স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায়! / সুলতানা রিজিয়া

স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায়!

স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায়!

স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায়! / সুলতানা রিজিয়া

এক সাগর রক্তের বিনিময়ে

বাংলার স্বাধীনতা আনলো যারা

আমরা তোমাদের ভুলবো না’

না, আমরা তাদের ভুলিনি। বাংলার জনগণ ভুলেননি। বাঙালি জাতি ভুলেননি। বাংলার জল, বাংলার স্থল, বাংলার সবুজিয়া বনানীও ভুলেনি। ২৬ মার্চ আমাদের মহান স্বাধীনতা অর্জনের রক্তরাঙা দিন। অকুতোভয় বীর মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মদানে স্মরণীয় দিন। এই দিন ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্তে রঞ্জিত লাল সবুজ পতাকা অর্জনের দিন,স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ নামক এক মুক্ত স্বাধীন ভূখণ্ড লাভের দিন। বাংলাদেশের এই স্বাধীনতা দিবসে বাঙালি জাতি তাদের সকল দুঃখ বেদনা,স্বজন হারানোর হাহাকার, মা বোনদের সম্ভ্রম হারানোর যাতনা ভুলেছিলো। বাংলাদেশের মানুষের কাছে এইদিন একাধারে  আনন্দ এবং বেদনার দিন।

১৯৭১সালে ২৫ মার্চে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী পরিকল্পিত গণহত্যা শুরু করেছিলো, যার মাধ্যমে তারা ১৯৭১ এর মার্চ  ও এর পূর্ববর্তী সময় সংঘটিত বাঙালি  জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে দমন করতে চেয়েছিল। তাদের এমন হীনতম কুটিল চক্রান্তের ফলশ্রুতিতে একাত্তরের ২৫শে মার্চ বাঙালি জাতির ললাটে কালো অধ্যায় অঙ্কিত করতে তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানের হানাদার সৈন্যবাহিনী বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা শহরের নিরীহ ঘুমন্ত মানুষকে নির্বিচারের হত্যা করেছিলো। এই গণহত্যার রক্তের দাম রাখতেই সূচনা হয়েছিলো বিশ্বের অভূতপূর্ব যুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের মরনপণ লড়াই। শান্তিপ্রিয় স্বাধীনতাকামী আপামর বাঙালি জাতি দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে শত্রুবাহিনীর বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো। বাঙালি জাতি তাদের কোমলে কঠোরে গড়া সত্তার প্রমাণ দিতেই হাতের বাঁশি রেখে তুলে নিয়েছিলো অস্ত্র। সাত মার্চের রেসকোর্স ময়দানে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উদাত্তকণ্ঠের আহ্বানই ছিলো তাদের কাছে বিজয়ের মন্ত্র, স্বাধীনতার তৃষ্ণা, পরাধীনতার শৃঙ্খলমুক্তির প্রতিজ্ঞা। তাঁরই নির্দেশে বাঙালিজাতি দৃপ্ততায় ক্ষিপ্র হয়ে উঠেছিলো। মরণপণে বাজি রেখেছিলো সাত কোটি বাঙালি ( ব্যতিক্রম ধর্তব্য নয়) আপন জীবন, হৃদয়ে রোপন করেছিলেন স্বাধীনতার চেতনা, লড়াকু যোদ্ধার পথ বেছে নিতে ফেরারি হয়েছিলো উচ্চতর প্রশিক্ষণার্থে, জোট বেঁধেছিলো অটল অবিচল মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনে। বাঙলার দামাল কিশোর – যুবকরা জীবনের স্বাভাবিক চাওয়া পাওয়ার হিসাব ভুলেছিলো, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আনন্দ উল্লাসের পর্ব স্থগিত রেখেছিলো, কেউবা তার প্রাণপ্রিয় প্রেমিকার আকর্ষণ ছিঁড়ে যুক্ত হয়েছিলো এক সাগর রক্ত দেয়ার ব্রতে। মাতৃভূমি শৃঙ্খলমুক্ত করতে।

একাত্তরের ২৫ শে মার্চে বাঙালিজাতির ভাগ্যে যে করুণ অধ্যায়ের সূচনা হয়েছিলো তা বিশ্বের বুকে এক কালো কুৎসিত অধ্যায় হিসাবে চিহ্নিত হয়ে আছে।  তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানের জনসাধারণকে দাবিয়ে রাখাতে, মেধাশূন্য করাতে, ভারবাহী প্রাণি করার অভিলাসে পাকিস্তানি হানাদার সৈন্যবাহিনী বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা শহরের বুকে রাতের অন্ধকারে নিরীহ ঘুমন্ত মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করেছিলো। রাজনীতির কালো থাবা বিস্তারে নির্মম চক্রান্তের জাল বুনেছিলো। গণহারে এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদেই বিশ্বের বুকে সূচনা হয়েছিলো অভূতপূর্ব মুক্তিযুদ্ধ, মরণপণ লড়াই। শান্তিপ্রিয় স্বাধীনতাকামী আপামর বাঙালিজাতি দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে সমরাস্ত্রে সজ্জিত সুদক্ষ ও চৌকশ পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছিলো। হাতে তুলে নিয়েছিলো দেশজ সহজলভ্য সাধারণ অস্ত্র। প্রাথমিক পর্যায়ে এইসব অস্ত্র নিয়ে সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়লেও পরবর্তিকালে আধুনিক সমরাস্ত্রের প্রশিক্ষণ শেষে দীর্ঘ নয়মাস বীরবিক্রমে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে সন্মুখ সমরে থেকেছে। মুক্তিযোদ্ধাদের জীবনপণ সেই সাহসী পদক্ষেপে ত্রিশলক্ষ শহীদের রক্ত ধারায় পাকিস্তানি যোদ্ধারা নিদারুণ পরাজয়ে ভেসে গিয়েছিলো। ১৬ ডিসেম্বরে ঢাকার সোহরাওয়ার্দী ময়দানে পরাজিত পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর ৯১,৬৩৪ জন সদস্য  মুক্তিযোদ্ধাদের সমন্বয়ে গঠিত যৌথবাহিনীর কাছে আনুষ্ঠনিকভাবে আত্মসমর্পন করতে বাধ্য হয়েছিলো। ঢাকার রেসকোর্স মাঠে পাকিস্তানের পক্ষে সেই আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর করেছিলেন জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজি। তিনি যৌথবাহিনীর প্রধান জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কাছে আত্মসমর্পণ করেন। পাকিস্তান সরকারের ২৩ বছরের জোর, জুলুম, নির্যাতন, অত্যাচার ও দখলদারিত্বের অবসান হয়। পূর্ববাংলার মানুষ বিজয়ের আনন্দে স্বতঃস্ফুর্ত জীবনের পথে ঘুরে দাঁড়িয়েছিলো, ছিনিয়ে এনেছিলো জন্মভূমির স্বাধীনতার গৌরব। মুক্তিযোদ্ধার সেই নয়মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ, জীবন দানের করুণ শোকগাথা বিশ্বের ইতিহাসকে করেছিলো চমৎকৃত, মহিমান্বিত। বিশ্বের মানচিত্রে বাংলাদেশকে, বাঙালি জাতিকে শ্রেষ্ঠত্বের আসনে অধিষ্ঠিত করেছিলো।

ঐতিহাসিক ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের তেজদীপ্ত স্বাধীনতার আহ্বানে ভীত সন্ত্রস্ত পাকিস্তানীর হানাদার বাহিনীর হত্যাযজ্ঞ শুরু করেছিলো ২৫ শে মার্চের কালোরাতে। নিরীহ জনগণের রক্তের স্রোতে ফুটে উঠেছিলো স্বাধীনতার রক্তরবি। তারই আলোয় উদ্ভাসিত হয়েছিলো বাঙালির স্বাধীনতার পবিত্র তৃষ্ণা। সেই তৃষ্ণাই এই দেশকে দিতে পেরেছে স্বাধীন সার্বভৌম একটি দেশ, বাংলাদেশ। যে দেশের মাটিতে আমরা প্রাণখুলে গাইতে পারি- ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি।’

সেই স্বাধীনতার সোনালি সূর্যের উজ্জ্বলতায় নতুন করে, দীপ্তিময়তায় আমাদের স্মরণের আলো-ছায়ায় আন্দোলিত হয় লাল সবুজ বিজয়ের আনন্দ। সেই আনন্দে আমরা যেমন উচ্ছ্বল হই, তেমনি ভাবেই প্রিয়জনের বিয়োগ ব্যথায় মুহ্যমান থাকি। শ্রদ্ধায়, কৃতজ্ঞতায় এবং মুগ্ধতায় শহীদদের স্মরণ করি। তাদের আত্মার শান্তি কামনা করি। এই দেশ, বাংলাদেশকে বিশ্বসেরা ভেবে আমরা পুলকিত হই। মনে মনে আওড়াই-

এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি

সকল দেশের সেরা সে যে আমার জন্মভূমি!’

বিশ্বনন্দিত বাংলাদেশেকে গণতান্ত্রিক শক্তির সংঘবদ্ধ প্রয়াসে ও রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে আন্তরিক এবং নির্ভুল পরিকল্পনায় অগ্রগামী হতে হবে। এজন্য দুর্নীতিমুক্ত কল্যাণমূলক শাসনব্যবস্থা যেমন প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন তেমনি প্রয়োজন স্বাধীনতার প্রকৃত গৌরবগাথা এবং আত্মত্যাগের সত্যিকার ইতিহাস ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা।

স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের গৌরবময় স্বাধীনতাকে জাতীয় জীবনে স্থিতিশীল করতে শথপ নিয়ে দেশ ও জাতির জন্যে আমাদের কাজ করে হবে। স্বাধীনতা দিবসের চেতনাকে আমাদের জাতীয় জীবনের সর্বত্র ছড়িয়ে দিতে হবে। দেশে একটি শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে পারলেই স্বাধীনতা দিবসের সত্যিকারের তাৎপর্য আমরা অনুধাবন করতে সক্ষম হব।

আমাদের জাতীয় জীবনের বিভিন্ন সমস্যা, সংকট, অভাব, অনটন, অশিক্ষা, দারিদ্র্ দূর করে দেশকে একটি আত্মনির্ভরশীল দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে পারলেই স্বাধীনতাপ্রাপ্তি সফল হবে, অর্থবহ হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে যে, আমাদের ভৌগোলিক স্বাধীনতা এলেও অর্থনৈতিক মুক্তি এখনো আসে নি। নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যসহ স্বাভাবিক জীবন যাপনে অর্থনৈতিক সামর্থ্য  সর্বসাধারণের নাগালের বাইবে। জীবন যাপনে শ্রেণি বৈষম্যের বিলোপ ও অর্থনৈতিক মুক্তি আসলেই স্বাধীনতা দিবসের প্রকৃত চেতনা বাস্তবায়ন সম্ভব হবে। আমাদের সকলকে তাই অর্থনৈতিক মুক্তির জন্যে, জাতির কল্যাণের জন্যে সমাজে তথা রাষ্ট্রের সর্বস্তরের দুর্নীতি, দুঃশাসনের মূলোৎপাটন করতে হবে। 

স্বাধীনতা একজন মানুষের জন্মগত অধিকার। অনেক রক্ত, ত্যাগ ও তিতিক্ষার বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে আমাদের স্বাধীন বাংলাদেশ। এর জন্যে ৩০ লাখ মানুষকে শহীদ হতে হয়েছে, ২ লাখ মা—বোনকে তাদের ইজ্জত দিতে হয়েছে। আমরা এখন স্বাধীন দেশের নাগরিক। এ স্বাধীনতাকে আমাদের যে কোনো মূল্যে অক্ষুণ্ণ রাখতে হবে। স্বাধীনতার চেতনায় দেশকে এগিয়ে নিতে হবে অর্থনৈতিক মুক্তির পথে। সুখী, সমৃদ্ধিশালী বাংলাদেশ গড়তে পারলে স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদদের স্বপ্ন পূরণ হবে। মনে রাখতে হবে-

রক্তের দামে অর্জিত আমাদের দেশ- বাংলাদেশ,

প্রাণের টুকরো বিসর্জনের দামের দেশ-বাংলাদেশ,

নারীর মান সম্মান লুন্ঠনে যাতনার দেশ-বাংলাদেশ,

সাত সমুদ্র অশ্রুজলে স্নাত এই দেশ- বাংলাদেশ,

বিশ্বশ্রেষ্ঠ মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ে এই দেশ- বাংলাদেশ।

সুলতানা রিজিয়া
সুলতানা রিজিয়া
%d bloggers like this: