রবীন্দ্রনাথের বিজয়া এক বিদেশীনির কথা / আফরোজা পারভীন

রবীন্দ্রনাথের বিজয়া এক বিদেশীনির কথা

রবীন্দ্রনাথের বিজয়া এক বিদেশীনির কথা / আফরোজা পারভীন

 

‘আমি চিনি গো চিনি তোমারে, ওগো বিদেশিনী’ রবীন্দ্রসঙ্গীতটি শোনেনি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া ভার। রবীন্দনাথের যে গানগুলি খুব বেশি গীত হয় এটি তার একটি। গানটি এক বিদেশীনিকে নিয়ে লেখা। গানের বাণীতেই আছে সেই বিদেশীনির কথা। কে সেই বিদেশীনি কেউ জানেন, কেউ জানেন না।

 গানটি  লেখার ত্রিশ বছর পরে রবীন্দ্রনাথ দেখা পান তাঁর গানের বিদেশীনির । দেখা পান দক্ষিণ আমেরিকার দেশ আর্জেন্টিনায়। তাঁকে দেখেন শারদপ্রাতে আর মাধবীরাতে। ঠিক যেমন বলেছেন গানের বাণীতে তেমনভাবেই। বিদেশীনির নাম ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো। রবীন্দ্রনাথ ডাকতেন ‘বিজয়া’। আমাদের সাথে পরিচয় করান ওই নামেই। ‘ভিক্টোরিয়া’ শব্দটিকে বাংলায় অনুবাদ করে বানান ‘বিজয়া’। 

বিজয়া বা ভিক্টোরিয়ার সাথে অদ্ভুত এক সম্পর্ক ছিল  রবীন্দ্রনাথের। শোনা যায় এক গভীর প্লেটোনিক প্রেমের সম্পর্কের কথা।  রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বয়স তখন ৬৩, ওকাম্পোর ৩৪।

রবীন্দ্রনাথের জীবনে প্রেম আখ্যান কম নয়। নানান দেশের নানান বয়সী রমণীর সাথে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়েছেন তিনি। রয়েছে অনেক গল্প । কিন্তু সাতসমুদ্দুর তের নদীর ওপারের বিদেশিনীর সাথে  এই প্রেমের সম্পর্ক  অমর হয়ে রইল নানান কারণে। পেলো বিশেষ মাত্রা।

ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো একজন আর্জেন্টাইন নারীবাদী লেখিক, ‘সুর’ নামের একটি পত্রিকা সম্পাদনা করতেন তিনি। 

বিগত ত্রিশের দশক থেকে ষাটের দশক পর্যন্ত প্রবল পরাক্রমে রাজত্ব করেছিল পত্রিকাটি। 

ওকাম্পো ছিলেন আধুনিকা, ফ্যাশন সচেতন। সে সময়কার ফ্যাশন সম্রাজ্ঞী কোকো শ্যানালের সাথে ব্যক্তিগত বন্ধুত্ব ছিল তাঁর। বন্ধুত্ব এবং পরিচয় ছিল ভার্জিনিয়া উলফ, কঁতেস দ্য নোয়াই, সিলভিয়া বিচ, ন্যান্সি এস্টর, ইন্দিরা গান্ধী এবং সুসান সোনট্যাগের মতো নারীদের সাথে। ইগোর স্ত্রাভিন্সকি, মরিস রাভেল, এরনেস্ট আনসার্মে, পল ভ্যালোরি, ল করবুসিয়ের, আলবেয়র কামু, আদ্রিয়েন মোনিয়ের, আলডাস হাক্সলি,ভিটা স্যাকভিল ওয়েস্ট, গ্যাব্রিয়েলা মিস্ত্রালসহ সেসময়কার খ্যাতিমান লোকজনের সাথে পরিচয় ছিল তাঁর। সাক্ষাৎ হয়েছিল প্রিন্স অব ওয়েলস এডওয়ার্ড-৮, য়ুং এবং মুসোলিনির সাথেও। কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৬৭ সালে বিশ্বভারতী থেকে তাঁকে ‘ দেশিকোত্তম’ উপাধি দেয়া হয়েছিল। একই বছর তিনি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মানসূচক ডিগ্রী লাভ করেন, যা এর আগে ৩৩০ বছরে মাত্র দশজন নারীকে  হয়েছে। ১৯৭৭ সালে আর্জেন্টাইন একাডেমি অব লেটার্স’ এর সভানেত্রী নির্বাচিত হয়েছিলেন । চেয়ারটি এর আগে পুরুষেরই করায়ত্ত ছিলো। 

ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর জন্ম ১৭ এপিল ১৮৯০ আর্জেটিনার বুয়েনোস আয়ারসে। রবীন্দ্রনাথ বয়সে ২৯ বছরের বড় ওকাম্পোর । ১৮১৬ সালে স্পেনের ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্ত হয় আর্জেন্টিনা। স্বাধীন জাতিরাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। ভিক্টোরিয়ার পরিবার ছিল ধনাঢ্য। ছিল অভিজাত ভূমিমালিক। তাঁর পূর্বপুরুষের অনেকেই দেশের স্বাধীনতা আন্দোলন ও ইতিহাসের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। এ পরিবারে ক’জন বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী ছাড়াও রয়েছেন বিখ্যাত চিত্রশিল্পী প্রিলিদিয়ানো পেরিডন। এসব কারণে আলাদা মর্যাদা ছিল পরিবারটির।

ভিক্টোরিয়া বেড়ে উঠেছেন ঔপনিবেশিক অনুশাসন ও ক্যাথলিক ঐতিহ্যের মধ্যে। সেসময় নারীর শিক্ষার্জনের সুযোগ ছিল অতি সামান্য। অনেকেই পড়তে লিখতে জানতেন না। গান এবং বাদ্যযন্ত্র বাজানোর দক্ষতার মধ্যেই সীমিত ছিল নারী শিক্ষা। গৃহকর্ম আর পারিবারিক  সীমানাতেই বাধা ছিলো তাদের জীবনের গন্ডি ।

 ছেলেবেলোতেই মা রোমানা একুইয়ারে ভিক্টেরিয়াকে মেয়েদের জন্য প্রযোজ্য সামাজিক বিধিনিষেধ সম্পর্কে জানিয়েছিলেন। কিন্তু এসব ভালো লাগতো না ভিক্টোরিয়ার। তার ভালো লাগতো ছেলেদের মতো খেলাধুলা করতে।  কিন্তু তাকে মেয়েদের মতো আচরণ করতে হুকুম দেওয়া হতো। কষ্ট হতো ভিক্টোরিয়ার।

ভিক্টোরিয়ার বাবা মিগুয়েল ওকাম্পো নামকরা স্থাপত্য প্রকৌশলবিদ হলেও অত্যন্ত গোঁড়া ছিলেন। পিতৃতান্ত্রিকতার বিশ্বাসী ছিলেন তিনি। ভিক্টোরিয়া দেখতে দারুণ সুন্দর আর খুব বুদ্ধিমতী। বাবার খুব গর্ব ছিল মেয়েকে নিয়ে। বাবা বলতেন, ‘কী আফসোস! এটা যদি ছেলে হতো তা হলো একটা ভালো পেশায় যেতে পারতো।’

 রুটিনবাধা পড়াশুনা আর বাড়ির অনুশাসনে বিরক্ত হয়ে উঠেছিলেন ভিক্টোরিয়া। বাড়িতে একজন ফ্রেঞ্চ গভর্নেস  ফ্রেঞ্চ, ল্যাটিন, ধর্মগ্রন্থ, ইতিহাস, গণিত, প্রাকৃতিক বিজ্ঞান পড়াতেন। ভিক্টোরিয়া পড়তে চাইতেন সাহিত্য ও পুরাণ। অন্য বিষয়ে তার আগ্রহ ছিল না। মাঝে মাঝে বিদ্রোহ করতেন। বিদ্রোহে ফল হয়েছিল।  একসময় তাকে ইংলিশ, স্পেনিশ, ইতালিয়ান এবং সঙ্গীত শেখাবার জন্য ভিন্ন ভিন্ন শিক্ষক নিয়োগ করা হয়। ফ্রেঞ্চ শিক্ষক তাকে ফ্রেঞ্চ ধ্রুপদ গ্রন্থ পড়তে সাহায্য করেন। ফেঞ্চ ছিল তার ভীষণ প্রিয়। ইংরেজি শিক্ষকের উৎসাহে তিনি শেকসপিয়ারের নাটক ও চার্লস ডিকেন্সের উপন্যাস পড়েন।আর্থার কোনান ডয়েলের শার্লক হোমস তার খুব প্রিয় ছিল। জুর্ল ভার্নের ক্যাপ্টেন হ্যাটেরাসকে  চরিত্রটির প্রতি আকর্ষণ ছিল ভিক্টোরিয়ার। উত্তর মেরুর প্রেমে পড়ে সেখানে একটি পতাকা উড়াবার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করার জন্য সব ধরণের আত্মত্যাগ করতে প্রস্তুত ছিলেন তিনি। লরেন্স অব অ্যরাবিয়া, দ্য সেভেন পিলার্স অব উইজডম পড়ার পর রীতিমতো নায়কের প্রেমে পড়ে যান ভিক্টোরিয়া। এভাবেই অনেক ক্লাসিক সাহিত্যের সাথে তাঁর পরিচয় হয়।

ভিক্টোরিয়ার পরিবার ঘন ঘন ফ্রান্সে যেতো আর অনেকদিন ধরে অবস্থান করতো। এরফলে মাতৃভাষা স্পেনিশের বদলে ফ্রেঞ্চই হয়ে ওঠে তাঁর প্রধান ভাষা।ভিক্টোরিয়া নিজের কথাগুলো বলার জন্য লেখায় মন দিলেন। জীবন ও মৃত্যুর রহস্য অনুসন্ধান ছিল তাঁর প্রিয় বিষয়।

১৯১২-র নভেম্বরে ডক্টর লুই বার্নাদো দে এস্ত্রাদাকে বিয়ে করেন তিনি। লুই ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। কিন্তু   স্বামীর সাথে কখনই তাঁর বুদ্ধিবৃত্তিক  লেনদেন হয়নি। ফলে এ বিয়ে সুখের হয়নি। বিয়ের কয়েক মাসের মধ্যে সম্পর্কে চিঁড় ধরে। একই ছাদের নিচে থাকতেন, তবে থাকতেন বিচ্ছিন্ন। ক্যাথোলিক পরিবারিক ঐতিহ্য অনুযায়ী তালাক দেয়া সম্ভব ছিল না। এই সময় একজন কাজিনের সাথে তাঁর প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এ সম্পর্কের ব্যাপারে কোনো রাখঢাক ছিলো না ওকাম্পোর। এই সম্পর্ক স্বামীর সাথে তাঁর সম্পর্ককে আরো জটিল করে তোলে।  ১৯১৬ সালে বিখ্যাত স্পেনিশ লেখক ওর্তেগা গ্যানসেত বুয়েনোস আইরেস-এ আসেন বক্তৃতা দিতে । ওর্তেগা ভিক্টোরিয়ার আলোচনা শুনেছিলেন। তাঁর  লেখা দান্তে ও রিয়াত্রিচের উপর প্রবন্ধ পাঠ করেছিলেন। পাঠ করার পর  তাঁর মধ্যে এ বিশ্বাসের জন্ম হয়েছিল যে, ভিক্টোরিয়া একজন মেধাবী লেখক। শুধু তাই নয় অপরূপা ভিক্টোরিয়ার সৌন্দর্যে আকৃষ্ট হয়েছিলেন তিনি। ভালোবাসার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কিন্তু ভিক্টোরিয়া তাঁকে উৎসাহিত করেননি। নিজের জীবন নিয়ে বড়ই ঝামেলায় ছিলেন তিনি। ছিলেন বড়ই টালমাটাল অবস্থায়।

 ১৯২২ সালে পর্যন্ত স্বামীর সাথে এক বাড়িতেই ছিলেন। এরপর আর সম্ভব হলো না। এ বছর   ছোট একটি অ্যাপার্টমেন্টে উঠে আসেন তিনি। কিন্তু তাঁর পরিবারে বা সে সময়ের সামাজে এ ধরণের ঘটনা কখনো ঘটেনি। ফলে অনেক রকম সমস্যার মুখোমুখি হতে হয় তাঁকে। একসময় তিনি আত্মহত্যা করার কথাও ভাবেন। কিন্তু প্রাণরসে ভরপুর জীবনবাদী মানুষ ছিলেন। তাই এ কাজটি করতে পারেননি।

বই তিনি বরাবরই পড়তেন। এবার আরো বাড়িয়ে দিলেন। বই প্রকাশের উদ্দেশ্য নিয়ে লিখতে শুরু করলেন। দান্তের ডিভাইন কমেডি তাঁকে আচ্ছন্ন্ করে রাখল। এ বই তাঁর নিজের ভেতরকার শক্তি আর গভীরতা আবিষ্কার করতে সাহায্য করল। একসময় তাঁর লেখা প্রকাশিত হলো বুয়েনেস আইরেসের নাম করা সংবাদপত্র লা নেশন-এ।  তিনি খোলামেলা বিশ্লেষণাত্মক লেখা লিখলেন নারীভাবনা নিয়ে । তখনকার সমাজে এ ধরনের লেখা ছিল নারীর জন্য নিষিদ্ধ। নারীভাবনার কথা লিখে এবং প্রকাশ করে তিনি সমাজে হইচই ফেলে দিলেন। আরো একটা সমস্যা ছিল। তিনি ফ্রেঞ্চ ভাষায় লিখতেন। আর্জেন্টাইন পাঠকরা তাঁর ভাবনাকে ফরাসি থেকে নিজেদের মতো করে স্পেনিশ ভাষায় অনুবাদ করে গোড়ামিপূর্ণ ব্যাখা ও বিশ্লেষণ প্রচার করতে থাকলো। এতে তিনি রাগ করলেন ঠিকই  কিন্তু তাঁর নিজের মধ্যে একটা দ্বন্দ্বেরও  সৃষ্টি হলো। তিনি আর্জেন্টাইন। এটাই তাঁর পরিচয়। এই পরিচিতি তিনি ভালোবাসতেন। কিন্তু ইউরোপীয় সংস্কৃতি ও ফ্রেঞ্চভাষা তাঁর জন্য অনেক স্বস্তিকর ছিল। এতে করে তাঁর দুই নৌকায় পা দেবার মতো অবস্থা হলো।

তিনি ভার্জিনিয়া ওলফ ও গ্যাব্রিয়েল মিস্ত্রাল-এর ভক্ত ছিলেন। এদের লেখার প্রভাবে তিনি নিজেকে নারী লেখক হিসেবে প্রকাশ করতে শুরু করলেন। তিনি নিজের নারীত্ব নিয়ে গৌরব বোধ করলেন। তিনি ছিলেন একরোখা, জেদি। ভীষণ আবেগী। কিন্তু পাশাপাশি আবার মানবতা এবং নারী স্বাধীনতার প্রশ্নে আপোষহীন। যুক্তিবাদী ছিলেন। মানসিকতায় ছিলেন শিশুর মতোই সরল। 

ভিক্টোরিয়া লিখছেন,পড়ছেন।  গোটা বিশ্বের লেখালিখির খবর রাখছেন। ১৯১৩ সালে তিনি খবরের কাগজে পড়লেন ‘গীতাঞ্জলি’র জন্য ভারতীয় লেখক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নোবেল সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছেন। ভিক্টোরিয়া গীতাঞ্জলির ইংরেজি অনুবাদ এবং আঁদ্রে জিদ-এর ফ্রেঞ্চ অনুবাদ সংগ্রহ করলেন। তিনি বইয়ের পাতা উল্টেই দেখলেন রবীন্দ্রনাথের স্কেচ ।  চোখবন্ধ, বুদ্ধের অবয়ব, হাতে বই, গভীর ধ্যানমগ্ন।  আলখেল্লা, তাঁর চুল ও দাড়িতে তিনি অপরূপ! তিনি গভীর মগ্নতা নিয়ে গীতাঞ্জলি পড়লেন। মিস্টিক পঙক্তিমালা পাঠ করলেন

একটি নমস্কারে প্রভু

একটি নমস্কারে

সমস্ত মন পড়িয়া থাক

তব ভবন দ্বারে

নানা সুখের আকুলধারা

মিলিয়ে দিয়ে আত্মহারা

একটি নমস্কারে প্রভু

একটি নমস্কারে

সমস্ত গান সমাপ্ত হোক

নীরব পারাপারে

ভিক্টোরিয়া পুনঃপাঠ করলেন,  আবারো পাঠ করলেন।

আমি বহু বাসনায় প্রাণপণে চাই

বঞ্চিত করে বাঁচালে মোরে

এ কৃপা কঠোর সঞ্চিত মোর

জীবন ভ’রে।

গীতাঞ্জলি প্রথম পড়ার দিনটির কথা লিখেছেন ওকাম্পো।

‘[তখন] আমার গান শেখার সময়। মাদাম ‘র’ তখনো এসে পৌঁছাননি। ধূসর রেশমে আস্তীর্ণ স্বপ্নালোকিত একটি ঘরে পিয়ানোর গায়ে হেলান দিয়ে কবিতাগুলো পড়ছি। শীতকাল। বুয়েনেস আইরেসের রাস্তাঘাটের হট্টগোল আমাকে অনুসরণ করে এসেছে, আপাতত চাপা পড়ে গেছে বদ্ধ জানালা আর পর্দার আবরণে। পিয়ানোর পাশে দাঁড়িয়ে থর থর করে কাঁপছে আমার যৌবনও:

কাঁদতে লাগলাম। পড়তে লাগলাম। মাদাম ‘র’ এলেন এবং বিচলিত হয়ে শুধালেন: “কী হয়েছে?” কী করে বোঝাই, হয়নি যে কিছুই, অথচ”

সম্ভবত গীতাঞ্জলির আধ্যাত্মিক কবিতাগুলো তাঁর টালমাটাল জীবনে কিছুটা শান্তি এনেছিল সে সময়। পরবর্তী কয়েক বছর ওকাম্পো বুঁদ হয়ে রইলেন রবীন্দ্রনাথের লেখায়। লিখে ফেললেন একটি অসামান্য লেখাও, ‘রবীন্দ্রনাথ পড়ার আনন্দ’।

রবীন্দ্রনাথের লেখার প্রেমে পড়লেন ভিক্টোরিয়া। আকাঙক্ষা করতে লাগলেন যদি কখনও দেখা হয় সেই দিনটির!

১৯২৪ সালে পেরুর স্বাধীনতা সংগ্রামের শত বছরের বার্ষিকীর অনুষ্ঠানে যাবার আমন্ত্রণ পেয়ে জাহাজে উঠলেন রবীন্দ্রনাথ। মাঝপথে অসুস্থ হয়ে আর্জেন্টিনায় অবস্থান করতে হয় তাঁকে । রবীন্দ্রনাথের পেরু যাবার খবর পেয়েছিলেন ভিক্টোরিয়ো। পেয়েছিলেন অসুস্থ হবার খবরও। অসুস্থ কবি আর্জেন্টিনার বুয়েনেস আইরেসের হোটেলে প্লাসায় ছিলেন । সাথে ছিল  সহযাত্রী এবং কাজের সার্বক্ষণিক সঙ্গী লেনার্ড এলমহার্স্ট।  সেখানেই একদিন হাজির হলেন একাধিক ভাষায় লিখন এবং পঠনে পারদর্শী, রবীন্দ্র ভক্ত ওকাম্পো । 

দিনটি ছিল ১৯২৪ সালের নভেম্বরের একটি দিন। রবি ঠাকুরের সাথে প্রথম সাক্ষাতের মুহূর্তটি ভিক্টোরিয়ার লেখায় উঠে এসেছে ঠিক এভাবে,

‘ প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তিনি এলেন; নীরব, সুদূর, তুলনাহীন বিনীত। ঘরে এসে দাঁড়ালেন, আবার এও সত্যি যে ঘরে যেন তিনি নেই।তেষট্টি বছর, প্রায় আমার বাবার বয়সী, অথচ কপালে একটি রেখাও নেই, যেন কোন দায়িত্বভারই নষ্ট করতে পারে না তাঁর সোনালী শরীরের স্নিগ্ধতা। সুগোল সমর্থ গ্রীবা পর্যন্ত নেমে এসেছে উছলে-ওঠা ঢেউতোলা সাদা চুলের রাশি। শ্মশ্রুমন্ডলে মুখের নীচের দিকটা আড়াল, আর তারই ফলে ওপরের অংশ হয়ে উঠেছে আরো দীপ্যমান। মসৃণ ত্বকের অন্তরালে তাঁর সমগ্র মুখাবয়বের গড়ন এক অবিশ্বাস্য সৌন্দর্য রচনা করেছে, তেমনি সুন্দর তাঁর কালো চোখ, নিখুঁত টানা ভারী পল্লব। শুভ্র কেশদাম আর স্নিগ্ধ শ্মশ্রু, এর  বৈপরীত্যে জ্বলে উঠছে তাঁর চোখের সজীবতা।’

ওকাম্পো এসেছিলেন কেবল একটিবার দেখবার জন্য। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ অসুস্থ জেনে অনেকটা জোর করেই তাঁকে হোটেল থেকে তুলে নেন ওকাম্পো। থাকার বন্দোবস্ত করলেন তাঁর এক আত্মীয়ের (ভাড়া করা) বাসায় । বাড়িটির নাম ‘মিরালরিও’। একটি উঁচু মালভূমির উপর বাসাটি অবস্থিত। বাড়ির সামনে  পেছনে বিশাল প্রাঙ্গণ। সবুজ ঘাস যেন  গালিচা বিছিয়ে দিয়েছে সে প্রাঙ্গণে। বাড়ির উত্তর দিকে দিকচিহ্নহীন বিশাল নদী ‘প্লাতা’। প্লাতা শব্দটির অর্থ রূপা’। শুরুতে সাতদিন থাকার কথা থাকলেও কবি ‘প্লাতা নদীর ধারের’ বাসাটিতে কাটিয়েছিলেন  প্রায় তিন মাস। তার প্রতিটি দিনই ছিল ঘটনাবহুল।

বাড়ির অলিন্দটি বড়ই প্রিয় ছিল রবীন্দ্রনাথের। ওটি  যেন তাঁর নিজেরই অলিন্দ। ওই অলিন্দ নভেম্বর-ডিসেম্বর এবং জানুয়ারির দিনগুলো মুখরিত ছিল কবি আর ওকাম্পোর কলকাকলীতে।

প্লাতা নদীর তীরের ওই বাড়িতেই হয়তো রচিত হয়েছিল ওকাম্পো আর রবিঠাকুরের মাঝে সেই ‘রহস্যময় প্রেমের’ উপাখ্যান। রবীন্দ্রনাথ মিরালরিওর বাসায় যেদিন পৌঁছিয়েছিলেন সেদিনই রচনা করছিলেন ‘পূরবী’র অন্তর্গত  ‘বিদেশী ফুল’ কবিতাটি

 হে বিদেশী ফুল, যবে আমি পুছিলাম

‘কী তোমার নাম’,

হাসিয়া দুলালে মাথা, বুঝিলাম তরে

নামেতে কী হবে।

আর কিছু নয়,

হাসিতে তোমার পরিচয়।

 হে বিদেশী ফুল, যবে তোমারে বুকের কাছে ধরে

শুধালেম ‘বলো বলো মোরে

 কোথা তুমি থাকো’,

হাসিয়া দুলালে মাথা, কহিলে ‘জানি না, জানি নাকো’।

বুঝিলাম তবে

শুনিয়া কী হবে

থাকো কোন্দেশে।

 যে তোমারে বোঝে ভালোবেসে

তাহার হৃদয়ে তব ঠাঁই,

আর কোথা নাই।

তিন দিন পরে অর্থাৎ ১৫ই নভেম্বর কবি লিখলেন ‘অতিথি’ কবিতাটি। ১৬ই নভেম্বর ‘অন্তর্হিতা’, ১৭ তারিখে ‘আশঙ্কা’, ২১ তারিখে ‘ শেষ বসন্ত’। কবিতাগুলিতে প্রেমের অভিব্যক্তির আতিশয্যে বিব্রত হয়ে কবি কবিতাগুলো দেশে পাঠানো উচিত হবে কিনা ভেবে দ্বিধান্বিত ছিলেন।

রবীন্দ্রনাথের বুয়ানস আয়ারসে বাস যাতে উপভোগ্য হয়ে উঠে সেজন্য সবকিছুই করেছিলেন ওকাম্পো। একটি সুসজ্জিত ঘর,  খোলামেলো অলিন্দ, কবিতা লেখার উপযোগী পরিবেশের থেকে শুরু করে সঙ্গ দেয়া, দর্শনার্থীদের সাথে কবির সাক্ষাতের ব্যবস্থা করা, সাহিত্যিকদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া, কবির পছন্দের জায়গায় নিয়ে যাওয়া সবই করেছিলেন ওকাম্পো। এ সব করতে ওকাম্পোর অনেক খরচ হয়েছিল। শোনা যায়, এই খরচ মেটানোর জন্য ওকাম্পো খুব দামী একটি হীরের টায়রা নামমাত্র মূল্যে বিক্রি করে দিয়েছিলেন।গয়না বিক্রির টাকা থেকে দশ হাজার পেসো আগাম ভাড়া দিয়ে এসেছিলেন রবিঠাকুরের জন্য বরাদ্দকৃত  মিরালরিওর বাড়িটির মালিককে। শুধু তাইই নয়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের  দেখাশুনার জন্য তাঁর ব্যক্তিগত পরিচারিকা ফানিকে নিয়োগ দিয়েছিলেন। ফানি রান্নাবান্নাসহ চব্বিশ ঘণ্টা তদারকি করত কবির। 

ওকাম্পোর সাথে বসে অলিন্দ থেকে নদী দেখতেন রবীন্দ্রনাথ। দেখতেন নদীর স্রোত, বয়ে চলা, জলের  খেলা।মাঝে মাঝে বাসার পাশের তিপা গাছের নীচে চলতো তাঁদের ফিসফাস কথকথা।  কখনো রবিঠাকুর বাংলা কবিতা আবৃত্তি করে শোনাতেন ওকাম্পোকে।  ওকাম্পো মন্ত্রমুগ্ধের মতোন শুনতেন। ওকাম্পো তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন, ‘রবীন্দ্রনাথ যখন বাংলায় কবিতা আবৃত্তি করতেন, সে আবৃত্তিই গান হয়ে উঠতো। শব্দগুলি উনি এমন বিশুদ্ধ স্পষ্টতার সাথে উচ্চারণ করতে পারতেন যে, আমি কিছু কিছু শব্দ স্মৃতিস্থ করে পুনরুচ্চারণ করতে পারতাম’। 

আর্জেন্টিনা আসার কয়েকদিনের মধ্যেই আমি চিনি গো চিনি তোমারে, ওগো বিদেশিনী/তুমি থাক সিন্ধুপারে ওগো বিদেশিনী গানটির ইংরেজি অনুবাদ ওকাম্পোর হাতে তুলে দিয়েছিলেন রবিঠাকুর।মূল গানটি গানটি কবি লিখেছিলেন শিলাইদহে ১৮৯৫ সালে। রবীন্দ্রনাথ ওকাম্পোকে বাংলা কবিতা আর গানের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন, অন্যদিকে ওকাম্পো রবিঠাকুরকে আন্তর্জাতিক সাহিত্য ও সঙ্গীতের সাথে পরিচয় করিয়ে দেবার চেষ্টা করতেন। বোদলেয়রের ‘পাপের পুষ্পগুচ্ছ’ কাব্যগ্রন্থ থেকে আবৃত্তি করে শোনাতেন ওকাম্পো। 

আর্জেন্টিনায় থাকাকালীন সময়ে রবীন্দ্রনাথের জন্য ওকাম্পো কিনেছিলেন একটি আরাম কেদারা। আর্জেন্টিনা থেকে চলে আসার সময় ভিক্টোরিয়া সেটিকে জোর করে জাহাজে তুলে দেন। এ নিয়ে জাহাজের ক্যাপ্টেনের সাথে তাঁর তুমুল ঝামেলা হয়। কারণ চেয়ারটি কবিগুরুর জন্য বরাদ্দকৃত কেবিনে ঢুকছিল না। কিন্তু ওকাম্পো ছিলেন নাছোড়বান্দা। মিস্ত্রী ডাকিয়ে জাহাজের কেবিনের দরজা খুলে চেয়ারটিকে ভিতরে ঢুকানোর ব্যবস্থা করেছিলেন তিনি । আরাম কেদারাটিকে শান্তিনিকেতনে নিজের শয্যাপাশে স্থান দিয়েছিলেন রবিঠাকুর। তিনি সেই চেয়ারটিতে বসে ওকাম্পোকে স্মরণ করতেন। ১৯২৫ সালের ৫ই জানুয়ারি রবিঠাকুর ওকাম্পোকে লিখেছিলেন, ‘আমার দিন আর রাতগুলোর একটা বড় অংশ কাটে তোমার চেয়ারে ডোবা অবস্থায়, যে চেয়ারটি আমাকে অবশেষে বুঝিয়ে দিয়েছে তোমার পড়ে শোনানো বোদলেয়রের সেই কবিতাটির লিরিক তাৎপর্য’। আরাম কেদারায় বসে কবি ভাবতেন, লিখতেন ভালবাসার কবিতা। মৃত্যুর ঠিক চারমাস আগে, ১৯৪১ সালের এপ্রিল মাসে কবিগুরু লিখলেন,

আরো একবার যদি পারি

খুঁজে দেব সে আসনখানি

যার কোলে রয়েছে বিছানো

বিদেশের আদরের বাণী।

আর্জেন্টিনা বাসের সময়টুকু ছিল রবীন্দ্রনাথের জন্য যেন এক স্বপ্নের ঘোর লাগা লগ্ন। আর্জেন্টিনা থেকে ফিরে বহু বছর পরেও রবিঠাকুর সান ইসিদ্রোর স্মৃতি রোমন্থন করতেন। শান্তিনিকেতন থেকে ওকাম্পোকে প্রায়ই চিঠি লিখতেন,

‘আমার মন চলে যায় সান ইসিদ্রোর বারান্দাটিতে। স্পষ্ট এখনো মনে পড়ে সকালবেলা আলোয় ভরা বিচিত্র লাল নীল ফুলের উৎসব। আর বিরাট সেই নদীর উপর নিরন্তর রঙের খেলা, আমার নির্জন অলিন্দ থেকে অক্লান্ত সেই চেয়ে দেখা’।

সন্দেহ নেই, ওকাম্পোর ওপর রবিঠাকুরের  প্রভাব ছিল। একইভাবে রবিঠাকুরের সৃষ্টির পেছনেও ওকাম্পোর প্রভাব ছিল অসমান্য। ‘পূরবী’ কাব্যগ্রন্থের অধিকাংশ কবিতা ওকাম্পোকে মনে করেই লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। রবিঠাকুর গ্রন্থটি উৎসর্গও করেছিলেন ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোকে। বইটির উৎসর্গপত্রে লেখা আছে ‘বিজয়ার করকমলে’। ১৯৩৯ সালে এক চিঠিতে কবি ওকাম্পোকে লিখেছিলেন,

‘ইতোমধ্যেই তুমি জানো যে ভাস্বর সেই দিনগুলি আর তার কোমল শুশ্রূষার স্মৃতিপুঞ্জ ধরা আছে আমার কবিতাগুচ্ছে, হয়তো আমার অন্যতম শ্রেষ্ঠ রচনা। পলাতক স্মৃতিগুলি আজ কথায় বন্দী। ভাষার অপরিচয়ে তুমি কোনদিন একে জানবে না, কিন্তু তোমাকে নিশ্চিত বলতে পারি যে, এ কবিতা বেঁচে থাকবে অনেকদিন’।

রবীন্দ্রনাথ আর্জেন্টিনা ত্যাগ করেন ১৯২৫ সালের ৩ জানুয়ারি। দেশে ফেরার মাস খানেকের মধ্যেই তিনি প্রকাশ করলেন ‘পূরবী’ কাব্যগ্রন্থ। বইটি প্রকাশের পর ওকাম্পোকে পাঠিয়েছিলেন কবিগুরু। ১৯২৫ সালের ২৯শে অক্টোবর ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোকে একটি চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন,

‘বাংলা কবিতার একটা বই তোমায় পাঠাচ্ছি, যেটা তোমার হাতে নিজে তুলে দিতে পারলেই খুশি হতুম। বইখানা তোমায় উৎসর্গ করা, যদিও এর ভিতরে কী রয়েছে তা তুমি জানতে পারবে না। এই বইয়ের অনেক কবিতাই লেখা হয়েছিল সান ইসিদ্রোয় থাকার সময়ে’।

১৯৪০ সালের জুন মাসে ওকাম্পো একটি চিঠিতে জানতে চেয়েছিলেন, ‘কবি, যে বইটি তুমি আমাকে উৎসর্গ করেছিলে তার নাম কি?’

রবীন্দ্রনাথ ১৯৪০ সালের ১০ জুলাইয়ের চিঠিতে উত্তরে জানিয়েছিলেন, ‘যে বইটি তোমাকে উৎসর্গ করেছিলাম তার নাম জানতে চেয়েছ। এর নাম পূরবী; মানে পূর্বদিক -স্ত্রী লিঙ্গে।’

ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো এক চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘বইটাতে কী আছে তা জানার জন্য আমি পাগল হয়ে আছি।’

রবীন্দ্রনাথ ওকাম্পোকে বই উৎসর্গ করলেন। ভিক্টোরিয়াই কি কম ভালোবাসেন কবিকে ! প্রেমের পরীক্ষায়  তিনিই বা পিছিয়ে থাকবেন কেন! রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে তিনি পুরো একটি বই লিখে ফেললেন । ১৯৬১ সালে প্রকাশিত হলো ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর বই ‘ ‘সান ইসিদ্রোর উপত্যকায় ঠাকুর’ বা ‘সান ইসিদ্রোর উপত্যকায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর’। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বায়োপিক ‘থিঙ্কিং অব হিম’ সিনেমায় উঠে এসেছে বিজয়ার সাথে তাঁর এই প্রেমের গল্প ।

এই বইটি ছাড়াও ওকাম্পো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়ে আরো  লেখা লিখেছেন। কবি প্রয়াত হবার পর ‘সুর’ পত্রিকায় ওকাম্পো লিখেছিলেন দীর্ঘ একটি ‘অবিচ্যুয়ারি’ নিবন্ধ। তাঁর চোখে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন, ‘মিতবাক, স্নেহপরায়ণ, উদাসীন, পরিহাসপ্রিয়, গম্ভীর, আধ্যাত্মিক, খামখেয়ালি, প্রশ্রয় দিতে ওস্তাদ, উৎফুল্ল, কঠিন, কোমল,  নৈর্ব্যক্তিক, সুদূর, বিবেকী এবং আবহাওয়ার মতোই পরিবর্তনশীল’ এক মানুষ। 

ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর সাথে রবীন্দ্রনাথের দেখা হয় মাত্র দু’বার। ১৯২৪ সালে আর্জেন্টিনায় দেখা হওয়ার পর আবার দেখা হয় প্যারিসে, ১৯৩০ সালে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মধ্যে লুকিয়ে ছিল মহান এক চিত্রকর । ওকাম্পোর উৎসাহেই প্রকাশ পেয়েছিল তাঁর এই প্রতিভা। ১৯৩০ সালে প্যারিসের বিখ্যাত পিগাল গ্যালারিতে রবীন্দ্রনাথের আঁকা ছবিগুলোর প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করে দেন ভিক্টোরিয়া। 

তাঁদের লেখা চিঠিগুলোতে দেখা যায়, একজন আরেকজনকে বিভিন্ন দেশে এবং বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ করেছেন। রবীন্দ্রনাথ ভিক্টোরিয়াকে বারবার শান্তিনিকেতনে আসার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন।  ভিক্টোরিয়ার আসা হয়নি। দেখা না হলেও যোগাযোগ বন্ধ ছিল না। নিয়মিত একজন আরেকজনকে চিঠি লিখতেন, টেলিগ্রামে বার্তা আদান-প্রদান হতো।

রবীন্দ্রনাথ তাঁর একেবারে শেষ চিঠিতে ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোকে লিখেছিলেন,

‘এতোদিন পরে তোমার আমাকে মনে পড়ল-কী যে ভালো লাগছে! পৃথিবীর সব রঙ ফিকে হয়ে আসছে যখন, বিমর্ষ মন কেবল তাদের  নৈকট্যই কামনা করে যাদের স্মৃতি সুখময় দিনগুলোর সাথে জড়িয়ে আছে। যতো দিন যায়, সেই স্মৃতিগুলো যেন গাঢ় হতে থাকে।”

রবীন্দ্রনাথ যখন অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন, সেসময়েও তার পরিবারের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ করেছেন ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো। খোঁজখবর নিয়েছেন রবীন্দ্রনাথের। ভিক্টোরিয়া রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুসংবাদ পান গাড়িতে, রেডিওর সংবাদে। স্মৃতিকথায় ভিক্টোরিয়া লিখেছিলেন,

‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মারা গেছেন, তাঁর ভারতবর্ষে। খবর পেলাম পথে, রেডিও থেকে, বুয়েন্স আয়ার্স আর মার দেল প্লাতার মাঝামাঝি জায়গায়। নির্জন রাজপথে ছুটে চলেছে গাড়িটা। চতুর্দিকে বিস্তীর্ণ সমতলভূমিকে ঢেকে আছে শীতের ধূসর আকাশ…।”

রবীন্দ্রনাথের পারিবারিক জীবনের কথা জানতে চেয়েছিলেন ওকাম্পো। কবি বলেছিলেন তাঁর স্ত্রী ও পুত্রকন্যাদের কথা। বলছিলেন কয়েকজনের অকালমৃত্যু প্রসঙ্গে। রবীন্দ্রনাথের ব্যাপারে ওকাম্পোর আগ্রহ আর কৌতূহল ছিল সীমাহীন।  

রবীন্দ্রনাথকে বাঙালি যতটা চেনে ততটা চেনে না  ওকাম্পোকে। চেনায় রয়ে গেছে অনেক খামতি। সেটাই স্বাভাবিক । পুরুষ রমণীর সম্পর্কের রসায়ন শুধু ওই পুরুষ নারীই বলতে পারে। রবীন্দ্রনাথ-ওকাম্পোকে নিয়ে বাঙালি  প্রেমকাহিনি শুনতে চেয়েছে। কবি সাহিত্যিকদের প্রেম ভালবাসার গল্প পাঠকমাত্রেই ভালেবাসে। ধরেই নেয় ওরা প্রেম ভালোবাসা আধার।রবীন্দ্রনাথ ওকাম্পোর ক্ষেত্রেও সেটাই ঘটেছে। কিন্তু আসলে কতটা কি ছিল সেটা যেমন জানা সম্ভব নয়, সেই মাত্রা পরিমাপও সম্ভব নয়। তবে যাইই বলা হোক না কেন, দূরত্ব আর বয়সের বাঁধা ছাপিয়ে এক বাধাহীন স্মৃতিময় সম্পর্ক ছিল তাঁদের। উভয়ের কাহিনি আর রচনা প্রমাণ করে দুজন দুজনকে প্রগাঢ়ভাবে ভালোবাসতেন, শ্রদ্ধা করতেন,সমীহ করতেন। আর তার ফলশ্রুতিতে আমরা পেলাম কিছু অমর সৃষ্টি। 

১৯৭৯ সালের ২৭ জানুয়ারি ভিলা ওকাম্পোতে মত্যুবরণ করেন ভিক্টোরিয়া। 

 

তথ্যসূত্র:

১.ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো এক রবি-বিদেশিনীর খোঁজে –   অভিজিৎ রায়

 ২. ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো কিংবা রবীন্দ্রনাথের বিজয়া – কালের কণ্ঠ

 ৩. বেলা শেষে প্রেম – প্রথম আলো

৪. রবীন্দ্রনাথের বিজয়া –  দৈনিক জনকণ্ঠ

৫. ডযবহ ঙপধসঢ়ড় সবঃ জধনরহফৎধহধঃয …  ঞযব উধরষু ঝঃধৎ

আফরোজা পারভীন
আফরোজা পারভীন
%d bloggers like this: