নক্ষত্র হয়ে গেছেন বড়দা / শারমিনা পারভিন

নক্ষত্র হয়ে গেছেন বড়দা

নক্ষত্র হয়ে গেছেন বড়দা

নক্ষত্র হয়ে গেছেন বড়দা / শারমিনা পারভিন

 

২৬ মার্চ ১৯৭১।

 আজ থেকে  ৫২ বছর আগে আমরা আমাদের  কাঙ্ক্ষিত  স্বাধীনতা লাভ করেছিলাম। 

 ব্রিটিশদের শাসনে ছিলাম আমরা ১৯০ বছর। আর পাকিস্তানি  সামরিক  জান্তার  অধীনে ছিলাম,আরো ২৩ বছর।

 

সব মিলিয়ে  ২১৩ বছরের শাসন  শোষণের  নাগপাশ থেকে  বেরিয়ে  আমরা স্বাধীনতা লাভ করেছি এক রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্যে  দিয়ে।

জীবন  দিয়েছে ৩০ লক্ষ শহিদ । লুণ্ঠিত হয়েছে অসংখ্য  মা বোনের  সম্ভ্রম।

 

পেয়েছি  লাল সবুজের  বর্ণিল পতাকা। 

একটি দেশ, পৃথক জাতিসত্তা, ,মানচিত্রে  নিজেদের  স্থান। 

 

২৬ মার্চ সম্পর্কে  লিখতে  গিয়ে  কত স্মৃতি  মনে ভিড় করছে।

২৩ মার্চে আমার বড়দা নড়াইল  থেকে পিরোজপুর  যাচ্ছিলেন।

তখন বড়দা সাঈফ মীজানুর রহমান  পিরোজপুরের  ডেপুটি  ম্যাজিষ্টেট।

 

আমি  বায়না ধরলাম, দাদার সাথে আপার বাসায় যশোরে যাব।

আমার ভাইয়া (বড় দুলাভাই) , তখন যশোর এম,এম কলেজে বাংলার অধ্যাপক।

তখন দেশ  বেশ উত্তপ্ত।

এখনও মনে আছে দাদা  আব্বাকে বলছেন,  বঙ্গবন্ধু  স্বাধীনতার ডাক দিয়েছেন, দেশ এবার স্বাধীন হবেই ইনশাআল্লাহ। 

আমি  তখন এতই ছোট যে, স্বাধীনতার মানে কি  জানতাম না।

বাড়ির  আলোচনা, উত্তেজনা  দেখে এটুকুই  বুঝতাম, কিছু  একটা ঘটছে।

 

দাদার  সাথে যশোরে  গেলাম।

তখন মানুষের  তেমন গাড়ি  ছি লনা।

দাদার গাড়ির  কাছে এসে পাড়ার ছেলে মেয়েরা  ভিড় জমাচ্ছিল।

আমি  গাড়িতে উঠতে গিয়ে  হাতে বেশ ব্যথা পাই। গাড়ির  দরজায় চাপ লাগে হাতে।

দাদা সাথে সাথে দৌড়ে  গিয়ে পানি  এনে হাত বেধে দেয়।

 

যশোরে গিয়ে  আপার বাসায় ভাত খেয়ে  দাদা ভাবিকে নিয়ে  চলে যায়।

 

সেই  যাওয়াটাই  ছিল  দাদার আমাদের  কাছ থেকে শেষ যাওয়া।

আপা, দাদার জন্য  দুধ লাউ রেঁধেছিলেন।

 

২৫,মার্চ রাতে পাকিস্তানি  বাহিনী  বাঙালির উপরে বর্বরোচিত  হামলা চালায়।

পাখির  মতন হত্যা করে অন্ধকার  নিকষ রাত্রিতে শত শত বাঙালিকে।

 

বাংলার সন্তানের  বসে থাকেনি। ঝাঁপিয়ে  পড়েছে বঙ্গবন্ধুর ডাকে।

যার যার আছে, তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে

ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ে তোল।

শুরু  হলো মুক্তিযুদ্ধ। 

 

আমাদের  বাড়ির একটা পোড়া কাঠামো ছিল।

আগুনের  লেলিহান  শিখা সারাদিন  জ্বলেছে  বাড়িটায় তিনদিন  ধরে। 

পুড়ছে  আফসার উকিলের বাড়ি, পুড়ছে।

 

ভাইরা মুক্তিযুদ্বে। আব্বাও।

 

আমরা হবখালী নামক একটা গ্রামে আশ্রয় নিয়েছি।

 

২৫ তারিখ রাতে যখন নৃশংস  হত্যাকাণ্ড চলছিল,তখন আমরা আপার বাসায় সারারাত  বসে ছিলাম। দেয়ালে শেল এসে বিঁধছিল। ছোট মানুষ আমি, আপার ছেলে কল্লোল তখন দু বছরের।

সারারাত কাঁদছিল।

আপা তাকে থামানোর  কী চেষ্টা! 

সৈকত তখন আপার পেটে।

 

এক বিভীষিকাময় রাত কাটলো।

সকাল হলো। সবার জানে যেন পানি এলো।

সারাদিন  শেল পড়ার শব্দ। 

দরজা জানালা সব বন্ধ।

মিলিটারির গাড়ির শব্দ শোনা যাচ্ছে। 

 

পাশের বাসার গগনবিদারী কান্নার  আওয়াজ।

তার ছেলেকে  পাকিস্তানিরা ধরে  নিয়ে  গেছে।

কার্ফু  জারি হয়ে গেছে। 

 

বিকেলের দিকে কারফিউ  অল্প  সময়ের জন্য  উঠলো।

হঠাং  মেজদা যেন দেবদূতের  মতো আবির্ভুত  হলো। মেজদা আমাদের  নিতে এসেছে।

নড়াইল  থেকে লং মার্চ করে এসেছে।

সঙ্গে  অনেকে। 

 দাদা আপাকে বলেন, আপা তাড়াতাড়ি  সব গুছিয়ে  নেন। আপা,হাঁটতে  পারে না, কোন রকমে গহনার বাক্সটা আর কল্লোলের কিছু  কাপড় নিয়ে  বেরিয়ে  পড়ে।

 তালা খুজে পাচ্ছিল না, ছোট একটা টিপ তালা দেয় দরজায়।

আপা কাঁদছে, বারবার বাসার দিকে ফিরে  ফিরে  তাকাচ্ছে। 

আমি  আনন্দে আছি। 

বাড়ি  যাচ্ছি, মার কাছে।

 

পথে মামা,মামী,মামাতো ভাইবোনকে নেয়া হলো।

হাঁটছিতো, হাঁটছি।

আপা পারছে না।

মেজদার কোলে কল্লোল। 

যশোরের  খড়কী থেকে ঝুমঝুমপুর এলাম।   

কোন গাড়ি ঘোড়া নেই। অনেক  অপেক্ষা  করার পর একটা ট্রাক পাওয়া গেল। আপা,কোনভাবেই  উঠতে পারছিল না। অনেক  কষ্টে  টেনে  হিঁচড়ে উঠানো হলো। আপার শরীর অনেক  ভারী।

ব্যথায় কষ্ট  পাচ্ছে। 

 

সারা রাস্তা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে  যাচ্ছে। 

একটু বাদে বাদে খাকি পোশাক পরা লোক থামাচ্ছে।

আমি বুঝতে পারছি  না, এরা কারা? পরে শুনেছি  ইপিআরের সৈন্যরা। তারা আমাদের  সাহায্যে  করছিল।

 

নড়াইলে পৌছালাম। মা,দৌড়ে  আসলো।

এখানেও সেই  বিড়ম্বনা। 

আপা নামতে পারছে না।

যাহোক শেষপর্যন্ত  নামতে পারলো  চেয়ার এনে তার উপরে পা দিয়ে। 

 

রাতটা কোনক্রমে কাটলো। ভয়াবহ উত্তেজনা।

ছোড়দা তখনও আসেনি।

সারারাত  ভাইয়া, মামা, দাদারা রেডিও  নিয়ে  বসে আছে।

সকাল হলো।

হঠাং খবর এলো বাড়ি থেকে বেরিয়ে  যেতে হবে।

এক কাপড়ে পাঁচ  মিনিটের  নোটিশে  বেরিয়ে  এলাম।

নদীটা পার হতে পারলাম না, আমাদের  বাড়িতে  আগুন লেগেছে। দেখলাম,নদীর ওপার থেকেই  আমাদের  বাড়ি পুড়ছে।

মা, আপা,হাউমাউ  করে কাঁদছে।

আমি এত হাঁদারাম, কেন কাঁদছেে, তাই  বুঝতে পারছি না।

 

কোথায় যাচ্ছি, তাও জানি না।

খুজতে  খুঁজতে  গেলাম আব্বার পরিচিত  এক গ্রামে। হবখালী।

যে বাসাটায় আমাদের  জায়গা হলো সেটা একটা ভাঙ্গা  পুরোনো  পোড়ো বাসা।

নিচে ইট বিছানো।

ভাঙ্গা একটা চৌকি বিছানো। ছয়জন মানুষের  জায়গা হলো দুহাত  চৌকিতে। 

 

খাওয়ার সংস্থান নেই। পরনে কাপড় নেই। 

কল্লোল সারাদিন  দুধের  জন্য  কাঁদত। 

আপা,মা,সারাদিন  কাঁদত। 

আমি  বুঝতাম না, কল্লোলকে কোলে করে ঘুরে বেড়াতাম। তবে ক্ষুধায় খুব  কষ্ট  পেতাম। 

আমরা দুধে ভাতে মানুষ  হয়েছি।

অভাব অনটন কী কোনদিন  জানতাম না।

 

কচু ঘেচু  তুলে খাওয়া চলতো।

দাদাদের  আব্বার  খবর নেই, ছোট  আপু মামার বাড়িতে। 

 

দিন চলে যাচ্ছে। 

এক কাপড়ে থাকি।

আপার ডেলিভারির দিন এগিয়ে  আসছে।

 

আমরা খেয়ে না খেয়ে দিনাতিপাত  করছি।

এসময়ে মা, আপা  যাদের  কাছে গহনা রাখতে দিয়েছেন, তারা গহনাটা সরিয়ে  ফেলে।

মাথায় আকাশ ভেঙে  পড়ে।

বেঁচে থাকার যে সম্বলটুকু ছিল,  তাও শেষ হয়ে যায়।

 

কোন উপায়ন্তর না দেখে নড়াইল চলে আসার সিদ্ধান্ত নেয়া হলো।

বাড়ি এখন রাজাকারদের  দখলে।

জানালা দরজা কিছু  নেই। 

আমাদের  বাসায় ঢুকতে দেবে না।

নিজের বাড়ি  পরের দখলে।

মা,অনেক  কাকুতি মিনতি  করে একটা রুম চাইলো।

 

আয় রোজগার নেই। ভাইয়া  চাকরিতে  যোগদান  করেছে।

৩০ টাকা বেতন। 

তা দিয়ে  সংসার খরচ,আমাদের  খরচ চালানো কত কষ্ট। 

 

যাই হোক, জীবনের  নিয়মে জীবন  চলে যাচ্ছে। এর মধ্যে  সৈকত হবে। সারারাত  আপা কষ্ট  পেলো।

ঘরের দরজা নেই। কাপড় টাঙ্গিয়ে ঢাকা হলো।

বাইরে  রাজাকাররা দাঁড়িয়ে  আছে।

কী বিভীষীকাময় পরিবেশ!

কোন ধাত্রী  আসে না ভয়ে।

সারারাত কষ্ট  পেয়ে, চৌদ্দটা সেলাই  পড়লো।

জমে মানুষে টানাটানি  করে সৈকত হলো।

যেন দেবশিশু।

অথচ সৈকত পেটে থাকতে আপা কিছুই  খায়নি। সৈকত কত সুন্দর  হয়েছিল। 

মনে হয়নি,আপার কোন পুষ্টির অভাব ছিল। 

 

বড়দা, মেজদা, আব্বার খবর নেই। 

এদিক দেশ স্বাধীনের খবর আসছে।

বাড়িটা তখনও রাজাকারের  দখলে।

মামাবাড়ি পুড়িয়ে  দিয়েছে, দাদাবাড়িও।

ছোট আপু মামীরা তিনদিন  নৌকায় অবস্থান  করেছে।

সীমাহীন  কষ্ট! 

