পেঁপের ডালনা/  দীলতাজ রহমান

দীলতাজ রহমান

পেঁপের ডালনা রাঁধতে গেলেই আজিজা বানুর মনে একটা গল্প ঘুরতে থাকে। তা হলো যে পরিবার থেকে তিনি ডালনাটা রান্না করতে শিখেছিলেন, তাদের জীবনের খন্ড খন্ড চিত্রগুলো তার কাছে জীবন্ত হয়ে ওঠে। যেন সেই কয়েক বছর যাবৎ দেখা একটানা তাদের জীবনযাত্রাটাই সেলুলয়েড ফিতার মতো তার মনে চলতে থাকে । বহু বছর ধরে আজিজা বানু গল্প লেখেন। বহু গল্প তিনি লিখেছেন। বেশ কয়েকটি বইও আছে। এই গল্পটিও লেখার জন্য তার মনে গুছিয়ে তুলে রাখা আছে। কিন্তু কাছে থেকে দেখা এমন কাহিনিটি তিনি কোনদিক থেকে শুরু করবেন তাই ভেবে পাননি। নাকি তিনি কল্পনাতেও খেই হারিয়ে ফেলেন ভজখট লাগা ওই পরিবারটির ভেতর ঢুকে! কারণ আজিজা বানু এখনো যেন চোখের সামনে সরবে একে একে তাদের সবাইকে চলতে-ফিরতে দেখেন। যেন তারা আজো তার সবচেয়ে নিকটবর্তী প্রতিবেশী হয়ে আছে। আর আজিজা বানু যেন নিজের কাজকর্ম ফেলে তাদের নিত্য অনটনের সংসারে ঢুকে আজো মাকড়সার মতো মিশ্র বোধের মায়াবী জালে সেখানে গিয়ে আটকে যান।

 

এই তো বছর ছয়েক আগে একদিন এক রাস্তায় আজিজা বানুর সাথে ওই পরিবারের কর্তা খালুর দেখা। আজিজা বানুর তাতে প্রাণটা চমকেই উঠলো। তার মনে হলো, একেবারে হারিয়ে যাওয়া নিজের কারো সাথে দেখা হলো। খালু মানে ওই পরিবারের কর্তা। যাদের থেকে আজিজা বানু ডালনা রান্না রান্না করতে শিখেছিলেন।

 

পাশাপাশি থাকা একটানা অনেকগুলো বছরেও আজিজা বানুর খালুর নাম জানা হয়নি। খালুর স্ত্রীকেও তিনি অমনি খালা ডাকতেন। আর তাই শুনে শুনে আজিজা বানুর তখনকার ছোট ছোট ছেলেমেয়ে চারটিও তাদের স্বামী-স্ত্রী দুজনকে খালা-খালু ডাকতো। আর খালা-খালুর দুই ছেলে মজিবর-হবিকে তারা মামা ডাকতো। জোছনা, রোখছানাকে আন্টি। শিমুকে অবশ্য কিছু ডাকতো না। কারণ শিমু ছিলো খালা-খালুর এক মেয়ের ঘরের নাতনি। তবে শিমুর মাকে নিয়ে ওই পরিবারের কেউ কোনোদিন একটিও কথা তোলেনি। কেউ শিমুর মা বিষয়ে জানতে চেয়েও তাদের থেকে উত্তর পায়নি। যেন শিমু পানিতে ভেসে আসা কেউ। সে ওদের কারো থেকে জন্ম নেয়নি। তাই বলে তার প্রতি অযাচিত অনাচারও কাউকে করতে দেখেননি আজিজা বানু। জোছনা রোখছানার সাথে সেও অধিকার বলে পেয়ে যেতো পাতে সমান খাবার। নখপলিশ-রঙিন ফিতে থেকে ঈদের সমান সওদা।

 

  **

 

খালুকে সেদিন রাস্তায় দেখে আজিজা বানু রিকশাওয়ালাকে রিকশা থামাতে বললো। কুশলাদি জানতে মুখ খোলার আগেই খালু তাকে চিনতে পেরে হকচকিয়ে গেলো। তারপর আর বিলম্ব না করে খালু আজিজা বানুকে রিকশা থেকে হাত ধরে টেনে নামালো। রিকশা ভাড়াটাও খালু দিতে চাইলো। কিন্ত আজিজা বানু তাকে বহু কষ্টে নিবৃত্ত করতে পারলো।

 

আজিজা বানুকে তাড়িয়ে বাসায় নিতে নিতে খালু বললো, আমরা এই বিল্ডিংয়ে দুইডা রুম ভাড়া নিয়া থাহি। আইছেন যহন, আপনার খালারে দেইক্খা যান…। টিনের ঘরে থাহা এহন লুকশান। তাও যুদি সামনে একখান উডান থাকতো। তাইলে আর ওই বাড়িডা ছাড়তাম না। পরের বাড়িরতন পানি টাইন্না আর কত? আর সবতে তো আপনের মতো না। যারা আপনের বাড়িডা কিনছে, তারা তো আমাগোরে আর ডোকতেই দেয়নায়।’

 

 যেখানে আজিজা বানু নামলেন, খালুদের নতুন বাসা সে রাস্তা থেকে দূরে নয়। এইটুকু কথা বলতে বলতে খালু বাসার কলিংবেল টিপলেন। কলাপসিবল গেট খুলতে যেটুকু দেরি। কিন্তু পাঁচতলা বাড়ি থেকে নিচেরতলার একটা অংশ খালুদের ভাড়া নেয়া সর্বসাকুল্যে সে দুইরুমের ভেতর খালা কই! মজিবরকে দেখা যাচ্ছে। মজিবরের বয়স তখন পঞ্চাশের মতো হলেও, তার বয়স যেন আরো কমে গেছে। তাকে পয়ত্রিশের বেশি লাগছে না। ঘরে আট এবং দশ বছরের মতো দুটি ছেলেমেয়ে। তাদেরকে দেখেই আজিজা বানুর বুঝতে বাকি থাকে না, মজিবর আবার বিয়ে করেছে। আর ওই চটপটে, সুন্দরী যুবতীই মজিবরের চতুর্থ স্ত্রী।

 

খালু আজিজা বানুকে গেট পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে তাকে অপ্যায়ণের জন্য দোকান থেকে বিস্কুট ও কোনো পানীয় আনতে গিয়েছিলো। তিনি হন্তদন্ত হয়ে ফিরে এসে আজিজা বানুর উদ্দেশ্যে বললো, আপনার খালার লগে কথা হইছে?

 

আজিজা বানু বললেন, না তো! খালা কই?

 

পাশের খাটে শোয়া শীর্ণ একটি দেহের দিকে তর্জনি উঁচিয়ে খালু বললো, ওই তো!

 

আজিজা বানু ওই রুমটিতে ঢুকে মজিবর ও তার বউয়ের সাথে কথা বলতে বলতে মনে করেছিলো ওখানে কাঁথা-কাপড় দলা হয়ে পড়ে আছে। কিন্তু কাছে গিয়ে দেখলেন, কোথায় সেই গাট্টাগোট্টা মাংসল খালা! এ তো হাড্ডির সাথে চামড়া লাগানো এতটুকু একটি দেহ পড়ে আছে। তার গায়েও ছোট একটি জামা। সম্ভবত তা তার ওই দশ বছরের নাতনির। আজিজা বানু ডুকরে কেঁদে উঠলেন। তিনি একটু আগেও ভাবতে পারেননি, তিনি এভাবে কাঁদতে পারেন। এর ভেতর ঘুমে অচ্ছন্ন খালাকে খালু ডেকে তুললো। আজিজা বানুকে দেখিয়ে, স্ত্রীকে বললো, কও তো এইডা ক্যেডায়?

 

খালা পিটপিট করে তাকিয়ে মৃদুস্বরে বললো, কেডায় আবার, পাশের ঘরের মহিলা!

 

খালু বললো, আরে না, ভালো কইরা দেহো, এইডা দুলালের আম্মা!

 

খালুর কথার পরে খালা চোখ বড় করে তাকিয়ে এক ঝটকায় উঠে পড়তে চাইলো। কিন্তু পারলো না। মাথাটা বালিশে পড়ে গেলো। কিন্তু গলা ছেড়ে কেঁদে পুরনো স্মৃতি বয়ন করে বিলাপ করতে লাগলো। তাতে আজিজা বানুর আরো কান্না এসে গেলো। কারণ খালাকে দেখে না চেনা গেলেও খালার কণ্ঠটা অবিকৃতই ছিলো। আজিজা বানুর তখন কত কত কথা মনে পড়ে যাচ্ছিলো। জীবনের কম সময় তার গেছে এই খালার পাশে বসে। কোনো প্রয়োজন ছিলো না তার এই পরিবারটির কাছে। বরং তাদেরই বারবার প্রয়োজন হয়েছিলো আজিজা বানুকে। আজিজা বানু ওদের তিনজনের দিকে একসাথে চোখ তুলে জানতে চাইলেন, খালার এই অবস্থ কী করে হলো?

 

খালুসহ মজিবর, মজিবরের বউ সবাই সমস্বরে জবাব দিলো, দুইবচ্ছর ধইরা প্যারালাইসিস। হার্টের বাল্বও একটা নষ্ট…। 

 

  চোখ ও মন আর্দ্র থাকতে থাকতেই আজিজা বানুর জানা হয়ে গেলো, জোছনা, রোখছানা এবং তাদের বড় মেয়ে চামেলি ভালো আছে। জোছনা, রোখছানা ঢাকাতেই নিজের মতো করে স্বামী-সন্তান নিয়ে সংসার করছে। আর চামেলি ফিরে গেছে গ্রামে। তার স্বামীরও প্যারালাইসিস হইছে। শেষে তাকে সবাই হাতে পায়ে ধরে নেয়ার মতো নিয়েছে।

 

আজিজা বানু বললেন, পরে যে বিয়ে হলো চামেলি বুজির?

 

খালু বললো, তার সাথেও সম্পর্কটা নটখট আইয়া উঠছিলো। শেষে আমি চামেলিরে কইলাম, আমার বাড়ির ভিডা তর টাকা দিয়া কেনোন লাগবো না। ওইডা তরে আমি এমনিই লেইখ্যা দিমু। আমারতন পাকা কথা পাইয়া তারপর সে বিষধর সাপ ফিইরা গ্যাছে। ওরে কি সহজ মনে করছেন খালা?

 

মজিবরের স্ত্রী বললো, আপা, শিমুরে দ্যাখছেন তো? শিমুরেও তার মা নিয়া গ্যাছে।

 

খালু বললো, হ! আগে তো যাত্রাপালা করতো বুইল্লা আমরা শিমুর মায়ের নামই উচ্চারণ করতাম না। দ্যাখছেন না? এহন শিমুর সোয়ামী শিমুরে কয়, তোমার মা একজন অভিনয় শিল্পী! যদি সিনেমা- টেলিভিশনে অভিনয় করতো, তহন তোমরা তোমার মায়েরে নিয়া গর্ব করতা। কিন্তু যাত্রার শিল্পীও একই রকম শিল্পী।

 

শিমুরও কোনো বড়লোকের ছেলের সাথে বিয়ে হয়েছে। শিমুর চেহারা খুব সুন্দর। তাই পাত্রপক্ষ খুবই নাকি আগ্রহ করে নিয়েছে। সবশেষ খবর, সরলার বিয়ে হয়েছে এবং তার একটি ছেলেও হয়েছে। বছর দুয়েক সে ছেলের বয়স। চোখ ভেজা হলেও বিদ্যুতের শক খাওয়া মানুষের মতো আঁৎকে ওঠেন আজিজা বানু। খালুর দিকে তাকিয়ে বলেন,  বলেন কি খালু? এই সেদিন জন্ম হলো সরলার! চোখের সামনে ভাসছে ঘটনাটা। শিশুর চিৎকার শুনে আমি দোতলা থেকে হোঁচট খেতে খেতে নেমে ছুটে গেলাম। আপনাদের ঘরে গিয়ে দেখলাম রক্তমাখা সরলাকে। তখনো নাড়ি কাটা হয়নি…। খালা সরলার মাকে সামলাতে ব্যস্ত। তারপর সরলার সাতদিনের দিন, কত কত বাজার করে আনলেন। আমাদেরও দাওয়াত ছিলো আপনাদের ঘরে…।

 

খালু বললো, দুলালের আম্মা, ম্যাগে ম্যাগে বেইল কম অয় নাই। হিসাব কইরা দ্যাহেন! আমি যহন আপনের পোলাপনরে দেখছি, সবগুলার তহন সব কয়টা কইরা দুধদাঁত পইড়া শ্যাষ অয়নাই। দুলাল তহন ক্লাস ফুরে পড়ে। মনে আছে আমারে একদিন স্কুলে পাডাইছিলেন আনতে। এহন চাইর পোলাপান দ্যাশ-বিদ্যাশ নিজেগো মতো ছড়াইয়া পড়ছে। এই এলাকার মানুষ আপনাগোরে একটুও ভোলেনাই। আর আমরা কইলাম আপনেগো সব খবরই রাহি…।’

 

খালুর এই কথায় আজিজা বানুর কন্ঠ নতুন করে আবার আর্দ্র হলো। বোজাকন্ঠে তিনি বললেন, কিন্তু আসল খবরটাই জানেন বলে মনে হয় না, খালু…।

 

খালু চোখ তুলে আশ্চর্য হয়ে বললো, কী খবর?

 

আজিজা বানুর অনেকক্ষণ লাগলো কান্নার হেঁচকি গিলে গিলে বাক্যটি শেষ করতে, দুলালের আব্বা যে মারা গেছে, তাই তো জানেন না দেখছি!

 

ঘরের সবাই একসাথে হায় হায় করে উঠলো আজিজা বানুর বলা নতুন খবরে। খালাও টনটনে স্বরে কত কথা বলে যাচ্ছে। দুলালের আব্বাকে নিয়ে।

 

দুলালের আব্বাকে এরা সবাই দেখেছে, খালি মজিবরের এই চতুর্থ স্ত্রী ছাড়া। তাই মজিবর আর খালু একসাথে সেই বউকেই বলে যাচ্ছে, জানো, এমন মানুষ দুনিয়াতে আর অইবো না। আমরা যহন ওনাগো বাড়ির সামনের বাড়িতে ভাড়া গেলাম, একেবারে মরুভূমি। বাসা ভাড়া নেওয়ার আগে আশেপশে পুকুর দেখছিলাম। ভাবছিলাম ওই পানিতে নাওয়া- ধোওয়া, রান্দনের কাজ চলবো। খাওনের পানি আর কতডুক…। পরে ভাড়া নেওয়ার পর দেহি সব পুকুর শুকনা। তহন খিলগাঁওয়ের ওই এলাকা জুইড়া তিন চাইরডা বাড়িতে খালি পানির নতুন লাইন আইছে। খালাগো বাড়ি আর আমাগো বাড়িওয়ালার বাড়ির মাঝখানে খালি ইটের গাঁথনির একফুটের সীমানা আছিলো। সেই সীমানা টপকাইয়া আমরা এত্তগুলা মানুষের সব পানি আনছি। খালা এট্টু মুখ কালা করলেও খালু ডাইকা কইতোা, যা পানি লাগে নেন আপনারা। আমরা তো বিল্ডিংয়ের ভেতরে থাকি, আপনারা এখান থেকে কাপড়চোপড়ও ধুয়ে নিতে পারেন। এত শান্ত মানুষ আমি আর দেখিনাই। তার নিজের বউ-বাচ্চাগো সাথে কখনো এট্টু জোরে কথা কয়নাই ক্যা…।’   

 

মজিবরের বউ বলে উঠলো, তাইলে অমুন বাড়িতে ভাড়া থাকতে গেছিলেন ক্যা আব্বা, যেই বাড়িতে খাওনের পানিও নাই?

 

খালু বললো, বাড়িওয়ালা কইছিলো, আপনেরা থাকতে থাহেন। পানি নিয়া দিমু। কিন্তু ওয়াসার লোক যা ঘুষ চাইতো, তা দেওনের ক্ষেমতা আছিলো না আমাগো সেই বাড়িওয়ালা বেডার।

 

**

 

খালুর কথামতো সময়ের হিসাব করতে গিয়ে আজিজা বানুর চোখের সামনে ভেসে উঠলো, খালা-খালু যখন তার বাড়ির সামনের বাড়িতে এলো, তখন সরলার মা নতুন বউ। একখানা টিনের ঘরের একপাশে দু’জনের একখানা চৌকি। সেই চৌকি চেপে বেড়া দিয়ে রুমের মতো করে আড়াল করা। আর খালারা সবাই থাকতো, খোলা এপাশে ঢালা বিছানায়, দিনভর যেখানে রান্নাবাড়া-খাওয়া চলতো। খালা-খালুর সংসারে একটানা খেয়োখেয়ি লেগেই থাকতো। কারণ জোছনা, রোখছানা কোনো কাজ করতো না। শিমুসহ তারা মুখে মিষ্টি কথার ফুলঝুরি নিয়ে সেজেগুজে ঘুরে বেড়াতো। আর বাপ-ভাইদের থেকে টাকা চেয়ে নিয়ে ভিউকার্ড কিনে জমাতো। তাদের এসব কোমল শখের জন্য আশেপাশের বাড়ির সব ভদ্র পরিবারের ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা তাদের সাথে সেঁটে থাকতো। তাদের জোটের সঙ্গী ছিলো আজিজা বানুর ছেলেমেয়েরাও। জোছনা, রোখছানাকে তারা আন্টি বলতো। বয়সে অসম হলেও একসাথে কানামছি-গোল্লাছুট খেলতো। ঘরে এনে একসাথে টেলিভিশন দেখতো। মগ্ন হয়ে ওদের থেকে রূপকথার গল্প, বা বাংলা সিনেমার গল্প শুনতো ঘন্টার পর ঘন্টা ধরে।

 

ওদিকে সরলার মা শাশুড়ির ওপর রেগে হলেও রয়েসয়েই বলতো, আম্মা, জোছনা, রোখছানাকে ক্যান কন না কাজেকামে এট্টু হাত লাগাইতে?

 

খালা তখন শান্তস্বরে বলতো, থাউক। ওগোটুক তো আমিই করি!

 

ক্রমে সরলার মা’রও সংসারে শেকড় গভীর হতে হতে সেও মাঝে মাঝে সরলাকে কোলে নিয়ে আজিজা বানুর বাসায় এসে বসে থাকতো। আজিজা বানুকে একদিন সে বললো, আপা, দেখেন, আমার শাশুড়ি তার মাইয়া গো দিয়া কোনো কাজ করায় না। আমি কিছু কইলেই কয়, অগোটুক তো আমিই করি! তয় উনি মাইয়া গো টুক করলে আমার টুক করতে পারবো না ক্যান! আপা, সব ফালাইয়া থুইয়া আইছি। করুক বুড়ি আইজ সব!

 

**

 

 এমনি কোনো একদিন সরলার মা আরো বলেছিলো, আচ্ছা আপা কন দেহি, এই যে আমার ননদ দুইডা পয়সা খরচ কইরা নায়ক-নায়িকাগো ছবি কেনে। সে ছবি বুকে লইয়া ঘোরে। ওরা কি ওইরকম নায়ক জামাই পাইবো? বিয়া তো অইবো ভাইগো মতন, অয় কোনো অফিসের পিয়নের লগে। নইলে রিকশাওয়ালার লগে। তাইলে ক্যান আমার শ^শুর-শাশুড়ি, ওরগো ভাইয়েরা ওগো ক্যান প্রশ্রয় দেয়? শিমুর মা’র কথা জানেন কিছু?

 

আজিজা বানু হা করে তাকিয়ে থাকে সরলার মা’র মুখের দিকে। মনে হয়, ওই পরিবারটি তার নিজের অংশের মতো হয়ে গেছে। ওদের ভালমন্দ সবই তার গায়ে লাগে। কিন্তু রহস্যটাও জানতে ইচ্ছে করে। আজিজা বানু মুখ খোলার আগেই সরলার মা বলতে থাকে- সুন্দর দেইখ্যা এক বেটার সাথে চইল্লা গেছিলো, শ্যাষে সে ফালাইয়া থুইয়া গ্যাছে। বিয়া অইছিলো কি না, ঠিকনাই। এক রাইতে আইসা সাতদিনের শিমুরে মা-বাপের কাছে গছাইয়া দিয়া আবার আন্ধার থাকতে চইল্লা গ্যাছে। শিমুর এখন সাত বছর। এর ভিতর বাতাসের কাছেও একটা খবর পাঠায়নাই! চেহারা-সুরত বোলে ভালো তাই যাত্রাদলে পার্ট কইরা খায়, কেউ কেউ আইসা ফিসফিসাইয়া কয়।

 

আজিজা বানু বললেন, তুমি জানলে কীভাবে? এসব কথা তো নিজের কেউ তোমাকে বলবে না!            

 

সরলার মা বললো, আপার কি মাথা খারাপ? এইসব ঘটনা চাপা থাকেনি? যাগো সামনে ঘটছে, তারা কেউ না কেউ তো মাঝে মাঝে আহে। তারা মিইল্লা নিজেরাই কওয়াকওয়ি করে! আমারে দ্যাকলে চুপ অইয়া থাহে। আর আমার ননাসে, চামেলি আপায় এই বয়সে আইসা কী কাম করলো, সেইটা দেহেন না ক্যা?

 

**

 

খালা-খালুর বড় মেয়ে যা করেছে, তাকে আজিজা বানু সমর্থন করেছে। অন্যদের চোখে ভজখট লাগলেও, একচোখা সমাজের মুখে এই থাপ্পড়টা একটা মাইল ফলকের মতো ঠেকে তার কাছে। কিন্তু সেই সংবেদনশীল মানুষ কই ছাই ঘেঁটে তুষের আগুনের মতো নারীর একান্ত কষ্টগুলো নিয়ে সুবিবেচিত রায় দেবে!

 

সরলার মা বলে যায়, জানেননি আপা, আমার বিয়ার কথা পাকা অওনের পরও আমার বাপ-মা আমারে দিতে চায়নাই। কারণ আগেরতন কয় নাই। পরে শোনে সরলার বাপের আগে বিয়া আছোলো। আমার শ^শুর ম্যালাদিন যাবত আমাগো বাড়ি এইডা ওইডা লইয়া গ্যাছে, খাইছে। আমারে বউমা বউমা বোলাইছে, তহন, ওনার পোলার আগে বিয়া আছিলো শুইন্যা যহন আমারে  আমার বাপ দিতে চায়নাই, শ্যাষে আমি হাঁইটা চইলা আইছি আমার শ^শুরের মুখ চাইয়া। আমার বিয়া পড়াইছে তাগো বাসায় আইনা। অথচ, আমার শ^শুর আমার সে প্রতিদান দেয়নাই আফা! তার মাইয়ারা, নাতিনডা তিনোজন জোট বাইন্দা ঘুইরা বেড়ায়, আর আমারে দিয়া একলা ঘরের হগলডি কাজ করায়। আমার শাশুড়ি বুড়ামানুষ. রান্দন ছাড়া আর কী করতে পারে? কন আপা?’

 

     **

 

মজিবর কোনো এক সরকারি অফিসের পিয়ন ছিলো। হবি রিকশা চালাতো। খালুও ধানাই পানাই টাইপের কিছু করতো। না করলে অতো বড় সংসারটা একবেলা পান্তা আর দুইবেলা ডালভাত খেয়ে, তেল-সাবান ব্যবহার করে চলতো কী করে! জোছনা আর রোখছানা তো সাবানের পরিবর্তে তখন থেকে স্যাম্পুই ব্যবহার করতো। যখন ওই এলাকায় বসবাস করা অফিসারদের ঘরেও স্যাম্পু পৌঁছেনি।

 

**

 

ফরিদপুরের ভাঙ্গা থানায় খালুদের বাড়ি ছিলো। খালাই একদিন বলেছিলো দেশে তাদের বাড়ির ভিটাটুকু ছাড়া এখন আর কিচ্ছু নেই! একখানা মাত্র ঘর ছিলো, রাজাকাররা পুড়িয়ে দিয়েছে। আর মুক্তিযুদ্ধের আগে গ্রামে কী নিয়ে কার মামলা হয়েছিলো। খালুরও তাতে নাম ছিলো। সেই থেকে খালু পলাতক ছিলো। খালু কোথায় ছিলো পরিবারের কেউই জানতো না।

 

আজিজা বানু বললেন, পাকিস্তান আমলে তো অমনই ছিলো দশা। আমার তখন শিশুকাল। তাতেই দেখেছি কোনো কারণে কোনো গ্রামে একবার পুলিশ ঢুকলে দিনের পর দিন সেই গ্রামের কোনো পুরুষ মানুষ বাড়িতে থাকতো না। এলোপাতাড়ি দৌড়ে বের হয়ে যেতো। পালিয়ে থাকতে থাকতে কত পরিবার ছিন্মমূলও হয়ে যেতো। আর এখন দেখেন কতখানে খুন করেও আসামী পুলিশের সামনে দিয়ে বুক ফুলিয়ে হাঁটে।

 

খালা আবার বলতে শুরু করে, যুদ্ধ শুরু অইলে সব যহন একাকার অইয়া গ্যালো, তহন আপনের খালু গিয়া বাড়িতে উদয় অইলো।’

 

দেশ স্বাধীন হলে খালারা সবাই একসাথে ঢাকা চলে আসে। খালা আরো বলছিলো, আপনের খালু কইছে, এইখানতন টাকা পাডাইয়া যদি দ্যাশে বইস্যা কিন্যাই খাইতে অয়, তাইলে আর গ্রামে থাহন ক্যান…।

 

একদিন হলো কি, খালা ঘরের ভেতর কাজেকর্মে ব্যস্ত। খালুসহ মজিবর, হবি যে যার মতো বাইরে। জোছনা, রোখছানা, শিমু আগে আগে খেয়ে প্রতিদিনের মতো বেরিয়ে গেছে। মেয়ের বয়সী কেউ একজন উদাস সে দুপুরে ভয়ার্ত মনে ঘরের ভেতর মাথা ঢুকিয়ে বললো, ও খালা, সরলার মা ওভাবে তহন থেইকা ভিজা কাপড় গায়ে জড়াইয়া খাড়ায়া আছে ক্যান? কারেন্টে ধরলোনি?

 

খালা বেরিয়ে এসে দেখলো, ঠিকই। সরলার মা ভিজে কাপড় হাতে ঠায় দাঁড়ানো। আর তার ধরে রাখা কাপড়ের আরেক অংশ কাপড় নাড়া তারের ওপরের তারে।  

 

খালারা যে অবৈধভাবে পাশের ঘর থেকে বিদ্যুৎ নিয়েছে, সেই বৈদ্যতিক তার কাপড় নাড়া তারের অল্প ওপর দিয়ে গেছে। সরলার মা গোসল করে পরনের শাড়ি ধুয়ে তারের ওপর ফিকে মারতে, সে শাড়ি, কাপর নাড়া তার পেরিয়ে ওই বৈদ্যতিক তারে পৈাঁছে গেছিলো এবং তারের সেখানে ছিলো জোড়ালাগা। কিন্তু সে জোড়ায় কসটেপ লাগানো ছিলো না।

 

ততোক্ষণে সেখানে দু’চারজন পুরুষমানুষও জড়ো হয়ে গেছে। তাদেরই কেউ চুলোর কাছ থেকে একখানা চেলাকাঠ নিয়ে সরলার মাকে তার ভেজা কাপড় থেকে আলাদা করেছে।

 

** 

 

সংসারের প্রতিদিনের খুটিনাটি কলহের খবর সরলার মা’র বাপের বাড়িও গড়াতো। সেই জের ধরে তারা মামলা করার ভয়ও দেখিয়েছিলো, তাদের মেয়েকে এরা কৌশলে মেরেছে জানিয়ে। কিন্তু তাদের এ পরিকল্পনা  কিন্তু হালে পানি পায়নি। কেউ তেমনটি সাক্ষী দেয়নি খালা-খালু ও তাদের পরিবারের বিরুদ্ধে। তবে আশপাশের জানালা দিয়ে কয়েক রাত ওদের ঘরের পিছনের উলঝুলু পোশাকে কোনো পাগলকে বসে থাকতে দেখেছে কেউ কেউ। আর তাতেই তারা ধরে নিয়েছিলো, ওটা তাহলে ডিবি পুলিশ।

 

সরলার বয়স তখন বছর দুই। তবু কিছুদিন পর এই সরলার কথা ভেবেই দুই পরিবারের বোঝাপড়ায় আবার সরলার মা’র ছোটবোনকে সরলার বাবা মজিবরের সাথে বিয়ে দিয়ে আনে। দু’জনের জন্য সেই চৌকির সাথে চাপানো বেড়ার আড়ালের পাতানো বড়বোনের বিছানায় এবার ছোটবোনকে তুলে দেয়া হলো। কিন্তু এই ছোট বোনকে বউ করে আনাটা পরিবারের জন্য জ¦ালার ওপর রসুন তেলার মতো হলো। সরলার মা’কে আজিজা বানু কখনো মজিবরকে মারতে দেখেননি। কিন্তু সরলার খালাকে দমাদম কদিনই মেরেছে মজিবর। আর মারের কারণও গোপন থাকেনি। মজিবর বৌ করে আনা শালিকে মারতো আর বলতো, তরে আমি বিয়া কইরা আনছি না? তুই আমার লগে থাকবি না ক্যা? এ্যাঁ? তুই আমার লগে শুইবি না ক্যান? ইশ, কয় আবার ছোডো! এই, তরতন ছোডো মাইয়াগো বিয়া অয় না?

 

এরকম এক মারের সময় একদিন আজিজা বানু গিয়ে সেখানে হাজির হলে খালা ভীষণ বিষন্ন বদনে বললো, দ্যাহেনদি খালা, আমার আর ঝামেলা কমলো না। সরলার কথা চিন্তা কইরা সরলার মা’র বইনরে আনলাম, এহন নিত্যই অশান্তি করে। সে এহানে সুংসার করবো না বোলে!

 

কিছুক্ষণের ভেতর আজিজা বানুকে একা পেয়ে সরলার খালা, ফিসফিসিয়ে বললো, আপা, সারারাইত ধইরা আমারে করে। এই শ্যাষ অইলো, আবার ধরে। সকালে ঘুমেরতন ওডার আগে আরেকবার টাইন্যা ডুকাইয়া দেয়। আর যেদিন অফিস থাহে না, সেদিন সারাদিনই…। আমি এত্ত পারি আপা? কন!

 

আজিজা বানু এই প্রথম খেয়াল করলেন, বারোহাত শাড়ির ভেতর সরলার যে খালা সরলার মা হয়ে এসেছে, তার বয়স মাত্র, তের কি চৌদ্দ। আজিজা বানু এতদিন ঘোমটা সরিয়ে খেয়াল করেননি। তাই আজ ওই তের- চৌদ্দ’র কথার ধরণে আজিজা বানু লজ্জা পেয়ে গেলেন। কী বলবেন বুঝতে না পেরে নিজের সীমানায় চলে এলেন এবং ক’দিন না যেতেই শুনলেন, সরলার খালা পালিয়ে গেছে। কাপড়চোপড় কিচ্ছু নেয়নি। খালি তিন আনা সোনার রিং জোড়া, যা তার কানেই ছিলো, আর পরনের যা কাপড় ছিলো, তাই নিয়ে গেছে। আর সেদিনই খালু তাকে তার বাপের বাড়ি কামরাঙ্গির চর থেকে ফিরিয়ে আনতে গেলে, তারা খালুকে বেঁধে রাখতে চেয়েছিলো। কিন্তু খালু অবস্থা বুঝে কৌশলে পালিয়ে এসেছে।

 

   **

 

ঢাকার খিলগাঁওয়ের মেরাদিয়া আজিজা বানু তার জীবনের শুরুতেই যে বাড়ি করেছিলেন, তখনি প্রাচীর দেয়ার মতো টাকা ছিলো না। আজিজা বেগমের স¦ামী তখন একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা হলেও যা বেতন পেতেন, সংসারেই খরচ হয়ে যেতো। তবু ব্যাংক স¦ল্প সুদে ব্যাংকারদের লোন দেয়াতে ওই শহরের উপকন্ঠে তিনকাঠা জমি কিনে একটি পাকা বাড়ি তারা করার সাহস তারা দেখিয়ে ছিলেন।

 

আজিজা বানুদের তিনকাঠা জমির সীমানা রক্ষাকারী একফুট প্রাচীরের ওপাশে আরেকজনের একটি দুইকাঠার প্লট ছিলো। সেখানে তারা শুধু একখানা টিনের ঘর করে রেখেছিলো। ঘরের সামনে সিকি চিলতে উঠোন ছাড়া সে ঘরে গ্যাস পানি বিদ্যুৎ কিছুই ছিলো না। নিম্ন আয়ের কাউকে কাউকে ও ঘরে আজিজা বানু ভাড়া থাকতে দেখেছেন। তারপর কয়েকমাস গেলে বাড়িওয়ালা এসে হম্বিতম্বি করেছেন ভাড়ার জন্য। টাকার পরিবর্তে প্রতিবারই সে ঘরের মালিক পরবর্তী কোনো একদিন টাকা পওয়ার প্রতিশ্রুতি নিয়ে গেছেন। কিন্তু তিনি বাড়ি ভাড়ার টাকা নিতে এসে জেনে গেছেন, ভাড়াটিয়া পালিয়ে গেছে। এমন অরক্ষিত অবস্থার বাড়িটি থেকে একদিন আজিজা বানু দেখলেন তাদের কল থেকে না বলেই একের পর এক মেয়ে- বৌ এসে পানি নিয়ে যাচ্ছে। এলাকায় বাড়িঘরের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় ওয়াসার সাপ্লাইয়ের পানি একসময় এমনিতে আসতো না। তাই প্রেসার কমে যাওয়ার পর ওয়াসার পাইপের সাথে চাপকল লাগানো হয়েছিলো। বেশ ক’দিন অতিবাহিত হলেও আজিজা বানু ওদের কাউকে পানি নিতে মানা করতে পারলেন না। কারণ ওদের সবারই চেহারার দিকে তাকালে মনে হয় মৃদু মায়া ঝলকে ওঠে। তাই একদিন তিনি নিজেই গেলেন নিজের উঠোনটুকু পেরিয়ে সেই মজবুত কাচনির বেড়ার চৌচালা টিনের মাঝারি ঘরখানাতে। দেখতে গেলেন, কারা এতো স্বতঃস্ফূর্তভাবে বালতি-কলস ভরে ভরে অন্যের বাড়ির পানি নিয়ে যেতে পারে।  আজিজা বানু যাওয়া মাত্রই বাড়ির বয়স্ক কর্তা-কর্ত্রী অনুর্ধ্ব ত্রিশের আজিজা বানুকে একসাথে খালা ডেকে, বসতে জলচৌকি এগিয়ে দিয়ে পরিবেশটা এত আন্তরিক করে ফেললো, যে তারপর বহুবছর ধরে তারা আজিজা বানুর বাড়ির পানিতেই চলছিলো। একফুট উচ্চতার প্রাচীর পাঁচফুট হলেও তারা পরে ঘুর পথে এসে এসে পানি নিয়ে যেতো। তারপর একসময় পুরো বাড়িটাই আজিজা বেগমরা বিক্রি করে দিয়ে অন্যত্র চলে গিয়ে পুরনো বিক্রিত বাড়িতে আর তেমন যাওয়া হতো না! কারণ তিনি নিজে একজন কেজো মানুষ। স্মৃতির তাপ মনে মনে পোহালেও বারবার পুরনো প্রতিবেশীদের কাছে ফিরে যাওয়া সম্ভব ছিলো না।

 

        **

 

দুই হাজার পনের সাল থেকে আজিজা বানু অস্ট্রেলিয়াতে ছেলেমেয়ের কাছে আসা-যাওয়া করছেন। একবছর থাকার পর দুইহাজারের তের অক্টোবর অস্ট্রেলিয়া থেকে রওনা হয়ে চৌদ্দ অক্টোবর দেশের মাটিতে পা রাখার পর থেকেই আবার তার তখন থেকেই ফিরে আসি আসি অবস্থা চলছিলো। এই ক’দিন আগে শেষবার নয় মার্চ অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ড থেকে তার বড় মেয়ে খুকুমনি ফোন করে বললো, আম্মা, তোমার ভিসা হইছে। ষোল তারিখের ভেতর না এলে তোমার আবার মেডিকেল চেকাপ লাগবে…!

 

আজিজা বানু নিজে শ^াসকষ্টের রোগী। তারওপর দেশে তার বহু কাজ অসমাপ্ত। তিনি তাই মেয়েকে বললেন, আজ নয় তারিখ। ষোলো তারিখের ভেতর কী করে যাই! আমার একটা কাপড় চোপড়ও কেনা হয়নি!

 

ওপাশ থেকে উত্তর এলো, এতদিন কী করছো?

 

: এতদিন কী করছি মানে? আগে তো ভিসা হওয়ার পর সময় পেতাম ইচ্ছে মতো যাওয়ার। তার ভেতর যা যা কেনার কিনে ফেলতাম! এবারও তেমনটি ভেবে রেখেছিলাম!

 

: তোমার প্রচুর কাপড় চোপড় এখানে আছে। আর এনে বোঝা বাড়াইও না!

