শিশুর মনোজগত ও আমার মানস শিল্পী রবীন্দ্রনাথ / প্রণব মজুমদার

শিশুর মনোজগত ও আমার মানস শিল্পী রবীন্দ্রনাথ

শিশুর মনোজগত ও আমার মানস শিল্পী রবীন্দ্রনাথ

শিশুর মনোজগত ও আমার মানস শিল্পী রবীন্দ্রনাথ / প্রণব মজুমদার

 

রবীন্দ্রনাথ আমাদের সকলের। তিনি সব মানুষের। শিশু থেকে বয়োবৃদ্ধের। প্রতিটি মুহূর্তে সব বয়সী মানুষের মনোজগতে বিচরণ করেন তিনি। তাঁর সুবিশাল সৃজনশীলতা আমাদের চেতনার প্রতিটি অনুভূতিতে উপস্থিত। জলে, মৃত্তিকায় আকাশ বা বায়ুমণ্ডলে ভৌগলিক বিশ্ব পরিমণ্ডলের সকল স্থানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অস্তিত্ব অনুভব করি আমরা। নব প্রাণের প্রথম চিৎকারে তিনি বিদ্যমান। এমন কী নিঃশ্বাসের প্রতিটি ছোঁয়ায় স্পর্শ মেলে তাঁর সৃজন সাহিত্যে। তিনি সকলের কথা ভেবেছেন। অসীম সে সাহিত্য ভাণ্ডার আমাদের জানান দেয় প্রতিনিয়ত। সমগ্র প্রাণীকূলের সত্তায় ও মননে বিশ্বকবি রবি ঠাকুর জাগ্রত।

বাংলা সাহিত্যের অধিকাংশ লেখকের লেখালেখির সূচনা শিশু সাহিত্য দিয়ে। সাহিত্যের শাখা প্রশাখার ছড়া বা কবিতার মাধ্যমই এ ক্ষেত্রে বেশি প্রাধান্য পেয়েছে। রবীন্দ্রনাথও সে পথে পরিভ্রমণ করেছেন। মাত্র ৮ বছর বয়সে কবিতা দিয়ে তাঁর সাহিত্যে প্রবেশ। সাধু ভাষায় লিখিত সে কবিতাটার কথা আজও আমাদের মনে পড়ে।

মীনগণ দীন হয়ে ছিল সরোবরে

এখন তাহারা সুখে জলে ক্রীড়া করে।

রবীন্দ্র সাহিত্যকে অনুসরণ করে বাংলা সাহিত্যের উত্তরসূরি লেখকগণ হেঁটেছেন। এখনও সে ধারা প্রবাহমান। প্রকৃতি, প্রেম, সুখ, দুঃখ, আরাধনা, শোক ও আনন্দে বিরাজমান বিশ্বকবি। সাহিত্যের সব শাখায় তাঁর সদর্প উপস্থিতি। ছড়া, কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ, গীতরচনা, চিত্রশিল্প, কণ্ঠদান কোথাও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাদ যাননি। শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতির সকল কলায় তাঁর একচ্ছত্র আধিপত্য। মাঝে মাঝে আমার মনে হয় সাহিত্যের সীমাহীন এলাকায় রবীন্দ্রনাথ একমাত্র শিশুমনজয়ী সার্থক ব্যক্তিত্ব। ছোটদের জন্য তিনি ছিলেন সর্বদা নিবেদিত। ছোটদের ভালোবাসতেন বলেই শিশু কিশোরদের কাছে রবীন্দ্রনাথ অতি জনপ্রিয়।

আমার মতো অনেক লেখকের অনুসরণীয় বিশ্বজয়ী এই কবি! তাঁর একটি ছড়া আমাকে প্রবলভাবে অনুপ্রাণিত করেছে ছেলেবেলায়। ‘বৃষ্টি পরে টাপুর টুপুর, নদে এল বান’ ছড়াটি আমার শিশু মনকেও দোলা দিত। তালে তালে সে ছড়া আওড়াতাম। এর প্রচ্ছন্ন প্রভাব পড়ে আমার প্রথম লেখায়। জন্ম জায়গা আমার মফঃস্বল শহর চাঁদপুর। কোড়ালিয়া সড়কের দত্ত বাড়ীতে ছেলেবেলার বেশির ভাগ সময় কেটেছে। টিনের ঘরে আমাদের দীর্ঘ পরিবারের বসবাস। গ্রীষ্মের স্কুল ছুটি চলছে। দুপুরে দাবদাহ বেশ। সূর্যের তাপে টিনের চাল গরম হয়ে প্রচণ্ড তপ্ত। হঠাৎ মেঘে আকাশ কালো হয়ে গেল! তারপর ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি! টিনের চালে বৃষ্টির শব্দ আমাকে আন্দোলিত করলো খুব। মাথায় এল ছন্দময় শব্দ। চোষ খাতায় লিখলাম-

