শেষ অভিমান/ আফরোজা পারভীন

শেষ অভিমান

শেষ অভিমান

শেষ অভিমান/ আফরোজা পারভীন

 

দিশা আর কতদিকে দৌড়াবে। একজনই তো মানুষ সে। পা দু’খানা। সে পায়ে প্রচণ্ড ব্যথা। ব্যথা নিয়ে ভাবার অবশ্য সময় নেই তার। সময় নেই নিজের দিকে তাকাবার। বেশিরভাগ দিন সকালে নাস্তা হয় না। নাস্তা করার কথা মনেও থাকে না। ভোরের আলো ফোটার আগেই রান্নাঘরে ঢোকে। এক এক রোগির জন্য এক একরকম খাবার। স্যুপ, ব্রেড, সবজি, জাউ। তাতে আছে ঘরের রান্না। পার্মান্টেট বুয়া তিনদিনের কথা বলে বাড়ি গিয়ে পনের দিনের বেশি পার করে ফেলেছে।  ছুটা বুয়া একটা আছে। একদিন এলে তিনদিন আসে না। এলেও মাঝে মাঝে দিশাকে পায় না। ও তখন এ হাসপাতাল ও হাসপাতাল দৌড়াচ্ছে। ঘর দোরে পা রাখার উপায় নেই। বাসনপত্র ডাই হয়ে থাকে। এসব আবার দিশাকেই ঝাটপাট দিতে হয়, বাসনকোসন ধুতে হয়। ময়লা ঘরদোর থেকে হাসপতালে যেতে সাহস হয় না তার। যদি জার্ম ছড়িয়ে যায়। তাই পেটে খাবার থাকুন বা না থাকুক দিশাকে ঘরবাড়ি পরিষ্কার রাখতে হয়, নিজেও পরিষ্কার থাকতে হয়। 

দিশার ভাই নেই। একটা ছেলের জন্য বাবা মায়ের প্রচেষ্টার কমতি ছিল না। পর পর দুই মেয়ে হবার পর সেই যে মায়ের সন্তান ধারণ বন্ধ হলো আর হয়নি। কোন অসুখ বিসুখ ছিল না, নিটোল নিরোগ শরীর। কিন্তু হলো না। বিধাতার ইচ্ছে বোঝা দায়। আগে বাবা মা মাঝে মাঝেই বিলাপ করতেন। বৃদ্ধ বয়সে অসুখ বিসুখের সময় কে তাদের দেখবে এই উৎকণ্ঠায় থাকতেন। একদিন দিশা, নিশা দুই বোন খুবই অসন্তুষ্ট হয়ে বাবা মায়ের সামনে দাঁড়িয়ে বলেছিল,

: এই যে তোমরা দিনরাত হাহুতাশ করছ, দীর্ঘশ্বাস ফেলছ, ছেলে থাকলে যে তোমাকের রাজা রাণী বানিয়ে রাখত তার কী কোন নিশ্চয়তা আছে?

ভাষাটা একটু বেশি রূঢ় হয়ে গিয়েছিল সেটা ওরা জানে। কিন্তু নিজেদের সামলাতে পারেনি। দিনরাত যদি ছেলে ছেলে করে আর ভবিষ্যতে তাদের অনিশ্চয়তার কথা ভেবে উদ্বিগ্ন থাকে তাহলে তো ওদের ছোট করা হয়! 

 হঠাৎ এই আক্রমণে বাবা হকচকিয়ে গিয়েছিলেন। মা আমতা আমতা করে বলেছিলেন,

: না মানে বিয়ে হলে তো মেয়েরা শ্বশুরবাড়ি চলে যায়। বাবা মাকে তো সাধারণত ছেলেরাই দেখে তাই বলছিলাম

: তা মেয়েরা শ্বশুরবাড়ি গেলে কী দেখতে মানা। তোমার যদি ছেলে থাকত আর সেই ছেলের বউ যদি বাবা মাকে দেখত তোমরা মানা করতে?

: না, তা কেন

: তাহলে? শোন মা, শোনেন আব্বা, ওসব দিন বদলে গেছে। সন্তান সন্তানই সে ছেলে হোক অথবা মেয়ে । কই আমাদের তো আপনারা  মেয়ে বলে ছেলের চেয়ে কিছু কম দিয়ে মানুষ করেননি । তাহলে এ চিন্তা কেন আপনাদের? তাছাড়া আমরা পরমুখাপেক্ষী হবো না।  বৃদ্ধ বাবা মাকে যদি শেষ বয়সে দেখতেই না পরি তাহলে আমাদের শিক্ষা দীক্ষার দরকার কি। 

একনাগাড়ে অনেকক্ষণ বলে থেমে গিয়েছিল দু’বোন। 

এরপর মা বাবা আর কোনদিন পুত্র সন্তান না থাকা নিয়ে আক্ষেপ করেননি। 

নিশার দুই মাসের বাচ্চা। এর আগে তার ছিল ঝূঁকিপূর্ণ  প্রেগনেন্সি। বিয়ের অনেক বছর পর বাচ্চা হয়েছে। বাচ্চা জন্মানের সময় অনেক সমস্যা ছিল। সারা বছর অসুখে ভোগে, বাচ্চাও অসুস্থ।  ও নিজেকেই সামলাতে পারে না। এ অবস্থায় পুরোটা এসে পড়েছে দিশার উপর। 

মা হাসপাতালে আছেন দীর্ঘদিন। ক্যান্সারের লাস্ট স্টেজ।  কখনও সেন্স থাকে কখনও থাকে না। অধিকাংশ সময় নল দিয়ে খাওয়াতে হয়। একটু ভালো হলে কেবিনে আনা হয়, দুদিন যেতে না যেতে আবার খারাপের দিকে গড়ায়। তখন আইসিইউতে নিতে হয়। এখন একটু ভালো। কেবিনে আছেন। মাকে দেখার জন্য সার্বক্ষণিক আয়া রেখেছে দিশা। তারপরও  মা দিশার পথ চেয়ে থাকেন। দিশার পা কেবিনে পড়ামাত্র বন্ধ চোখেই বুঝতে পারেন। কাঁপা কাঁপা হাতে ওর হাত ধরতে যান। দিশার চোখে পানি আসে।

আব্বাকে  সপ্তাহে তিনদিন ডায়ালিসিস করতে হয়। বাসায় কেউ থাকে না বলে আব্বাকে এটা নার্সিংহোমে ভর্তি করেছে দিশা। ওখানেই সপ্তাহে তিনদিন ডায়ালিসিস হন। আব্বার জন্যও নার্স রেখেছে। কিন্তু আব্বা   চান দিশা ডালিসিসের সময় উপস্থিত থাকুক। দিশার একমাত্র সন্তান অনুপম। 

তার পনের দিন ধরে ডেঙ্গু। প্রথম দিকে হাসপাতালে ভর্তি করাতে পারেনি। অনেক তদবির করে একটা সিট পেয়েছে।  প্লাটিলেট দ্রুত নেমে যাচ্ছিল ওর। পাগলপ্রায় হয়ে উঠেছিল দিশা। এখন কিছুটা ভালো। অনুপম চায় দিশা সব কিছু ছেড়ে ওর পাশে বসে থাকুক। দিশা রাতে ওর কাছে থাকে। কিন্তু তাতে অনুপমের মন ভরে না। ওর কমপ্লেন লেগেই থাকে। স্বাভাবিক, মাকে তো চাইবেই।

স্বামী আদিবের পায়ে সমস্যা আছে। মাঝে মাঝেই গেঁরো ফুলে যায়, সেখানে রস হয়, পানি জমে। ব্যথায় চিৎকার করে। ব্যথার ইঞ্জেকশন নিয়ে ঘুমায়। দেশ বিদেশে অনেক চিকিৎসা হয়েছে। নিরাময় হয়নি। এই অসুখের জন্য ওর চলতি ব্যবসাটাও ডোবার পথে। ও বাসায় পড়ে থাকে আর ব্যথায় চিৎকার করে। মাঝে মাঝেই ওকে নিয়ে হাসপাতালে ছুটতে হয় দিশাকে। ওর গম্ভীর আর বিমর্ষ মুখ দেখে দিশা বুঝতে পারে, অসুখ ওর দেহে। তবে মনে ওর কোন আনন্দ নেই। না শুধু অসুখের কারণে এই আনন্দহীনতা নয়। দিশাকে ও একেবারেই কাছে পায় না। ও কখনই দিশাকে ওর পরিবারের প্রতি কর্তব্য করতে বারণ করে না। কিন্তু তাই বলে তার প্রতি, তার সন্তানের প্রতি, এই সংসারের প্রতিও তো দিশার কিছু কর্তব্য আছে। 

