প্রতীক্ষা – বেগম জাহান আরা

প্রতীক্ষা - বেগম জাহান আরা

দুবার রিং হয়েই কেটে গেলো ফোনটা। এই বিভূঁইয়ে আমার ফোন বড়ো একটা আসে না। মনোযোগ দিয়ে একটা বই পড়ছিলাম। মাত্র পেয়েছি হাতে। নায়ক নায়িকার তর্ক যখন তুঙ্গে, তখন এলো ফোন। বিরক্তই হলাম। ভাবলাম, যাক কেটে গেছে, ভালোই হয়েছে। আবার চোখ দিই বইয়ের পাতায়। আলস্যের আরাম হারাম করে বই পড়া। তিন দিন পরে ফেরত দিতে হবে।

নায়িকা বলছে, এখন আমি বাচ্চা নিতে পারবো না।

নায়ক বলে, যে এসেছে তাকে নিয়ে নাও।

-তারপর? বাচ্চা পালবে কে?

-তুমি আমি দুজন মিলে।

-আমার প্রমোশনটা মাঠে মারা যাবে এখন বেবি নিলে।। জানি, সেটাই চাও।

-চাকরি বড়ো, না আমাদের প্রেমের ফসল বড়ো?

-এইসব শোষনের ভাষায় কথা বলো না। আমি আজই যাবো ক্লিনিকে।

-প্লিজ এমন করো না।

-তুমিও এমন করো না প্লিজ।

-আমাদের তো প্ল্যানই ছিলো, এই বছরে বেবি নেবো।

-আমারও প্ল্যান ছিলো, তুমি ইরেনার সঙ্গ ছেড়ে দেয়ার পরে বেবি নেবো।

-কার সাথে কি মেশাও, বলতো হানি?

-কথায় আর কাজ হবে না ডিয়ার।

-আমি চাই, বেবিটা আসুক আমাদের ঘরে।

-আমি চাই না। উত্তপ্ত হয়ে ওঠে দুজনেই।

 

আবার রিং বাজে। নির্জন বিকেলের প্রহর বিদীর্ণ হয়ে যায় একেবারে। নাহ, এবার ফোনটা ধরা দরকার। বই রেখে উঠতেই হয়।

 

-হ্যালো, শুভ বিকেল।

-হ্যালো। শুভ বিকেল। ও প্রান্তের কথা।

-কে বলছেন ভাই?

-কণ্ঠ শুনে চিনতে পারলে না?

-আর একটু কথা বলেন প্লিজ।

-আমার তো এদেশে এই সময়ে আসার কথাই ছিলো, না? মেইল পাওনি?

-মানে, মানে, কার, কোথায়? কিসের মেইল? বুঝতে পারছি না।

মিষ্টি একটা হাসির আওয়াজ এলো। চেনা চেনা মনে হয় হাসিটা।

-কি হলো, এখনও চিনতে পারলে না?

-হার মানছি, প্লিজ বলেন আপনি কে? বিপন্ন লাগছে আমার।

-লাগুক, লাগুক, আর একটু বিপন্ন লাগুক। আবার হাসি।

 

কথাবার্তা এমন আপনজনের মতো যে, শক্ত কথাও বলতে পারছি না। কিন্তু কিছুতেই মনে করতে পারি না কোথায় শুনেছি এই কণ্ঠ?

-হার মেনেছি, এইবার মাফ চাইছি, তো বলেন দয়া করে কে আপনি?

-তাহলে থাক, পরে আবার কথা হবে। চিনতেই যখন পারছো না।

-প্লিজ রাগ করবেন না। বয়স হয়েছে। অনেক কিছুই ভুলে যাই আজকাল।

-তাই বলে আমাকেও ভুলে গেলে?

 

কি মুসিবত! রাগে দুঃখে নিজের গায়ে চিমটি কাটতে ইচ্ছে করছে। বলি, প্লিজ আর ধাঁধা নিতে পারছি না। মাথা ঘুরতে লেগেছে।

-পরশু বার্লিনে আসছি। সময় খুব কম হাতে। বার্লিন রেল স্টেশনের ম্যাকডোনাল্ডে অপেক্ষা করবো। তুমি চলে এসো। ঘন্টা দুই গল্প করা যাবে।

-বার্লিনে যাওয়া বললেই যাওয়া? ভালো করে রাস্তা ঘাট চিনি না। যেতে পারবো কি না, কিছু না জেনেই প্রোগ্রাম করে রেখেছেন? অবাক মানুষ তো আপনি?

আবার সেই হাসি। তারপর বলেন, কি করবো বলো? হাতে এতো কম সময় পাবো তা ভাবিনি।

-এমন দেখা না হলেই ভালো ছিলো না কি?

-না না, এই কথা বলো না। সতরো বছর পর দেখাটা তো হবে। তোমাকে দেখার তৃষ্ণায় মরে যাচ্ছি প্রিয়জন।

 

এখনও মনে করতে পারছি না, কে এমন করে কথা বলতে পারে? প্রায় চার কুড়ি বছর সময় পার করেছি। এখন আমাকে দেখার তৃষ্ণা কার থাকবে? একাকী জীবনে বই পড়ে আর কিছু লেখালেখি করে সময় কাটাই। পরিবারের সবাই ব্যস্ত। তাই আমিও খুঁজে নিয়েছি নিজের ব্যস্ততা। কানে ফোন রেখেই একটু অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিলাম।

 

-তাহলে ওঁই কথাই রইলো। পরশু বুধবার, বার্লিন রেলস্টেশন, ম্যাকডোনাল্ড, বেলা এগারোটায়। সেদিন যদি চিনতে না পারো, তাহলে পরজন্মে আবার দেখা হবে প্রিয়জন। তোমাকে ভালোবাসি। এই ভালোবাসা আছে, থাকবে, বাড়বে। তিনি

রেখে দেন ফোন।

 

শুনশান বাড়ি। স্তব্ধ বিকেল। বিছানায় খোলা বইটা। হাতে ধরা  শব্দহীন ফোনের রিসিভার। শুধু তার কন্ঠস্বর বাজছে আমার কানে। আগামি বুধবার, বার্লিন রেলস্টেশন ম্যাকডোনাল্ড , বেলা এগারোটায়। এই বয়সে রহস্য ভালো লাগে? কিন্তু মন থেকে,  কান থেকে, ইথার থেকে শব্দগুলো যাচ্ছে না কিছুতে।

 

এমন বিপদেও পড়ে কেউ! কে হতে পারে? কার সাথে সতেরো বছর দেখা হয়নি? আমাকে ভালোবাসে। আমার সাথে দেখা করতে চায়। প্রিয়জন বলে সম্বোধন করে। বার্লিনে দেখা না হলে পরজন্মে দেখা হবে বলে জানায়। কেমন এক শিহরণ জাগে চেতনায়। একটু একটু ভালোও লাগে। ভালোবাসার কথা শুনলে এখনও এমন আকুল ব্যাকুল লাগে? নিজের কাছেই অবাক। মনটা তাহলে এখনও জীবিত আছে?

 

বাড়ির লোকজন আসবে সন্ধে আটটায়। এখন বাজে সাড়ে পাঁচটা। বই পড়ার বারোটা বেজে যায়। কিছুক্ষণ ঘরের ভেতর হাঁটাহাঁটি করি। একটু ঠান্ডা ঠান্ডা ভাব। জার্মানির সামারেও মাঝে মাঝে আমার শীত করে। তার ওপর মেঘ করেছে। সোনায় সোহাগা। শালটা হাতের কাছেই  থাকে। তুলে গায়ে জড়াই।

 

মনে পড়ি পড়ি করেও পড়ছে না তার কথা। সে কি সেই পুনের বন্ধুটা? একবেলা না দেখলে যার বদহজমের মতো হতো, সেই কি? শীর্ণ মুঠা নদীর ধার দিয়ে হাত ধরাধরি করে হেঁটে হেঁটে বাজার করতে যেতাম একসাথে, সেই কি? মুঠা নদীর ব্রিজের ধারে বসে বসে গান গাইতাম দুজনে মিলে, সেই তার সাথেই তো। ডেকান কলেজে একসাথে বসে টিফিন খেতাম সেই মারাঠি মহিলার রেস্তোঁরায়। বিশেষ করে সাবুদানার খিঁচুড়িটা খুব ভালো বানাতো মহিলা। চা-টাও ছিলো চমৎকার। কান্ধা পোহে মন্দ ছিলো না। প্রথম প্রথম খিঁচুড়ি থেকে কারিপাতা বেছে ফেলে দিতাম। আমার ভালো লাগতো না। ও বলতো, আহা ফেলো না, আমাকে দাও।

 

কি অনায়াসে আমার ছোঁয়া খাবার খেয়ে নিতো। কতোদিন এক থালাতে  দুজনে মিষ্টি , চানাচুর, বিস্কুট খেয়েছি। আমি বলতাম, তোমার জাত যাবে ‘চিতপাবনি’ ব্রাহ্মণ। ও বলতো, জাত তো গেছেই মনে মনে। সে তো আর জাত পাত, দেশ বিদেশ, ধর্ম বর্ণ বোঝে না। ভালোবাসার জন্যই ভালোবাসে।

 

ঠাট্টা করে বলতাম, মানেটা কি হলো?

বলতো, ভালোবাসার মানে বোঝো? গভীর চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলতো।

-বলো না শুনি।

-আকাশ। ভালোবাসা মানে, পুরো আকাশ। যার কোনো দিক নেই, শুরু নেই, শেষ নেই। যেখান থেকেই তাকাও, সে তোমার।

হেসে আল্লাদে ওর গায়ে ঢলে পড়তাম। কখনও আমার কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে থাকতো ও। বলতো, উপায় থাকলে তোমাকে বিয়ে  করতাম। সারারাত গান শুনতাম প্রিয় মুখ থেকে।

-ঘুমোতে কখন?

-ঘুমোতাম না।

-পাগলের মতো কথা বলছো গো।

-যা খুশি বলতে পার প্রিয়জন। আমার কথা আমি বললাম।

 

একদিন ভগবান রজনীশ-এর আশ্রমে যেতে চাইলাম। পুনেতে তখন রজনীশ-এর “সেক্স টু গড” ধর্ম দারুণভাবে তরুণ সমাজকে আকৃষ্ট করছে। তার আশ্রমে দেশি বিদেশি নারী পুরুষ যুবকেরা আসছে। ওরা সবাই গেরুয়া কাপড় পরে চলা ফেরা করে। মুঠা নদীর একপারে ডেকান কলেজ, অন্য পারে রজনীশের আখড়া। গরমের সময় ছেলেরা এক্টুকরো কাপড়ের নেংটি ছাড়া কিছু পরতো না। ডেকান কলেজের পাশ থেকেই দেখা যেতো এই সব দৃশ্য। লজ্জাও পেতাম, হাসতামও।

 

তো আমাকে কিছুতেই যেতে দেবে না ও। ওখানে গেলে নাকি কেউ ফিরতে পারে না। কতোবার বলেছি, দুজনেই যাই একসাথে। তাতেও রাজি না। ফলে রজনীশ-এর আশ্রম দেখাই হলো না। আফসোস হয়। রাগও হয়। আমাকে হারানোর সে কি ভয়! আমি যতোই হাসি, ও ততোই মুখ মলিন করে। আহা, কি সুন্দর সময় ছিলো আমাদের! ডেকান কলেজের থাই ছাত্রি, মাঞ্চেরি আমাদের বলতো, মানিকজোড়।

 

মনে পড়ছে এখন। প্রিয়জন বলার মানুষ আমার জীবনে একজনই। নিশ্চয় সেই ‘চিতপাবনি’ ব্রাহ্মণই হবে। সেই  পাগলটাই। নইলে এমন করে জোর দিয়ে নিঃসঙ্কোচে আর কে বার্লিন যাওয়ার কথা বলতে পারবে?

 

কিন্তু ওর কোনো চিঠি তো পাইনি? ওর যে জার্মানি আসার  কথা ছিলো, সেটাই তো আমি জানিনি। লজ্জাই লাগছে এখন। কি মনে করলো ব্রাহ্মণ?

 

আজকাল স্মার্ট ফোনে তো কল ব্যাক করা যায় সহজেই। তাড়াতাড়ি ফোনটা হাতে নিই। আবার ভাবি, থাক না সে সাসপেন্সে। আমি চিনতে পারিনি, এটা ভেবেই থাক।

হয়তো কষ্ট পাবে একটু। পাক না। দেখা  হলে সব মেঘ কেটে যাবে।

 

সিদ্ধান্ত নিই বার্লিন যাওয়ার। গোলম থেকে বার্লিন যাওয়া খুবই সহজ। গিয়েছি দুতিন বার। কিন্তু একা যাইনি কখনও। গোলম থেকে এক ট্রেনেই যাওয়া যায়। কিন্তু অনেকখানি হাঁটতে হবে। আজকাল হাঁটতে বেশ কষ্ট হয়। তার চেয়ে ভালো, বাসে করে পটসডাম মেইন রেলস্টেশনে গিয়ে বার্লিনের ট্রেন ধরা।

 

বেলা এগারোটায় বার্লিনে পৌঁছুতে পারি, এমন সময়ের ট্রেন দেখে রাখলাম। কি অস্থিরতা! সকাল কাটে তো বিকেল কাটে না। রাত কাটে তো দিন কাটে না। সব প্রতীক্ষাই বুঝি এমনি হয়। আহা, কতোদিন পর দেখা হবে! কেবল সময়ের হিসেব করছি। পটসডাম থেকে কিছু ফুল নিতে হবে। লাল গোলাপ নিলে বেশি রোমান্টিক হবে। কয়েক রকম গোলাপ নেয়াই ভালো। সেই যে হায়দ্রাবাদ গিয়েছিলাম, তখন একদিনের জন্য পুনেতে গিয়ে দেখা করেছিলাম। রাতের ট্রেনে হায়দ্রাবাদ থেকে পুনে, আবার পরের দিন সন্ধের ট্রেনে পুনে থেকে হায়দ্রাবাদ।

 

একটা পুরো দিন অটোরিকশায় ঘুরেছিলাম আমরা দুজন। লম্বা এম জি রোডের এই প্রান্ত ঐ প্রান্ত ঘুরে ফিরে খেলাম সেই পুরনো  রেস্তোঁরায়। কস্তুরবা সোসাইটিতে সেন দাদার বাসায় গেলাম। খাওয়া হলো সেখানেও কিছু। আমার গুণী গাইড ড. কেলকার স্যারের বাসায় গেলাম। কোথা দিয়ে বারো ঘন্টা কেটে গেলো, বুঝিনি। সন্ধে বেলায় পুনে রেল স্টেশনে গাড়িতে তুলে দিয়ে বিদায় নিলো ও। হাতটা ধরেই ছিলো ট্রেন চলতে শুরু করার আগ পর্যন্ত। ঠিকই তো, সতেরো বছর আগের কথা। একটা প্রজন্মের ব্যবধান বলতে গেলে। আহা জীবন! কি অনায়াসে বয়ে যাও সময়ের রথে বসেই।

দশটা আটান্ন মিনিটে ট্রেনটা বার্লিন মেইন স্টেশনের চোদ্দ নম্বর প্লাটফর্মে থামলো। বুক ধুক ধুক  করছে আমার। চিনতে পারবো তো ওকে? স্টেশন তো নয়, এলাহি কারবার। যেমন ভালো লাগে, তেমন আউলা লাগে। প্রতি এক দুমিনিট পর পর মাথার ওপরে আশে পাশে ট্রেনের পর ট্রেন আসা যাওয়া করছে। ছুটির দিনে থৈ থৈ করে লোক। আজ কিছু কম মনে হলো। তবু অনেক। যে যার গন্তব্যে ব্যস্ত।  কারও সাথে হাই হ্যালো নেই। তাই কথার উচ্চ গুঞ্জনও নেই। জনারণ্যে সবাই একা পথিক। কথা যা, তা স্মার্ট ফোনের সাথে। মেশিনে টিকিট কেটে নিচ্ছে কেউ কেউ। সেখানেও কথা নেই। সময়ের আকাল তো আছেই। কথারও আকাল আছে মনে হয়। হাত ধরে যে সব জুটি হাঁটে, তারা মাঝে মাঝেই পরস্পরকে চুমু খায়। জড়িয়ে ধরে। যেনো চারপাশে ভূবনের আর কোনো বাসিন্দা  থাকে না। হোমো, লেসবিয়ন, সবই দেখা যায়। ফিরেও চায় না কেউ।

 

ট্রেন থেকে নেমে একটু এদিক ওদিক দেখলাম। দ্বিধা দ্বন্দ্ব ভ্রান্তি কিছুই থাকার কথা নয় এখানে। কাঁটায় কাঁটায় ট্রেন আসবে। সাধারণত নির্ধারিত প্লাটফর্মে থামবে। ও নিশ্চয় জানে, এগারোটার ‘রিজিওনাল বান’ (ট্রেন) কোন প্লাটফর্মে থামবে। তবে আমাকে নিচে নামতে হবে। ম্যাকডোনাল্ডস মনে হয় তিন তলায়। সেই কবে একবার এসেছিলাম, কিছুই মনে নেই। গোলোক ধাঁধার মতো লাগছে। ধীরে ধীরে এগিয়ে যাই লিফটের দিকে।

 

আস্তে করে হাঁটছি। পাঁচ তলার ওপর প্লাটফর্ম। কি বাতাস! পুরো স্টেশনটা একটা উপগ্রহের মতো। ঝড় বৃষ্টি রোদ কিছুই লাগে না। তবু ঠান্ডা লাগছে আমার। পাতলা সোয়েটার গায়ে থাকার পরও শালটা জড়াতে হলো। সামনেই লিফট। দাঁড়ালাম। যন্ত্রটা  মানুষ পেটে নিয়ে ওপরে উঠছে। সিঁড়ি আছে। ইলেভেটর আছে। কিন্তু আমি লিফটেই যাবো। যন্ত্রটা এসে থামলো। মানুষগুলো নামছে।

 

হঠাত পেছন থেকে দুটো উষ্ণ হাত আমাকে জড়িয়ে ধরলো। চমকে ঘুরে দাঁড়ালাম। দুজন দুজনকে এক ঝলক দেখে জড়িয়ে ধরলাম পরস্পরকে আবার। আহ, কতোদিন পর! কি শান্তি! কি শান্তি! শেষ হলো প্রতীক্ষার প্রহর।

 

আবেগ সামলে ঠিক ঠাক দঁড়ালাম মুখোমুখি। ও হেসে বললো, চিনতে পেরেছো?

-খুব ভালো করে। সব মনে পড়েছিলো সেদিনই।

-ফোন করোনি কেনো?

-তোমাকে সাসপেন্সে রাখার জন্য। হাসলাম দুজনেই।

-খুব শুকিয়ে গেছো তুমি। চোখের ওপর চোখ রেখে বলে ও।

-না তো! হেসে বলি, সতেরো বছর সময় তো কম নয়। কিন্তু এরই মধ্যে কালো চুলগুলো  পাকিয়ে ফেলেছো। পড়েও গেছে কুন্তল রাশি অনেক।

-খারাপ লাগছে দেখতে, না?

 

আবার জড়িয়ে ধরি ওকে, বলি, বৌদি, আমার পর্ণা বৌদি। কি বলো এসব?

-দিদিভাই। কান্না জড়ানো কণ্ঠে ও বলে, অহনাদি, আমার  প্রাণের দিদি।

আমাদের দুজনের চোখেই পানির ধারা। পর্ণা বৌদি বললো, দেখা হলো অবশেষে অহনা দি।

-সত্যি। নিজ দেশে নয়। একেবারে ভিনদেশে। বাংলাদেশ নয়, ভারত নয়, সুদূর জার্মানিতে। একেই বলে ভালোবাসা বৌদি। অবিশ্বাস্য।

 

খাওয়া দাওয়া কখন করবো? ম্যাকডোনাল্ডসে ভিড় দেখে অন্য রেস্তোঁরায়  গিয়ে এক প্লেট নুডলস নিলাম। বসলাম গিয়ে বারান্দার ধারে। ভেবেছিলাম, পরে বার্গার খেয়ে নেবো। চিতপাবনি ব্রাহ্মণ আবার এক প্লেটে আমার সাথে খেলো। কই খেলাম, বলতে পারি না। প্লেটের খাবার কমছে না, কিন্তু সময় কমে যাচ্ছে। মনে হয়, দুই মিনিটে উড়ে গেলো  দুই ঘন্টা সময়। বৌদিকে ফিরতে হবে হামবুর্গ। ফেরত টিকেট কাটা আছে।

 

স্টেশন থেকে দেখা যাচ্ছিলো স্প্রি নদীর ওপর নির্মিত সুরম্য জার্মান সংসদ ভবন। একবার এসেছিলাম ছেলের সাথে বেশ কয়েক বছর আগে। তখন ‘চেক পয়েন্ট চার্লি’ এবং জার্মানির ভাঙা দেয়ালও দেখেছি। আহারে জীবন! ছোট্ট আয়ুতে কি বড়ো চৌহদ্দি! কেউ কি সবটুকু দেখতে পারে? মোচড় দিয়ে ওঠে বুকের ভেতর।

 

রেস্তোঁরায় অনেক লোক। তবে এরা সবাই ‘চুপ শা’-এর শিষ্য। হয় মৃদুস্বরে কথা বলে, নয়তো চুপচাপ খায়। কিছুই আমাদের আকৃষ্ট করলো না। আমরা ডুবে গেলাম শীর্ণ সেই মুঠা নদীর অগভীর জলে। তারপর কথার অবগাহন। কতো কথা বললাম তার হিসেব নেই।  সতেরো বছরের তৃষ্ণা! আকন্ঠ শুকিয়েই থাকলো, বিদায়ের সময় হয়ে গেলো। ভাবতেই পারিনি।

 

বৌদি ট্রেনে ওঠার আগ মহুর্ত পর্যন্ত আমরা কথাই বলে গেলাম। বিদায়ের আগে আর একবার জড়িয়ে ধরলাম পরস্পরকে। আবার কবে দেখা হবে, কে জানে? আদৌ হবে কিনা, সেটাও প্রশ্ন। জীবনের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে আশা করতে সাহস হয় না। হুড় মুড় করে নয়, সাপের মতো নিঃশব্দে এসে দাঁড়ালো ট্রেনটা। কামরায়  উঠে ঝরঝরিয়ে সেকি কান্না বৌদির। আমারও! পুনে থেকে প্রতিবার বাড়ি আসার সময় যেমন করে আমরা দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতাম, ঠিক সেইরকম কান্না। কে জানে আমাদেরকে লেসবিয়ন মনে করছে কি না অন্যেরা? এদেশেতো লেসবিয়নেরা আইনত বিয়েও করতে পারে। দূর, কি যায় আসে আমাদের?

 

ট্রেন যেমন পিলপিলিয়ে আসে, তেমন পিলপিলিয়ে যায়। শব্দ নেই তারও। যেনো লুকিয়ে লুকিয়ে পরকীয়ায় আসে যায়। বাড়ি ফিরবো আমিও। লুকিয়ে লুকিয়ে মন খারাপ করবো। জানতে পারবে না কেউ। আমাদের এক আকাশ ভালোবাসার কথাও তো জানবে না কেউ। অনেকেই  ভাবে, এই বয়সে মানুষের সুকুমার বোধ, বুদ্ধি, আবেগ, কিছুই থাকে না। কথাটা কিন্তু একেবারেই বেঠিক। মনটা আমার খুলে খুলে যাচ্ছে অল্পবয়সী প্রেমিকের মতো। কথা বলতে পারিনি কেউ শেষ মুহুর্তে।

ব্রাহ্মুণের সাথে আমার এই বন্ধুত্বের কথা কেউ বুঝতেই পারে না।

 

হুইসেল বেজে উঠলো। হাত ছেড়ে দিয়েছিলাম আগেই। ব্যাগ থেকে টিসু পেপার বের করে চোখ মুছে দেখি, জানান না দিয়ে, কোনো শব্দ না করে,  বিদায় বাণ উচ্চারণ করতে না দিয়ে অসভ্য নির্বিকার ট্রেনটা চলে যাচ্ছে তার গন্তব্যে। সময় মতো প্লাটফর্ম না ছাড়লে যেনো বার্লিন উলটে যাবে।

 

শক্ত বিশাল পাটাতনের ও পাশেই পনরো নম্বর প্লাটফর্ম। নিঃশব্দে এসে দাঁড়ালো আমার ট্রেনও। এই আসা যাওয়ার পৃথিবীতে এবার গন্তব্যে যেতে হবে আমাকেও।