সাম্যের দুর্গোৎসব – রনি রেজা

সাম্যের দুর্গোৎসব - রনি রেজা

বাঙালি জন্মগতভাবেই উৎসবপ্রেমী। যে কোনো উৎসব ধর্ম-বর্ণ-জাতি-প্রথা ভেদাভেদ ভুলে পালন করতে জাতি হিসেবে বাঙালি এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। কোনো উৎসব সামনে পেলে তাতে মেতে ওঠা বাঙালির এক অনন্য বৈশিষ্ট্য।

সনাতন ধর্মালম্বীদের একটি চিরায়ত সাংস্কৃতিক উৎসব দুর্গাপূজা। তবে বাঙালির সৌম্য আর ভ্রাতৃত্বের শক্তিতে এ উৎসব আজ সর্বজনীন উৎসবে রূপ নিয়েছে। বাংলার ষড়ঋতুর তৃতীয় ঋতু শরতের আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষে শারদীয় দুর্গাপূজা এবং ঋতুরাজ বসন্তের চৈত্র মাসের শুক্লপক্ষে বাসন্তী দুর্গাপূজা উদযাপনের প্রথা রয়েছে। বছরে দুবার দুর্গোৎসবের প্রথা থাকলেও বাংলাদেশে শরৎকালীন (শারদীয়) দুর্গোৎসবই বেশি উদযাপিত হয়ে থাকে। তাই তো প্রতিবছর শরৎ চরদিকে শুভ্রতা ছড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে বাংলার ঘরে ঘরে লেগে যায় শারদীয় দুর্গোৎসবের রঙ। বাংলার প্রতিটি ঘরে, পাড়া, মহল্লায় পরিলক্ষিত হয় দুর্গাপূজার আমেজ। আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা মেতে ওঠে পরমানন্দে। সবার মাঝে ছড়িয়ে পড়ে দুর্গোৎসবের আমেজ।

প্রতিবছরের ধারাবাহিকতায় এ বছরও দুই বাংলায় জমজমাট পূজার আয়োজনে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন পূজারিরা। তারকাঁটার সীমানা ভেদ করে মেতে উঠেছে বাঙালি। দুই বাংলার অলিগলি, রাস্তাঘাট, খেলার মাঠ, এমনকি বাড়ির উঠানেও তৈরি হচ্ছে পূজার প্যান্ডেল। বিভিন্ন আঙ্গিকে প্রতিমা নির্মাণ, বিভিন্ন ধরণের চোখ ধাঁধানো আলোকসজ্জা, সুবিশাল প্যান্ডেল, পাশাপাশি তথ্যচিত্র প্রদর্শনী, দুর্গা দেবীর চলচ্চিত্র প্রদর্শনী, প্রসাদ বিতরণ, অরতি প্রতিযোগিতাসহ বিচিত্র ও বৈচিত্রময় আয়োজন দেখা যায় পূজা মন্ডপগুলোতে। অন্য সব সংস্কৃতি ভিন্ন ভিন্ন ঐতিহ্য থেকে পালন করা হলেও দুর্গোৎসবের রয়েছে বিশাল ধর্মীয় ও শিক্ষণীয় ইতিহাস। আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষের ষষ্ঠ থেকে দশম দিন পর্যন্ত শরদীয় দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়। এই পাঁচটি দিন যথাক্রমে দুর্গাষষ্ঠী, মহাসপ্তমী, মাহষ্টমী, মহানবমী, ও বিজয়া দশমী নামে পরিচিত। আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষকে বলা হয় দেবীপক্ষ। দেবীপক্ষের সূচনার দিনটি মহালয়া। এদিন সনাতন ধর্মালম্বীরা তাদের পূর্বপুরুষদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।

দেবীপক্ষের শেষ দিনটি হলো কোজাগরী পূর্ণিমা। এদিন হিন্দু দেবী লক্ষ্মীর পূজা করা হয়। কোথাও কোথাও ১৫ দিন ধরে দুর্গাপূজা পালিত হয়। সেক্ষেত্রে মহালয়ার আগের নবমী তিথিতে পূজা শুরু হয়। আবার শারদীয় দুর্গাপূজাকে অকালবোধনও বলা হয়। হিন্দুশাস্ত্র অনুসারে শরৎকালে দেবতারা ঘুমিয়ে থাকেন। তাই এই সময়ে তাদের পূজার যথাযথ সময় নয়; বলে মনে করে সনাতন ধর্মালম্বীরা। কিন্তু রাম ও রাবণের যুদ্ধের সময় শরৎকালেই রামকে সাহায্য করার জন্য দেবী দুর্গার বোধন পূজা করেছিলেন ব্রহ্মা। আর অকালে এই পূজার রীতি চালু হয়েছিল বলেই একে অকালবোধন বলা হয়। কৃত্তিবাস ওঝা তার রামায়নে লিখেছেন, রাম স্বয়ং দুর্গার বোধন ও পূজা করেছিলেন। এজন্য স্মৃতিশাস্ত্রগুলোতে শরৎকালকে দুর্গাপূজার বিধান দেওয়া হয়েছে।

ইতিহাস থেকে পাওয়া যায়- প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে পাঞ্জাবের হরপ্পা ও সিন্ধুর মহেঞ্জোদারোতে দুর্গাদেবীর পূজা হতো। পঞ্চদশ শতকে তৎকালীন শ্রীহট্ট (বর্তমান সিলেট) এলাকার রাজা গণেশ চন্দ্র প্রথম প্রতিমা স্থাপন করে দুর্গাপূজা শুরু করেন। এছাড়া ষোড়শ শতাব্দীতে রাজশাহী অঞ্চলের রাজা কংশ নারায়ণ দুর্গাপূজা শুরু করেন। অষ্টাদশ শতকে নদীয়ার রাজা কৃষ্ণ চন্দ্র দুর্গাপূজা করেন। এ থেকে স্পষ্টই বোঝা যায়, দীর্ঘদিন ধরেই দুর্গাপূজা ছিল রাজা, জমিদার, জোতদার, মহাজন, প্রতাপশালী ও বিত্তবানদের দখলে। পরবর্তীতে কালক্রমে দুর্গাপূজা সাধারণ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। ক্রমেই বাড়তে থাকে এর পরিধি। যা আজ সর্বজনীন উৎসবে পরিণত হয়েছে। বর্তমানে ভারত, বাংলাদেশ, নেপালসহ ভারতীয় উপমহাদেশ এবং বিশ্বের একাধিক রাষ্ট্রে গুরুত্বের সঙ্গেই পালিত হচ্ছে এই উৎসবটি।

হিন্দু ধর্ম ও তার অনুসারীদের হাজার বছরের বিশ্বস অনুযায়ী, দেবী কোন বাহনে চড়ে মর্ত্যলোকে আসবেন এবং ফিরে যাবেন- তার ওপরই নির্ভর করে বাঙালির জীবনাচরণ ও প্রকৃতি। দেবালয় থেকে দেবী দুর্গার আগমনের মূলমন্ত্র হচ্ছে শত্রুর বিনাশ ও সৃষ্টির পালন। অসুর বিনাশ করে তার ভক্তদের কল্যাণ সাধন করা দেবী দুর্গার কাজ। দেবী দুর্গাকে সবাই মা দুর্গা, পার্বতী, মহামায়া, কৈলাশী, দুর্গতিনাশিনী, চন্ডী, বাসন্তী, পরমা প্রকৃতি, নারায়ণী, ভদ্রকালী, হৈমবতী, ঈশ্বরী, বৈষ্ণবী, মহেশ্বরী ইত্যাদি নামে অভিহিত করে। কোনো কোনো মতে বলা হয়, দুর্গা কোনো দেবীর নাম নয়। যে দেবী দুর্গম নামক অসুরকে বধ করেছিলেন তাকে দুর্গা নামে পূজা করা হয়ে থাকে। ‘দ’ অক্ষরটি দৈত্য বিনাশ করে, ‘উ’-কার বিঘ্ন নাশ করে, রেফ-কার, রোগ নাশ করে, ‘গ’ অক্ষরটি পাপ নাশ করে  এবং ‘অ’-কার শত্রু নাশ করে। এর অর্থ দৈত্য, বিঘ্ন, রোগ, পাপ ও শত্রুর হাত থেকে যিনি রক্ষা করেন- তিনিই দেবী দুর্গা।

দেবী দুর্গার ১০ হাত দৃশ্যত। তার অষ্টাদশভুজা, ষোড়শভুজা, দশভুজা, অষ্টাভুজা ও চতুর্ভুজা মূর্তি দেখা যায়। তবে দশভুজা রূপটিই বাঙালি পূজারিদের কাছে বেশি জনপ্রিয়। তার বাহন সিংহ ( কোনো কোনো মতে বাঘ)। মহিষাসুর মর্দিনী-মূর্তিতে তাকে মহিষাসুর নামে এক অসুরকে বধরত অবস্থায় দেখা যায়। যখনই দুঃখ, ক্লেশ, বিপদ, আপদে স্বর্গের দেবতা ও মর্ত্যের মনুষ্যসমাজ মূহ্যমান হয়েছে, এ থেকে পরিত্রাণের জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠেছে; তখনই পরিত্রাতা রূপে আবির্ভূত হয়েছেন দুর্গতিহারিণী শ্রী শ্রী দুর্গা দেবী। মহালয়ার (আমাবস্যার) পরে ‘জিদ’ পূজার মাধ্যমে শুরু হয় পূজার আনুষ্ঠানিকতা। ঘটের সামনে ফুল, বেলপাতা, ফল দিয়ে মা দুর্গাকে আহ্বান করা হয়। ‘জিদ’ পূজার দিন থেকে শুরু করে সারা রাত উপবাস থেকে  পরদিন সকালে উপবাস ভেঙে ‘জিদ’ পূজার সমাপ্তি ঘটে। এরপর মহালয়ার দিন দশভুজা দেবী দুর্গাকে মন্ত্রেও মাধ্যমে আমন্ত্রণ জানানো হয়। প্রতি পদে ঘট স্থাপন করে দ্বিতীয়া, তৃতীয়া, চতুর্থা ও পঞ্চমীতে দেবীর ঘটে পূজা করা হয়। ষষ্ঠিতে ঢাকঢোল পিটিয়ে, শঙ্খ বাঁজিয়ে অধিবাস পূজা (আমন্ত্রণ) করে সেই ঘট স্থাপন করা হয় মন্দিরে। এরপর সপ্তমী, অষ্টমী ও নবমী পার করে দশমীবিহিত পূজা সমাপন করে শেষ হয় দুর্গাপূজার ১০ দিনের আনুষ্ঠানিকতা। পূজাম-পের ঢাকের তালে দুলে ওঠে বাঙালির হৃদয়। আকুল মনে উচ্চারিত হয়- ‘যুগ যুগ জিও দুর্গোৎসব’।