সভ্যতার বিনির্মাণে শ্রমজীবী মানুষের মূল্যায়ন/ ড. মুহাম্মদ নজরুল ইসলাম খান 

নজরুল ইসলাম খান

ড. মুহাম্মদ নজরুল ইসলাম খান

 

আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে জীবিকা অর্জনের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। আর এই জীবিকা অর্জনের অন্যতম উপায় হচ্ছে শ্রম বিনিয়োগ করা। দেহ ও মনের তৎপরতা তথা কায়িক ও মানসিক কর্মতৎপরতার দ্বারা কোনরূপ উৎপাদনশীল কাজ করাকে শ্রম হিসেবে গণ্য করা হয়। যেখানে দেহ ও মনের সম্মিলিত সমন্বয় না ঘটে সেখানে শ্রমকে সার্থকরূপে বিনিয়োগ করা যায় না। শ্রমকে উন্নয়ন তথা উৎপাদনশীল কর্মকাণ্ডে বিনিয়োগ করতে হলে দেহ ও মনের সমন্বয় জরুরি। শুধু দেহ বা শুধু মন দিয়ে শ্রমকে কখনো বিনিয়োগ করা গেলেও তাতে শ্রম বিনিয়োগের প্রকৃত উদ্দেশ্য সাধিত হয় না। ইসলামে শ্রম বিনিয়োগের ব্যাপারে ব্যক্তিকে যেমন উৎসাহিত করা হয়েছে তেমনি শ্রমকে কাজে না লাগিয়ে বেকার বসে থাকাকেও নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। কেননা জীবিকা বা অর্থোপার্জনের জন্য শ্রমই হচ্ছে প্রাণশক্তি। উপার্জনের জন্য এ শক্তিকে বিনিয়োগ করতেই হবে। হযরত ওমর ফারুক (রা) বলেছেন : ‘তোমাদের মাঝে কোন ব্যক্তি যেন শ্রমের মাধ্যমে অর্থোপার্জনের পথ বন্ধ না করে। বেকার বসে থেকে যেন না বলে, হে আল্লাহ! তুমি আমাকে রিযিক দাও। কারণ তোমরা নিশ্চয়ই জান, আসমান থেকে স্বর্ণ-রৌপ্যের খণ্ড ঝরে পড়ে না’। এ কারণে দেখা যায়, নবী-রাসূলগণ কায়িক শ্রমের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহের প্রতি গুরুত্বারোপ করতেন। শ্রম, চাকুরি ও অন্যান্য পেশায় আত্মনিয়োগ করতে উৎসাহ প্রদান করতেন। পরিশ্রম করতে কুণ্ঠাবোধ  করতেন না। এ প্রসঙ্গে রাসূল (সা) বলেছেন : ‘নিজের পরিশ্রমের দ্বারা উপার্জিত খাদ্যের চেয়ে উত্তম খাদ্য কেউ কখনো খায়নি। আল্লাহর নবী দাউদ (আ) নিজের পরিশ্রমের দ্বারা উপার্জিত খাদ্য খেতেন’। (বুখারী) আমাদের প্রিয় নবীও (সা) শ্রমের মাধ্যমে অর্থোপার্জন করে জীবিকা নির্বাহ করা পছন্দ করতেন। তিনি বলেছেন : ‘আল্লাহর প্রত্যেক নবীই বকরী চরিয়েছেন। সাহাবীগণ জিজ্ঞাসা করলেন আর আপনি? তখন তিনি বললেন, আমি কয়েক কিরাত মজুরিতে মক্কাবাসীর বকরী চরাতাম’। (বুখারী) অন্যান্য নবী-রাসূলগণও কঠোর পরিশ্রম করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। এ প্রসঙ্গে রাসূল (সা) বলেছেন : ‘হযরত দাউদ (আ) কর্মকার ছিলেন, আদম (আ) কৃষক ছিলেন, নূহ (আ) ছুতার (কাঠমিস্ত্রী) ছিলেন, ইদরিস (আ) দরজী ছিলেন আর মুসা (আ) ছাগল চরিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতেন’। (ফতহুল বারী, ৪র্থ খণ্ড, পৃ.৩০৬) অন্য একটি হাদীস থেকে জানা যায়, আমাদের নবী এক ইহুদীর কূপ থেকে নির্ধারিত পারিশ্রমিকের বিনিময়ে পানি তুলে দিতেন। হযরত খাদিজার (রা) ব্যবসায়-বাণিজ্য পরিচালনা করতেন। এসব কিছুর বিনিময়ে তিনি পারিশ্রমিক নিতেন। তাই তিনি মনে করতেন জীবিকা নির্বাহের ব্যপারটি শ্রম নির্ভর পর নির্ভর নয়। শ্রম বিনিয়োগ সম্মানের, এর দ্বারা ধনী-দরিদ্র, উঁচু-নিচু মূল্যায়নের কোন সুযোগ নেই।

মহান আল্লাহ তাআলার চিরন্তন বিধান হচ্ছে- মানুষ আল্লাহর দেয়া রিযিক থেকে শ্রম বিনিয়োগ করে জীবিকার্জন করবে। তার শারীরিক, মানসিক, জ্ঞান-প্রজ্ঞা ও কৌশলকে কাজে লাগিয়ে সাধ্যমত প্রয়োজনীয় জীবিকা অর্জনের চেষ্টা করবে। এই শ্রম দুই ধরনের হতে পারে। কায়িক (দৈহিক/শারীরিক) ও বুদ্ধিবৃত্তিক। কায়িক শ্রমের মাধ্যমে মানুষ বিনা মূলধনে অর্থোপার্জন করতে পারে। ইসলাম এরূপ শ্রমকে সম্পদরূপে স্বীকৃতি দিয়েছে। অর্থাৎ কারো যদি কোনরূপ বিষয়-সম্পদ না থাকে তবে তার শ্রমই হবে বিষয়-সম্পদের বিকল্প সম্পদ। শ্রমকেই বিশেষ সম্পদরূপে মূল্যায়ন করা হবে। যেমন হযরত মুসা (আ) তাঁর বিবাহের মোহরের বিনিময়স্বরূপ তার স্ত্রীর বকরী চরানোর চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছিলেন। কেননা মুসা (আ) এর কাছে বিবাহকালীন সময়ে মোহরানা আদায় করার মত তার শ্রম ছাড়া কোন অর্থ-সম্পদ ছিলনা। বিষয়টি আল-কুরআনে এভাবে এসেছে : ‘আমার একান্ত ইচ্ছা আমার দুটি কন্যার একটিকে তোমার সাথে বিবাহ দেব। তবে শর্ত এই যে, তুমি আট বছর আমার কাজ করে দেবে, আর যদি দশ বছর পূর্ণ করে দাও, সেটা তোমার অনুগ্রহ’। (সূরা কাসাস : ২৭)

ইসলামী অর্থনীতিতে একজন দায়িত্বশীল ও বুদ্ধিদীপ্ত শ্রমজীবীর শ্রম বিনিয়োগ করার উত্তম পন্থা হচ্ছে মুদারাবাত। এই পদ্ধতিতে একজন শ্রম আর অন্যজন মূলধন বিনোয়োগের মাধ্যমে ব্যবসা পরিচালনা করে লাভ-লোকসানের সমান অংশীদার হতে পারে। শ্রম ও অর্থ বিনিয়োগ করে উভয়ই শিল্পমালিক হতে পারবে। আমাদের প্রিয় নবী (সা) নবুওয়াতের পূর্বে এই পদ্ধতিতে হযরত খাদিজার (রা) ব্যবসায়-বাণিজ্যে শ্রম বিনিয়োগ করেছিলেন। (হাফিয ইব্ন কাসীর, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ৩য় খণ্ড, পৃ. ২০৫) শাহ ওয়ালী উল্লাহ দেহলভী (র)-এর মতে : ‘পারস্পারিক সহযোগিতামূলক কর্মকাণ্ডের মধ্যে মুদারাবা অন্যতম পদ্ধতি। এতে পুঁজি বা মূলধন একজনের আর শ্রম অন্যজনের। পারস্পারিক সম্মতির ভিত্তিতে এই পন্থায় উভয়ই মুনাফার মালিক হয়’। (হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগা, পৃ. ১২০) এ ছাড়াও কৃষি ভূমিতে উৎপন্ন দ্রব্যের অংশীদারীত্বে, ফলফলাদির বাগান উন্নয়নে ও অনাবাদী ভূমি আবাদ করণে কেউ শ্রম বিনিয়োগ চুক্তিতে অনাবাদী জমি আবাদ করলে শ্রম বিনিয়োগকারী ঐ জমির মালিক হবে। রাসূল (সা) বলেছেন : ‘যে ব্যক্তি মালিকানাবিহীন ভূমি আবাদ করবে, সে ঐ জমির মালিক হবে’। (আবু দাউদ, তিরমিযী) 

