স্বাধীনতা যুদ্ধের সত্যি ঘটনা/ অনুপা দেওয়ানজী

স্বাধীনতা যুদ্ধের সত্যি ঘটনা/ অনুপা দেওয়ানজী

 

দেশ তখন স্বাধীন হয়েছে বেশ কয়েক মাস হবে।আগরতলা শরণার্থী ক্যাম্প থেকে ফিরে এসে হরিপুর গ্যাস ফিল্ডে কিছুদিন থাকার পরে আমার কর্তা সিলেটের  টেংরা টিলায় পোস্টিং নিয়ে এসেছে।

এক দুপুরে আমার কর্তা দুপুরের লাঞ্চ সেরে অফিসে চলে যেতেই আমিও কাজের লোকটা নেই বলে হাতের কাজ টাজ গুছিয়ে একটু গড়িয়ে নেবো বলে খাবার ঘরের দরজাটা লক করতে এসে দেখি  কোথা থেকে যেন পরিষ্কার সাদা থান পরা  বয়সটা ঠিক আন্দাজ করে বলতে পারছি না। দেখে মনে হয় তিরিশও হতে পারে আবার চল্লিশের দিকেও হতে পারে এক মহিলা  আমার বাংলোর বারান্দায় চুপচাপ এসে বসলো।দীর্ঘক্ষণ হেঁটে আসার ক্লান্তি তার চেহারায়।

মহিলার মধ্যে এমন একটা সম্ভ্রমতা ছিলো যে তাকে  আমার ঠিক অভাবী বলে মনে হচ্ছিলো না। 

চেহারাটা ঠিক বাঙ্গালী মেয়েদের মতো নয়। ফর্সা রঙ অনেকটা পাহাড়ি মেয়েদের মতো চেহারা ।তবে চেহারায় খুব ক্লিষ্টতার ছাপ।

কোম্পানির সুরক্ষিত বেষ্টনী পেরিয়ে এই মহিলা আমার কোয়ার্টারের বারান্দায় কিভাবে এলো আমি তা ভাবার আগেই সে যখন একটা কাপড়ের থলে বের করে আমার কাছে কিছু চাল ভিক্ষে করে বসলো আমার তো তখন আরও  অবাক হবার পালা।

এই মহিলাকে  ভিখিরি বলতে আমার মন কিছুতেই সায় দিচ্ছিলো না।

তারপরেও আমি তার জন্যে আধসেরের মতো চাল যখন নিয়ে গেলাম দেখি সে আমার বারান্দায় বসে ক্লাব ঘরের দিকে উদাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।

আমাকে দেখেই চাল গুলি থলের মধ্যে ভরতে ভরতে সে বললো সংগ্রামের সময়ে ওইটা পাকিস্তানিদের ক্যাম্প আছিলো আফনে ইতা জানইন?

আমি বললাম জানি কিন্তু তুমি এটা কেন জিজ্ঞেস করছো?তোমাকে তো আমি টেংরাতে আগে কখনো দেখিনি?

সে উত্তর দিলো ক্যামনে দেখবা? আমি তো এর আগ ইহান ভিক্ষা করতে  আর আইছিনা।আমার বাড়ি ইখান থাকি বেশি দূর নাই।যুদ্ধর সময়  ছিড়া আর ময়লা কাপড় পিইন্ধ্যা ওই ক্যাম্প গিয়া আমি  ইনফর্মারর কাম করতাম।

মহিলার কথায়  আমার পিলে চমকে গেলো। 

কি বলছে এই মহিলা?

আমার অবাক চোখের দিকে তাকিয়ে থেকে সে হেসে বললো বয়স তো কম অইলো না গো মাইয়া।

সেই যে বছর ইস্কান্দর মির্জা সামরিক আইন জারি করলো হ্যার বাদে তো তাইনরে সরাইয়া আইয়ুব খান বইলা।সেই বছর আমার বিয়া হইল।

আমি বললাম তার মানে১৯৫৮তে?

