সময়ের কাহন -১২/ অনুপা দেওয়ানজী

সময়ের কাহন 10

সময়ের কাহন

ধারাবাহিক স্মৃতিগদ্য

সময়ের কাহন -১২/ অনুপা দেওয়ানজী

 

কিছুক্ষণ পরে  মেহমুদা এসে দেখে আমি সন্দেশ বানাচ্ছি। সে আমাকে জিজ্ঞেস করলো, আন্টি আজ আপনে এক তরফ কিঁউ ডিজাইন রাখা? দুসরি তরফ খালি কিঁউ?

আমি তাকে ভাঙা সন্দেশের ছাঁচটা দেখিয়ে বললাম ভাঙাটা দিয়ে করা যাবে না।

মেহমুদা বললো, হায় ক্যায়সে টুটা আন্টি?

আমি বললাম, আরিফ তো ভাঙাটাই দিলো।বোধহয় আনার সময়ে হাত থেকে পড়ে ভেঙে গেছে।

মেহমুদা বললো, আন্টি আমি ওকে বারবার বলেছি, তোড় না নেহি। কাগজ দিয়ে মুড়িয়েও দিয়েছি এজন্যে। এরপর আরিফকে ডেকে ধমক দিয়ে  জিজ্ঞেস করলো, ছাঁচটা কি করে ভাঙলো এটা যদি সে স্বীকার না করে তাহলে মার খাবে।

আরিফ মারের ভয়ে স্বীকার করলো যে সে দেখতে চেয়েছে ওটা সত্যি সত্যি ভাঙে কিনা?

আমি তো তার কথা শুনে হাসতে হাসতে শেষ। 

বুদ্ধিমান ছেলেই বটে। নিষেধ না করলে সে হয়তো এই পরীক্ষাটা করতো না।

 শীত ক্রমশ জাঁকিয়ে পড়তে শুরু করেছে। মাঝে মাঝে এতই ঠাণ্ডা পড়ে যে, কলের মুখে পাতলা বরফ জমে যায়। এমন কী  সকালে গাড়িও স্টার্ট নিতে চায় না। বাথরুমের বিশাল ড্রামের  নিচে গ্যাসের নিবু নিবু আঁচে সারাক্ষণ জল গরম হতে থাকে।  রুমহিটার চালিয়ে রাখতে হয়।

সেই ঠাণ্ডার মধ্যেই আমার কর্তা তিন চারদিনের জন্যে  অফিসের কাজে গেছে করাচিতে। তোফাজ্জল সাহেবও নেই। কিছুদিন ধরে তিনিও লাহোরে। বাড়িতে আমি একা বলে মেহমুদা আর তার ছোট বোন সুরাইয়া আমার সাথে থাকে। রিনা ভাবি বলেছিলেন তাঁর বাসায় থাকতে। আমি যাইনি বলে ফোনেই রোজ খবর নেন।

এক সকালে ফোনেই ভাবির কাছে শুনলাম ফিল্ডের একটা বাচ্চার নাকি হঠাৎ শরীর খুব খারাপ হয়ে পড়েছে । ডাঃ সাথে সাথে গাড়িতে স্টার্টও দিয়েছিলেন যাবার জন্যে। কিন্তু প্রচণ্ড  ঠাণ্ডার জন্যে কিছুতেই  তাঁর গাড়ি স্টার্ট নিচ্ছিলো না। অনেক কষ্টের পরে  যখন স্টার্ট নিলো তখন তিনি গিয়ে দেখেন  বাচ্চাটা মারা গিয়েছে।

খবরটা শুনে খুব মন খারাপ হয়ে গিয়েছিলো।  মেয়েকে নিয়ে একা থাকার সাহসটা কেমন জানি চুপসে গেলো।  দুদিন পরেই মেয়ের বাবা ফিরে আসলে সেই ভয় কিছুটা  কেটে গেলো।

ক্রচস্টিচের কাজ শুরু করেছি আমি আর মেহমুদা। উর্দু বলতে পারলেও লিখতে জানি না বলে সে ডাকে চিঠি পাঠিয়ে আমার জন্যে  জি,এম,সি র ফুল সেট আনিয়ে দিয়েছে। সেখান থেকেই ডিজাইন তুলছিলাম। মেহমুদা গল্প করছিলো তাদের গ্রামের একটা লোকের নাকি বয়সের গাছপাথর নেই।লোকটার বয়স কতো সে নিজেও জানে না। দাঁত পড়ে গিয়েছে সেই ক-বে। চুলগুলিও ধবধবে সাদা। হঠাৎ করে সেই সাদা চুলে নাকি কালো কালো ছাপ দেখা যাচ্ছে আর দু একটা দাঁতও উঠতে শুরু করেছে।

আমি তো শুনে অবাক! বললাম, এমন ঘটনার কথা আমি আর শুনিনি। এও সম্ভব নাকি?

গল্প করতে করতেই এক সময় দেখি রোদ এসে পড়েছে  বারান্দায়। আমি সেলাই রেখে বারান্দায় এসে  দাঁড়ালাম। ভেড়ার পশম দিয়ে হাতে বানানো উলের লম্বা জোব্বা পরে সেই শীতের মধ্যে বুড়ো মালি দেখি  এক বালতি লাল রঙ নিয়ে চলেছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, অত রঙ দিয়ে কী হবে?  মালি হাসতে হাসতে উত্তর দিলো, রঙ নেহি মেমসাব ইয়ে তো লোহু। কসাইখানাসে লে আয়া।

রক্ত শুনে আমি হাঁ করে তাকিয়ে রইলাম। তাও কি না এক বালতি?এত রক্ত কিসের জন্যে?

আমার হাঁ করা মুখের দিকে তাকিয়ে সে বললো, আঙুরকা পদাকা লিয়ে লায়া মেমসাব। এই বলে আঙুরগাছের গোড়ায় রক্তগুলি ঢেলে দিলো।

মালি বললো এতে নাকি আঙুর মিষ্টি হয়। 

মেহমুদা আর সুরাইয়া আমার বাসায় আছে। আরিফেরও তাই নিজের বাসায় আর থাকতে ইচ্ছে করে না।সকাল হলেই সেও আমাদের বাসায় চলে আসে। এসেই আমার মেয়েকে প্লাস্টিকের খেলনা নিয়ে খেলতে দেখে সে বড়দের মতো  আমাকে উপদেশ দেয়, বেবীকো প্লাক্সিটকা চিজ মাত দিজিয়ে। প্লাক্সিট আচ্ছা নেহি হোতে আন্টি।

কখনও আবার বলে,  তাদের বাসায় নাকি অনেকগুলি চড়ুইপাখি পাখি আসে। তার মধ্যে একটা চড়ুই পাখি এত বেশি ভাল যে আমি দেখলে অবাক হয়ে যাবো।

আমি জিজ্ঞেস করলাম,  কি রকম ভালো? 

সে উত্তর দিলো, অন্য চড়ুইরা যখন মারামারি করে বা খেলতে থাকে সেই পাখিটা তখন অজু করে।

আরিফের সাথে গল্প করতে আমার নিজেরও ভারি মজা লাগে। বানিয়ে বানিয়ে সে যে কত কিছু বলে।

   আমার কর্তা করাচি থেকে ফিরে আসলে তার বস নাদিম শেখ আর তাঁর স্ত্রী তাদের আড়াই বছরের ফুটফুটে  ছেলেটাকে কোলে নিয়ে আমাদের কোয়ার্টারে  বেড়াতে এলেন। দুজনেই আমাদের খুব পছন্দ করতেন। মাঝে মাঝেই আসেন। তবে সেদিন এসেছিলেন আমার কর্তাকে নয় আমাকে দাওয়াত দিতে। ভাবি আমাকে বললেন, “আগামী কাল আমার বাসায় একটা ধর্মীয় অনুষ্ঠান আছে। শুধুমাত্র মহিলারাই আসবেন।কোরান শরীফ পড়বে সবাই। আপকো  যানা পড়েগা ভাবী “

আমি বললাম, ভাবী ধর্মীয় অনুষ্ঠানের আমি তো কিছুই বুঝবো না। কোরান শরীফও কিছুই বুঝবো না। ওখানে আমি গিয়ে কী করবো?

