রোজকার টুকিটাকি – রাশেদুল ইসলাম
(এক)
বড় বিচিত্র প্রাণী এই মানুষ । ভূতে ভীষণ ভয় তার । কিন্তু ভূতের গল্প তার প্রিয় । নিজে প্রেমে ‘ছ্যাক’ খেতে চায়না । কিন্তু ‘ছ্যাক খাওয়া’ গল্প সে ভালবাসে । তাইত, লাইলী-মজনু, শিরি-ফরহাদ, দেবদাস-পারু- অমর হয়ে থাকে তার মনে । সফল প্রেমের গল্প মনে রাখে না সে । নিজে দুঃখ পেতে চায় না । কিন্তু দুঃখের স্মৃতিগুলো সযতনে আগলে রাখে সে । তাই, স্মরণীয় ঘটনার কথা এলে, নিজের দুঃখের স্মৃতি হাতড়ায় শুধু। অতি সুখের স্মৃতি মনে দাগ কাটে না তার। এবার কক্সবাজার এসে এমনই মনে হয়েছে আমার । সমুদ্র দেখার সময় নয় এটা । আবার অসময়ে না এলে সমুদ্রের ভয়ংকর সুন্দর এমন রূপ দেখাও সম্ভব নয় ।
সমুদ্র আমা্র প্রিয় । বহুবার সমুদ্রে এসেছি আমি । কিন্তু, সমুদ্রের এই রুদ্র রূপ দেখা হয়নি আগে । মেঘভরা আকাশ, নিঝুম রাত, আর সমুদ্রের হু হু গর্জন- এক ধরণের ভয়াল ছবি ফুটিয়ে তোলে মনে । একবার অমাবশ্যার রাতে নদীর ধার দিয়ে শ্মশান পার হয়েছিলাম আমি । না, সে রাতে তেমন কিছু ঘটেনি । কিন্তু, সেই স্মৃতি মনে হলে এখনও গা ছম ছম করে আমার । জীবনে কতবারই না শ্মশানের উপর দিয়ে গেলাম । সেগুলো কিছুই নয় । শুধু সেই একটা রাতের কথা মনে পড়ে আমার । গত রাতের সমদ্র দেখা অনেকটা সে রকম । সমুদ্রের ক্রুদ্ধ গর্জনে বুকে কাঁপন ধরে যেন । পৃথিবীর তিন ভাগ জল আর একভাগ স্থল । কাল রাতে মনে হয়েছে গোটা পৃথিবীর দখল চায় সে । তাইতো এমন উন্মত্ততা । বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘সিন্ধু’ কবিতায় সমুদ্রের এই রুদ্রমূর্তির একটা বর্ণনা আছে –
‘তিন ভাগ গ্রাসিয়াছোঁ, একভাগ বাকি,
সূরা নেই, পাত্র হাতে কাঁপিতেছে সাকি’ ।
একজন মাতাল যত মদ পান করে, ততই মদের চাহিদা বেড়ে যায় তার । যে নারী মদ পরিবেশন করে, তার পাত্রে এসময় যদি মদ না থাকে, তাহলে সে মাতালের ভয়ে কাঁপতে থাকে। মদ না পেয়ে মাতালটি এখন তাকেই খেয়ে ফেলবে বোধহয় । ঠিক একইভাবে সমুদ্র যখন ক্ষেপে যায়, যখন তার উত্তাল ঢেউ গ্রাম কে গ্রাম গ্রাস করতে থাকে, তখন এই পৃথিবী নামক গ্রহ সেই ‘সাকির’ মত ভয়ে কাঁপতে থাকে যেন ।
মজার ব্যাপার ! সকালের সমুদ্র সম্পূর্ণ আলাদা । কি মোহনীয় রূপ তার ! গত রাতের রুদ্রমূর্তির কোন ছাপ নেই সেখানে । প্রাণের স্পন্দনে ভরা এই সমুদ্র । এ বিশাল সমুদ্র কি শিক্ষা দেয় মানুষকে ? সমুদ্রের এই আচরণ কি মানুষের জীবনের মত নয় ? দুঃখের ঘোর অমানিশায় একজন মানুষ যখন হাবুডুবু খায়; ছটফট করে; তখন তার মনে হয় ‘এ আঁধার কখনও যাবে না মুছে তার পৃথিবী থেকে’ । কিন্তু একদিন ঠিকই সেই আঁধার কেটে যায় । সুন্দর ফকফকা একটা দিন আসে তার । শুধু চাই একটু ধৈর্য । সবর । সমুদ্রের বিশালতার কাছে এই শিক্ষাই তো আমরা পেতে পারি !
সমুদ্রের দিকে লম্বা সালাম ঠুকি আমি । আমার সামনে বিস্তীর্ণ সৈকত । আমি বাচ্চা ছেলের মত ছুটতে থাকি ।
( চলবে)
Facebook Comments Sync