সময়ের কাহন-১১ / অনুপা দেওয়ানজী

সময়ের কাহন 10

সময়ের কাহন

সময়ের কাহন-১১ / অনুপা দেওয়ানজী

মূলতানের মাটির জিনিসের সৌকর্যের কথা বইতে পড়েছিলাম। তবে মেলায় নিজের চোখে দেখে  রীতিমতো মুগ্ধ হয়ে গেলাম।

অপূর্ব সুন্দর তাদের হাতের কাজ। ইচ্ছে করছিলো অনেক কিছু কিনতে। কিন্তু অতদূর থেকে প্লেনে  আনতে গেলে ভেঙে যেতে পারে ভেবে শুধুমাত্র  মাটির  একটা ডিনার সেট কিনলাম।

 পূর্ববঙ্গে মাটির সানকির ব্যবহার থাকলেও মাটির ডিনার সেটের ব্যবহার তখনও দেখিনি।

ডিনার সেট ছাড়াও কিনলাম কাশ্মিরী কোটি,হায়দ্রাবাদি কাঁচের আর মাটির  চুড়ি, হায়দ্রাবাদি আচার, বালুচ স্যাণ্ডেল আর সাজ্জি কাবাব।

স্যুই গ্যাস যদিও একটি  বিশাল গ্যাস ফিল্ড।পাকিস্তানের বিভিন্ন জায়গার প্রচুর মানুষ সেখানে  চাকরি করতেন। তারপরেও  সে ছিলো সীমাবদ্ধ ও সংরক্ষিত এক টাউনশিপ জীবনযাত্রা।

তার মধ্যেই আমি বেলুচিস্তানকে যতটুকু দেখেছি বা জেনেছি ।

বেলুচিস্তানের সাধারণ মানুষের আভ্যন্তরীণ জীবনযাপন,তাদের ঘর সংসার, সুখ দুঃখগুলি দেখা বা জানার ইচ্ছে থাকলেও   একেবারে কাছ থেকে আমার  দেখা হয়নি।

মেলায় বিভিন্ন প্রদেশের মানুষ দেখে, তাদের পোশাক, পরিচ্ছদ আর সংস্কৃতি দেখে যেমন খুব ভালো লেগেছিলো ঠিক তেমনি  ফিল্ডের বাইরের দুজন মানুষ আমাদের বাড়িতে বেড়াতে এসেছিলেন  বলেও খুব ভালো লেগেছিলো। 

ভদ্রলোকের নাম শংকর ভাটিয়া।

 বেলুচিস্তানেই তার বাড়ি।

 ছুটির দিন ছিলো।সন্ধ্যে তখনও হয় নি।এমন সময়ে তারা এলেন।

দীর্ঘদেহী সেই ভদ্রলোকের পরণে ছিলো ধবধবে সাদা ঢিলেঢালা সালোয়ার আর লম্বা কুর্তা,মাথায় ঐতিহ্যবাহী সিন্ধি টুপি।তাঁর স্ত্রীর পরণেও সালোয়ার আর রেশমী সুতোয় অপূর্ব সুন্দর  হাতের এম্ব্রয়ডারি কাজের লম্বা ,ঢিলেঢালা বালুচ পোশাক।

আমরা তাদের  সাদর অভ্যর্থনা জানালাম।

আলাপ পরিচয়ের পরে  গল্প এমন জমে উঠলো যে কিছুতেই আর শেষ হচ্ছিলো না।

স্বামী স্ত্রী  দুজনেই এতটাই আন্তরিক ছিলেন যে , দেশ বা ভাষা সেখানে এতটুকু বাধার সৃষ্টি করছিল না।

প্রথম দিন পরিচয়ের সাথে সাথেই তাদের সাথে  হৃদ্যতার বন্ধনে আমরাও যেন বাঁধা হয়ে গেলাম।

কী নিয়ে যে তাদের সাথে আলাপ শুরু হয়েছিল তা ঠিক মনে নেই।

যতই চেষ্টা করি না কেন এই বয়সে তা তুলে আনতে গিয়েও আগের মতো পারি না।

 স্মৃতির অতল গভীরে সেসব গল্পের অনেক কিছুই হারিয়ে গেছে।

এটুকুই শুধু  মনে আছে, আমি যেমন বেলুচিস্তান সম্পর্কে জানতে আগ্রহী ছিলাম তারাও তেমনি পূর্ব পাকিস্তান  সম্পর্কে জানতে ইচ্ছুক ছিলেন। 

আলাপের এক প্রসঙ্গে ভদ্রলোক আমাদের পারিবারিক এলবাম দেখতে আগ্রহ প্রকাশ করতেই আমি এলবামটি এনে  দিলে তিনি খুব আগ্রহ নিয়ে এলবামের ছবিগুলি দেখতে শুরু করলেন। ছবি দেখতে দেখতে একসময়ে  আমাকে অত্যন্ত বিনয়ের সাথে জিজ্ঞেস করলে,ন আমার এলবাম থেকে তিনি দুটি ছবি নিতে চাইলে আমি দেবো কি না?

আমি জিজ্ঞেস করলাম কোন দুটি?

 তিনি  লাল পাড় গরদের শাড়ি পরা আর সিঁথিতে সিঁদুর দেয়া আমার মা আর বাবার  একটা যুগল ছবি আর সেইসাথে আমাদের একটা  পারিবারিক ছবি নিতে চাইলে আমি সানন্দে তাকে ছবি দুটি দিয়ে দিলাম।

 

গল্প করতে করতে অনেকটা সময় পেরিয়ে গেলো। ভদ্রলোকের স্ত্রী কিছুটা স্বল্পভাষী হলেও ভদ্রলোকের কথা আর ফুরায় না। এক সময়ে স্ত্রীর তাড়াতে তাকে উঠতেই হল।

যাওয়ার আগে পরের সপ্তাহেই তাদের বাড়িতে যাওয়ার জন্যে দুজনেই আমাদের নিমন্ত্রণ করে গেলেন।

 দেখতে দেখতে পরের  সপ্তাহ এসে গেলো।

 আমরা শংকর ভাটিয়ার বাড়িতে যাবার জন্যে  প্রস্তুত হলাম।

আমার কর্তা নিজেই ল্যান্ডরোভার চালাচ্ছিলো। মরু রাস্তা ধরে গাড়িটা ছুটছিলো।

বিশাল ফিল্ড পেরিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা তার বাড়ির কাছে এসে পড়লাম।

 বিকেল গড়িয়ে গিয়েছে বলে ধুলো তেমন উড়ছিলো না। 

 ফিল্ড থেকে খুব বেশি দূরে নয় তার বাড়ি।

বাড়ির সামনে  গাড়িটা যখন থামলো আমি তো সেই বাড়ি দেখে অবাক। এমন আজব ধরণের বাড়ি আর কখনো দেখিনি।

মনে মনে ভাবছিলাম এটা  বাড়ি নাকি মাটির বিশাল গুদাম? এই গুদামে মানুষ থাকে কি করে? বাড়ির  দরজা জানালাই বা কোথায়? 

 

খানিকক্ষণ পরে বুঝলাম বাড়িটি আসলে একটি একতলা  বাড়ি।

 তাল তাল মাটি দিয়ে যার ছাদ থেকে নিচ পর্যন্ত ঢাকা। 

আমার কর্তা বললো, শীতের সময়ে গরম আর গরমের সময়ে বাড়িকে ঠাণ্ডা রাখার জন্যে এখানে এই ব্যবস্থা করা হয়।

 বাড়িটি দেখার সাথে সাথে আমি কেন জানি দরিদ্র বেলুচবাসীদের নালার  ভিতরে বাস করার একটা অর্থ খুঁজে পেলাম।

এভাবেই হয়তো  এখানকার আদিবাসীরাও তীব্র গরম বা ঠাণ্ডার হাত থেকে নিজেদের রক্ষা করতেন।

বেলুচিস্তানে কোটিপতি লোকদের বাড়িও নাকি বাইরে থেকে দেখলে মাটির গুদামই মনে হবে। তবে ভেতরে  ঢোকার পরে সে ধারণা বেমালুম পালটে যায়।

ভদ্রলোকের ঘরে বিদ্যুতের ব্যবস্থা ছিলো না। কারণ পাক সরকার বেলুচবাসীদের  এই সুবিধাটুকু তখনও দেয়নি।

বিদ্যুৎ তো নেই এমন কি গ্যাস বা জলের সাপ্লাইও নেই।

গ্যাস ছাড়া বেলুচিস্তানে প্রচুর কয়লাও পাওয়া যায়। সেসব কয়লা অন্য প্রদেশে চলে গেলেও কয়লা তবুও কেনা যায়।

বাড়ির ভেতরে  খোলা উঠানে সেই  কয়লার আঁচেই রান্না হচ্ছিলো।  শংকর ভাটিয়ার মা নিজে  রান্নার তদারক করছিলেন।

 দুজন বেলুচ কাজের মহিলা তাকে সাহায্য করছিলো।

স্যুই গ্যাস ফিল্ড থেকেই বেলুচিস্তানের বুক জুড়ে  বিশাল বিশাল গ্যাস লাইন একটানা চলে গেছে পাকিস্তানের অন্যান্য রাজ্যে অথচ স্যুইবাসীরা সেই গ্যাস থেকে বঞ্চিত। 

 জলের সাপ্লাই নেই বলে শংকর ভাটিয়ার ঘরে একজন জলবাহক  কোন এক কুয়া থেকে চামড়ার মশক ভর্তি জল তুলে এনে বিশাল এক জালায় ঢালছিলো।

চামড়ার মশক এর আগে আমি দেখিনি।

ঘুরে ঘুরে তাঁদের বাড়িটা দেখছিলাম।

সন্ধ্যে হয়েছে তখন। উপাসনার সময় হয়েছে বলে তারা আমাদের  প্রার্থনা ঘরে নিয়ে গেলেন।

ঘরটা খুলে দিতেই দেখি ঘরের মেঝে থেকে দেয়াল আগাগোড়া সবটাই মাদুর দিয়ে মোড়া।

একটা দেয়ালে শোভা পাচ্ছে গুরু নানকের একটা বড় ছবি।

এছাড়া আর কিছুই নেই। 

 নানকের জন্ম পাকিস্তানের লাহোরে। ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে যিনি সবাইকে নিজের কাছে টেনে নিতেন, মূর্তিপূজা বা একাধিক ঈশ্বর নয়, এক ওঙ্কারে যিনি বিশ্বাস করতেন। 

আমরা প্রার্থনা ঘরে ঢুকে তার ছবির সামনে প্রণাম করলাম।

এরপর  সেখান থেকে এসে বসার ঘরে বসলাম।  

যেখানে এক কোনে  বিশাল একটা তেলের প্রদীপ থির থির করে জ্বলছে।

  মাটির  গুহার মতো আলো আঁধারে ঘেরা সেই বাড়িতে বসে মনে হচ্ছিলো যেন বহুযুগ আগে ফেলে আসা প্রাচীন কোন যুগে ফিরে গিয়েছি।

ওই বাড়ি আর ওই আলো আমাকে যেন ক্ষণে ক্ষণে  শিহরিত করছিলো। 

 গল্প করতে করতে একসময়ে খাওয়ার আহবান আসতেই  খাবার ঘরে ঢুকে দেখি সে এক বিশাল আয়োজন। 

কী নেই খাবার টেবিলে? পরোটা, আফগানিপোলাও, রুটি,কাবাব,সব্জী, মাছ,মাংস,হালুয়া,ফল স-ব। 

কিন্তু এত খাবার খাবে কে?

 

পরিবেশন করছিলেন শংকর ভাটিয়ার স্ত্রী নিজে। যতই বলি ভাবি আর দেবেন না এত খেতে পারবো না। তিনি মোটেও ছাড়বার পাত্রী নন। সামনে আবার দাঁড়িয়ে আছেন তার শাশুড়ি। 

ভদ্রলোক দেখি ভালোই  খেতে পারেন। খেতে খেতেই তিনি জিজ্ঞেস করলেন, আমরা বেলুচিস্তানে এসেছি যখন তখন শালকোটের রাজধানী কোয়েটা শহর দেখেছি কিনা?

আমি জিজ্ঞেস করলাম শালকোট?

শংকর ভাটিয়া হাসতে হাসতে বললেন  বেলুচিস্তানের আরেকটা নাম শালকোট । অবশ্য মানুষের মুখে এ নামের এখন তেমন চল নেই।

আমি বললাম, না দেখা হয়নি। তবে ইচ্ছে আছে দেখার।

তিনি বললেন,  জরুর যাইয়ে ভাবি।ন্যাচারাল সিনারির জন্যে কোয়েটাকে ক্ষুদে প্যারিস বলা হত এক সময়।

আমি বললাম, কোয়েটাকে অনেকে  ‘ফলের বাগান’ও বলে শুনেছি। 

খেতে খেতে তাকে জিজ্ঞেস করলাম,  এখানে এসে শুনেছি  বেলুচিস্তানের মানুষ  নাকি পাকিস্তান সরকারের শাসনের কোন ধার ধারে না? তাদের নিজেদের আইন আছে? সেই আইনেই তারা চলে?

 এজন্যেই কি এখানকার উন্নয়নের জন্যে পাক সরকারের কোনরকম আগ্রহ নেই?

