রবীন্দ্রনাথের রস-রসিকতা ৩/ রক্তবীজ ডেস্ক

এগারো.

রবীন্দ্রনাথ তখন থাকতেন দেহলীতে। একদিন শালবীথির পথ ধরে তিনি চলেছেন লাইব্রেরির দিকে। পরণে লম্বা গেরুয়া রঙের জোব্বা, মাথায় কালো টুপি। আশ্রমে সদ্য এসেছে এক মারাঠী ছাত্র, নাম ভান্ডারে। কবিকে দেখামাত্র ভান্ডারে ছুটল তাঁর দিকে। ছাত্ররা অবাক। সবাই  চেয়ে  চেয়ে দেখল ভান্ডারে গুরুদেবকে কি যেন বলছে। গুরুদেব অল্প অল্প  হেসে না না করছেন। মনে হলো তিনি কোনো বিষয়ে অল্প অল্প আপত্তি জানাচ্ছেন। কিন্তু ভান্ডাওর নাছোড়। শেষ  মেষ ভান্ডারে গুরুদেবের হাতে কী গুঁজে দিল। গুরুদেব মৃদু হেসে সেটা জোব্বার ভেতরে রেখে দিলেন। ভান্ডারে একগাল হেসে ফিরে এল। সে কবিকে প্রণাম বা নমস্কার কিছুই করল না।  পুরো ঘটনাটা ঘটল ছেলেদের চোখের সামনে। ভান্ডারে ফিরে এলে ছেলেরা সবাই ওকে ঘিরে ধরে  জানতে চাইলো, ‘গুরুদেবকে কী দিলি?’

ভান্ডারে মারাঠী হিন্দিতে বলল, ‘গুরুদেব কোন? ওহ তো দরবেশ  হৈ।’

 সমস্বরে ছেলেরা বলল, ‘না না, তিনি তো গুরুদেব।’ ভান্ডারে বলল, ‘ক্যা গুরুদেব, গুরুদেব করতা  হৈ? হাম উসকো আঠান্নি দিয়া।’

আঠান্নি মানে আধুলি। ছেলেরা বিস্ময়ে ফেটে পড়ল।

‘বলিস কীরে! আধুলি দিয়েছিস গুরুদেবকে?’

এপর ছেলেরা ভান্ডারির  পেট থেকে টেনে বের করল আসল কথা। ভান্ডারের ঠাকুমা দেশ ছাড়ার সময় তাকে বলেছিল, সে যেন সন্ন্যাসী, দরবেশকে দান দাক্ষিণ্য করে।  তাই সে ঠাকুমার কথামাতো দরবেশকে আধুলি দিয়েছে । দরবেশ প্রথমটায় কিছু আপত্তি জানিয়েছিল। তবে ভান্ডারে দমেনি। খুব চালাক সে,  লেগে ছিল, দরবেশের হাতে পয়সা গুঁজে দিয়ে তবে ফিরেছে।

ভান্ডারে অবশ্য আশ্রমে ক’দিন কাটানোর পরই রবীন্দ্রনাথের পরিচয় জেনে গেল। ততদিনে ভান্ডারের অত্যাচারে ছাত্র শিক্ষক সবাই অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। রবীন্দ্রনাথ একদিন ভান্ডারেকে ডাকলেন। বললেন, ‘হ্যাঁরে, শেষ পর্যন্ত তুইও এসব আরম্ভ করলি? তোর মতো ভালো ছেলে আজ পর্যন্ত দেখিনি, আর তুই এখন এমন সব কান্ড আরম্ভ করলি যে, সবার সামনে আমাকে মাথা নিচু করতে হচ্ছে। মনে নেই, তুই দানখয়রাৎ করতিস, আমাকে পর্যন্ত তুই একটা পুরো আধুলি দিয়েছিলি? আজ পর্যন্ত কত ছাত্র এল গেল, কেউ আমাকে একটি পয়সা পর্যন্ত দেয়নি। সেই আধুলি আমি কত যত্নে তুলে রেখেছি। দেখবি?’

এরপর ভান্ডারে শান্ত হয়ে গেল। পরবর্তীকালে  প্রতি সকালে সে  বৈতালিকে নেতৃত্ব দিত।

 

বারো

এক তরুণ কবি রবীন্দ্রনাথকে চিঠি লিখলেন;-

“কপালটা ভিজে যাবে দুই নয়নের জলে”

কবিতার এই চরণটি কেমন হয়েছে জানাবেন।

 রবীন্দ্রনাথ উত্তর দিলেন না।

তরুণ কবি চিঠি লিখতেই থাকলেন। একবার, দুইবার, তিনবার!  শেষে কবি অতিশয় বিরক্ত হয়ে কটুভাষায় চিঠি লিখলেন রবীন্দ্রনাথকে । এবার মহাবিরক্ত রবীন্দ্রনাথ উত্তর দিলেন;-

” পা দুটো বেঁধে রেখো তাল তমালের ডালে,

কপালটা ভিজে যাবে দুই নয়নের জলে।” 

 

 তেরো

এক ভক্তের গৃহে রবীন্দ্রনাথের নিমন্ত্রণ ছিল। খাওয়ার সময় বুঝলেন  পরিবেশিত ডিম পঁচা। কবির সাথে বন্ধু-বান্ধব ছিল।  তারা ভীষণ বিরক্ত। নিমন্ত্রণ করে এ কেমন ব্যবহার! কিন্তু সবাই ইতিউতি তাকিয়ে  দেখলেন রবীন্দ্রনাথের প্লেটে ডিম নেই। তিনি পঁচা ডিম খেয়ে ফেলেছেন! বাড়ি ফেরার পথে একজন জিজ্ঞাসা করলেন, গুরুদেব আস্ত একটা পঁচা ডিম আপনি কিভাবে খেয়ে ফেললেন?

রবীন্দ্রনাথ বললেন,

: আরে খাইনি তো। দাড়ির ভিতর দিয়ে চালান করে বাম হাতে নিয়ে পকেটে রেখে দিয়েছি। এই যে সাথে করে নিয়ে এসেছি।  

 

চৌদ্দ

গোপেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায় সে আমলে একজন  বিখ্যাত সঙ্গীতশিল্পী। খুব নামডাক তার। বিস্তর ভক্ত-শ্রোতা।  জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়িতেই একবার বসেছে তাঁর গানের জলসা  । সে জলসায় রবীন্দ্রনাথ নিজ উপস্থিত ভক্ত শ্রোতা হিসেবে। গোপেশ্বর বাবু গান শুরু করলেন। একসময় শ্রোতারা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে গান গাইবার অনুরোধ জানালেন। রীতিমতো চাপ দিতে থাকলেন তারা। অগত্যা রাজি হলেন কবি।হাসি মুখে বললেন,

: গোপেশ্বরের পর কি এবার দাড়িশ্বরের পালা?

 

 পনের

 

 রবীন্দ্রনাথ তখন শান্তিনিকেতনে অবস্থান করছিলেন। কি ব্যাপারে যেন একটা সভা বসেছে শান্তি নিকেতনে। সভার শুরুতে যে ঘরটিতে সভা বসেছে তার সম্বন্ধে কেউ কেউ আলাপ করছিলেন, ঘরটি বেশ, জাঁকজমকও সুন্দর। রবীন্দ্রনাথ হঠাৎ বলে উঠলেন-এ ঘরটিতে একটা বাঁ-দোর আছে। কবির কথা শুনে ঘরসুদ্ধ লোক একেবারে হতবাক।  এ ওর মুখের দিকে তাকাতে লাগলেন। রবীন্দ্রনাথ তাদের অবস্থা দেখে মুচকি হেসে ফেললেন। বললেন বাঁদর নয়, আমি বাঁ-দোরের কথা বলছি। দেখছ না ঘরটির ডান দিকে একটি দরজা এবং বাঁ-দিকেও একটি দরজা।