রোমেনা আফাজ: বাংলার আগাথা ক্রিস্টি/  আফরোজা পারভীন

আফরোজা পারভীন

আফরোজা পারভীন

রোমেনা আফাজ একজন জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক। অসংখ্য বইয়ের রচয়িতা তিনি। ‘দস্যু বনহুর’ নামে এক আদর্শবাদী, ন্যায়পরায়ণ, সৎসাহসী দস্যুকে নিয়ে সিরিজ রচনা করেছেন তিনি। এই বনহুর দস্যু হয়েও যেন দেবতা। এমন দস্যু সবাই চায়, যে ন্যায়ের পক্ষে, যে মানুষের মঙ্গল চায়। 

আমাদের সমসাময়িক মানুষেরা অর্থাৎ যাদের বয়স পঞ্চাশোর্ধ তার সবাই কম-বেশি রোমেনা আফাজের নাম জানেন। ৬০-৮০-এর দশকে রোমেনা আফাজের দস্যু বনহুর সিরিজ পড়েনি এমন পাঠক কমই আছে। কিশোর ও কৈশোরোত্তীর্ণদের মধ্যে এ রহস্য সিরিজের কারণে তিনি ছিলেন তুমুল জনপ্রিয় । আর একটু বড়রা তাঁকে পছন্দ করতেন তাঁর অমর কিছু উপন্যাসের জন্য। সব মিলিয়ে সব শ্রেণির পাঠকের কাছে তিনি ছিলেন ভীষণ আদৃত ।

 রোমেনা আফাজের জন্ম ২৭ ডিসেম্বর, ১৯২৬ – মৃত্যুবরণ করেন ১২ জুন, ২০০৩ । বগুড়া জেলার শেরপুর শহরের জন্মগ্রহণ করেন তিনি । তাঁর আদি বাড়ি ছিল বগুড়া জেলার জলেশ্বরীতলা। 

রোমেনার পিতা কাজেম উদ্দীন আহম্মদ, মাতা বেগম আছিয়া খাতুন। পিতা মাতার তিন কন্যা ও দুই পুত্রের মধ্যে তিনি ছিলেন জ্যেষ্ঠ। মাত্র তের বছর বয়সে ১৯৪০ সালে বগুড়া জেলার সদর থানার ফুলকোট গ্রামের এক মুসলিম পরিবারের ডা. মো. আফাজ উল্লাহ সরকারের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। তিনি ছিলেন বগুড়া ডেমাজানী হাইস্কুলের প্রতিষ্ঠাতা এবং বিশিষ্ট সমাজসেবি। রোমেনা আফাজ ২ মেয়ে ও সাত ছেলের জননী। তাঁর সন্তানরা অধিকাংশ দেশের বাইরে থাকেন। 

বিয়ের পর পড়াশুনা চালিয়ে যান রোমেনা আফাজ। তিনি ১৯৪১ সালে ম্যাট্রিকুলেশন ও ১৯৪৩ সালে বগুড়া আজিজুল হক কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেন। তিনি একাধারে লেখক, সমাজসেবী, আদর্শ গৃহিণী এবং মমতাময়ী মা।

তাঁর লেখা শুরু হয়েছিল কবিতা দিয়ে। মায়ের অনুপ্রেণায় লিখেছিলেন প্রথম কবিতা ‘বাংলার চাষী’। অধুনালুপ্ত সাপ্তাহিক ‘বগুড়ার কথা’ পত্রিকায় সেটি প্রকাশিত হয়। কবিতাটি প্রকাশিত হয় কলকাতা থেকে প্রকাশিত মোহাম্মদী পত্রিকাতেও। কবিতাটির প্রথম চার লাইন ছিল:

‘বাংলার চাষী

মুখে নাই হাসি

 পেটে নাই ভাত

খাটে দিনরাত।’