শ্রম পারিশ্রমিকের বিনিময়ে বিনিয়োগ করা যায়। তবে মনে রাখতে হবে, শ্রম মহান আল্লাহর দেয়া একটি বিশেষ নিআমত। আল্লাহর পক্ষ থেকে এটি বান্দার কাছে আমানত স্বরূপ রক্ষিত আছে। তাই যেসব কর্মকাণ্ডে শ্রম বিনিয়োগ করলে মানসিক ও নৈতিক মূল্যবোধ উপেক্ষিত হয় এবং সামাজিক পরিবেশ বিপর্যস্ত হয় সেসব ক্ষেত্রে শ্রম বিনিয়োগে ইসলামের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। কেননা এতে শ্রম বিনিয়োগের প্রকৃত উদ্দেশ্য তথা জুলুম শোষণ ও বেকারত্বের অবসান ঘটানো সম্ভব হয় না। এরূপ শ্রম বিনিয়োগের ফলে সামাজিক মর্যাদা ও অনাবিল শান্তির প্রত্যাশা সুদূর পরাহত হয়।

সৃষ্টির সেরা মাখলুকাত হিসেবে মানুষ একে অন্যের ভাই। জাতি ধর্ম বর্ণের মর্যাদার ভিত্তিতে মানুষের মর্যাদা নির্ণীত হয় না। বংশীয় আভিজাত্য, বংশীয় গৌরব কিংবা সামাজিক যশ-খ্যাতির মূল্যও ইসলামে নেই। ইসলামের মূল দর্শনই হচ্ছে মানুষ একে অন্যের ভাই, কারো মাঝে কারো ভেদাভেদ নেই। রাসূল (সা) এ প্রসঙ্গে ঘোষণা করেছেন : ‘ইসলামে কোন ব্যক্তি বা জাতি মানবতার ঊর্ধ্বে নয়। আল্লাহর কাছে মনিব, চাকর, উঁচু-নিচু, ধনী-গরীব, আমীর-প্রজা সবাই সমান। কারো কোন পার্থক্য নেই।পার্থক্য আছে কেবল তাকওয়া ও সৎকর্মে। কাজেই এ অবস্থায় কেন তোমরা তোমাদের অধীনস্তদের হীন মনে কর’। পবিত্র কুরআনে মানুষে মানুষের মর্যাদার মাপকাঠি হিসেবে তাকওয়া বা আল্লাহভীতিকে নির্ণয় করা হয়েছে। অর্থাৎ কোন ব্যক্তির কত সম্পদ আছে বা তার কত পার্থিব যশ-খ্যাতি আছে তা দিয়ে আল্লাহ মানুষের মর্যাদা নির্ণয় করেন না, তার কাছে মর্যাদার মাপকাঠি হচ্ছে একমাত্র তাকওয়া। এ প্রসঙ্গে আল-কুরআনে এসেছে : ‘তোমাদের মধ্যে সে ব্যক্তিই আল্লাহর কাছে অধিক সম্মানিত যে বেশি আল্লাহকে ভয় করে’। (সূরা হুজুরাত : ১৩)

বস্তুত এ কারণেই ইসলামে শ্রমিক মালিক হিসেবে কোন পার্থক্য করেনি। কেননা ইসলামের দৃষ্টিতে সকল মানুষই শ্রমিক বা শ্রমজীবী। সকলের মর্যাদা এক ও অভিন্ন। এখানে আশরাফ আতরাফের ভেদাভেদ নেই। ইসলাম-পূর্বযুগে শ্রমজীবী মানুষকে মানুষ হিসেবে মূল্যায়ন করা হতো না। তাদেরকে পণ্য মনে করে পশুর ন্যায় ব্যবহার করা হতো। মাঠে-ঘাটে শ্রমিকরা যখন কাজ করতো তখন তাদের পায়ে পালানোর ভয়ে শিকল বেঁধে দেয়া হতো। কাজ-কর্মে সামান্য ভুলের জন্য চাবুক মারা হতো। এভাবে মালিকপক্ষ শ্রমিকদের সাথে পশুর ন্যায় নির্দয় আচরণ করে কাজ আদায় করতো। রাসূলের (সা) আগমনের পর তিনি এই করুন চিত্রের পরিবর্তনের জন্য একটি সমাজ বিপ্লব ঘটাতে দৃঢ় প্রত্যয়ী হন। যেখানে শ্রমজীবী মানুষের মর্যাদা রক্ষা হবে, খেটে খাওয়া মানুষের সামাজিক অধিকার নিশ্চিত হবে। তিনি আদর্শ সমাজ বিনির্মাণের যে স্বপ্ন দেখছিলেন তা অল্প সময়ের মধ্যে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাই শ্রমজীবী মানুষের মর্যাদা প্রসঙ্গে ঘোষণা করেছেন : ‘শ্রম দ্বারা উপার্জনকারী আল্লাহর বন্ধু’। (আল-হাদীস) তিনি আরো বলেছেন : ‘শ্রমিকের ঘাম শুকানোর পূর্বে তার পারিশ্রমিক দিয়ে দাও’। (ইব্ন মাজা) হযরত আবু হুরাইরা (রা) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা) বলেছেন :‘আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি শ্রমিক নিয়োগ করে মজুরি পরিশোধ করেনি, কিয়ামতের দিন আমি তার বিপক্ষে দাঁড়াবো’। (বুখারী) অন্য একটি হাদীসে এসেছে, রাসূল (সা) বলেছেন : ‘নিয়োগকারী যেন নিয়োজিত শ্রমিকের কাছ থেকে তার সামর্থ্যরে বাইরে কোন কাজ আদায় না করে। শ্রমিকের স্বাস্থ্যের ক্ষতি হতে পারে এমন কোন কাজ করতে যেন তাকে বাধ্য না করে’। (তিরমিযী) এভাবে রাসূল (সা) কারো অধীনস্থ কর্মচারীর সাথে উত্তম আচার-আচরণ ও উত্তম খাদ্য সামগ্রীর ব্যবস্থা করতেও নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন : ‘তোমরা যা খাবে তোমাদের অধীনস্থদেরও তাই খাওয়াবে। তোমরা যা পরবে তাদেরও তাই পরতে দিবে’। (আল-হাদীস) পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থায় যেখানে মালিক, শ্রমিক, মনিব চাকর সম্পর্ক সেখানে ইসলামী জীবন ব্যবস্থায় মালিক-শ্রমিক ভাই ভাই সম্পর্ক। সমাজতন্ত্রের দৃষ্টিতে যেখানে শ্রমিক শত্রু হিসেবে চিহ্নিত সেখানে ইসলামের দৃষ্টিতে শ্রমিক বন্ধু হিসেবে পরিচিত। 

 

অতএব বলা যায়, বিশ্ব সভ্যতার নির্মাতা হিসেবে পরিচিত শ্রমজীবী মানুষের কল্যাণে কিংবা তাদের যাথাযথ মর্যাদার উন্নয়নে ইসলামের নির্দেশনা অত্যন্ত সুস্পষ্ট। তাই তাদের প্রতি সৌহার্দপূর্ণ আচরণের মাধ্যমে আগামীর সুন্দর পৃথিবী উপহার দিতে সহযোগিতা ও সহমর্মিতার হাত সম্প্রসারিত করতে হবে।