একসাথে আমার এতগুলি  প্রশ্ন শুনে তিনি আমার দিকে এমনভাবে তাকালেন যেন সেই মুহূর্তে  ঘুমন্ত কোন আগ্নেয়গিরি ফুঁসে উঠবে।

ভদ্রলোক আফগানি রুটি ছিঁড়ে মুখে পুরতে গিয়ে রুটি ছেঁড়া বন্ধ করে ক্ষুব্ধ স্বরে বললেন, আপনে ঠিকহি শুনা ভাবিজি। মগর কিঁউ নেহি শুনতে ও নেহি শুনা?

 সেই বয়সে রাজনীতির প্রতি আমার কোনরকম আগ্রহই ছিলো না। রাজনীতি কি তা বুঝতামও না।

তবে  বেলুচিস্তানের লোকদের অবর্ণনীয় কষ্ট নিজের চোখে দেখার পরে কি কারণে  তাদের প্রতি  পাকিস্তানের এই বিমাতাসুলভ আচরণ  এটা জানবার খুব আগ্রহ ছিলো।

আমি তাকে, বললাম আপহি বাতাইয়ে ম্যায় তো ইঁহা পরদেশি হুঁ। 

ভদ্রলোক  রুটি ছিঁড়তে ছিঁড়তে বললেন

  আর্থিক উন্নয়নে যে প্রদেশটার অবদান সবচেয়ে বেশি সরকার যদি সেই প্রদেশটাকে ইচ্ছে করে অবহেলা করে তাহলে সেই প্রদেশের জনগণ  কেন পাক সরকারের শাসন বা আইন  মানতে চাইবে আপনিই বলুন?

এই কষ্ট কি তারা শুধুমাত্র বেলুচিস্তানে জন্মেছে বলেই?

আপনি নিজে যে গ্যাস ফিল্ডে আছেন সেই গ্যাস ফিল্ড থেকে পাক সরকারের সর্বোচ্চ আয় হয় অথচ বেলুচবাসী কি তার কোনরকম সুফল পায়? 

ভাবুন তো বেলুচিস্তানের বুকের ওপর দিয়েই গ্যাস লাইন চলে গেছে অন্যান্য প্রদেশে অথচ বেলুচবাসীরাই কিনা গ্যাস থেকে বঞ্চিত! 

শুধু গ্যাস না ভাবি তেল,তামা,ব্রোঞ্জ,সোনা    

প্ল্যাটিনাম,ইউরেনিয়াম সবই এই দেশের মাটির নিচে ঘুমিয়ে আছে।

অথচ প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ এই প্রদেশটিকে জাগিয়ে তোলার  জন্যে পাক সরকারের কোনরকম ইচ্ছেই নেই।

এত সম্পদ থাকার পরেও আপনি ভাবতে পারেন বেলুচিস্তানেই দারিদ্র‍র হার সবচেয়ে প্রকট?

আমি চুপ করে তার কথা শুনছি।

তিনি বললেন, আপনি যখন এখানে আছেন নিশ্চয়ই দেখেছেন এখানকার লোকদের মাটি খুঁড়ে বাস করতে? শুধু মাটি খুঁড়ে বাস নয়  একটি মাত্র পোশাককেও  তিন জেনারেশন পর্যন্ত তাদের পরতে হয়।

এত অভাব কি তাদের প্রাপ্য ? 

ভদ্রলোকের মুখের রেখাগুলিতে কষ্টের আর যন্ত্রণার যে ছাপ ফুটে উঠছিলো আমার স্মৃতিতে তা আজও ম্লান হয়নি।

 আমার উৎসুক দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে তিনি বলতে লাগলেন, শিক্ষা নেই,চাকরি নেই,স্বাস্থ্য,পুষ্টি, চিকিৎসা কিছুই বেলুচবাসির জন্যে নেই।

আছে কি জানেন? আমার চোখে চোখ রেখে তিনি স্পষ্ট স্বরে উচ্চারণ করলেন,

 আছে শুধু গৃহভৃত্যের কাজ। শুধুমাত্র  এ জন্যেই যেন বেলুচদের জন্ম হয়েছে।

আমাদের  হক মেরে  আমাদের ওপরেই ওরা  স্টিম রোলার চালাচ্ছে।

ভাবি পশুর জীবনও  এর চেয়ে ভালো।

শুধু কি গ্যাস? বেলুচিস্তানের  কয়লাও অন্য জায়গায় চলে যায়।

আমার ছোট ভাইটা কোয়েটার এক হোস্টেলে থেকে লেখাপড়া করে।

 তাদের ভূগোল বইয়ে নাকি লেখা আছে বেলুচিস্তানের কয়লা ভালো না।

ভাইটা একদিন ক্ষেপে গিয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করলো, আমাদের কয়লা ভালো না হলে মাটি খুঁড়ে তুলে নিয়ে যায় কেন?

কি উত্তর দেবো বলুন?

এমন কি বেলুচিস্তানের লোক বলে তাকে নাকি অন্য প্রদেশের ছেলেরা  বলে, তোমরা তো পাহাড়ি লোক।

সে যখন আমাকে  জিজ্ঞেস করে  আমরা যদি পাকিস্তানি হয়ে থাকি তাহলে আমাদের এক দৃষ্টিতে দেখা হয়না কেন?

আমি বললাম কিন্তু কেন এত বিদ্বেষ?

শংকর ভাটিয়া খেতে খেতে বলে চলেছেন, ভাবি এই বিদ্বেষ আজকের নয়। সেই১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই শুরু হয়েছে।  যার কোন সুরাহা আজ পর্যন্ত হয় নি। 

আর কবে যে হবে তাও ভবিষ্যতের গর্ভে।

আমি আর আমার কর্তা চুপ করে তার ক্ষোভ মেশানো কথা শুনছিলাম।

১৯৪৭সাল শুনে সালটা যেন আমার বুকেও ধাক্কা দিয়ে গেলো।

আমরাও যে ১৯৪৭ সাল থেকে জ্বলছি। 

বেলুচবাসীর মতো আমরাও তো পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকে সবক্ষেত্রেই উপেক্ষিত, নির্যাতিত, শোষিত আর বঞ্চিত হয়ে চলেছি।

আর এর প্রতিক্রিয়া হিসেবে কখনো রাষ্ট্র ভাষার আন্দোলন, কখনো স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন, কখনো জনসংখ্যাভিত্তিক আইন পরিষদ গঠনের দাবী,আবার কখনো বা অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করার দাবী সমানে জানিয়ে আসছি।

বেলুচিস্তানের মতো পূর্ব পাকিস্তানের সম্পদও তো একতরফা পাচার হয়ে শুধুমাত্র পশ্চিম পাকিস্তানকেই সমৃদ্ধ করে চলেছে। 

তবে আশার কথা, পশ্চিম পাকিস্তানে আইয়ুব শাহীর দশ বছর স্থায়ী স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে ব্যাপক গণআন্দোলন হচ্ছে যার ঢেউ এখন পূর্ব পাকিস্তানেও খুব ভালোভাবেই বইতে শুরু করেছে।

গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা আর আঞ্চলিক অর্থনৈতিক স্বাধিকারের দাবি নিয়ে গঠিত ছয় দফা কর্মসূচির প্রবক্তা শেখ মুজিবুর রহমান বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন।

অথচ আমাদের দেশ থেকে প্রায় তিন গুণ বড় বেলুচিস্তান। পাকিস্তানের এক বৃহত্তম প্রদেশ হয়েও দেশটিতে কোনরকম আন্দোলনই দানা বেঁধে উঠতে পারছে না কেন?লোক সংখ্যা কম বলেই কি?

আমি তাঁকে এই প্রশ্ন করলে তিনি উত্তর দিলেন, সেটা যত না বড় কারণ তার চেয়েও বড় কারণ হচ্ছে১৯৪৭ সালের ১৪ আর ১৫ আগষ্ট যখন পাকিস্তান আর ভারত স্বাধীনতা লাভ করলো তখন প্রায় ছয়শরও বেশি দেশীয় রাজ্য ছিলো যারা চাইলে পাকিস্তান বা ভারতের সাথে যুক্ত না হয়েও স্বাধীন থাকতে পারতো কিন্তু তারা তা করেনি।

এইবার আমি খুব আগ্রহ নিয়ে তাঁর কথায় নড়েচড়ে বসলাম।

শংকর ভাটিয়া বললেন, ভাবি এই সব দেশীয় রাজ্যের মধ্যে বেলুচিস্তানও ছিলো।

কালাত,মাকরান,লাসভেলা আর খারান নামে ছিলো  তার চারটা করদ রাজ্য। 

কালাতই হল বেলুচিস্তান। 

পাকিস্তান সৃষ্টির পর  কালাত চুক্তি নামে একটা চুক্তির মাধ্যমে বেলুচিস্তানের শাসকরা পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়। 

এই চুক্তির শর্ত ছিলো  প্রতিরক্ষা,অর্থনীতি আর পররাষ্ট্রনীতি ছাড়া বাকি সব ক্ষমতা বেলুচিস্তানের হাতেই থাকবে।

৪৮ সালে জিন্নাহ্ র সাথে সেই চুক্তি হবার পরে পাকিস্তানের শাসকরা সেই চুক্তি  মানার কথা দূরে থাক উল্টো সেনাবাহিনী পাঠিয়ে বেলুচিস্তানের আরও অনেক অঞ্চল দখল করে নেয়।

পাকিস্তান যখন  চুক্তির অবমাননা করে এই নাশকতামূলক ঘটনা ঘটালো  কালাতও তখন কিছুতেই বেলুচিস্তানের সাথে আর থাকতে চাইলো না। 

তারাও আগের মতোই আবার  নিজেদের স্বাধীন বলে ঘোষণা দিলো।

 জিন্নাহ  তাদের বোঝাবার চেষ্টা করে যখন ব্যর্থ হলেন তখন ১৯৪৮ সালের মার্চ মাসে নিজেই   কালাতকে তার অধীনস্থ হিসেবে ঘোষণা দিয়ে  এপ্রিলে তাদের ওপরে  সামরিক অভিযান শুরু করে দিলেন।

শুরু হল তখন কালাতের সাথে পাকিস্তানের যুদ্ধ। এই যুদ্ধে কালাত হেরে যায়।

যুদ্ধে হেরে গেলে কালাতের খান ইয়ার পাক সরকারের সাথে সন্ধি চুক্তি করলেও তার অন্য দুই ভাই করিম বালুচ আর রহিম বালুচ  কিছুতেই তা মানলেন না।তারা পাক সেনার ওপরে আক্রমণ চালিয়ে যেতে থাকেন।আর পাকিস্তানও তাদের ওপরে শোষণ চালাতেই থাকলো।

কোথায় বালুচ নেতাদের স্বপ্ন ছিলো এই চারটি রাজ্য নিয়ে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন করবে তা নয়।

১৯৫৮ সালে তাতে ঘৃতাহুতি দিয়ে আইয়ুব খান সামরিক শাসন জারির আগেই রাষ্ট্রের ক্ষমতা নিজের হাতে নিয়ে কালাতে সেনা অভিযান শুরু করলেন।

এতে করে বালুচরাও  তাদের রাজনৈতিক কৌশল পালটে কঠোর অবস্থান নিতে বাধ্য হল।

ভদ্রলোকের কথা বলার ভঙ্গিতে এমন একটা উদ্দীপনা  ছিলো আমরা মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনছিলাম।

শুরু হয়ে গেল অসহযোগ আন্দোলন। 

বালুচদের এই অবস্থানের কারণে সেনাবাহিনী তখন করিম বালুচ ও তার অনুসারীদের বিরুদ্ধে গোপন ষড়যন্ত্রের অভিযোগ আনে।

যার ফলে বিদ্রোহ দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। 

বেলুচিস্তানের একেবারে গহীনে সেনাবাহিনী তখন একটি নতুন গ্যারিসন স্থাপন করলো। 

 বালুচরাও বসে নেই।তাদের গেরিলারাও তখন যানবাহন বা ট্রেনে বোমা ছুঁড়ে  গুপ্ত হামলা চালাতে আরম্ভ করলো।

এর জবাব দিতে  টিক্কা খান নামে এমন এক ব্রিগেডিয়ার জেনারেলকে পাঠানো হল। যার নিষ্ঠুরতার কোন নজির নেই। সে এসেই এমন নৃশংস অভিযান শুরু করলো যেজন্যে তাকে বেলুচিস্তানের কসাই নামে ডাকা হয়।

 ইয়াহিয়া খান আসার পরে বালুচরা এই যুদ্ধ বিরতিতে সম্মত হলেও বিদ্রোহ কিন্তু থামেনি।

স্বাধীনচেতা বেলুচ জাতির তীব্র অহংবোধ আর অদম্য সাহসিকতার জন্যে পাক সরকারের পক্ষে কখনও বেলুচিস্তানকে শাসন করা সম্ভব না ভাবি।বেলুচরা স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত এই বিদ্রোহ থামার নয়, থামবে না।

সামনেই তো নির্বাচন।এই নির্বাচনে বেলুচিস্তান থেকে ভুট্টো একটিও ভোট পাবে না বলে রাখলাম।

নির্বাচনের পরে আমার কথাটি মিলিয়ে নেবেন।

অনেকক্ষন রাজনীতির কচকচানিতে ঘরের আবহাওয়া একটু গুমোট হয়ে পড়েছিলো । শংকর ভাটিয়ার মা  তাই প্রসঙ্গ  পাল্টাবার জন্যে  আমাদের  জিজ্ঞেস করলেন, “আপলোক মাকরানমে মাতাজি কা মন্দির দর্শন মে নেহি গিয়া?”

আমার কর্তা জিজ্ঞেস করলেন,” মাতাজি কা মন্দির?  নেহি তো? ও কাঁহা পর?”

-কিঁউ হিংলাজ পর?

আমার কর্তা বললেন,” হাঁ শুনেছি হিংলাজ এই বেলুচিস্তানের কোন এক জায়গায়। কিন্তু মন্দিরের জায়গাটা ঠিক কোথায় জানি না। 

হিংলাজের নাম শুনে আমি চমকে উঠলাম। বিশিষ্ট লেখক কালিকানন্দ অবধূতের লেখা বিখ্যাত বই “মরুতীর্থ হিংলাজ” বইটি আমি মুগ্ধ হয়ে পড়েছি। অপূর্ব লেগেছিলো।না পড়লে হিংলাজ সম্পর্কে জানতামই না। 

পরে সিনেমাতেও দেখেছি।

মানসচক্ষে কেন জানি থিরুমলের উষ্ণ জলের কূয়ার ভেতরে ডুবে যাবার দৃশ্যটা হঠাৎ ভেসে উঠলো।

হিংলাজ এখানেই? আর আমি তা জানতেও পারিনি?

শংকর ভাটিয়া আমাদের উৎসাহ দেখে বললেন, চলিয়ে ম্যায় আপলোগোকো হিংলাজ মাতাজি কা মন্দির দর্শন  মে লে যাউংগা।

আমাদের খাওয়া শেষ হয়ে গিয়েছিলো। এই সময়ে ভাবি হাতে ধরিয়ে দিলেন ক্ষীর আর গাজরের হালুয়া। 

সে হালুয়া ছিলো খাঁটি দেশি ঘি,পেস্তা,বাদাম, দুধ আর ক্ষোয়া ক্ষীরে কষায়িত। 

আমি ভেবেছিলাম এসব আবার ছাগলের দুধ দিয়ে তৈরী না তো?

এক চামচ মুখে তুলে দেখি না।গরুর দুধ দিয়েই বানানো।

অপূর্ব তার স্বাদ।

কথায় কথায়  তখন বেশ রাত হয়ে গেছে।কর্তার আবার পরদিন সকালেই অফিসে দৌড়াতে হবে।কাজেই গল্প করার ইচ্ছে থাকলেও তাদের কাছ থেকে বিদায় নেবার অনুমতি চাইলাম।

আমি যাবার সময়ে ভাবির জন্যে কী নেবো ভেবে ভেবে অবশেষে আমার সুটকেশ খুলে একখানা জামদানী শাড়ি নিয়ে গিয়েছিলাম।ভাবির হাতে শাড়িটি তুলে দিতেই তিনি শাড়িটা দেখে  ভারি খুশি হয়ে বললেন, ঢাকার জামদানী আর গালা দেয়া সোনার বালা খুব প্রসিদ্ধ তিনি জানেন। 

আমি বললাম,  ঠিক আছে আমি ছুটিতে গেলে আপনার জন্যে ঢাকার গালা দেয়া একজোড়া সোনার বালা নিয়ে আসবো।

আসবার আগে পরের সপ্তাহের ছুটিতে  তাদের নিমন্ত্রণ করে এলাম।

ফেরার পথে গাড়িতে বসে আমি আমার কর্তাকে বললাম, হিংলাজ মন্দির যে এখানে তুমি তা এতদিন আমাকে বলোনি কেন?

আমার কর্তা বললো,  আমি অনেককেই জিজ্ঞেস করেছি কিন্তু মন্দিরটা ঠিক কোন জায়গায় তা ঠিক বলতে পারে নি।

আমি বললাম তাতে কি? আমরা হিংলাজ চলে গেলেই পারতাম।তারপর সেখানকার লোককে জিজ্ঞেস করলেই তারা দেখিয়ে দিতো। 

সে হাসতে হাসতে বললো,  তুমি যত সহজে বলে ফেললে ব্যাপারটা মোটেই অত সোজা নয়। মাকরানের  দুর্গম  পাথুরে পাহাড়ের এক গুহার ভেতরে ওই মন্দির। শুনেছি সেই গুহায় নাকি হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকতে হয়।

দুর্গম সেই  পাহাড়ে কান্ডি ছাড়া তুমি যেতেই পারবে না।পরিচিত কাউকে না নিয়ে সেখানে ওভাবে যাওয়াটাও ঠিক হবে না।

আমি বললাম, আমাদের প্রতিবেশী খাজা সাহেবের যে ছোট্ট ছেলেটা আমাদের বাসায় খেলতে আসে তাকে তুমি দেখেছো?

আমার কর্তা বললো, দেখেছি। কেন বলতো?

সবাই বলাবলি করে ছেলেটা নাকি খাজা সাহেবের নিজের ছেলে নয়। চুল দেখলেই বোঝা যায় ছেলেটা মাকরানের।খাজা সাহেব আর তাঁর স্ত্রী তো পাঞ্জাবের লোক।

আমার কর্তা বললো, ছেলেটার চুল কেমন তাতো লক্ষ্য করিনি? 

– অনেকটা ব্ল্যাক আমেরিকানদের মতোই কোঁকড়া চুল।

মাকরানিদের চুল নাকি খুব কোঁকড়া হয়।

আজ মাকরান নামের জায়গাটার কথা শুনে মনে হল তাই বললাম।

আমার কর্তা বললো শুধু জন্ম দিলেই কি মা?  মানুষ করে তুলতে পারাটাও কি কম? 

 বাংলোর কুল গাছে কুল পাকতে শুরু করেছে।এখানকার গাছ উচ্চতায় খুব একটা বাড়ে না বলে গাছটা উচ্চতায় না বাড়লেও খুব ঝোপালো। 

কুলগুলি  আমাদের ঢাকাই কুলের মতোই বড় বড়। স্বাদও একই রকম।আমার মেয়ে একটা চেয়ারে দাঁড়িয়ে সেই কুল একটা একটা করে ছেঁড়ে আর খিল খিল করে হাসে।

আশেপাশের বাচ্চারা খেলতে এলে আমি তাদের নিজ হাতে কুল পেড়ে তাদের কোঁচড় ভর্তি করে দিই।

শীতের সময়ে স্যুই ফিল্ডে সিনেমা দেখতে যাওয়ার সময়ে অনেকেই পাতলা কম্বল সাথে করে নিয়ে যেতো।বিশাল এক খোলা অডিটোরিয়ামে সিনেমা দেখার স্থান ছিলো।

 কর্মীদের গ্যালারিতে অন্তত একসাথে দুইশ কর্মীর বসার জায়গা ছিলো।কর্মকর্তাদের জন্যে ছিলো বিলাসবহুল স্থান।সেই সাথে ছিলো চা,কফি,কোল্ড ড্রিংক,আইসক্রিম,সমোসা ইত্যাদির ব্যবস্থা। 

 

আমি সিনেমা দেখতে গেলে মেহমুদাও আমার সাথে যেতো।ভাবি কখনোই সিনেমা দেখতেন না।

 এক শীতের রাতে কম্বল টম্বল নিয়ে আমি আর মেহমুদা সিনেমা দেখতে গেছি।কর্তা তখন অফিসের  কাজে করাচি গেছেন।

সিনেমার নামটা ঠিক মনে নেই। ঘটনার এক জায়গায় নায়কের পিতার মারা যাবার দৃশ্য দেখে আমার মেয়ে তো হাউ মাউ করে কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি তুলে আর থামে না। যতই তাকে বোঝাই যে,এটা সিনেমা।

 ছবিতে যা দেখানো হচ্ছে তা সত্যি নয়। কিন্তু মেয়ের কান্না কিছুতেই থামে না। অগত্যা আমি আর মেহমুদা সিনেমা ছেড়ে কম্বল টম্বল নিয়ে আবার ঘরের পথ ধরলাম।

বিদায় নেবার সময়ে তাকে বললাম, কাল আমি সন্দেশ বানাবো। আমার ছাঁচগুলি আরিফের হাত দিয়ে একটু পাঠিয়ে দিও।

আরিফ মেহমুদার ছোট ভাই। বয়েস আট কি নয় হবে।

মেহমুদা বললো, জরুর আন্টি।

একটু পরেই আরিফ যখন আমাকে এসে জিজ্ঞেস করলো,” আন্টি আপ নে বাজিকো (বড় বোন)  মিট্টি কো যো চিজ দিয়িথি ও আপকো এক চাইয়ে না দোনাহি চাইয়ে?

আমি একটু অবাক হয়ে বললাম,” এক সে তো মেরা কাম নেহি বনেগি।বাজিকো যাকে বোলো মুঝে দোনোহি চাইয়ে “

আরিফ তখন আমাকে বললো,”আন্টি এক তো তোর(ভেঙ্গে) গিয়া।”

এই বলে সে একটা আস্ত ছাঁচ আর আরেকটা  ছাঁচ দু’টুকরো অবস্থায় আমার হাতে দিয়ে দৌড়ে পালিয়ে গেলো।

 

চলবে

অনুপা দেওয়ানজী 
অনুপা দেওয়ানজী