রোমেনা আফাজ
রোমেনা আফাজ

কবিতাটিতে এক  অল্প বয়সি  লেখকের দরদী মনের ছোঁয়া স্পষ্ট। তিনি দেখেছেন কৃষকের দুর্দশা। দেখেছেন তারা দিন রাত খাটে কিন্তু তাদের পেটে ভাত নেই। পেটে ভাত নেই বলে মুখেও হাসি নেই। যা দেখেছেন তাইই লিখেছেন। বাংলার কৃষক জীবনের সুখ-দুঃখ, বঞ্চনার কথা ফুটে উঠেছে তাঁর লেখায়। পরবর্তীকালে তিনি  আসানসোলের সাঁওতালদের দুঃখগাথা নিয়ে লিখেছেন। তিনি গণমানুষের  লেখক ছিলেন। তাদের কথাই বলেছেন বারবার। তিনি চেয়েছিলেন গণমানুষের মধ্য থেকেই  জন্ম নিক একজন নায়ক যে হবে  তাদের একজন। যে তাদের হয়ে প্রতিবাদ করবে, ন্যায় প্রতিষ্ঠায় হবে নির্মম, অধিকার আদায়ে হবে আপোসহীন। তিনি সফলও হয়েছিলেন। তাঁর হাত দিয়ে বেরিয়ে এসেছিলো ভিন্ন ভিন্ন কাহিনি নিয়ে একের পর এক দস্যু বনহুর। সে কালের তরুণ সমাজ মুখিয়ে থাকত দস্যু বনহুর সিরিজের পরবর্তী বইয়ের জন্য। 

লন্ডনের ‘আওয়ার হোম’ পত্রিকা ১৯৬৬ সালে রোমেনা আফাজের রহস্য উপন্যাসের সমালোচনা করে তাঁকে ‘পাকিস্তানের আগাথা ক্রিস্টি’ বলে উল্লেখ করেন। পত্রিকায় লেখা হয় ‘শি মে ওয়ানডে বি নোন অ্যাজ আগাথা ক্রিস্টি’। লেখকের ‘রক্তে আঁকা ম্যাপ’ বইটির সমালোচনা করে পত্রিকাটি এ মন্তব্য করেছিল। সেখানে আরো যা লেখা ছিল তার বাংলা তর্জমা হলো: ‘তাঁর রচনাশৈলি আকর্ষণীয় এবং কাহিনি চিত্তাকর্ষক। তিনি ইতিমধ্যে ভারত ও পাকিস্তান উভয় দেশের বাঙালি পাঠকের কাছে সুপরিচিত হয়ে উঠেছেন। বিলাতের বাঙালি পাঠকরাও তাঁর বই পছন্দ করেন।’

একটা সহজ প্রশ্ন অনেকের মনেই ঘুরপাক খেতে পারে। একজন সাধারণ মেয়ে বা সাধারণ গৃহবধু কি করে এ ধরণের রহস্য সিরিজ লিখলেন! এর পেছনে একটা গল্প আছে।  লেখকের পিতা সরকারি চাকরি করতেন। পুলিশ পরিদর্শক ছিলেন তিনি । কার্যোপলক্ষে তাকে অবিভক্ত ভারতের বিভিন্ন জায়গায় যেতে হতো। ফলে রোমেনা বাবার সঙ্গে বাংলাদেশ তো বটেই কলকাতা, বীরভূম, মেদিনীপুর, হুগলি, চন্দনপুর, লক্ষৌ, দিল্লি, আগ্রা এবং আজমীর শরীফ প্রভৃতি স্থান ঘুরেছেন। বাবার মুখে শুনেছেন অসংখ্য অপরাধ ও অপরাধীর রোমহর্ষক কাহিনি। তাদের খুঁটিনাটি বিষয়াদি জেনেছেন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা।  রোমেনার কিশোর মনে সেগুলো প্রভাব ফেলেছে । নিজেও অনেক দেখেছেন । জানাশুনার পরিধিও ছিল ব্যাপক।

তিনি লিখেছেন ছোটগল্প, কবিতা, কিশোর উপন্যাস, সামাজিক উপন্যাস, গোযেন্দা সিরিজ , রহস্য সিরিজ। তাঁর ২৫০ বইয়ের মধ্যে কয়েকটি উল্লেখযাগ্য বই হচ্ছে:  দেশের মেয়ে, জানি তুমি আসবে, সোনালী সন্ধ্যা, হারানো মানিক, কাগজের নৌকা, কুন্তিবাঈ, প্রিয়ার কণ্ঠস্বর, নিয়তির চক্র ইত্যাদি। 

কিশোর উপন্যাস: মান্দি গড়ের বাড়ি, দস্যু বনহুর, দস্যু রানী, রক্তে আঁকা ম্যাপ, বিদগ্ধা জননী ইত্যাদি।

তিনি ৩৭ টি সামাজিক সমাজসেবামূলক প্রতিষ্ঠােেনর সঙ্গে জড়িত ছিলেন। সাহিত্যে অবদানের জন্য  পেয়েছেন স্বাধীনতা পদক (২০১০)সহ মোট ২৭টি পুরস্কার।

রোমেনা আফাজের লেখনীশক্তি ছিল অসাধারণ। সহজ সরল ঝরঝরে ভাষায় লিখতেন তিনি। সব  শ্রেণির পাঠকের জন্য সহজবোধ্য ছিল তাঁর লেখা। তিনি বনহুর চরিত্র কোমলে কঠোরে এমনভাবে সৃষ্টি করেছিলেন যে সেকালের  কিশোরের চোখে বনহুর ছিল হিরো। তারা বনহুর হতে চাইত। অন্যায়ের বিরুদ্ধে  বনহুরের প্রতিবাদ  নিজের প্রতিবাদ হিসেবে দেখেছিল অনেক কিশোর- তরুণ। তারা স্বপ্ন দেখেছিল সত্য আর আদর্শবাদি হবার, দেশপ্রেমিক হবার, গরিবের পাশে দাঁড়াবার।  বনহুরের  চারিত্রিক দৃঢ়তা আকৃষ্ট করেছিল অগুনতি কিশোর-তরুণের মন। এই সিরিজের স্লোগান ছিল,  ‘সত্য ও ন্যায়ের প্রতীক দস্যু বনহুর।’ যে সর্বদা গরিবের বন্ধু, চোরাকারবারী কালোবাজারি মজুতদারের চিরশত্রু, সাক্ষাৎ যমদূত।

রহস্য লেখক হিসেবে সে সময় পশ্চিম বাংলায় ফালগুনী মুখোপাধ্যায় পাঠকপ্রিয়তার শীর্ষে ছিলেন। তবে উভয় বাংলায় রোমেনা আফাজই ছিলেন বেশি প্রিয় । এর প্রধান কারণ তাঁর বই পঠিত হতো ঘরে ঘরে। দুপুরে না ঘুমিয়ে গৃহবধুরা তাঁর বই পড়তেন। সহজ সরল বনহুর সিরিজ মন কেড়েছিল বালক বৃদ্ধ সবার। বনহুর সিরিজের ‘আশা’ চরিত্রটিও জনপ্রিয়তা পেয়েছিল।  লেখকের ‘রক্ত আঁকা ম্যাপ’ থ্রিলার সিরিজও ছিল খুব জনপ্রিয়। 

কিন্তু গভীর পরিতাপের র বিষয় এটাই যে, একসময়ের তুমুল জনপ্রিয়  লেখক রোমেনা আফাজ আজ বিস্মৃতপ্রায়। তাঁর স্মৃতিটুকু ধরে রাখার জন্য আজ পর্যন্ত কোনো সরকারি কোনো  নেয়া হয়নি। তাঁর  জন্মদিন-মৃত্যুদিনে বগুড়ার বাইরে একবারটির জন্যও তাঁকে স্মরণ করা হয় বলে জানা নেই। কোনো সাহিত্যপাতায় তাঁর স্মরণে কোনো লেখা দেখা যায় না এসব দিনে। তাঁর স্মরণে কোনো সভা আলোচনা হতেও কখনও  শুনিনি। তিনি আস্তে আস্তে হারিয়ে যাচ্ছেন বিস্মৃতির অতলে। পরবর্তী প্রজন্ম তাঁর নাম জানবে বা শুনবে কীনা সে বিষয়ে সংশয় আছে। 

বগুড়ার জলেশ্বরীতলায় তাঁর স্মরণে গড়ে উঠেছে একটি জাদুঘর। মন্তেজুর রহমান আঞ্জু পারিবারিক উদ্যোগে তিনি গড়ে তুলেছেন ‘ রোমেনা আফাজ স্মৃতিঘর’।   ঘরটি ছোট। সেই ঘরে সাজানো রয়েছে  রোমেনা আফাজের লেখা সব  বই, ফটোগ্রাফ, চিঠিপত্র, বিভিন্ন পুরস্কার । রয়েছে  রোমেনা আফাজের বিভিন্ন বয়সের দুর্লভ কিছু  ছবি। পরিবারিক ছবিগুলি পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে তাঁর মধুর সম্পর্কের নির্দেশক। আছে কাজের স্বীকৃতি পুরস্কারের ক্রেস্ট। সাজানো আছে দুটি আলমিরায়  ভক্তদের লেখা অসংখ্য চিঠি। আছে রোমেনা আফাজের সঙ্গে চিত্রপরিচালকদের ছবি।