 

আজিজা বানু ফোন রেখে দিলেন।

 

পেটের ছেলেমেয়ের সাথে তর্ক চলে না। কিন্তু ষোল তারিখ কি, শেষে জানতে পারেন, বারো তারিখের টিকেট কাটা হয়েছে। সাথে যাচ্ছে তার ছোট পুত্র আরিফ। আরিফের আগেই ভিসা করা ছিল। যার মেয়াদ আছে জুলাই পর্যন্ত। তাই ত্বরিৎ আসতে সহজ হয়েছে।

 

আজিজা বানু এই যে বারবার আসেন, সেটা তার মেয়ের কাছে। কিন্তু এসে ওঠেন ছেলের কাছে। এবার করোনা ভাইরাসে জন্য এসেই দুই সপ্তাহ প্রায় বাধ্যতামূলক আটকে পড়া। মানে হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকা। তারপর তো লক ডাউন। মেলবোর্ন থেকে কুইন্সল্যান্ডের ফ্লাইট অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য বন্ধ।

 

আজিজা বানুর নিজের থাকার বিষয়ে ছেলে বা মেয়ের কাছে থাকা নিয়ে কোনো পছন্দ বা পক্ষপাতিত্ব নেই। সেই প্রথমবার অস্ট্রেলিয়া আসার আয়োজন করতে করতে গুনগুন করে ক’দিন নিজের অজান্তে রবি ঠাকুরের গানের ভেতর থেকে এইটুকুু অংশ তার মন আপনা আপনিই গাইতে শুরু করেছিলো, ‘পথ আমারে সেই দেখাবে যে আমারে চায়/ আমি অভয় মনে ছাড়ব তরী এই শুধু মোর দায়…।’ কিন্তু তিনি টের পেয়েছেন, এই আসা যাওয়া করতে করতে তার মনের স্থিরতা নষ্ট হয়ে গেছে। একজন লেখিকা হিসাবে জীবনের এই সময়টা তার লেখালেখিতে ভিন্নমাত্রা আনতে পারতো। কিন্ত তিনি যাওয়া-আসার এই দীর্ঘ পথের বৈচিত্র আত্মস্থও করতে ব্যর্থ। নাহলে এতে করেও তার লেখালেখিতে উৎকর্ষই আসার কথা ছিলো।  তা না আসার কারণ তিনি জানেন বলে নিজেকে ক্ষমা করে দেন। আর সেটা তিনি একই সাথে অনেক কিছু করতে চান। করেনও। নাহলে তিনি বারবার এভাবে ছুটে ছুটে আসবেনই বা কেন!

 

তার বন্ধু শেলী সেনগুপ্তা তাকে বলেছেন তুমি যা করো, সেটা আত্মঘাতী মানুষের কাজ। একজন সৃষ্টিশীল মানুষ নিজের সৃষ্টিশীলতার বিরুদ্ধে যায়, এমন কাজ কখনো করেন না। অথচ তুমি তাই করো!

 

 শেলী আরো বলেছেন, তুমি আমাকে দোখো! আমাকেও কানাডাতে আমার মেয়ে-জামাই ডাকে। আমি যাই না!

 

 শেলী সেনগুপ্তার কথার উত্তরে আজিজা বানু বলেন, আরে আমি তো তোমার মতো শিল্পনিষ্ঠ মানুষ নই! আমি শুরু থেকে মা দুর্গা হতে চেয়েছিলাম। এজন্যেই তো কিছু হলাম না! আর এখন আমার নিজেকে মনে হয় ছাই ফেলতে ভাঙাকুলো। তাই বিনাশ হতে হতে কেউ যদি কাজে লাগাতেই পারে, লাগাক না!   

 

**

 

    এবার ছেলের বাসায় থাকতে ক’দিনই পেঁপের ডালনা রাঁধতে গিয়ে তিনি স্বগোক্তি করতে থাকেন, মাছে তরকারি দিলে আরিফ খাবে না। তাই পেঁপে দিয়ে ডালনাই রাঁধলাম। কারণ তরকারিও  তো খেতে হবে!

 

নিজেকে শোনানোর জন্য নিজে বলতে বলতে হোম কোয়ারেন্টাইনে থেকে অফিসের কাজে ব্যস্ত বউমাকে বলেন, এই পেঁপের ডালনা যতবার রান্না করি, সেই পুরো পরিবারের ভেতর ততোবার আমি নতুর করে ঢুকে যাই। যে এই ডালনা রান্না করতো, তাকে আমি খালা ডাকতাম। তখন ত্রিশের মতো বয়স আমার। তাই মায়ের বয়সী সে খালার ভেতর একটা মা মা বোধ তো কাজ করতোই। আর আমার খালা ডাকা দেখে তোমার শ^শুর থেকে আমার ছেলেমেয়ে সবাই তাকে খালা ডাকতো। তার স্বামীকে খালু ডাকতো। তাদের ছেলেমেয়েদের আন্টি-মামা। এই নিয়ে প্রায়ই ওদের আশপাশের মানুষেরা হাসাহাসি করতো! বলতো, মায়-বাপেও যা কয়, পুলাপাইনেও তাই কয়।

 

খালারা মাছ-মাংস তেমন একটা রান্না করতো না! এই পেঁপেই প্রায় প্রতিদিন ডাল দিয়ে পানি পানি করে রান্না করতো। ওড়ং দিয়ে নেড়ে নেড়ে বেশ অনেকক্ষণ জ¦াল দিয়ে রান্না করতো সেই খালা।

 

আজিজা বানুর বউমার নাম ইফা। ইফা অবাক চোখে তাকিয়ে বললো, ওড়ং কি?’ যেন এতক্ষণ শাশুড়ি যা বলেছে, সবই সে তার শ্রুতিযন্ত্র থেকে পরিহার করে চলেছে। শুধু ওড়ংটা মাথায় লেগেছে।

 

: ওড়ংকে একেক জায়গার মানুষ একেক নামে চেনে। এটা হচ্ছে নারকেল দুইভাগ করলে কেমন হয়, দেখেছো?

 

: দেখেছি!

 

: ওই নারকেল কুরিয়ে নেয়ার পর শক্ত বাটির মতো থাকে না?

 

: থাকে!

 

: ওই বাটির ভালো খ-টা লাগে ওড়ং বানাতে। আর ওই ভালো বাটিতে ওপরের দু’দিকে দু’টো ছিদ্র লাগে। এখন ওই ছিদ্র করার জন্য দেয়াল ছিদ্র করা ড্রিল মেসিন থেকে অনেক কিছুই পাওয়া যায়। কিন্তু আমাদের ছোট বেলায় নারকেলের ওই মালা বা বাটির দুদিকে দুটো ছিদ্র করতে, রান্নার সময় মহিলারা সূঁচালো কিছু চুলায় ঢুকিয়ে রাখতো। তারপর বারবার সেই লাল হয়ে যাওয়া দগদগে সূঁচালো লোহার জিনিসটি বাটিটার একপাশ একপাশ করে দুপাশে দুটো ছিদ্র করতো। তারপর বাঁশের চটা ছেঁচে গোল করে, ধরার জন্য লম্বা হাতল বানাতো।

 

: লম্বা বানাতো কেন?

 

আগে তো সবাইকে লাকড়ির চুলোয় রান্না করতে হতো। তাই হাতে আগুনের আঁচ যেন কম লাগে। এখন অবশ্য ওসব নেই। থাকলেও যারা গ্যাসে রান্না করে, তারা হাতল ছোট বানায়। আর এখন বিভিন্ন মেলায় দেখেছি, কারুশিল্পীরা নকশা টকশা করে বানায় বড়লোকের মন ভোলাতে। সময়ের বিববর্তনে সবকিছুরই ধরণ পাল্টায়! প্রকৃতিই পাল্টে যায়!

 

: তাই তো!

 

: ওই ওড়ং বানানোর আগে ভালো করে দা দিয়ে ছেঁচে, মানে মসৃণ করে নিতে হতো নারকেলের মালাটা। আর সূঁচালো যে জিনিসটি ব্যবহার করতো, মালাটা, মানে নারকেলের বাটিটি ছিদ্র করতে, তা ওই দায়ের আছাড়ি খুলে, দায়ের সূঁচালো দিকটি পুড়িয়ে ব্যবহার করতো। ওড়ং সংসারের খুব একটি প্রয়োজনীয় জিনিস ছিলো!

 

: এবার তোমার সেই তুলে রাখা গল্পটা বলো?’ কম্পিউটার থেকে চোখ না তুলেই ইফা বললো।

 

  

 

আজিজা বানু বললেন, তুমি শুনছো জানলে তো ভালো করে বলতাম। তিনি আবার বলতে শুরু করেন, খালাকে একদিন বলেছিলাম, খালা প্রতিদিন কেন পেঁপে দিয়ে ডাল রান্না করেন?

 

খালা বলেছিলো, খারাপ তো নাগে না রে মা! পিত্তিদিনই নতোন সোয়াদ নাগে।

 

আজিজা বানু চোখ দু’টি ইফার দিতে তুলে বললেন, জানো, খালার কথায় আমি লজ্জা পেয়েছিলাম। কারণ হাদিসে আছে, যারা হালাল রুজি খায়, তারা যা-ই খায়, তাই তাদের কাছে সর্বত্তোম স্বাদ লাগবে। তাই সারাদিনের পরিশ্রমের পর যতœ করে যা রাঁধবে স¦ামী-ছেলেমেয়ে নিয়ে খেতে বসে তার তো তাতে পরম তৃপ্তিই লাগবে!

 

কিছুক্ষণ আবার দম নিয়ে আবার তিনি বলতে শুরু করলেন, আরো কী হতো জানো, আমি প্রায়ই প্রায়ই খালার থেকে ওই ডাল চেয়ে নিয়ে আসতাম! কিন্তু আশ্চর্য, খালারা কেউ কিন্তু আমার কাছে কোনোদিনই কিছু চায়নি। আমি নিজে থেকে কিছু দিলেও যে তারা বর্তে গেছে, এই ভাবটাও তাদের কারো মধ্যে আমি দেখিনি! আমার মনেহয়, তাদের সাথে আমি আজো যে একাত্মতা বোধ করি, তা ওইটুকুতেই ঝুলে আছে। হয়ত তাদের সাথে আমার আর দেখা হবে না। খালার তো বেঁচে থাকার কথা নয়। খালুও এতদিন আছে কি না। বাকি যারা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, কী জানি আর কোথাও কোনোভাবে দেখা হবে কি না!

 

: তোমরা তো পুরো পরিবারের জন্য পানি দিতে, সেটাই কম কি!

 

: আরে পানি তো আরো কতজনকে দিতাম। সারা এলাকায় তিন-চারটে বাড়িতে মাত্র একসাথে সাপ্লাইয়ের পানি এলো, অন্য  সবাই কীভাবে কলে তালা দিয়ে রাখতো। আমরা তো ওসব ভাবতেই পারতাম না। একসময় বাউ-ারিও করা হলো। তখন ওইসব মানুষের গেট ধাক্কানো শুরু হলো। এমনি অধিকার হয়ে গেছিলো সবার।  

 

বউমার আর প্রশ্ন করার কিছু নেই। সে তার কাজে মন দেয়। শ^াশুড়িকে মৃদু হেসে স্মরণও করিয়ে দেয়, এখনি তার অফিসের সাথে মিটিং শুরু হবে।

 

কিন্তু আজিজা বানু থামেন না। বলেন, দুলালের যখন ছয় বছরের মতো বয়স, তখন ও আমাদের ছাদে ঘুড়ি ওড়াচ্ছিলো, ওরকম পানি নেয়া বাড়ির এক ছেলে এসে ঘুড়িটা কেটে নিয়ে গেলো। আর তাতে তোমার শ^শুরের সে কি মনে কষ্ট ছেলের কান্না দেখে। আর সেই হাউমাউ কান্নার রেশটা আমারও মন থেকে এতবছরেও মুছে যায়নি!

 

**

 

আজিজা বানু থামলেই যেন গল্পের সূত্র ছিঁড়ে যাবে। তিনি থেমে থেমে বলতে থাকেন, খালাদের পরিবার থেকে একটা বিষয় আমি মনের ভেতর আলাদা করে রাখছি। এটার ঝুলি আমিও যখন-তখন খুলি না। শুধু একাকী দৃশ্যগুলো সাজাই!

 

ইফা কম্পিউটার থেকে চোখ তুলে শাশুড়ির দিকে খালি এক ঝলক তাকায়। তাতেই আজিজা বানু আরেকটু জোরে শুরু করেন। একদিন বাড়ির উঠোনে নেমে খালাদের ঘর থেকে নতুন মানুষের কণ্ঠ শুনে আগ্রহ নিয়ে দেখতে গেলাম। দেখি খালা কাঁথা সেলাই করছে। সাথে সেলাই করছে দশাসই সাইজের আরেক মহিলাও। মহিলার কন্ঠে প্রচ- গ্রাম্য ঝাঁঝ। গায়ে রোদের প্রচ- আঁচড়। খালাকে বললাম, খালা উনি কে?

 

খালা কাঁথা থেকে চোখ না তুলেই উচ্ছ্বাসহীন কন্ঠে বললো, আমার বড় মাইয়া!

 

আজিজা বানু আশ্চর্য কণ্ঠে বললেন, কই, এতদিনে একবারও তো বলেননি, আপনাদের আরেকটা মেয়ে আছে?

 

  আজিজা বানুর কথার পরে দশাসই মহিলাটি সেলাই থেকে মুখ তুলে বলে উঠলো, ওই দেহো, আমি কি আর খালি খালিই কই, আমি অইলাম, আমার মা-বাপের হিসাবের বাইরের। আমার নামডাও এরা কেউ কয় না! আমি যে তাগো অরেকটা সুন্তান আছি তাও কয় না। তাও সবতের বড় আমি। মাইনষে কয়, বড়ডার দরদ বেশি। আর আমার কপালে মা-বাপের পক্ষেরতনও ছাই!

 

অজিজা বানু খালার বড় মেয়ের পক্ষ হয়ে বললেন, আসলেই তো তাই! খালা-খালু না হয় না বলেছে, জোছনা, রোখছানাও তো কখনো বলেনি, আমার বড়বোন আছে! ওরা তো প্রায়ই আমাদের বাসায় পড়ে থাকে!

 

খালার বড় মেয়ে এবার খালার উদ্দেশ্যে বললো, ও মা, আমার মনে লয়, তুমি আর বাবায় তোমাগো বিয়ার আগেই ভালবাসা কইরা আমারে প্যাডে লইছিলা, তাই তো আমার নামডা তোমরা শরমে কারু কাছে লও না। আবার যাইয়া এট্টু খোঁজও লও না। আবার জাগায় জাগায় ভাড়া থাহো, ঠিকানাও দেও না, আইতেও কও না। এইর লাইগ্যাই তো তোমার জামাই গোলামের পুত আমারে মার্ইরা-দর্ইরা হাড্ডি-মাংস এক করার সাহস পায়!

 

খালা সেলাই রেখে এবার আজিজা বানুর দিকে তাকায়। বলে, খালা, শোনেন, মুক্তিযুদ্ধ লাগনের বছরখানিক আগের কথা। আপনের খালুর কুনো খুঁজ নাই। পলাইয়া বাঁইচ্চা ছিলো, কি মরছে, তার কুনো ঠিক আছিলো না। এরই মইদ্যে এই মাইয়াডা  ডাঙ্গর অইয়া উঠছে, একজনে তার পুলার লাইগা ওয়ারে চাইলো, আমিও দিয়া বাঁচলাম। তহন বালোমন্দ দেহনের আমার ফুসরত আছিলো, কন? আর তহন তো বাড়ির কাছের উঠতি বয়সি পোলা, বালোই দেখছালাম!

 

আজিজা বানু বলেন, ঠিকই। মায়েদের অনেক জ¦ালা। আপনার জ¦ালা আমি বুঝি খালা। কিন্তু আপনি কোনদিনও তো আপনার এই মেয়ের কথা আমার কাছে বলেননিও…।

 

খালার এই বড় মেয়ের নাম চামেলি। তার কন্ঠ বড়ই বাঁজখাই!

 

আজিজা বানু মনে করেছেন, এতক্ষণ তিনি একাই বলে যাচ্ছেন। কিন্তু তার বউমা শুনছে না। কিন্ত ইফা কম্পিউটার থেকে                                                    চোখ না তুলেই বললো, বাঁজখাই কি?

 

আজিজা বানু বলেন, বাঁজপাখির ভয়ঙ্কর অবস্থা বোঝাতে শব্দটার ব্যবহার বোধহয়। আভিধান থাকলে তোমাকে বলতে পারতাম। কিন্তু অভিধান একখানা দেশে, আরেকখানা খুকুমনিদের বাসায়। আচ্ছা আমি পরে একদিন তোমাকে নিশ্চিত করবো, এটার আসল মানে কি!

 

ইফা বুঝতে পারে, শাশুড়ির সামনে থেকে এই গল্প শোনা থেকে নিস্তার নেই। সে ল্যাপটপ নিয়ে ওপরে নিজের রুমে চলে যায়। আজিজা বানু বুঝতে পাওে, বউমার মিটিং…। কিন্তু আজিজা বানু এবার নিজের মনে বলা নয়, এবার যেন সেই পুরনো স্মৃতি ঝালাই শুরু করলেন, খালার সেই বড় মেয়ে, যে তার সব ভাইবোনের বড়, সে তার মাকে কী অবলীলায় বলে উঠলো, মা তুমরা জানো, তুমরা আমারে কুন আগুনের ফালাইয়া আইছো? এই যে তুমরা এই বয়সে আইয়াও এ্যাহনো সকালে গুছোল করো। আর যে বেডার লাগে বিয়া দিছো, সে আর বচ্ছর কাতিমাসে এক শ্যাষ রাইতে আমার ধারে আইছিলো। আর সেই রাইতেই ওই মাইয়াডা প্যাডে আইছে। ওয়ার বয়সও দশ মাসে পড়লো, ব্যাডায় আর আমার কাছে আহেনাই!

 

আজিজা বানু তখন চামেলির কথা শুনতে শুনতে চমকে উঠেছিলেন। মা’য়ের কাছে কেন, জগতে কারো কাছে এই কথা বলা যায়, এটা তিনি আগে জানতেন না!

 

চামেলিকে আজিজা বানু তবু শেষ পর্যন্ত অশ্রদ্ধা করতে পারে না! বোঝাই যায়, চামেলি পরিশ্রমী। পাঁচ ছেলেমেয়ের মা সে। বয়সে আজিজা বানুর বেশ একটু বড়ই হবে। আজিজা বানু বোঝেন, ছেলেমেয়ে হতে তো আর বয়স লাগে না। ঋতু হওয়ার পর থেকে সময় মতো বীজ পেলেই জরায়ু তা ফোটাতে শুরু করে। আর চামেলির আরো দুঃখ আছে, তার ছেলেমেয়েরাও তার সাথে কুকুর- বেড়ালের মতো নাকি ব্যবহার করে।

 

এর কারণ একদিন চামেলি নিজেই বললো আজিজা বানুকে। বললো, বোঝছেন আপা, পোলাপানের সামনেই পোলাপানের বাপে আমারে কথায় কথায় ধইরা ধইরা মারে। আবার তারা এও দ্যাহে, আমার বাপের বাড়িরতন কেউ আমার খুঁজ-খবর করে না। আর যদি আমার কেও থাকতো, বা আমার নামে দুইকাডা জমিন থাকতো, তাইলে পোলাপাইনে আমারে দাম দিতো।

 

চামেলির চেহারাটা খালার অন্যান্য ছেলেমেয়ের মতোই বেশ ভালো। মায়াময়। তবে চামেলির হাত-পা ফাটা ফাটা। শরীরও শীর্ণ। তার স্বামীর কিছু জমিজমা আছে। তার স্বামী নাকি ফসলটা শুধু জমি থেকে উঠান পর্যন্ত এনে ফেলে। তারপর তা পিটিয়ে, মলন মলে একাই চামেলিকে ঘরে তুলতে হয়। লোকটা তারপরও নাকি আরেকটা বিয়ে করতে চায়।

 

আজিজা বানু ফস করে জিজ্ঞেস করেন, তাহলে আপনি যে বলেন, রাতে আপনার কাছেই আসে না…।’

 

: সুংসার বলাইবো। বুঝচ্ছেন দুলালের আম্মা আফা! আরেকজন থাকলে বেশি কইরা হাঁস-মুরগি, গরু বাছুর পালবো। একজায়গায় বিয়া একটা ঠিকও করছোলো। শ্যাষে সে মাইয়াওয়ালারা আমারে কয়, কাবিনে আপনে সই করবেন, যে আপনে আনতেছেন! শ্যাষে আমি তাগোরে কইলাম, হ্যায় বিয়া করবো, আমার কোনো আপিত্তি নাই। তয় আমি কোনো সইটই করতে পারমু না! হেরপর তারা কইলো মাইয়া দিমু না। আমি আবার হ্যাগোরে কইলাম, হোনেন আপনেরা, মানুষ নতুন কাপুড় ঘরে থুইয়া কি আর পুরান কাপড় পেন্দে? তাই যে বেডা বিয়া করতে চায়, সে আর পুরানা বউয়ের কাছে ফিরবো না নতুনডা থুইয়া। তাই দেন আপনেরা আপনেগো মাইয়ারে। কিন্তু তারা আর দেয়নাই!

 

আজিজা বানু অবাক হয়ে বলে ওঠেন, তো ভালো হোক, মন্দ হোক নিজের স্বামীকে কেউ বিয়ে দিতে চায়?

 

: আরে আফা, আমি তো জানি হ্যার ক্ষেমতা কদ্দূর। তাই ভাবছিলাম, আমি পারিানাই অন্য কেউ আইসা বিষটা মারুক!

 

**

 

সারাক্ষণ খই ফোটানোর মতো নিজের দগ্ধ জীবনের কথা বলা চামেলি আসার পর থেকে স্বল্পভাষী সরলার মা’র হয়েছে নতুন জ¦ালা। যাকে খালা-খালু থেকে সরলার বাপ পর্যন্ত কিছুটা সমঝে কথা বলে, তারও পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা নিয়ে চামেলি কটাক্ষ করে। কেন কাপড়ে দুইবার সাবান মাখায়! কেন প্রতিদিন মাথায় নারকেল তেল দেয়। কেন তার জন্য কিউট ভ্যানিসিং ক্রিম কিনতে হবে! মুখে কউরার ত্যাল দিলে কী হয়!

 

তারপর খালাই চাইতেছিল, চামেলি চলে যাক। প্রতিবেশী আজিজা বানুও তার এরকম অহেতুক খিটিমিটি দেখে বুঝতে পেরেছিলেন, যার জীবনে এতটুকু শিশিরের ¯িœগ্ধতা নেই, সে অন্যের এতখানি আতিশয্য সহ্য করতে না পারারই কথা!

 

**

 

মা-বাবা ও ভাইদের মনোভাব বুঝতে পেরে চামেলি একদিন ঝাঁঝিয়ে ওঠে। বলে, ক্যাঁ, এহনি যামু ক্যাঁ? আইছিলাম দুইদিনের লাইগ্যা। এহন তো বোঝতে পারছি, তোমরা ভালই আছো। আশেপাশের মাইয়ারা গার্মেন্টসে যাইতেছে। টাকা কামাই কইরা নিজেরা বুক ফুলাইয়া চলে। আমিও দেহি অগো মতো একটা চাকরি পাইনি!

 

খালা-খালুর মাথায় বাজ পড়লো। তাদের ছোট ছেলে হবি তেড়ে ওঠে বলে, বুজি তোমার মাথা খারাপ অইছে? গার্মেন্টসে সব কম বয়সী মাইয়ারা চাকরি করে! তোমারে ঝাড়– দিতেও তো নিবো না!

 

চামেলি ফণা তোলা সাপের মতো ছোট ভাইয়ের দিকে ফিরে বলে, আমারে নিজের চোউকখে দ্যাখতে দে! সারাজেবন অন্যের চক্ষু দিয়া দেখছি। এতদিন তো তগো ভাত আমি খাইনাই। আমার পাঁচ পাঁচটা পোলাপাইন আইছে, তরা কেউ তাগো কারো লাইগ্যা একটা সুতাও খরচ করছনাই।  এহন কয়ডা দিন আমারে থাকতে দে! আমি দেহি, কে আমারে কুনহানে নেয়, না নেয়!

 

খালু বলে ওঠে, একখানা ঘরের বেতর আমরা এতডি মানুষ ঠাসাঠাসি কইরা থাহি, হ্যারপর তুই গ্যাইড়া বইলে কেমুন কতা? আর গার্মেন্টসের দিক পা বাড়াইলে জামাই তরে আর ঘরে নিবোনি?

 

চামেলি তার বাবার কথায় আরো ক্ষেপে উঠে বলে, বাবা, আপনে কিন্তু আমারে চেতাইয়েন না। তাইলে কিন্তু আমি বংশের মুখে চুনকালি ডইল্লা দিমু! সংসারে মাইয়া বড় অইছে, সে তার বাপেরে-ভাইবোনেরে রাইন্দা খাওয়াক। তাগোরে ইট্টু আমার অভাবডা বোঝতে দ্যান…।

 

  চামেলির তেজের কাছে সবার হার হয়। বেশ কদিন পর আজিজা বানু খালার বাড়িতে গিয়ে চামেলিকে দেখে অবাক হন। আশ্চর্য হয়ে বলেন, আরে বুজি, আপনার মাথার চুল কে কাটছে? খুব সুন্দর লাগছে তো?

 

চামেলি কিছুটা শুদ্ধ করে বলার চেষ্টা করে, গার্মেন্টসে ভর্তি হইছি আপা। ওরা না কইছিলো, আমারে নিবে না! তাই ভাবছিলাম, দরকার হয়, গার্মেন্টসের ঝাড়–দারই হমু। তবু টাকা কামাই করার লাই¹া কিছু করমু! ওরা আমারে ভালো কাজই দিছে আপা।

 

আজিজা বানু বললেন, আপনি গার্মেন্টস চিনলেন কী করে?

 

: পাশের বাসা থেইকা দল ধইরা দেহি মাইয়ারা যায়, তাগো লগে গেছিলাম। পরদিন জোছনা- রোখছানারেও লইয়া গেছিলাম। কিন্তু দুইদিন কাজ কইরা অগো বলে মাথা ঘোরে। আর যায় না। মাথা ঘোরলেই কি? বেডারা টাকা দিবো কি এমতেই!

 

আজিজা বানু বললেন, আর আপনার মাথা ঘোওে না?

 

আমার তো ভালোই লাগতেছে। দিনভর বোতাম লাগাই। মাস গ্যালে ছয় আজার টাকা পামু! আর দ্যাশে থাইকা পুরা বতরের সুমায় ক্যাড়াইল দিয়া পিডাইয়া ফসল ঘরে তুলি, তার লাইগাও তো কেউ আমার দিকে এট্টু মায়ার চোউকখেও তাকায় নাই! ভাত খাইতে গ্যালেও খোডা! আমি খালি বলে খাই-ই!

 

আজিজা বানু বললেন, বাড়ি থেকে আপনাকে নিতে এলে?

 

চামেলি বলে, দুলালের আম্মা আফা, টাকা অইলো গিয়া আসল ভাতার! আর সব ভাতার ফস্কা গিরা! সে গিরা রাহেন বইল্লা থাহে।

 

আজিজা বানু চমকে ওঠেন মধ্যবয়সী গ্রাম্য চামেলির কথায়। তিনি মনে মনে ভাবেন, টাকাই বড় ভাতার। কথাটা ঠিক। কিন্তু অনেকেই তা বোঝেন না। চামেলির তেজটা ক্রমে আজিজা বানু ভালবেসে ফেলেন। এখন আর খালা-খালু বা পেঁপের ডালের জন্য নয়, চামেলির অকপট মনোভাব আর গতি-প্রকৃতি নির্ণয় করতেই আজিজা বানু ঘন ঘন আসেন।

 

সরলার মাকে এখন চামেলি সমঝে চলে। কারণ তার দশ মাসের মেয়ে শিশুকে সরলার মা-ই দেখে সরলার সাথে। সে-ই দুধ-সুজি মিলিয়ে রেঁেধ এক ফিডারে দুজনকে দু’বার দুধ খাওয়ায়।

 

ওদিকে ক’মাস যেতেই দেখা গেলো চামেলি তার মা-বাবার বাসার কাছে আরেকটি বাসা ভাড়া নিয়েছে। খালা-খালু বলেছিলো, যেই টাকা বাসা ভাড়া দিবি, সেইডা আমাগো দে। তুই আমাগো সাথে থাক। নইলে মানুষ খারাপ কইবো!

 

কিন্তু চামেলি খালি আলাদা বাসা ভাড়াই নেয়া নয়, সে একজনকে ঠিক করেছে। সে লোক চামেলির সাথেই চাকরি করে। তবে সে চামেলির চাইতে কয়েক বছরের ছোট। সেই চামেলির পিছনে লেগেছে, চামেলিকে দেখার পর থেকে। সে চামেলিকে বিয়ে করবে। বাবা-মা, ভাইবোনের রে রে করে মানা সত্ত্বেও চামেলি বিয়েটা করলোই। বাসাটা আগেই সে বাবা-মা’র কাছে নিয়েছে, সরলার মায়ের জন্য। সরলার মা তার বাচ্চা সামলাবে, তার জন্য তাকে তার বেতনের একটা অংশ দিয়ে দেবে।

 

আজিজা বানু ওদের বাসায় গিয়ে আর চামেলিকে পায় না। ছুটির পর চামেলির ওভার টাইম আছে। চামেলি রান্নাবান্না অবশ্য করে না। দুইজনের খাবারের চুক্তিভিত্তিক টাকা দেয় সে তার মা-বাবাকে।      

 

খালা-খালুর পরিবার আর চামেলির ওই অবস্থা দেখেই আজিজা বানুরা ওই এলাকা ছেড়ে চলে যান। বাড়িটা তখনো বিক্রি হয়নি। তাই একবার ভাড়ার টাকা তুলতে এসে খালার বাসায় গিয়ে চামেলির দেখা পেয়েছিল। সেদিন ছুটি ছিলো। আজিজা বানু চামেলিকে ডেকে বললেন, আচ্ছা বুজি, বলেন তো, এই যে বিয়েটা করলেন, আমার তো মনে হয় একসময় সব কূল হারাবেন…।

 

    চামেলি চোখ এতো বড় করে, যেন শুধু মুখে বলে আজিজা বানুকে বোঝাতে পারবে না। তারপর চোখেমুখে বলতে থাকে, শোনেন, দুলালের আম্মা আফা, যৌবন শ্যাষ হওয়া মানুষ পরিবারের কাছে খালি খোলা, বুঝলেন! যত্তই আপনে সুংসারে বান্দি খাটেন, সে পরিশ্রমের কুনো দাম নাই, যদি ভাতারে দাম দেয়, তো সে আলাদা কথা! সেডুক পাইলে তো বাইরই অইতাম না!

 

: আপনার যৌবন শেষ কে বললো? তাহলে এই লোক বিয়ে করতো আপনাকে?

 

: তাই তো! এহন যেই এট্টু ঢকঢাক অইয়া থাকা শুরু করছি, রাস্তায় গিয়া লম্বা লম্বা পা ফালাইতে শিখছি, এহন আমি নিজেই বুঝছি, যে নারীর যৌবন অত্ত সহজে যায় না। গ্যালে পুরুষেরডা যায়!

 

: আচ্ছা বুজি মনে করেন যদি এই লোক আপনাকে রেখে চলে যায়। তাহলে আর আপনার পুরনো সেই ভিটায় গিয়ে দাঁড়াতে পারবেন?

 

: শোনেন আফা, আমি তো খালি এক বেডার বউ না! পাঁচ পাঁচটা পোলাপানের মাও তো! যুদি পোলাপানের আমারে দরকার অয়, আমি ছিইট্টা চইলা যামু। তাতে আমার তাগো বাপের দরকার কি? তাগো বাপ আমারে থুইয়া বিয়া করতে চাইছেলে, আর আমি কইরা দেহাইয়া দিলাম! সেদিন এমনে এমনে যুদি না এইহানে আইতাম, আগে খাইছিলাম পুলাপানের বাপের যাঁতা। এরপর শুরু অইছে তাগো। কয়দিন পরে আবার পোলাগো বউগো যাঁতা খাওন লাগবো!

 

আর আফা, আপনে কি মনে করছেন, আমি যা কামাই করমু তা উড়াইয়াপুড়াইয়া খাম? সেইডা খামু না। আর এই বেডারও ভরসা করি না। দ্যাশে আমার বাপে যে ভিডা ফালাইয়া আইছে, সেই ভিডাডা আমি তাগো থেইকা কিইন্না নিমু। এগো ভাইল দেখলেই তো বোঝা যায়, এরা কেউ আর দ্যাশে যাইবো না। অতএব আমারে নিয়া আপনে খালি খালি চিন্তা কইরেন না…।

 

**

 

আরিফ ঘরে ঢুকে বললো, আম্মা শুনছো, অস্ট্রেলিয়া সরকার ঘোষণা দিয়েছে, যতো টুরিস্ট আছে তাদের দেশে, সব যেন চলে যায়।

 

ইফা বললো, তোর তো ভিসা আছে জুনের বারো তারিখ পর্যন্ত।

 

তাহলে?

 

: তবু নিজেকে অনাকাক্সিক্ষত মনে হচ্ছে সরকারের এই ঘোষণার পর থেকে।

 

আজিজা বানু বললেন, যদিও হাতে দুইমাস সময় আছে। তবু তখন আবার কী পরিস্থিতি হয়। দেশে গেলে হোম কোয়ারেন্টাইনে রাখলে সেটার জন্য চিন্তা নেই। কিন্তু যদি আবার এয়ারপোর্ট থেকে ধরে নিয়ে কোনো ক্যাম্পে তোলে, এটা শুনলে তো আমি হার্টফেল করবো!

 

আজিজা বানুর এই কথার পরে আর কেউ কোনো কথা বলে না। তিনি একা একাই তার ভাবনার ডালপালাগুলো একাই বিস্তারিত করতে থাকেন। মার্চের চৌদ্দ তারিখ তিনি এলেন। সপ্তাহখানেক হয়তো মেলবোর্নে থাকতেন। তারপর চলে যেতেন কুইন্সল্যান্ডে মেয়ের কাছে। ওখানে তার নাতিটাকে নাকি এখনো চাইল্ড কেয়ারে রাখতে হচ্ছে। এটাই এখন তাকে খুব অস্থির করছে। ছোট মেয়ে আঁখিমনিকে তিনি রেখে এসেছেন, ঘরে কাজের লোক নেই। মেয়ে বড় চাকরি করে। কিন্তু সংসারের কাজগুলো সুচারুভাবে করতে শেখাননি। সেটাও তার মাথা ভারী করছে। এখানে বড় ছেলে দুলাল ছাড়া কেউ বাইরে যাচ্ছে না। সে-ই অফিসে যাচ্ছে। অফিসে সে নাকি একাই কাজ করে। আর সবার ছুটি।

 

ফেরার পথে দুলাল একগাদা করে বাজার করে আনে আর নিজেই জীবানু নাশক ছিঁটিয়ে সেসব শুদ্ধ করে। আজিজা বানু মনের সুখে ছেলের আনা বাজার নিজের মতো করে শুধু রান্না করেন। তারপরই শুরু হয় পৌত্রী করিমননেসার সাথে তার লুডু খেলা। লুডু খেললে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার বুদ্ধি বাড়ে। তাই পৌত্রী’র জীবনে এই বুদ্ধিটুকু অবদান হিসাবে রাখতে তিনি খুব আন্তরিকভাবে তার সাথে খেলতে বসেন।

 

দাদীর প্রতিটি গুটি কাটার পর করিমননেসার মুখ ঝলমল করে ওঠে। তাই পৌত্রী’র ঝলমলে মুখ দেখতে আজিজা বানু ভান করেন তেড়ে আসা গুটির সামনে থেকে তিনি গুটি সরাতে ভুলে গিয়েছিলেন। কিন্তু এখন আর তা করেন না। এখন তিনি নিষ্ঠুর হাতে ঘ্যাচাং করে করে পৌত্রীর গুটির পেছনে ওঁত পেতে থেকে কেটে কেটে দেন। কারণ তাকে আসল খেলাটা শেখানোর জন্য। নাহলে সে খেলোয়াড় হিসাবে দুর্বল থেকে যাবে। শেয়নের সাথে লড়াই করেই কেবল শেয়ান হওয়া যায়।

 

**

 

 এ দেশের মানুষ নিয়ম মানা জাতি বলে এমনি এমনি সবাই দূরত্ব মেনে চলে। কঠোরভাবে লক ডাউনের দরকার হয় না।

 

আজিজা বানু এখানে কাছাকাছি সিটিজেনস্ পার্কে হাঁটাহাঁটির জন্য বাইরে যেতে ক’বার পা বাড়িয়ে আবার নিজেকে নিজে টেনে ধরেন। ভাবেন, এই ভাইরাসটা এমন নয়, যে যার হবে, শুধু সেই মরবে! না নিজের বংশধরকে তিনি কোনোভাবেই কোনো ঝুঁকিতে ফেলবেন না! নিজেকে বৃত্তবন্দি রাখেন আনন্দের সাথেই!

 

**

 

রান্না করা, লুডু খেলা, কিছু বইপড়ার চেষ্টা এগুলোই এখন সমান তালে চলছে আজিজা বানুর জীবনে। আর যতবার তিনি ওই ডালনা রান্নার আয়োজন করেন, ততোবারই গিয়ে সেই খালা-খালুর সংসারে গিয়ে ঢুকে পড়েন। যেখানে একদিন তাদের সবচেয়ে বড় মেয়ে নিজের ভরা সংসার ফেলে দুদিনের জন্য মা-বাবার কাছে বেড়াতে এসে নিজের জীবনটা আমূল পাল্টে নেয়ার সাহস দেখিয়েছিলো গতানুগতিক প্রথা ভেঙে, যা অনেক উচ্চশিক্ষিত নারীও পারেনি!