ভাবী বললেন,” আপ আ তো যাইয়ে জি।”

কর্তার বসের স্ত্রী।  কি করে না বলি।বুঝলাম আমাকে যেতেই হবে।

পরদিন সন্ধ্যের সময়ে তাদের বিলাসবহুল কোয়ার্টারে গিয়ে  দেখি একটা ঘরকে সম্পূর্ণ খালি করে গালিচা দিয়ে মুড়ে দেয়া হয়েছে। ঘরটাতে দামী আগরের সুবাস বইছে। ঘরের ঠিক  মাঝখানে খুব পাতলা পাতলা অনেকগুলি বই উঁচু করে জড়ো করে রাখা। আমন্ত্রিত মহিলারা সবাই মাথায় কাপড় দিয়ে গোল হয়ে বসে আছেন। গম্ভীর, পবিত্র একটা পরিবেশ।ভাবী আমাকে দেখে তাদের সাথে বসালেন। আমি তাদের দেখাদেখি চুপচাপ বসে রইলাম ।একসময়ে দেখি সবাই সেই বইগুলি একটা একটা করে হাতে নিয়ে গভীর ভক্তি আর মনযোগ দিয়ে চুপচাপ পড়তে শুরু করলেন। নাদিম ভাবী একটা বই আমার হাতেও তুলে দিলেন। আমি বইটা হাতে নিয়ে খুব মৃদু স্বরে বললাম,” ভাবী ইয়ে তো মুঝে পড়না নেহি আয়েগি। ভাবী বললেন কোই বাত নেহি।,”পড়তে হবে না।আপনি  হাতে নিয়ে বসে থাকলেই হবে।

এ কথার পরে আর কথা চলে না।

আমি বইটা হাতে নিয়ে চুপচাপ বসে রইলাম। 

সবাই আমার চারপাশে পড়ছে। ওদের সবার ভিড়ে নিজেকে তখন কেমন জানি একটা গণ্ডমূর্খ বলে মনে হচ্ছিলো। মনে মনে অনুভব করছিলাম পড়তে না জানা মানুষদের কথা। তবে চুপচাপ বসে থাকলেও  আমার  অবাক লেগেছিলো সেদিনের সেই ধর্মীয়  অনুষ্ঠানে আমার হাতে শাঁখা আর কপালে সিঁদুর দেখেও কেউ এতটুকু অবাক হলো না দেখে।

এটা শুধু পাকিস্তান নয়, আমার  মাতৃভূমিতেও আমি ঘুণাক্ষরে ভাবতে পারি না। আর বর্তমান পরিস্থিতিতে তো তা কল্পনাই করা যায় না।

 

 একসময়ে  কোরান শরীফ পড়া শেষ হলে  সবাই মিলে খুব আনন্দের সাথে চায়ের টেবিলে বসে পরোটা,কাবাব, পাকোড়া,দইবড়া, আলুছোলা,ফিরনি,পুডিং, রায়তা এসব খেতে খেতে গল্প করতে লাগলো।

বিশাল স্যুই ফিল্ডে আমি আর আমার কর্তাই একমাত্র সনাতন ধর্মাবলম্বী ছিলাম। কখনোই কোন রকম অসুবিধা অনুভব করিনি। সবার কাছ থেকেই আমরা সৌহার্দ্যপূর্ণ ব্যবহার পেয়েছি। কিন্তু  এর কিছুদিন পরেই যে এক মহাবিস্ময়  আমাদের জন্যে ওৎ পেতে বসেছিলো তা কে জানতো?

(চলবে)

অনুপা দেওয়ানজী 
অনুপা দেওয়ানজী