সময়ের কাহন – ১৪/ অনুপা দেওয়ানজী

সময়ের কাহন 10

সময়ের কাহন

ধারাবাহিক স্মৃতিকথা

সময়ের কাহন – ১৪/ অনুপা দেওয়ানজী

 

আমাদের পরিবারে এক ঝলক আনন্দ দেবার জন্যেই বুঝি তিনি এসেছিলেন। পরলোক বলে কিছু আছে কিনা জানি না,  যদি সত্যিই থেকে থাকে আমার ভাইটি যেন সুখে থাকে সেখানে! 

 

শংকর ভাটিয়ার মৃত্যুর পরে মনটা কেমন জানি উদাস হয়ে থাকে। এত ভালো একটা মানুষ এত তাড়াতাড়ি এমন করে সবাইকে কাঁদিয়ে চলে যাবেন কে ভেবেছিলো?

 

হিংলাজ যাবো বলে আমার মেয়ের খরগোশটা মেহমুদাদের বাসায় রেখে গিয়েছিলাম। ওটাকে ঘরে আনা হয়নি। আরিফ কিছুতেই ওটাকে ছাড়তে চাইছে না।এদিকে আমার মেয়ের তার খরগোশটা চাই।

আমি তাই আরিফকে বুঝিয়ে সুজিয়ে ওটা আনার জন্যে মেহমুদাদের বাসায় গেলাম।

গিয়ে দেখি ভাবি  ব্যাসনের ব্যাটারে ডুবিয়ে ডুবিয়ে  রুপচাঁদা মাছের টুকরো ভাজছেন । ভাজতে ভাজতেই আমাকে দু’টুকরো রসোরার আচার দিয়ে খেতে দিয়ে বললেন,” খেয়ে বলতো তোমাদের মতো মাছ ভাজা হল কিনা”?

আমি খেতে খেতে বললাম,  ভালো হয়েছে ভাবি।  তবে আমরা বেসনে কাঁচামাছ ডুবিয়ে ভাজার চেয়েও তেলে সরাসরি  মাছ ভেজে খেতে ভালোবাসি।

ভাবি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “বেসন না দেনে সে মছলি টুটতি নেহি”?

আমি বললাম, টুটেগি কিঁউ ভাবি?

ভাবি বললেন,” আচ্ছা! তো ফির মুঝে তো ও শিখনা চাইয়ে”।

আমি বললাম,  দিন এখুনি শিখিয়ে দিচ্ছি।

এই বলে তাকে সেই মাছের টুকরাই বেসন ছাড়া তেলে ভেজে দেখিয়ে দিলাম।

ভাবী তো দারুণ খুশি।

মাছ ভাজা হয়ে গেলে তিনি  পাঞ্জাবি নিয়মে মাংস চড়াতে বসলেন।

তাকিয়ে দেখি একটা হাঁড়িতে মাংসের টুকরোর সাথে  আস্ত পেঁয়াজ, রসুনের আস্ত কোয়া, আস্ত শুকনো লঙ্কা, আদা কুঁচি, আস্ত জিরে,ধনে,আস্ত গরম মশলা, আস্ত ট্যোমাটো , তেজপাতা, লবণ, হলুদ, দই আর সামান্য গরম জল দিয়ে উনুনে চড়িয়ে দিলেন।

আমি জিজ্ঞেস করলাম,  আপকি গোশ এয়সেই পাক যায়েগি?

ভাবি বললেন, থোরি এয়সে পাকেগি।

এরপর শুনলাম ওই মাংস রাতে খাবার জন্যে।

মাংশটা  ঢিমে আঁচে চার পাঁচ ঘন্টা থাকার পরে ভালোভাবে যখন সেদ্ধ হয়ে যাবে তখন ঘি দিয়ে কিছুক্ষণ কষিয়ে কাঁচা লংকা আর শাহী গরমমসলার গুঁড়ো দিয়ে নামানো হবে।

রান্নার প্রণালীটি আমার ভালোই লাগলো। 

 

আরিফ বাসায় নেই। খেলতে গেছে। এই সুযোগে ভাবি খরগোশটা আমার হাতে দিয়ে দিলেন।

বাসায় আনতেই আমার মেয়ে  খরগোশটা ফিরে পেয়ে তাকে বুকে জড়িয়ে ধরলো।

 

নূতন বাংলোর ন্যাড়া বাগানে এসে দাঁড়ালে মনটা কেমন জানি উদাস হয়ে যায়। যতদূর দৃষ্টি যায় ততদূর পর্যন্ত ধু ধু এক বিস্তীর্ণ অঞ্চল। না জানি এর শেষ কোথায়? 

সেদিকে তাকিয়ে যখন আমাদের দেশের সবুজ শ্যামল রূপটি মনে পড়ে তখন ভাবি, কী বিচিত্রই না আমাদের এই পৃথিবী। কোথাও রুক্ষ মরুভূমি, কোথাও সবুজ লাবণ্য,, কোথাও বিস্তীর্ণ সমভূমি, কোথাও থমকে দাঁড়িয়ে থাকা পাহাড়,কোথাও বরফের মুকুট মাথায় পর্বতের সারি, কোথাও আবার বিপুল জলরাশি নিয়ে ছুটে চলেছে নদ- নদী, সাগর, মহাসাগর। 

আবহাওয়াতেই কী কম বৈচিত্র্য! কোথাও প্রচণ্ড খরবায়ু, কোথাও তুষারবৃষ্টি ,কোথাও তীব্র ঠাণ্ডা আবার কোথাও  অফুরন্ত বৃষ্টিধারা।

তবে ওই ধু ধু প্রান্তরের দিকে তাকালেই আমার মনে হয় ছয়টি ঋতুর ডালির সম্ভারে আমাদের দেশের চেয়ে সুন্দর দেশ আর একটিও নেই।

সাধে কি আর কবি বলেছেন

” এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি

সকল দেশের রাণী সে যে আমার জন্মভূমি। “

 

কতদিন যে হয়ে গেলো জন্মভূমি দেখি না। মাঝে মাঝে মনে হয় নিজের দেশকে ভুলে যাচ্ছি।  কতদিন হয়ে গেলো বাংলার রূপ দেখি না,শিউলিফুলের গন্ধ নিই না,পথের ধারে,সোনালু,জারুল আর কৃষ্ণচূড়ার পাপড়ি ঝরে পড়া  দেখি না,  নদী দেখি না,গ্রাম দেখি না, বাংলার মায়েদের গৃহস্থালির শান্ত লক্ষীরূপ দেখি না,মাকে দেখি না,ভাইবোনকে দেখি না,দেশের মানুষ দেখি না!

জন্মভূমির  জন্যে এমন আকুল অনুভূতি বুঝি জন্মভূমি  ছেড়ে  না আসলে কখনোই বুঝতে পারতাম না।

মাঝে মাঝেই তাই মনটা উদাস হচ্ছিলো সেইসাথে  শরীরটাও কেমন জানি দুর্বল লাগছিলো। তাই ডাঃ মতলুবের কাছে গেলাম। তিনি আমাকে পরীক্ষা করে বললেন, ভাবি স্যুইমিং পুলে গিয়ে আপনার আর ঝাঁপাঝাপি চলবে না। আপনার মেয়ের খেলার সাথী আসছে।

 আমার মেয়ে খরগোশ ছাড়াও একটা বেবী এলিফ্যান্ট পুতুল নিয়ে সারাক্ষণ খেলে। পুতুলটা ছাড়া সে খায় না, ঘুমায় না। কেউ জিজ্ঞেস করলে বলে, এটা আমার ভাই।

শিশুদের মনের কথা বুঝি বিধাতাই আগে টের পান। বন্ধ হয়ে গেলো আমার সুইমিং পুলে গিয়ে সাঁতার কাটা, বাতিল হয়ে গেলো হিংলাজ ছাড়াও মহেঞ্জোদারো, লাহোর, কোয়েটা,ইসলামাবাদ, মারী বেড়াতে যাবার পরিকল্পনা। আমার কর্তা বললো,  এই সময়ে ঘোরাঘুরি তোমার জন্যে ঠিক না। আমি পরে তোমাকে নিয়ে যাবো।

 

কোথাও আর তেমন যাই  না।এর মধ্যেই একদিন শুনি তোফাজ্জল সাহেবকেও সিলেটে বদলি করা হয়েছে।

পুরো স্যুই ফিল্ডে বাঙালি বলতে আমরা আর রিনাভাবিরা ছাড়া আর কেউ নেই।

ইদানীং আমরা দুই পরিবার একসাথে হলেই দেশের রাজনীতি কোন দিকে গড়াচ্ছে তা নিয়েই বেশির ভাগ কথা হয়।এ নিয়ে আমাদের আগ্রহের আর শেষ নেই।

এমনি এক সান্ধ্য আড্ডা হচ্ছিলো ডাঃ মতলুবের বাসার লনে।

রাত তখন প্রায় নটা। আমরা উঠবো উঠবো করছি এমন সময় হঠাৎ গাড়ির আওয়াজ শুনে তাকিয়ে দেখি ফিল্ডের গাড়ি নয়,  একটা আর্মির গাড়ি এসে দাঁড়িয়েছে

গাড়ি থেকে নেমে মার্চের ভঙ্গিতে পা ফেলে এগিয়ে সামরিক পোশাক পরা একজন তরুণ মেজর এগিয়ে এসেই পরিচয় দিলেন তিনি আর্মির ডাক্তার। সবেমাত্র ইসলামাবাদ থেকে বদলি হয়ে স্যুইতে এসেছেন।

এই প্রথম তার স্যুইতে আসা।এসেই শুনেছেন এই ফিল্ডে কয়েকজন বাঙালি আছেন। কিন্তু তাদের সাথে আলাপ করার সময় করে উঠতে পারেন নি।

আজ ডিউটি শেষে এই পথ দিয়ে ফিরে যাওয়ার সময়ে কানে হঠাৎ বাংলা কথা এসে ধাক্কা দিলে তিনি আর থাকতে পারেন নি। গাড়ি থেকে নেমেই তাই সোজা চলে এসেছেন।

এতদিন পরে তার নামটা কিছুতেই মনে করতে পারছি না।

তবে এটুকু মনে আছে, আমাদের মধ্যে আরেকজন বাঙালিকে পেয়ে আমরা যে শুধু খুশি হয়েছিলাম তা নয়, তার কাছ থেকে বর্তমান রাজনীতি কোনদিকে গড়াচ্ছে,সামরিক প্রতিক্রিয়াই বা কী তাও হয়তো জানা যাবে তাই সবাই খুব আগ্রহ নিয়ে তার কাছে এসব নিয়ে আলাপ করতে চাইলে দেখলাম ভদ্রলোক সামরিক বাহিনীতে চাকরি করলেও পশ্চিমা শাসকদের ওপরে  নিজেই ভীষণ ক্ষুব্ধ । 

প্রাথমিক উচ্ছ্বাস কেটে যেতেই তিনি বললেন, আমার কথাই ধরুন। নীতিগতভাবে   কালাত, লাসভেলা,মাকরান আর খারান নিয়ে স্বাধীন একটি রাষ্ট্রগঠনের  জন্যে ১৯৪৭ সাল থেকেই যে স্বপ্ন বেলুচ নেতাদের ছিলো তাকে আমি সমর্থন না করে পারি না। 

 ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান সামরিক শাসন জারির আগেই রাষ্ট্রের ক্ষমতা নিজের হাতে নিয়ে এই কালাতেই যে সেনা অভিযান শুরু করেছিলেন তাতে কি বেলুচরা ভয় পেয়েছে? মোটেই না। 

তারা বরং তাদের কৌশল পালটে অসহযোগ আন্দোলনে নেমে পড়েছিলো। সেনাবাহিনী তখন বেলুচ নেতাদের বিরুদ্ধে গোপন ষড়যন্ত্রের অভিযোগ আনলো যার ফলে বিদ্রোহ বরং চারিদিকে আরও ছড়িয়ে পড়েছে। যা এখনো চলছে।

শুধু তাই নয় ১৯৫৮ এর বিদ্রোহের পরে বেলুচিস্তানের একেবারে গহীনে সেনাবাহিনী নতুন গ্যারিসন স্থাপন করলে সেই বিদ্রোহ প্রবল হয়ে সশস্ত্র বিদ্রোহের রূপ নেয়।

বেলুচ গেরিলারা ট্রেনে,যানবাহনে গুপ্ত হামলা এমন কি বোমা নিক্ষেপও শুরু করলো। 

 এর জবাবে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল টিক্কা খানের নেতৃত্বে সেনাবাহিনী যে অভিযান চালিয়েছিলো 

ডাঃ মতলুব তাঁর মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বললেন, মাই গড অভিযানের নামে সে ছিলো  এক বর্বর নৃশংসতা!  মানুষ কি আর সাধে তাকে বেলুচিস্তানের কসাই বলে?

ভদ্রলোক বললেন,  ইয়াহিয়া আসার পরে সে যুদ্ধ থেমেছে বটে তবে  বেলুচিস্তানের বিদ্রোহ কিন্তু থামে নি।

এরপর বললেন,  সত্যি কথা বলতে কি আমাদের ঘটনাও  ঠিক কোন দিকে গড়াচ্ছে তা  বলার উপায় নেই। তবে আর্মিদের মধ্যে যে একটা উৎকণ্ঠা শুরু হয়েছে এটা পরিস্কার।

 এজন্যেই আমি স্যুইতে পোস্টিং না নিয়ে ইষ্ট পাকিস্তানে ট্রান্সফারের চেষ্টা করেছিলাম। আমি কেন ইনফ্যাক্ট বাঙালি কোন সরকারি অফিসারেরই এখন  ট্রান্সফার নেবার উপায় নেই।

রিনা ভাবি জিজ্ঞেস করলেন, কেন?

তিনি উত্তর দিলেন,  কারণ ইষ্ট পাকিস্তানে  ট্রান্সফার  ওরা বন্ধ করে দিয়েছে।

ইসলামাবাদ থেকে আসা সেই তরুণ মেজর ক্ষুব্ধ স্বরে বললেন,  আইয়ুব খান পূর্ব পাকিস্তানের লোকদের খুশি করার জন্যে ঢাকাকে দ্বিতীয় রাজধানী ঘোষণা দিয়েই তাঁর কর্তব্য শেষ করে ফেলেছেন। অথচ প্রথম রাজধানী ইসলামাবাদের সাথে যে তার আকাশ পাতাল তফাত এটা পূর্ব পাকিস্তানের  কয়জন জানে?

ভাবা যায় ইসলামাবাদের জন্যে যেখানে খরচ করা হয়েছে তিন হাজার মিলিয়ন টাকা সেখানে ঢাকার জন্যে খরচ করা হয়েছে মাত্র তিনশ মিলিয়ন টাকা। তফাতটা একবার ভাবুন তো!

শুধু কি তাই? ইষ্ট পাকিস্তানের কোন একজন বাঙালি সচিবের নাম করতে পারবেন?

 নেই।

থাকলে তো পারবেন।

 

আমাদের এমন কথাও শুনতে হয় বাঙালিরা নাকি গাধার জাত। তাদের হায়ার এডুকেশনেরই বা কি দরকার?  মাদ্রাসা পর্যন্ত পড়লেই যথেষ্ট। জন্মই হয়েছে যাদের পশ্চিম পাকিস্তানের লোকদের গোলামী করার জন্যে তাদের পেছনে টাকাপয়সা খরচ করার  মানে দেশের সম্পদ নষ্ট করা।

কান মাথা গরম হয়ে ঝাঁ ঝাঁ করলেও মুখ বুজে এসব কথাও শুনতে হচ্ছে।

আমার কর্তা বললো,  দিন কিন্তু বদলাতে শুরু করেছে। আর্মিদের উৎকন্ঠা কী আর শুধু শুধু হচ্ছে? শেখ মুজিবুর রহমান যেভাবে বাংলার আনাচেকানাচে ঘুরে ঘুরে জনগণকে জাগিয়ে তুলছেন তাতে জনগণ এখন যথেষ্ট সচেতন। বেশিদিন তারা এই অন্যায় সহ্য করবে না। একটা দফারফা না করে থামবে না।

দেয়ালে পিঠ ঠেকলে বাঙালি তখন ঠিক জানে কি করা দরকার। নির্বাচনটা হয়ে যেতে দিন তারপর আমাদের গাদ্দার ডাকার পরিণাম কতটা যে ভয়ংকর হতে পারে তখন দেখা যাবে। 

কথায় কথায় রাত বাড়ছিলো।কিন্তু কারুরই ওঠার নাম নেই

রিনা ভাবি তখন সবার জন্যে রাতের খাবারের ব্যবস্থা করলেন।

শংকর ভাটিয়ার পরে দ্বিতীয়বার আমি সেই মেজরের মুখে টিক্কা খানের কথা শুনি।

ঘরে ফিরে আসার পরে আমার কর্তা বললো,  আমরা এসেছি আড়াই বছর হয়ে গেলো। ছুটিও জমা আছে। আমার ইচ্ছা নির্বাচনের আগেই ছুটি নিয়ে বাড়ি থেকে ঘুরে আসি। আমি চাই আমাদের বাচ্চার জন্মও পূর্ব পাকিস্তানেই হোক।

আমি তো যেতে পারলে এক পায়ে খাড়া।

পরদিনই আমার কর্তা ছুটির জন্যে দরখাস্ত করে দিলো।

 

(চলবে)

অনুপা দেওয়ানজী