রোমেনা আফাজের ৬ খানা উপন্যাস নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। সেগুলো হলে কাগজের নৌকা, মোমের আলো, মায়ার সংসার, মধুমিতা, মাটির মানুষ, দস্যু বনহুর। মনে পড়ে কাগজের নৌকা আর মোমের পুতুল সেসময় প্রচন্ড জনপ্রিয় হয়েছিল। মাসের পর মাস চলেছিল প্রেক্ষাগৃহে। অনেক নায়িকা জীবনে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন তাঁর চলচ্চিত্র দিয়ে। অনেকে অনেক পুরস্কার পেয়েছেন। আর একটি গভীর বেদনার কথা এটাই যে, বনহুরকে কেন্দ্র করে মাত্র একটি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। ‘দস্যু বনহুর’ শিরোনামের সেই চলচ্চিত্রে নাম ভূমিকায় সোহেল রানার বিপরীতে ছিলেন অঞ্জনা। চিত্রনায়িকা অঞ্জনার প্রথম চলচ্চিত্র ছিল এটি। বনহুর সিরিজে একশটির অধিক বই লিখেছেন রোমেনা আফাজ। তাঁর আর কোনো বইই কি চলচ্চিত্র নির্মাণ উপযোগী ছিল না? সুভাস দত্ত-এর মতো পরিচালক তাঁর কাগজের নৌকা উপন্যাস অবলম্বনে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন। তিনি কি কখনও কোনো খারাপ স্ক্রিপ্টের চরচ্চিত্রায়ন করেছেন? আমরা মাঝে মাঝেই নির্মাতাদের হাহুতাশ শুনি, চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য দেশে নাকি মৌলিক গল্পের অভাব । ঢাকার সিনেপ্লেক্সে দিনরাত চলে আয়রন ম্যান, স্পাইডার ম্যান, ব্যাটম্যান, সুপারম্যান।  অথচ আমাদের আছে বনহুর। আছে তাঁর কতো এডভেঞ্চার। আমরা তাকে  নায়ক বানাতে পারলাম না। ব্যর্থতা লেখকের। ত*ার এদেশে জন্ম নেয়া। এদেশে অধিকাংশ লেখককে কেউ মনে রাখে না। মনে রাখে তাদের পরিবার। তারাই গড়ে তোলে সংগ্রহশালা! আর তা যদি না হয়, আস্তে আস্তে এই মানুষগুলি হারিয়ে যায় কালের অতলে । অথচ এরা এদের জীবনের অমূল্য সময় ব্যয় করেছেন মানুষের জন্য, মানুষের কল্যাণে। 

রোমেনা আফাজ ‘প্রতিভার ক্ষয়’ নামে একটি কবিতা লিখেছিলেন। তিনি জীবিত অবস্থাতেই বুঝেছিলেন তাঁর ভবিতব্য। কারণ তিনি এ দেশ, এ সমাজ বুঝতেন। কবিতাটির কয়েকটি চরণ এমন:

‘জীবনকালে যে পেলো না মালা

চিনিলো না যারে করি অবহেলা

মৃত্যুর পরে কি হবে তার সুনাম!

কি হবে আর তাঁহারে স্মরি!

কি হবে আর স্মৃতিসৌধ গড়ি!

প্রদীপ যদি নিভে যায়

কি হবে তায়  তৈল ভরে হায়!

(প্রতিভার ক্ষয়)

 রোমেনা আফাজ জীবিতাবস্থাতে যথাযোগ্য মর্যাদা পাননি, মৃত্যুর পরও পেলেন না। আজ তাঁর মৃত্যুদিবস। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানাই।

 

 

সূত্র:

রাইজিংবিডি/ঢাকা/৩০ জুন ২০১৭