‘টাপুর টুপুর বৃষ্টি পড়ে

চালে আর ডালে

শব্দ করে ঝুমুর ঝুমুর

পড়ে তালে তালে।’

জীবনের প্রথম লেখা ছড়া- ‘টাপুর টুপুর বৃষ্টি পড়ে!’ ছাপা হয় ১৯৭৮ সালে ২৭ জুন দৈনিক সংবাদ-এর খেলাঘর পাতায়, ছড়িয়ে দিলাম ছড়া বিভাগে। রবীন্দ্রনাথের টাপুর টুপুর বৃষ্টি পড়ে ছড়াটি আমার প্রথম মৌলিক সৃজনের অনুপ্রেরণা বলতেই হয়।

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দের ৭ মে ব্রিটিশ ভারতের কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। সেদিন ছিল ১২৬৮ বঙ্গাব্দের ২৫ বৈশাখ। স্কুলে ভর্তি করানো হলেও রবীন্দ্রনাথ নিয়মিত ছাত্র ছিলেন না। বাড়িতেই তাঁর পড়াশোনার ব্যবস্থা করা হয়। কৈশোরেই লেখালেখির হাতেখড়ি । শিশু সাহিত্যেকে সমৃদ্ধ করতে তাঁর অবদান অপরিসীম। বাংলা সাহিত্যে ছোটদের উপযোগী সাহিত্য তিনিই প্রথম সমৃদ্ধ করে তুলতে সচেষ্ট হন। সৃষ্টি করেন কালজয়ী রচনা। তাঁর ছড়া, কবিতা, গল্প ও নাটকে শিশুদের যাবতীয় মনের কল্পনা এবং শিশুদের অনুভূতি প্রকাশ পেয়েছে বেশ ভালভাবেই।

মাকে বিপদ থেকে বাঁচানোর রূপকথা নিয়ে তিনি লিখেছেন ‘বীরপুরুষ’ কবিতা। এ কবিতায় তিনি তুলে ধরেন মাকে বাঁচাতে এক কিশোরের বীরত্বের গল্প। মায়ের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ পেয়েছে তাঁর অন্যান্য কবিতাতেও। ‘জন্মকথা’ কবিতায় কবি এক খোকার গল্প লিখেন যে কৌতূহলী হয়ে তার মাকে জিজ্ঞাসা করে- কোথায় খুঁজে পেয়েছে তাকে? তিনি লিখেছেন-

খোকা মাকে শুধায় ডেকে,

এলেম আমি কোথা থেকে’

তাঁর ‘শিশু’, ‘খাপছাড়া’, ‘শিশু ভোলানাথ’ ‘পাতা,’ ‘ছড়া’সহ নানা কাব্যগ্রন্থে রয়েছে শিশুদের প্রাধান্য। পাতা কাব্যগ্রন্থের সকল কবিতা যে কোনো শিশুর মনকে আনন্দ দেয়। রবীন্দ্রনাথ রূপকথাকে ছন্দে বেঁধেছেন! প্রকৃতিকেও মজার ছলে তুলে ধরেছেন তিনি। ‘আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে’ কিংবা ‘তাল গাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে’ তেমনই উদাহরণ।

প্রকৃতিবাদী কবি নানান বিষয়কে তুলে এনেছেন শিশুদের ছড়া কবিতায়। আষাঢ় মাসের মেঘ দেখে লিখেছেন-

নীল নবঘনে আষাঢ় গগনে

তিল ঠাঁই আর নাহিরে

ওগো, আজ তোরা যাসনে ঘরের বাহিরে। (আষাঢ়, ক্ষণিকা)

সোনার তরী, দুই পাখি শিশুদের জন্যে অনবদ্য সৃষ্টি। বৃষ্টি, নদী, চাঁদ, ফুল, পাখি এসব শিশুদের দারুণ প্রিয়। আর এগুলো নিয়ে যখন ছড়া ও কবিতা সৃষ্টি হয়, তখন তা হয় আরো উপভোগ্য। তিনি লিখলেন-

দিনের আলো নিভে এল

সূর্যি ডোবে ডোবে।

আকাশ ঘিরে মেঘ জুটেছে

চাঁদের লোভে লোভে।

রবীন্দ্রনাথ ছিলেন একজন সচেতন খেয়ালি মনের মানুষ। বিচিত্র রকম সাধ, ইচ্ছে ছিলো তাঁর মনের মধ্যে। ছোটদের মতো মনটাও তাঁর! যখন যা দেখেছেন তাই করতে চেয়েছেন বা হতে চেয়েছেন।

কবির ভাষায়-‘

‘যখন যেমন মনে করি

তাই হতে পাই যদি,

আমি তবে এক্ষুনি হই

ইছামতী নদী।

অথবা

‘মা যদি হও রাজি

বড়ো হলে আমি হব

খেয়াঘাটের মাঝি’ (মাঝি, শিশু)

ছড়া ও কবিতায় কবির শিশুমন বিদ্যমান ছিল প্রবলভাবে! গলির পাশে ফেরিওয়ালাকে দেখে ফেরিওয়ালা, মালিকে দেখে মালি, পাহারাদারকে দেখে পাহারাদার হতে চেয়েছেন।

শিশুদের কাছে মা অতি প্রিয় একটি শব্দ। সব কিছু যদি তাকে দেয়া হয়, তারপরও সে মাকে খোঁজ করবে। মা যেন তার থাকতেই হবে। তাই মাকে নিয়েও রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন অনেক ছড়া ও কবিতা। মাতৃবৎসল কবিতায় লিখেছেন তিনি-

মেঘের মধ্যে মা গো যারা থাকে

তারা আমায় ডাকে, আমায় ডাকে।

আমি বলি, ‘মা যে আমার ঘরে

তারে ছেড়ে থাকব কেমন করে?

ছোট শিশুদের থাকে নানান রকম দুরন্তপনা। আধো আধো কথায় শিশুরা মন ভরিয়ে দেয়। শিশু ছোট হলেও তার রং ঢং সত্যি মুগ্ধ করে। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়-

‘একটি ছোট মানুষ, তাহার একশো রকম রঙ্গতো।

এমন লোককে একটি নামে ডাকা কি হয় সঙ্গত’। (পরিচয়, শিশু)

রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পের জুড়ি নেই। তাঁর ছোট গল্পের শিশু চরিত্রগুলো পাঠকের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছে। ‘বলাই’ গল্পের বলাই, ‘পোস্টমাস্টার’ গল্পের রতন কিংবা ‘ছুটি’ গল্পের ফটিক বেঁচে আছে সকল কিশোরের হৃদয়ে। অনেক মজার মজার নাটিকাও লিখেছেন তিনি। হাস্যরসাত্মক একটি নাটিকা হলো -চিন্তাশীল। এসব রচনা শিশু সাহিত্যকে করেছে সুসংহত। তাই চিরকাল শিশুদের কাছে ভালোবাসার নাম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ছোট বড় সবার চোখেই জল চলে আসে। যেমন -‘গল্পসল্প’ বইয়ের ‘রাজার বাড়ি’, ‘বড়ো খবর’, ‘পরী’, ‘আরো সত্য’, ‘বাচস্পতি’ ইত্যাদি গল্প। এসব শিশুতোষ সৃজনশীল মৌলিক রচনা ছোটদের যেমন আনন্দ দেয়, তেমনি ‘সে’ বইটির জলে ডুবে মরার গল্প, শেয়ালের মানুষ হওয়ার গল্প, বাঘের গল্প, বন মানুষের মাথা ঠোকার গল্প, গেছো বাবার গল্প ইত্যাদি গল্প আমাদের আনন্দে ভরিয়ে তোলে। ‘তোতাকাহিনী’ সম্পূর্ণ শিক্ষামূলক শিশু কিশোর উপযোগী ছোট গল্প।

এশিয়া মহাদেশের মধ্যে সর্বপ্রথম সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজিতে লেখা গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থের জন্য তিনি এ পুরস্কার লাভ করেন।

রবীন্দ্রনাথকে বলা হয় কবিদের কবি। নিতান্ত অল্পবয়সে জ্ঞাননন্দিনী দেবীর পরিচালনায় প্রকাশিত ‘বালক’ পত্রিকা লেখার ভার অনেকটাই নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন তিনি। ফলে সৃষ্ট হয়েছে ছড়া আর গল্পের পসরা। জীবনের শেষ সময়েও আরো মনোযোগ আর দরদের সঙ্গে শিশুসাহিত্য রচনায় আত্মনিয়োগ করেছিলেন তিনি। শিশুদের জন্যেও তিনি প্রচুর লিখেছেন এ সময়।

রবীন্দ্রনাথ যখন ছোটদের জন্যে লিখেছেন, তখন তিনি মনে প্রাণে নিজেই ছোট্ট শিশু বনে গেছেন। শিশুদের চাওয়া পাওয়া, আধো আধো কথা বলা তাঁর সাহিত্যে হয়েছে জীবন্ত এবং প্রাণবন্ত। মূলকথা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শিশুতোষ রচনায় যে রস ও ছন্দের আয়োজন করেছেন তা শিশু মনের শ্রেষ্ঠ খোরাক। তাই শিশুদের কাছেও তিনি কিংবদন্তি মহান ব্যক্তি। এক মহীরুহ। সুবিশাল পৃথিবী!

প্রণব মজুমদার
প্রণব মজুমদার
%d bloggers like this: