প্রিয় কণ্ঠশিল্পী প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়/ লিয়াকত হোসেন খোকন

প্রিয় কণ্ঠশিল্পী প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়/ লিয়াকত হোসেন খোকন

একদা প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায় গেয়েছিলেন – ” মাগো আমার শোলক – বলা কাজলা দিদি কই?…… বাঁশবাগানের মাথার উপর চাঁদ উঠেছে ওই “।
এই গান গেয়েই তো প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায় আমাদের হৃদয়পটে কাজলা দিদি হয়ে রইলেন। তিনি আজ যে লোকেই থাকুন না কেন – তাঁর জন্মদিনে পাঠালাম একগুচ্ছ লাল রঙের ফুল……..।

২০০৪ সালের ২৯ জুলাই মারা যান সুরের প্রতিমা। নাম তাঁর প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়।
জন্ম তাঁর ১৯৩৪ সালের ২১ ডিসেম্বর ।

একটা গান লিখো আমার জন্য’ এই গান আমরা শুনি শৈশবে। এখনো মনে আছে আমাদের বাসার পাশে (পিরোজপুর শহরে) কুঞ্জবাবুর বাড়ি। তাঁর বাড়িতে পুজোর অনুষ্ঠান চলছে। মাইকে কত না গান বাজানো হচ্ছে। হঠাৎ শুনতে পেলাম ‘একটা গান লিখো আমার জন্য।’ শুনে তো থ’। পা আর চলল না। মুগ্ধ হয়ে শুনতে শুনতে নিজের গন্তব্যে চলে গেলাম। এরও কিছুদিন পরে শুনলাম, এ গানের শিল্পী প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়।

প্রতিমার শৈশব জীবন কেটেছিল বাংলাদেশের ঢাকায়। ঢাকায় থাকাকালীন তাঁর সঙ্গে সুধীরলাল চক্রবর্তীর পরিচয় হয়। তাঁরই উদ্যোগে প্রতিমা প্রথম ঢাকা বেতারে গান গাইবার সুযোগ পেলেন। কিছুদিন পরে ঢাকা ছেড়ে কলকাতায় গিয়ে আকাশবাণীর নিয়মিত শিল্পীর ছাড়পত্র পেলেন গিরিন চক্রবর্তীর সহায়তায়।

প্রতিমার গাওয়া উল্লেখযোগ্য গানের মধ্যে – ‘ত্রিবেণি তীর্থ পথে কে গাহিল গান’, ‘কেমনে কাটে রজনি’ গান দুটির কথা এখনো অনেকের মনে থাকার কথা। ‘ত্রিবেণি তীর্থ পথে কে গাহিল গান’ – এ গানটি তিনি একটি ছবির জন্য গেয়েছিলেন যা ছিল সুচিত্রা সেনের লিপে।

প্রতিমার স্বামী অমিয় বন্দ্যোপাধ্যায় মারা যান ১৯৮৬ সালে। এরপরে জীবনটা এলোমেলো হয়ে গেল। প্রতিমার গান বাংলাদেশের অনেক শিল্পীই রিমেক করে গেয়েছেন।

১৯৫২ সালে প্রতিমার মা তাঁকে পাঠিয়েছিলেন সুধীরলাল চক্রবর্তীর কাছে। সুধীরলালই তাঁকে
সুনন্দার বিয়ে’ ছবিতে প্রথম গান গাইবার সুযোগ করে দেন। আধুনিক বাংলা বহু হিট গানের সফল গায়িকা ছিলেন এই প্রতিমা।

নিতাই ঘটকের সুরে – ‘আমার সোনা চাঁদের কণা’, সুধীন দাশগুপ্তের সুরের – বাঁশবাগানের মাথার উপর চাঁদ উঠেছে ওই কিংবা ‘নীল শাড়ি শ্রীমতি চলে’ ইত্যাদি গানের কথা কোনোদিন শ্রোতারা ভুলবে না। খেয়াল, ঠুংরি ইত্যাদি গানও প্রতিমা গাইতেন। আমীর খানের সঙ্গে ডুয়েট গেয়েছেন ‘ক্ষুদিত পাষাণ’ ছবিতে (১৯৫৯)।

প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গাওয়া উল্লেখযোগ্য কিছু গান হলো – আমার সোনা, চাঁদের কনা, ভুবনে তুলনা নাই রে ; এই সুরঝরা খেলাতে ফাগুনের বেলাতে ; কুসুমদোলায় দোলে শ্যামরায় ; ছলকে পড়ে কল্কে ফুলে মধু যে আর রয় না ; তোমার দেওয়া অঙ্গুরীয় খুলতে পারিনি, তোমার দুচোখে আমার স্বপ্ন আঁকা ; তোমায় কেন লাগছে এত চেনা ; ত্রিবেণী তীর্থপথে কে গাহিল গান ; নিঙাড়িয়া নীল শাড়ি শ্রীমতী চলে ; প্রেম শুধু এক মোমবাতি ; বড় সাধ জাগে একবার তোমায় দেখি ; ভ্রমরা গুনগুন গুঞ্জরিয়া আসে ; মন যে খুশি খুশি আজ ; মিছে দোষ দিও না আমায় ; মেঘলা ভাঙা – রোদ উঠেছে লাগছে ভারী মিষ্টি ; সজনী গো রজনীকে চলে যেতে দাও ; সাতটি ★ তারার এই তিমির ; সাত রঙা এক পাখি – ইত্যাদি।

আলী আকবরের সুরে গৌড় মল্লার রাগে ‘সুরের পিয়াসী’ ছবিতে ডুয়েট গেয়েছিলেন এ,টি কাননের সঙ্গে।

প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গান:
১.
সাতটি তারার এই তিমির
একটি প্রেমের শান্ত নীড়,
আজ আকাশের নেই ভাবনা –
চন্দ্রকলায় ছন্দ মীড়।
দিয়েছ এনে একটি কলি,
ভাবনা জাগে কী যে বলি।
বলতে গিয়ে তোমায় দেখে
লাগে মনে ভয় —
জানি না কী যে হল, কেন এমন হয়।
বোঝো না কেন এ নীরবতা
এ তো আমার সকল কথা।
তুমি তো জানা আমার সবই,
তোমার মত নই তো কবি।
তোমার মতো বলা তো আর
সহজ কথা নয়,
নীরবে নিলাম জেনে তোমার পরিচয়।
কথা: সুধীর হাজরা।
সুর: সুধীন দাশগুপ্ত।

২.
একটা গান লিখো আমার জন্য।
না হয় আমি তোমার কাছে
ছিলেম অতি নগণ্য।
সে গান যেন আমায় উজাড় করে নেয়
সে সুর যেন আমার ব্যাকুল করে দেয়
আমি যেন হই তোমার মাঝে ধন্য।
আমি ছিলেম তোমার প্রেমের
প্রথম স্বপ্ননায়িকা
লিখেছি তোমার মনের আখরে
অনেক ছন্দ লিপিকা।
সেদিন আজও আমার
মনে পড়ে যায়
কেমন করে যেন
খুঁজে পায়
জীবনতরী যে
বোঝাই সখার জন্য।

কথা – সুবীর হাজরা।
সুর – সুধীন দাশগুপ্ত
৩.
ফাল্গুন অভিসারে
সাজল যে ফুল হারে বসুন্ধরা
সেই মালা নিয়ে আমি স্বয়ম্বরা
স্বরগের অপ্সরী মধুময় ছন্দে
ভরে দিল মোর মালা পারিজাত গন্ধে,
চাঁদ দিল জোছনায়
আপনার সুধা তায় পরান ভরা
কত মধু রং লেগে রাঙা হয়ে রাঙাল;
জীবনের উৎসবে আমি মোর মাল্য;
তাদের দেবো এই মালা আজি মধুলগ্নে
রয় যে গো অন্তরে নয়নের স্বপ্নে
ক্ষণে ক্ষণে শোনে প্রাণ
যার মধু আহবান আকুল করা।
সুর : দক্ষিণামোহন ঠাকুর।
ছবি : মহিষাসুর বধ।
৪.
বাঁশবাগানের মাথার উপর চাঁদ উঠেছে ওই,
মা গো আমার শোলোকবলা কাজলা দিদি কই।
পুকুর পাড়ে লেবুর তলে থোকায় থোকায় জোনাই জ্বলে
ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না তাই তো জেগে রই।
সেদিন হতে কেন মা আর দিদিরে না ডাকো,
দিদির কথায় আঁচল দিয়ে মুখটি কেন ঢাকো।
লেবুর তলে পুকুরপাড়ে ঝিঁঝিঁ ডাকে ঝোপেঝাড়ে,
রাত্রি হল মাগো আমার কাজলাদিদি কই।
৫.
সাত রঙা এক পাখী
পাতার ফাঁকে ডালে ডালে করছে ডাকাডাকি।
কোন দেশেতে ছিল
ফাগুন এনে দিল,
ঘাসের ফুলে পরশ দিয়ে বাঁধল মিলনরাখি।
সবুজ নিল বন, রঙিন হল মন,
লাল নিল তার জবা, হলুদ নিল চাঁপা,
আর যা ছিল ছড়িয়ে দিল মুখর হল সভা।
রাখাল ছেলে এল, ফুলের খবর পেল,
বাতাসে তার গন্ধ নিয়ে বুজল দুটি আঁখি।
কথা: সুধীর হাজরা।
সুর: সুধীন দাশগুপ্ত।
৬.
সজনী গো রজনীকে চলে যেতে দাও, শুধু একবার।
এই মন রজনীগন্ধা তুমি তুলে নাও
রজনীকে চলে যেতে দাও, শুধু একবার।
বাকি যদি থাকে কথা কোনো সজনী গো তুমি শোনো —
সে কথাটি মন রজনীগন্ধার কাছে বলে যাও, শুধু একবার।
কি হবে গো রজনীকে চোখে চোখে রেখে,
সে তো চলে যাবে ওই দূর থেকে দেখে।
সে কী এসে কাছে ধরা দেবে, সজনী গো দেখ ভেবে –
রজনীকে মন রজনীগন্ধা কাছে তাকে চাও, শুধু একবার।
কথা ঃ মিন্টু ঘোষ।
সুর: সুধীন দাশগুপ্ত।