ভালবেসে বিয়ে করেছে দিশা আর আদিব । এ বিয়েতে আদিবের বাবা মায়ের উৎসাহ ছিল। দিশা দেখতে ভালো। একটা নামকরা কলেজের সহকারি অধ্যাপক ওর বাবা মায়ের অঢেল টাকা। বাবা ভালো চাকরি করতেন। সরকারি প্লট ফ্লাট সবই আছে। দেশে সম্পত্তিও আছে বিস্তর। মাত্র দুই মেয়ে। ওরাই তো সব পাবে। আদিবের নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবার। আদিব  ব্যবসা করে। দিশার বাবা ব্যবসায়ী পাত্রের মাথে মেয়ের বিয়ে দেবেন কিনা এটা নিয়েই বরং ওরা দুঃশ্চিন্তায় ছিলেন। নিজে বড় চাকরি করতেন,  চাকুরে ছেলেই খোঁজার কথা। দিশার বাবার আপত্তি ছিল। তবে তিনি কখনই কিছু ছেলে মেয়ের উপর চাপিয়ে দেননি। তাছাড়া চাপিয়ে দিলেও লাভ হতো না। দিশা ছিল অনমনীয়। সুতরাং সহজেই বিয়ে হয়ে যায়। খুশিই ছিল দিশার বাবা মা। দামি দামি গয়নায় মেয়েকে মুড়ে দিয়েছিল ওর বাবা মা। ঘরভর্তি মূল্যবান আসবাব, ফ্রিজ, টেলিভিশন কোন কিছুরই কমতি রাখেনি ওরা। আর মাস গেলেই দিশার চাকরির অতগুলো টাকা। মেয়েটা টাকা পয়সা কখনও নিজের হাতে রাখেনি। বেতন পেয়ে পুরো টাকাটা তুলে দিয়েছে শাশুড়ির হাতে। ভালোই চলছিল সব। একটু মন খারাপ ছিল ওদের সন্তান না হওয়া নিয়ে। মাঝে মাঝেই বউমাকে সুপারামর্শ দিতেন শাশুড়ি। তা সে আফসোসও চলে গেল অনুপমের জন্মের পর। সুন্দর একটা নিটোল সংসার হলো ওদের। 

বছর দশের যেতে না যেতেই দিশার মায়ের ক্যান্সার ধরা পড়ল বজ্রপাতের মতো।  জমানো টাকা দিয়ে চিকিৎসা চলতে লাগল। ব্যয়বহুল চিকিৎসা। একসময় জমানো টাকা শেষ হয়ে গেল। শুধু হলো সম্পত্তি বিক্রি। ঠিক এই সময়ে ধরা পড়ল আব্বার কিডনির সমস্য। এক বছর পূর্ণ হতে না হতে তাকে ডায়ালিসিসে চলে যেতে হলো। স্রোতের মতো টাকা বেরিয়ে যেতে থাকল।  বার বার হাসপাতালে ভর্তি হয় ওরা। দিশা একবার এ হাসপাতাল একবার ওই হাসপাতালে ছুটছে। কখনও মায়ের বাড়ি পড়ে থাকছে দিনের পর দিন। একদিন শাশুড়ি ছেলেকে বলল,

: এভাবে তো সংসার হয় না বাবা। বউমা যদি বাড়ি না ফেরে 

: কিন্তু ওই বা করবে কি। ওর বাবা মাকে ফেলে কি করে?

: ওর তো একটা বোন আছে। সে দেখে না কেন?

: দেখে মা। তাছাড়া সেও ভীষণ অসুস্থ। 

: এতো দেখছি একটা অসুস্থ ফ্যামিলি। তুইও তো কিছু বলিস না

: বলব কি করে, বিয়ের আগে ওকে কথা দিয়েছি ওর বাবা মাকে দেখতে আমি সহযোগিতা করব। 

: তবে আর কি। এভাবেই চলুক। আমি সময়তো খাবার পাই না, তোর বাবা ওষুধ পায় না। ওযুর পানি পায় না। অনেক আশা করে  ছেলের বিয়ে দিয়েছিলাম । ছেলে মানুষ করে ভালো প্রতিদান পেলাম

এরপরও খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে কিছুদিন চলল। ওরা ছিলেন আরো কয়েক মাস। তারপর দেশে চলে গেলেন

দিশা শ্বশুর  শাশুড়িতে অনেক বুঝিয়ে ছিল। তাদের সহযোগিতা চেয়েছিল। কিন্তু তারা ছিলেন অনড়। চোখের পানি ফেলতে ফেলতে চলে গিয়েছিলেন শাশুড়ি। সেটাই স্বাভাবিক। আদিব তাদের একমাত্র ছেলে। শাশুড়ির সেই চোখের পানি এখনও মাঝে মাঝেই দিশার মনে পড়ে। অপরাধী মনে হয় নিজেকে। কিন্তু কী করবে সে?

সকাল থেকেই ছুটছে দিশা। ছেলের ডেঙ্গু বাড়াবাড়ি হয়েছে।  সে কারণে দিশা দুদিন মাকে দেখতে যেতে পারেনি। গতকাল সে যখন মায়ের কাছে গেল মা মুখ ফিরিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে শুয়েছিলেন। মা অন্যদিনের চেয়ে কাল ভালো ছিলেন। অন্য সময় ও গেলেই মা ঘুরে ওর দিকে তাকান। হাসার আর কথা বলার চেষ্টা করেন। এর চেয়ে খারাপ থাকলেও করেন। কিন্তু মা কাল ফিরে তাকালেন না। দিশা অনেকবার তাকে ডাকল

: মা মা 

মা তাকালেন না। নড়ার চেষ্টাও করলেন না। দিশা তাকে বার বার ডাকল। তারপর ভাবল মা হয়ত ঘুমিয়ে আছেন। সে অনেকক্ষণ বসে রইল। এরপর সিস্টার এলো। সে মাকে জিজ্ঞাসা করল,

: কেমন আছেন?

 মা ক্ষীণস্বরে বলল

: ভাল। 

সিস্টার মার পালস, প্রেসার, জ্বর  দেখলেন। ওষুধ খাওয়ালেন। চার্টে লিখলেন। তারপর চলে গেলেন। অর্থাৎ মা ঘুমাননি। ইচ্ছে করে তার সাথে কথা বলছেন না। তার মানে সে দুদিন আসেনি বলে তার উপরে মার অভিমান হয়েছে। সে মার হাত ধরল

: মা আমার উপরে অভিমান করেছ? 

মা কথা বললেন না।  আস্তে করে মাকে নিজের দিকে ফিরালো দিশা। মার দুচোখ ভরা অভিমান। সে চোখ যেন বলছে, আমি তোর জন্য অপেক্ষা করে থাকি অথচ তুই আসিস না। 

দিশা আস্তে মায়ের গালের উপর গাল ঠেকালো। বলল, 

: অভিমান করো না মা, আমার সবসময় তোমার কাছে আসতে ইচ্ছে করে, থাকতে ইচ্ছে করে। কিন্তু কি করব আমি যে 

বলতে গিয়ে বলতে পারল না দিশা। এখানে আসার আগে সে আব্বার কাছে গিয়েছিল । আব্বা তার হাত ধরে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলেছিলেন। হাঁফাতে হাঁফাতে বলেছিলেন.

: আমার মোটেও বাঁচতে ইচ্ছে করে না। আসলে অসুস্থ শরীরে কারো বাঁচা উচিত না, বেশিদিন কারো বাঁচা উচিত না। তুই আমাকে বলিস না কিন্তু আমি বুঝতে পারি তোর কত কষ্ট। 

: এসব কি বলছ আব্বা। আমার কোন কষ্ট নেই। তোমরাই তো আমার বল ভরসা। তোমরা আছ বলেই আমি এখনও শক্তি পাই। এভাবে বলবে না

: আমি চলে গেলে তোর কষ্ট কমত। কিন্তু নিজের ইচ্ছায় তো যাওয়া যায় না। আল্লাহকে সারাদিন ডাকি উনি যেন আমাকে তুলে নেন 

দিশা আব্বাকে কথা শেষ করতে দেয় না। মুখে হাত চাপা দেয়। আব্বাকে খাইয়ে পানি খাওয়ায়। তারপর মুখ মোছায়। আব্বা চেয়েছিলেন দিশা যেন তার ডায়ালিসিসের পুরোটা সময় পাশে থাকে।  কিন্তু ছেলেকে দেখতে যেতে হবে দিশাকে। তাই ডায়ালিসিস অর্ধেক হলেই সে চলে এসেছিল। করুণ চোখে তাকিয়ে ছিল আব্বা। 

 ছেলের কাছে যেতেই ছেলে জড়িয়ে ধরে বুকের মধ্যে মুখ লুকিয়ে ছিল। এই কদিনের লাগাতার অসুস্থতায় ওর হাড় জিরজিরে অবস্থা। শরীর ফ্যাকাসে। খুব দুর্বল হয়ে গেছে ছেলেটা। বাড়িতে নিয়ে গিয়ে ভালো করে খাওয়াতে হবে। তাই বা সে করবে কী করে তিন তিনটে রুগি সামলে। ছেলে বলেছিল,

: তুমি কেমন মা ছেলেকে একা রেখে চলে গিয়েছ। তুমি আজ যাবে না। অথবা আমাকে তোমার সাথে বাড়ি নিয়ে যাবে। আমি আর এখানে থাকব না। 

: একা কোথায়! নার্স তো আছে। সে তোর কাছে ছিলো না? ওকে আজ আচ্ছা করে বকে দেব।

: ছিল। ও আর তুমি এক ? আমি এখানে থাকব না। 

:সোনা আর একটু সুস্থ হ তোকে বাড়ি নিয়ে যাব। এইত আর মাত্র এক দুদিন। ছেলে দিশার আঁচল চেপে বসেছিল। সে আঁচল ছাড়িয়ে চলে আসতে দিশার খুব কষ্ট হয়েছিল। আসার সময় অনু খুব কেঁদেছিল। দিশাও কাঁদতে কাঁদতে এসেছিল। দুটো হাসপাতাল পার করে মায়ের কাছে এসে মার অভিমান দেখে ভেঙে পড়ে দিশা। মায়ের গালে মুখ ঘষতে ঘষতে অস্ফুটে  বলে 

: বলো আমি কোনদিক সামলাবো? বলো মা? 

ওর দুচোখের কোল বেয়ে পানি গড়ায়। একসময় মা একটু স্বাভাবিক হন। তবে পুরোটা নয়। চোখের কোণে তখনও দলা পাকিয়ে ছিল অভিমানের খানিকটা মেঘ। দিশা মার মাথায় হাত বুলাতে বলে,

: একটু হাসো না মা । একটু।

 মা হাসেন না। 

: কি হলো মা, এখনও রাগ করে আছ। একটু হাসো। তোমার হাসি দেখে বাড়ি যাই। 

মা কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলেন,

: কাল হাসব। কাল আসবি তো? কথা দে প্রতিদিন একবার আসবি। 

প্রতীক্ষা নিয়ে দিশার দিকে তাকিয়ে ছিলেন মা। এইত দুচারবছর আগেও মার চামড়া ছিল টানটান। ঘি বর্ণের ত্বক মায়ের, টানাটানা চোখ নাক। আব্বা নাকি তার রূপে পাগল হয়ে বিয়ে করেছিলেন। এখন মায়ের ঝুলে পড়া কুঁচকানো চামড়া, মসীবর্ণ রঙ দেখে কে বলবে একসময় তার চলাচলের পথে লাইন পড়ে যেত। সময় বড় নির্মম!

 মাকে কথা দিয়ে এসেছিল এখন থেকে রোজ সে মাকে দেখতে যাবে। একদিনও বাদ দেবে না। 

কথা তো দিয়ে এলো কিন্তু যাবে কি করে। মা আব্বা অসুস্থ হবার প্রথম দিকে অনেকেই হোঁজ খবর নিয়েছে। আত্মীয় স্বজন ফল নিয়ে হাসপাতালে দেখা করে এসেছে। বাড়িও এসেছে দু চারজন। যারা বেশি ঘনিষ্ঠ তারা একাধিকবার এসেছে। ওই পর্যন্ত। নিত্য মরাকে কে দেখে? 

দিশার চাকরিটা যাবার পথে। প্রথম দিকে কলেজ বেশ সহানুভূতিশীল ছিল। ছুটিছাটা চাইলে পেত। সিএল ইএল-এর বাইরেও বিশেষ বিবেচনায় বেশ কিছু ছুটি তাকে দিয়েছে কর্তৃপক্ষ যেসবের কোন হিসেব নেই। কিন্তু আর কতদিন। এখন সে উইদাউট পেতে আছে। কলেজ জানিয়ে দিয়েছে আর দুমাস তারা দেখবে। এর বেশি সম্ভব না। তাদের অসুবিধা হচ্ছে। কলেজে ছাত্র বেড়েছে শিক্ষকতো আর বাড়েনি। কথা সত্য। তাছাড়া দিশা নিজেও বোঝে কতদিনইবা কোন বিষয়ে বিবেচনা করা যায়। ও ভাবছে চাকরিটা ছেড়ে দেবে। এখন তার যা অবস্থা চাকরি সংসার দুটোই যাবার পথে। যাওয়ার আগে ছেড়ে দেয়াই ভাল। বরং সংসারটা বাঁচানোর চেষ্টা করা জরুরি। সেটাই করছে দিশা। 

 ফেরার পথে মোহাম্মদপুর বাজারে নামে দিশা। ইলিশ, কৈ  মাছ আর কচু কেনে। আদিব কচু  কৈ আর সরষে ইলিশ ভালবাসে। কতদিন এসব করা হয়নি। সারাদিন শুয়ে শুয়ে ব্যথায় কাঁতরায়। এদিকে দিশার হাত পাও কাঁপছে। কোন সকালে  বেরিয়েছে। সন্ধ্যা পার হয়ে গেছে। আসার সময় টেবিলে খাবার চাপা দিয়ে রেখে এসেছিল। কে জানে আদিব খেয়েছে কিনা। অভিমান করে মাঝে মাঝেই খায় না সে। কেন খায়নি জানতে চাইলে জবাব দেয় না। দিশা দুপুরে দুটো সিঙ্গাড়া  খেয়েছিল। ও  বুঝতে পারে না কিভাবে সবদিক সামলাবে। একদিকে নিজের বাবা মা , একদিক সন্তান, অন্যদিকে স্বামী। তার জন্য ত্রিশঙ্কু অবস্থা। সে কাকে রাখবে কাকে ফেলবে। সবদিক যে সে একা সামলাতে পারছে না। বাবা মা কেমন আছে নিয়মিত জানায় না বলে বোন নিশাও রাগ করে। নিশা ফোন করলে কথা বলতে ক্লান্ত লাগে দিশার। তাছাড়া কথা বলার সময়ও ওর নেই। নিশাও বুঝতে চায় না ও কি করে সামলাচ্ছে । 

বাসায় এসে দেখে আদিব খায়নি। টেবিলে খাবার চাপা দেয়াই আছে। খাবারে গন্ধ  উঠে গেছে। ও আদিবের কাছে গিয়ে মাথায় হাত রাখে

: খাওনি কেন?

আদিব ঝটকা দিয়ে হাত সরিয়ে দিলো। দিশা গায়ে মাখল না । বলল 

: সরষে ইলিশ করছি। কচু এনেছি।  তোমার পছন্দের সরিষা ইলিশ আর  কৈ কচু রাঁধব। চা দিচ্ছি । তোমাকে খাইয়ে শুইয়ে দিয়ে হাসপাতালে অনুপমের কাছে যাব। আসার সময় খুব কাঁদছিল ছেলেটা।

এবারও কোন কথা বলল না আদিব 

খুব যত্ন করে রাঁধল দিশা। টেবিলে খাবার সাজিয়ে আদিবকে ডেকে তুলল 

: টেবিলে যেতে পারবে না এখানে এনে খাইয়ে দেব 

আদিব কোন কথা বলল না, খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে টেবিলে গেল। দিশা পেট ভর্তি মাঝওয়ালা বড় একটা পেটি তুলে দিলো আদিবের প্লেটে। কাঁটা বাছতে বাছতে বলল

: দেখ আদিব তোমার সাথে আমার পনের বছর হলো। সবসময় তোমার সহযোগিতা পেয়েছি। মরণের ক্ষেত্রে কোন নিয়ম খাটে না। তারপরও বৃদ্ধ আর অসুস্থরাই আগে মারা যায় এমন একটা ধারণা আছে। সেই হিসেবে আমার বাবা মায়ের আর বেশিদিন সময় নেই। আমি তাদের প্রথম সন্তান। আমরা বেঁচে আছি, আল্লাহ বাঁচালে আরো অনেকদিন হয়ত একসাথে থাকতে পারব। কিন্তু ওরা? 