মহিলা বললো হয় হয়।আডান্ন সালই

তার পর থিইক্যা তো ই দেশ  স্বাধীন না হওন তরি সামরিক শাসনই চইললো।

একজন ভিখিরি ( যদিও ভিক্ষা কি কারণে তিনি করছেন তা আমার জানা নেই)মহিলার মুখে এসব কথা রীতিমতো অবিশ্বাস্য বলে মনে হতে শুরু করেছে তখন আমার।

আমি ততক্ষণে তুমি ছেড়ে তাঁকে আপনি বলতে শুরু করেছি।যেহেতু তিনি সাদা থান পরিহিতা সে হেতু বুঝলাম তাঁর স্বামী মৃত।তাইজিজ্ঞেস করলাম আপনার স্বামী কি করতেন?

ভদ্রমহিলা বললেন সে ইষ্ট পাকিস্তান রাইফেলসের একজন  সৈনিক ছিলো।পাকিস্তানর পাঞ্জাব তার বাড়ি।

আমার বিষ্ময় তখন চরমে উঠেছে।

অনেক প্রশ্ন একসাথে  ভিড় ঠেলে উঠতে শুরু করলো ।

 মহিলা  একজন পাঞ্জাব সেনার স্ত্রী? 

সত্যিকার অর্থে তাহলে সে কাদের ইনফর্মার ছিলো ? 

 যদি সে একজন পাঞ্জাব সেনার স্ত্রী হয়ে থাকে তাহলে  বাংলাদেশে কেন রয়ে গেছে?

 যুদ্ধে কি তার স্বামী মারা গেছে? নইলে সে সাদা শাড়ি পরে আছে কেন?

একজন পাঞ্জাব সেনাকে সে বিয়েই বা করলো কেন?

আমার সব যেন গুলিয়ে যেতে শুরু করলো।

 

আমি তাঁকে বললাম কিছু মনে করবেন না আপনি সাদা শাড়ি পড়েছেন বলেই জানতে চাইছি আপনার স্বামী কি যুদ্ধে মারা গেছেন?

মহিলা অদ্ভুত এক হাসি হেসে উত্তর দিলেন না গো যুদ্ধ তহন শুরুই  অয় নাই। একাত্তরের শুরুত  তো হ্যায় পাকিস্তান রক্ষার লাইগ্যা আমারে  ফালাইয়া ভাগি গেলো। 

ভালোবাসার বিয়া।তারে খুঁজতে গিয়াই তো আমি  সেই সমে কত যে নিষ্ঠুর সব জল্লাদখানা দেখলাম।যা দেখলি বুকর রক্ত হিম হইয়া যায়।

দুপুর তখন নিস্তেজ হতে শুরু করেছে। ঘুম আমার ছুটে গেছে তখন। তাঁকে বললাম আপনার কথাগুলি শুনতে আমার খুব ইচ্ছে করছে কিন্তু আপনার মুখ দেখে মনে হচ্ছে খুব খিদে পেয়েছে।  চারটে ভাত খাবেন?

মহিলা বললো হাঁচা কথাই কইছো গো মা। 

 

কাজের লোকটা সেদিন ছিলো না। ছুটিতে গেছে।আমি  তার জন্যে কিছু  ভাত আর তরকারি একটা প্লেটে করে নিয়ে  এলাম।

ভাত খাওয়ার পরে মহিলাকে বেশ ফ্রেশ মনে হল। আমি  জিজ্ঞেস করলাম আপনি কি বাঙ্গালী? 

মহিলা বললো না গো মা আমি খাসিয়া। 

আমি জিজ্ঞেস করলাম স্বামীকে যখন খুঁজে পেলেন না তখন আপনি কি করলেন?

তিনি উত্তর দিলেন ইচ্ছা কইরা যদি কেউ হারাইয়া যায় তারে কি আর খুঁইজ্যা পাওন যায় গো মাইয়া?

আমিও উপায় না দেইখা আবার বিয়া করলাম আর ঠিক তহন শুরু অইলো মুক্তিযুদ্ধ। 

 

আমার হউরবাড়ির গ্রাম ইখান থাকি বেশি দূর নাই।হউর বাড়ির কান্ধাতই  মুক্তির ক্যাম্প আছিলো। আমি মুক্তিদের সাহায্য করার লাইগ্যা  সোয়ামীরে না কইয়া  ফকিরনীর  মত সাইজ্যা  ভিক্ষা করার নামে পয়লা দিন যহন টেংরা ক্যাম্প আইলাম তহন পাকিস্তানি মেজর আমারে দেইখ্যা কইল এরে দেইখ্যা তো বাঙ্গালী মনে অইতাছে না মনে অয় অন্য জাত এই বইলা তারা আমারে  কিছু আটা আর কিছু ময়দা দিলো।

 

 কিন্তুক বাদর দিন যহন আবার গেলাম তহন তারা আমারে শুধু যে সন্দেহ করল তা নয় বাইন্ধা  রাইখ্যা  নির্যাতন কইরা হ্যার বাদে একসমে ছাইড়া দিলো।

অনেক কষ্টে আমি যহন বাড়িত ফিইর‍্যা আইলাম তহন আমার দ্বিতীয় সোয়ামীও আমি পাকিস্তানিদের ক্যাম্পে গেছি বইলা আমারে তালাক  দিয়া দিল।

দিলে দেউক।

আমারও তহন জিদ চাপছে।

এই সংসার করনর  থাকি দেশর কামে ঝাঁপাইয়া পড়নই ভালা।

কিন্তু রাজাকারর দল তহন টেংরাক্যাম্পত গিয়া জানাইয়া দিছে তারা ঠিক সন্দেহই করছে।আমি মুক্তিরে সাহায্য করি।

 দ্যাখতে দ্যাখতে জুন মাস আইয়া পড়ছে তহন। দোয়ারাবাজার  সীমান্তত পাকিস্তানি সৈন্য আর মুক্তি সৈন্যর মাঝে লাগলো   হাড্ডাহাড্ডি যুদ্ধ । হি যুদ্ধত আমরার মুক্তিরা গেল হারিয়া। তহন অনেক মুক্তির লগে আমারেও  পাকিস্তানি সৈন্যরা ক্যাম্প বাইন্ধা নিয়া যায়।আর ক্যাম্প নিয়া তহন পাকিস্তানি সৈন্য, রাজাকার আর আলবদর সবতে মিলিয়া আমার উপর নির্যাতন আর অত্যাচার করছে। ভাগিয়া  যাই বইল্যা আমারে তারা বাইন্ধা রাইখত।ভাগনর কুন উপায়ও আছিল না।

এক সময়ে  হিখান থাকি ছাড়া পাইয়া  আবার মুক্তিদের কাম লাগলাম। 

ছাড়া পাইয়া  আবার মুক্তিদের কাম লাগলাম। 

পাকিস্তানি সৈন্যদের খবর পৌঁছাইয়া দেওনের লাইগ্যা হয় পাগলি সাইজ্যা নয় ভবঘুইরা যেবলা যা মনে লয় তেমুন সাইজ্যা খবর পৌঁছানর কাম করতে লাগলাম।

কিন্তুক ই ফিরা যহন আবার ধরা পড়লাম তহন  পাকিস্তানিরা বড় অত্যাচার করছে গো মাইয়া। কুল্লে সাত দিন আমারে ল্যাংটা কইরা পশুর মতন তারা আমার শরীলডার উপর নির্যাতন চালাইছে।লোয়ার রড গরম কইরা আমার শরীলর শরমের জাগাত যহন পুইড়া দেওন শুরু করল তহন আমি আর তা সহ্য করতে না পারিয়া অজ্ঞান হইয়া পড়লাম।

আমি রুদ্ধশ্বাসে শুধু বলতে পারলাম তারপর? 

তিনি আঁচলে তাঁর খরখরে চোখ দুটি মুছে নিয়ে বলতে শুরু করলেন 

আমি যহন অজ্ঞান হইয়া গেলাম তারা তহন আমারে মরি গেছি ভাইব্যা ক্যাম্পর বাইরে নিয়া ফালাইয়া দিলো।সাত দিন বাদে যহন আমি হুঁশ ফিরিয়া পাইলাম তহন  মুক্তিরা আমারে ভারতর বালাট সেক্টরে পাঠাইয়া আমার চিকিৎসার ব্যবস্থা করলো।

আমি রুদ্ধশ্বাসে নির্যাতিতা মুক্তিসেনার কাহিনী শুনছি।গায়ের লোম আমার তখন খাড়া হয়ে গেছে।

তিনি তখন বলে চলেছেন সুস্থ হইয়া যহন ফির‍্যা আইলাম তহন আমার জিদ গেলো আরো বাড়িয়া। 

আমি অস্ত্র চালাইবার প্রশিক্ষণ নিলাম। প্রশিক্ষণ নিয়া পাকিস্তানি সৈন্যর বিরুদ্ধে ধরলাম সেই অস্ত্র।

স্বাধীনতা যুদ্ধের সত্যি ঘটনা2/ অনুপা দেওয়ানজী

নভেম্বর মাস আইয়া পড়ছে তহন।এই টেংরাটিলাত পাকিস্তানিগো লগে  সামনাসামনি যুদ্ধ করনর সমে আতকা আমার শইলে গুলি লাগলো।হের বাদে সুস্থ হইয়া মুক্তিগো লগেই ঝাঁপাইয়া পড়লাম সরাসরি যুদ্ধত।

একটার পর একটা সামনাসামনি যুদ্ধ করছি আমবাড়ি,বাংলাবাজার,টেকনাই,বলিউড়া,মহব্বতপুর,বেতুরা,দূরবীনটিলা,আধারটিলা। 

বলতে বলতে তিনি উদ্দীপ্ত হয়ে কোথায় যেন হারিয়ে যেতে লাগলেন। 

আমি তাঁর সেই দৃপ্ত চেহারার দিকে তাকিয়ে ভাবছিলাম দেশের জন্যে যিনি এত কষ্ট  করেছেন এমন একজন সংগ্রামী মহিলা এই নিভৃত পল্লীতে কেন ভিক্ষা করে বেড়াচ্ছেন?

তাঁর ভাইবোন বা বাবা মা নেই?

এ কথা জিজ্ঞেস করতেই তিনি বললেন ভাইরার কাছে গেছিলাম গো মা।তারা আমারে বাড়িত থাকনর জায়গা দেয় নাই।

 জিজ্ঞেস করলাম তাহলে এখন কোথায় থাকেন?

তিনি বললেন গ্রামের একজন আমারে থাকনর লাইগা হাঁস মুরগি থাকনর ঘর ইট্টু জায়গা দিছে ।সেও খুব গরীব মানুষ। হিখানই থাকি।

 

বেলা তখন পড়ে এসেছে।নির্বাক আমি কি বলবো তাঁকে বুঝতে পারছিলাম না।শুধু তাঁর হাতে  কিছু টাকা তুলে  দিয়ে বললাম আপনার নামটা কি জানতে খুব ইচ্ছে করছে।

তিনি বললেন আমার নাম কাঁকাত।

ইহান আমারে সবাই খাসিয়া মুক্তিবেটি নামে চিনে।ইতার লাইগ্যাই গার্ড আমারে আটকায় নাই।

 

বহুদিন পরে জেনেছি রনেন্দ্র তালুকদার নামে একজন সাংবাদিক তাঁকে ভিক্ষারত অবস্থাতেই আবিষ্কার করেছিলেন। 

মহিয়সী এই মহিলাকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বীরপ্রতীক সম্মানে সম্মানিতও করেছেন।

 জানিনা সেই সংবাদ মৃত্যুর আগে  তিনি জেনে গিয়েছেন কিনা?

সমাপ্ত।

অনুপা দেওয়ানজী 
অনুপা দেওয়ানজী