ে ঘর থেকে বের হয়ে এলো। বড়বুজি আম্মার ঘরে রয়ে গেলো। কি জানি কি নতুন পরিকল্পনা করবে। রত্না সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামছে। পরাজিত, বিধ্বস্ত,বিমর্ষ রত্না নেমে যাচ্ছে। নামছে নামছে আর কতো নিচে নামতে হবে রত্নাকে! আমরা তো পশু নই, মানুষ। আমাদের মধ্যে ন্যায় অন্যায় বোধ থাকবে, মনুষ্যত্ববোধ থাকবে। ভালবাসার সম্পর্কে সম্মান শ্রদ্ধাবোধ থাকবে। একজনের কষ্টে অন্যজন ব্যথিত হবে।
শাশুড়ির কুৎসিত নোংরা কথাগুলো থেকে মুক্তির যেন কোন পথ নেই। হঠাৎ হঠাৎই বিদ্যুৎ ঝলকের মতো একটা নাম মাথায় এল চাঁদনী …চাঁদনীবু…মেজ বুজি। এতোদিন কেন মনে হল না এই প্রিয় মানুষটিকে! কিভাবে ভুলে ছিল রত্না তার কথা!
রত্নার শারীরিক গঠন ভালো, মুখচ্ছবি সুন্দর এই যোগ্যতার জোরে তার জায়গা হয়েছিল তালুকদার বাড়িতে। শিকড় উপডে ওকে এ বাড়ির বৌ করে আনা হয়েছিল। রত্নার ইচ্ছের বিরুদ্ধে প্রতিনিয়ত বদলাতে বাধ্য করা হয়েছে। হাঁটা চলা, কথা বলা, আচার আচরণে তালুকদার বাড়ির উপযোগী করে তোলার চেষ্টায় তালুকদার বাড়ির সকল সদস্য। রত্না যখন নিজের অবয়ব ঝেডে ফেলে অন্যের খোলসে রূপান্তরিত হচ্ছিল সেই কষ্টকর সময়টাতে চাঁদনীবু দেশে এসেছিলো। রত্নার বিয়ের সময় আসার কথা থাকলেও বাচ্চাদের পরীক্ষার জন্য আসার সময়টা পিছিয়ে গিয়েছিল। চাঁদনীবু রত্নাকে তার যন্ত্রণা থেকে পুরোপুরি মুক্তি দিতে না পারলেও চাঁদনী দেশে আসাতে রত্নাকে নিয়ে বাড়াবাড়িটা কিছুটা হলেও কমেছে। তাছাড়া রত্নার কষ্টের সঙ্গী ছিল চাঁদনী। দুসপ্তাহ দেশে থেকে চলে গিয়েছিল আমেরিকায়। এরপর আরও দুবার দেশে এসেছিল। শেষবার যাবার সময় কি মনে করে গোপনে একটা মোবাইল নাম্বার দিয়ে বলল,
: যদি কখনও দরকার পড়ে ফোন করিস।
ভাবেনি চাঁদনীবুকে আলাদা করে কখনও ফোন করতে হবে। প্রচলিত স্রোতে গা ভাসিয়ে চলছিল। শত অন্যায় দেখেও মুখ বন্ধ করে ছিল। তালুকদারদের বিশাল লম্বা হাতের কাছে নিজের হাত দুটোকে খুব ছোট মনে হতো। তাই সে হাতের ব্যবহার ঘটায়নি। আর না ব্যবহারে হাত দুটো ক্রমাগত আরও ছোট হয়ে গিয়েছিল। তাছাড়া সরাসরি নিজের উপর না আসাতে চুপচাপই ছিল।
আবার নীরব সন্ধ্যাকেই বেছে নিল রত্না। বাচ্চা দুটো ঘুমাচ্ছে। টেলিভিশনের শব্দ খানিক চড়িয়ে দিয়ে ফোনে চাঁদনীবুকে আগাগোড়া খুলে বলে কাঁদতে লাগল। চাঁদনীর নিজের কানকেই অবিশ্বাস হবার যোগাড়। থম ধরে রইল খানিকক্ষণ। এরপর দৃঢ কণ্ঠে বলল,
: রত্না আমি আসছি। এর একটা হেস্তনেস্ত করেই ছাড়ব। তুই কাউকেই আমার আসার কথা বলিস না। একটু ধৈর্য্য ধর বোনটি আমার।
বাকি কথা কান্না এসে আটকে দিল। রত্না আর চাঁদনীর কান্না মিলেমিশে একাকার হয়ে গেল। রত্নার বুকের ভার অনেকটা কমে গেল, প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নিল।
আবারও সন্ধ্যার নিঝুম, নীরবতা ভেঙ্গে বড বুজি! তার সিরিয়াল দেখার সময় কারো উপস্থিতি সে সহ্য করতে পারে না। অথচ সে কিনা হাজির রত্নার ঘরে!
: রাঙা…রাঙা শুনেছিস? মেজ নাকি দেশে আসছে? তুই জানিস?
রত্নাকে অভিনয়ের আশ্রয় নিতে হলো…
: বড়বুজির যে কথা! আমি কি ভাবে জানব? কেন কি জন্য আসছে?
রত্নার চেহারা পড়ার চেষ্টা করছে চুমকি……
: মেজর বাপের বাড়ির সম্পত্তির ভাগ বাটোয়ারা হবে। তাই নাকি দেশে আসছে…
:ও, আচ্ছা..
তার কিছুক্ষণ পর ডাক পড়ল উপরতলা থেকে। শাশুড়ির কাজের মেয়ে এসে বলে গেলো। রত্নার খুব ভয় লাগছে, হাত পা কাঁপছে। বড়বুজির হাত থেকে নিস্তার পেলেও শাশুড়ির কাছে যেয়ে সব লেজেগোবর করে ফেলব নাকি! না আমাকে শক্ত হতে হবে। চাঁদনিবু কত হাজার মাইল দূর থেকে সব ছেড়ে শুধু আমার জন্য দেশে আসছে! আর আমি এইটুকু পারব না। পারতে আমাকে হবেই। রত্না নিজেকে বুঝায়…
চাঁদনীবু দেশে আসার আগেই ফল ফলতে শুরু করেছে….
আবারও সেই নিঝুম সন্ধ্যা, অথচ চারদিকে কেমন ফিস্ ফিস্ শব্দ করে কারা যেন কথা বলছে। দ্রুত পায়ে হাটাচলা করছে। রত্না অবাক হয়ে ভাবে, এ বাড়িতে এসেছে পাঁচ বছর হতে চলল বিয়ে শাদি বা অনুষ্ঠানাদি ছাড়া একদিনের জন্যও এ বাড়ি তার সন্ধ্যার বৈশিষ্ট হারায়নি। তবে আজ কি হল? বেশি দেরি করতে হল না। এ কান ও কান হয়ে কথাটা অতি দ্রুত রত্নার কানেও এসে গেল। আসমা তার বাক্স পেটরা নিয়ে এ বাড়ি ছেড়েছে। এও কানে এলো, আসমাদের পুরো পরিবারকে অনেক দূর শহর সিলেটে তালুকদারদের চা বাগানের কাজ দিয়ে পাঠানো হচ্ছে।
রাতে ঘুমাত যেয়ে নিজের ঘরে নিজেকে আর পরবাসী মনে হচ্ছে না। কেমন শান্তি শান্তি লাগছে,অথচ এরকমই তো থাকার কথা ছিল। স্বামী সন্তান নিয়ে এক ঘরে থাকা। যেটা থাকার কথা তাই কি সব সময় থাকে? থাকে না। তা পাবার জন্য কত সংগ্রাম করতে হয়। চাঁদনিবুকে জডিয়ে ধরে অভিবাদন জানাতে ইচ্ছে করছে। তার জন্যই আজ নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠা পেতে যাচ্ছে।
চাঁদনিবু দেশে এসে দুদিন থেকে ফিরে গেলো তার গন্তব্যে। তার আসার পর আর নতুন করে কিছু করার দরকার পড়েনি। তবে যাবার আগে গোপনে এবং প্রকাশ্যে প্রত্যেককে তার নিজ নিজ অবস্থান সম্পর্কে ভালোমতো জানিয়ে দিয়ে গেল। চাঁদনিবুর দেশে আসাটা বীরের মতো, যেন আসল,দেখল এবং জয় করলো।
রত্নার বুঝতে কষ্ট হল না তার প্রতি সবার দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনটা। চোখে পড়ার মতো, শাশুড়ি, বড়বুজি এবং নিজের স্বামী সকলেই এখন রত্নাকে একটু হলেও সমীহ করে চলে। এরা এটা বুঝেছে, রত্না তার নিজের অধিকার আদায়ের সংগ্রাম করতে জানে। সেটা যেভাবেই হোক না কেন।
Facebook Comments Sync