আমি বাজার  করতাম। মাছ কেনার পয়সা ছিল না।

একদিন  একটা পোনা মাছ কিনে,  লেজ বের করে দিয়েছি। 

যাতে বোঝা যায়, আমি  মাছ কিনেছি। 

ভাবা যায়! আমরা মাংস,  মাছ ছাড়া ভাত খেতাম না।

 

মিলিটারিরা আমাকে দেখে বলে, তুমারা ভাই  মুক্তি  কৌই হ্যায়?

 

আমি  ভয়ে দৌড়ে  পালাতাম। আমার মাথায় একটা ফোঁড়া হয়েছিল।

একবার একটা মিলিটারি  আমার মাথায় বাড়ি  মেরেছিল।

কাচা ফোঁড়া ফেটে দরদর করে রক্ত পড়েছিল। 

 

কত কষ্ট, কত হৃদয়বিদারক  ঘটনা!

একদিন, এক রাজাকারের মেয়ে আমাকে পুকুরে পানির  মধ্যে  চেপে  ধরেছিল।

আমার দম বন্ধ হয়ে যায়।

কিভাবে বেচে আছি  আমি  জানি না।

 

দেশ স্বাধীন  হলো। সবাই  ঘরে ফিরছে।

আব্বা, দাদারা ফিরে  এলো।

এলো না দাদা।

দাদার কোন খোঁজ  নেই। 

মা, আব্বা পাগল!

খাবার সংস্থান নেই। 

 

খবর শোনা গেল, বড়দা শহিদ হয়েছেন। ৫ মে দাদা  ট্রেজারির  অস্ত্র  মুক্তিযোদ্বাদের হাতে তুলে দেন।

দাদাকে ধরে  নিয়ে  যায় পাকিস্তানিরা।

গাড়ির  চাকার সাথে বেধে  টানতে টানতে  নিয়ে  যায়,বলেশ্বর নদীর তীরে।

ওরা বলে, বল পাকিস্তান   জিন্দাবাদ। 

দাদা চিৎকার  করে  বলেছিলেন, জয় বাংলা।

ওরা বেয়োনেট  দিয়ে  খুঁচিয়ে  খুঁচিয়ে  জীবন্ত দাদাকে বলেশ্বর  নদীতে  ফেলে দেয়। 

আমার দাদার গায়ে কোন

 চামড়া ছিল না।

বাংলাদেশের কোথাও আমার দাদার কবর নেই। 

যেখানে  গিয়ে  আমরা দু’ফোটা চোখের পানি ফেলতে পারি।

 

দাদাকে আমরা খুঁজে পাইনি।

দাদা হারিযে গেছে, আকাশের নক্ষত্র  হয়ে।

 

আমরা বেঁচে  আছি।

মা স্বাধীনতার চৌত্রিশ বছর পর মারা গিয়েছেন।

তখনও দাদাকে খুঁজেছেন।

ভাইবোনেরা ঘুরে দাঁড়িয়েছে। 

বড় দুলাভাই, আপার সহমর্মিতা, সহযোগিতায়।

 

এখন  স্বাধীন  দেশে বাস করছি।

বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য দুহিতা দেশ চালাচ্ছেন। 

অপ্রতিরোধ্য অগ্রযাএায় দেশ এগিয়ে  যাচ্ছে। 

বঙ্গবন্ধু  সোনারবাংলার স্বপ্ন  দেখেছিলেন,তা বির্নিমাণ  করছেন সুযোগ্য কন্যা।

 

২৬ মার্চ প্রতিবার আসে।

বিনম্র  শ্রদ্ধায় পালন করি।

শ্রদ্ধায় অবনত হই সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ  বাঙালি  জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু  শেখ  মুজিবুর  রহমানের প্রতি।

বিনম্র  শ্রদ্ধা  জানাই ৩০লক্ষ শহিদ, সেই  সব মা বোনদের প্রতি  যাদের  ত্যাগের বিনিময়ে  আমরা স্বাধীনতা পেলাম

শারমিনা পারভিন
শারমিনা পারভিন