দিশা ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে । আদিব এঁটো হাতেই ওকে জড়িয়ে ধরে 

: সরি দিশা, সরি

 

দুই 

ছুটতে ছুটতে মায়ের হাসপাতালে পৌঁছায় দিশা। মাকে কথা দিয়ে এসেছিল প্রতিদিন আসবে । আসার কোন পরিবেশ ছিল না। সকাল থেকেই আদিবের ব্যথা বেড়েছে। অসহ্য যন্ত্রণায় কাঁতরাচ্ছে সে। তার মধ্যেই বার বার বলেছে দিশাকে হাসপাতালে যেতে। আসার সময় আদিবকে বলে এসেছে, বিকালে ওকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে। আদিব বলেছে, আগে বাবা মা অনুপমকে দেখ। কালকের ঘটনায় আদিব যেন একেবারে বদলে গেছে। আদিবের কথা ভাবতে ভালবাসায় ভরে ওঠে দিশার বুক। আহারে বেচারা তার জন্য জীবনভর কত স্যাক্রিফাইসই না ও করল! দিশা মনে মনে ভাবে, বাবা মা সুস্থ হয়ে উঠলে আদিবের সর্বোচ্চ যত্ন নেবে সে। ওর পছন্দের জিনিসগুলো রান্না করে খাওয়াবে, পছন্দের জায়গায় ঘুরতে নিয়ে যাবে। আর সবার আগে আর একবার সব চেয়ে ভাল হাসপাতাল থেকে খুব ভাল করে চিকিৎসা করাবে ওর। দরকার হলে বিদেশে নিয়ে যাবে। 

লিফট আসতে দেরি হচ্ছে। এক একটা মুহূর্ত যেন এক ঘন্টা মনে হচ্ছে দিশার। মায়ের কাছে পাঁচটা মিনিট বেশি থাকলে মা শান্তি পান। আজ মার কাছে অনেকক্ষণ থাকবে দিশা। আজ আব্বার ডায়ালিসিস নেই। আজ সম্ভব না হলে আব্বার কাছে যাবে না। মার কাছে থেকে মার অভিমান ভাঙাবে। 

মার কেবিনে এসে দেখে কেবিন  বোঝাই ডাক্তাররা। ও আসামাত্র ডাক্তারদের একজন বলেন

: এসেছেন ? ভাল করেছেন! আপনাদের কেউ কাছে পিঠে থাকে না এটাই সমস্যা। ওনার অবস্থা হঠাৎ করে খুব খারাপ হয়েছে। আইসিইউতে ট্রান্সফার করতে হবে। 

: করুন । যা লাগে করুন। মাকে বাঁচাতে হবে। 

বলতে বলতে  মার দিকে ছুটে যায় দিশা। মার স্যালাইন অক্সিজেন সবই চলছে। তার মাঝেই যেন মা একটু কাত হয়ে ওর দিকে  তাকান। তার ঠোঁটে চমৎকার একটা হাসি। সে হাসি যেন বলছে, 

: এসেছিস, কথা রেখেছিস ওরে আমার সোনা মেয়ে 

এর দু ঘন্টা পর মারা যান মা। 

মার কফিনের পাশে বসে আছে আদিব আর দিশা। চারপাশে অনেক লোক। নিশা তারস্বরে কাঁদছে। কাঁদছে আরো অনেকে। দিশা যেন কাঠ হয়ে গেছে। শক্ত নিরেট ভাবলেশহীন। ওকে ধাক্কা দিয়ে আদিব বলে,

: একটু কাঁদো দিশা। নিজেকে ক্ষমা করতে পারছি না। আমি আর একটু মানবিক হলে মা বোধহয় আরও কিছুদিন বেশি বাঁচতেন! কাঁদতে থাকে আদিব। দিশার কান্না সে কান্নাকে ছাপিয়ে যায়।

আফরোজা পারভীন
আফরোজা পারভীন
%d bloggers like this: