রবীন্দ্রনাথের রস-রসিকতা/ রক্তবীজ ডেস্ক

 

 

রবীন্দ্রনাথ এক  অনন্য সাহিত্য প্রতিভা ।  এমন প্রতিভা বিরল। শুধু সাহিত্য নয়, বিরল তাঁর ব্যক্তিত্বও। তাঁর ব্যক্তিত্বে একদিকে যেমন ছিল অটল গাম্ভীর্য,  তেমনই ছিল রসিকতা,  চপল হাস্যরস। এই রসিকতা আর হাস্যরসের প্রমাণ তাঁর  সাহিত্যেই কেবল নয়. ধরা পড়েছে তাঁর ব্যক্তি জীবনে।

কবিগুরু হাসতেন, মজা করতেন। মায়াবী হাসিতে ভরে  তুলতেন চারদিক। ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথের রসিকতার সাথে   পরিচিত ছিলেন তাঁর বন্ধুজন, সুহৃদরা। বিভিন্ন পরিপ্রেক্ষিতে সেসব তারা উল্লেখ করেছেন।  সেসব রসিকতার কিছু অংশ নিয়ে এই লেখার প্রয়াস।

তাঁর রচিত সাহিত্যের এক বিশাল জায়গা জুড়েই রয়েছে হাস্য- কৌতুক। তবে এ আলোচনা তাঁর সাহিত্যের হাস্য রস বিষয়ে নয়, ব্যক্তি জীবনের রসিক রবীন্দ্রনাথ।

১,নেপাল রায় ছিলেন শান্তিনিকেতনের একজন শিক্ষক। একদিন হঠাৎ গুরুদেবের কাছ থেকে একটি চিঠি পেলেন।  চিঠিতে লেখা ছিল, ‘কাল বিকেলে আমার এখানে এসো ও চা পান করে দণ্ড নিয়ো।’

চিঠি পেয়ে নেপালবাবু হতবাক!  ভেবে পেলেন না কী এমন অন্যায়  করেছেন যে গুরুদেব তাকে  দণ্ড দেবেন। দুঃশ্চিন্তায় রাত কাটলো তার। পরদিন যথাসময়ে উত্তরায়ণে গুরুদেবের সাথে দেখা করলেন। রবীন্দ্রথ তাঁর  সাথে নানান প্রসঙ্গে আলাপ-আলোচনা করলেন। চা জলখাবার খাওয়ালেন। ভোজনরসিক নেপালবাবুর কিছুই খেতে ভালো লাগলো না। খাবেন কী করে বুকের মধ্যে ভয় লুকিয়ে আছে। বেশ অনেকটা রাত  পর্যন্ত গল্পগুজবের হলো । নেপালবাবুর মনে গভীর উৎকণ্ঠা। কিন্তু  গুরুদেব  দণ্ডের কথা কিছুই বললেন না। এক সময়ে নেপালবাবু যাবার জন্য উঠে দাঁড়ালেন।  তখন গুরুদেব ভেতর থেকে একটা মোটা লাঠি এনে  নেপালবাবুর হাতে দিয়ে বললেন, ‘এই নাও তোমার দণ্ড, সেদিন যে এখানে ফেলে গিয়েছিলে তা একদম ভুলে গেছ।’

এমনই মজার মানুষ ছিলেন রবীন্দ্রনাথ।

 

দুই.

রবীন্দ্রনাথ উত্তরায়ণের বারান্দার এক কোণে টেবিল চেয়ারে বসে লিখতেন। সেদিনও লেখায় মগ্ন ছিলেন তিনি। একজন সাঁওতাল মেয়ে বাগানের ঘাস পরিষ্কার করে বিকেলে রবীন্দ্রনাথের পাশে এসে দাঁড়াল। রবীন্দ্রনাথ তার দিকে তাকাতেই বলল, ‘হ্যাঁ রে, তুর কী কুন কাজ নেই? সকালবেলা যখন কাজে এলাম দেখলাম এখানে বসে কী করছিস! দুপুরেও দেখলাম এখানে বসে আছিস আবার সনঝেবেলা আমাদের ঘরকে যাবার সময় হয়েছে এখনো তুই এখানে বসে আছিস, তুকে কী কেউ কুন কাজ দেয় না?’

রবীন্দ্রনাথ মাঝে মাঝে হেসে হেসে এ গল্পটা বলে বলতেন, ‘ দেখেছ সাঁওতাল মেয়ের কী বুদ্ধি! আমার স্বরূপটা ও ঠিক ধরে ফেলেছে।’

 

তিন.

রবীন্দ্রজীবনীকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় তখন শান্তিনিকেতনের  দায়িত্বে ছিলেন। তিনি পড়াশুনা করার জন্য  প্রতিদিনই গ্রন্থাগার থেকে বোঝা বোঝা বই নিয়ে  যেতেন। রাতে রাতে সেগুলি পড়তেন। একদিন বিকেলে বইয়ের বোঝা নিয়ে তিনি বাড়ি যাচ্ছিলেন। এমন সময় দূর থেকে কবিগুরুর ডাকলেন, ‘ওহে   বৈবাহিক, শোনো শোনো!’

প্রভাতবাবু ভীষণ  অবাক হয়ে গুরুদেবের কাছে গিয়ে বললেন, ‘আপনি আমাকে  বৈবাহিক বলছেন কেন?’

গুরুদেব হেসে বললেন ‘আরে সে  বৈবাহিক নয়, আমি তোমাকে ডাকছি বই-বাহিক বলে।’

 

চার

রবীন্দ্রনাথ সবে  কৈশোরে পা  রেখেছেন। একদিন এক বন্ধুকে বললেন, ‘জানো, ব্রাহ্মসমাজ লাইব্রেরির পুরনো বই ঘাঁটতে ঘাঁটতে ভানুসিংহ নামের এক  মৈথিলী কবির পোকায় কাটা পুঁথি পেলাম। এই দেখ, আমি তার কয়েকটা কবিতা নকল করে এনেছি।’

রবীন্দ্রনাথ বন্ধুকে কবিতাগুলো পড়ে শোনালেন। বন্ধু  কবিতা শুনে অবাক। ‘আরে চমৎকার কবিতা! এগুলো বিদ্যাপতি চন্ডীদাসের লেখার থেকেও ভালো। আমাকে এগুলো দাও, অক্ষয়বাবু খুশি হয়ে এগুলো পুরনো কবিতার নতুন সংকলনে ছাপিয়ে দেবেন।’

কিশোর রবীন্দ্রনাথ লজ্জিত হলেন। কুণ্ঠিতভাবে বললেন, ‘আসলে এগুলো আমারই লেখা। এ দেখো, তার খসড়াগুলো।’

কবিতাগুলো ‘ভানুসিংহ’-এর নামে ‘ভারতী’ পত্রিকায় ছাপা হয়ে প্রশংসা কুড়ালো। সবাই কবিতা পড়ে প্রাচীন কবি ভানুসিংহের প্রশংসা করতে লাগল। শুধুমাত্র পরিচিত কিছু মানুষ জানতেন কবিতাগুলো পনেরো বছর বয়সী কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা।

 

পাঁচ.

সাহিত্যিক বনফুল সস্ত্রীক রবীন্দ্রনাথের সাথে দেখা করতে এলেন । বনফুলের স্ত্রী  কবির জন্য ঘরের দুধ দিয়ে সন্দেশ  তৈরি করে নিয়ে গেলেন। কবির হাতে সন্দেশের কৌটো দিতেই  কবি একটা সন্দেশ মুখে পুরে বললেন, ‘এ সন্দেশ তুমি ভাগলপুরে পেলে কী করে?’

বনফুল তার গৃহিণীকে ইঙ্গিত করে বললেন, ‘ইনি করেছেন। আমাদের গাই আছে, তারই দুধ থেকে হয়েছে।’

রবীন্দ্রনাথ ক্ষিতিমোহন সেনের দিকে তাকিয়ে গম্ভীরভাবে বললেন, ‘এত বড়ো চিন্তর কারণ হলো!’

‘ কেন?’

‘বাংলাদেশে দুটি মাত্র রসস্রষ্টা আছে। প্রথম দ্বারিক, দ্বিতীয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, এযে তৃতীয় লোকের আর্বিভাব হলো।’

মিষ্টি হাসিতে ভরে উঠলো তাঁর মুখ।

(চলবে)