সময়ের কাহন/ অনুপা দেওয়ানজী
সময়ের কাহন/ অনুপা দেওয়ানজী
পর্ব -২
একতলা সেই মেসবাড়ির মতো বাড়িটিতে থাকতেন আমার বড় ভাশুর ,একমাত্র দেবর, বড় ভাশুরের বড় ছেলে তুষার, আর মেজ ভাশুরের বড় মেয়ে নমিতা।
তুষার টেনে আর নমিতা তখন নাইনে পড়ে। বড় ভাশুরই তাদের পড়া দেখিয়ে দেন।
এছাড়া সাঁচির বাপ বলে আধবুড়ো এক কুঁজোমতো কাজের লোক ছিলো। চোখে তার পুরু লেন্সের চশমা ছিলো । দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে পিঠে আড়াই মনের চালের বস্তা নিয়ে বার্মাতে জেটির সিঁড়ি বেয়ে ওঠানামা করতে করতে পিঠটা ধনুকের মতো বাঁকা হয়ে গিয়েছিল। লোকটা নুয়ে নুয়ে হাঁটতো। পরণে থাকতো হেঁটো ধুতি আর ফতুয়া। ভাশুরদের জন্যে রান্নাবান্নার কাজ করতো। দেখে মায়া লাগতো।পিতৃদত্ত নামটা তার সাঁচির বাপের আড়ালেই ঢাকা পড়ে গিয়েছে। যদিও তার সাঁচি নামের ছেলেটাকে বাপের খোঁজ নিতে কখনো দেখিনি।
আমার শাশুড়িই তাকে গ্রাম থেকে এনে রান্নার কাজটি দিয়েছেন। রান্নাবান্না যে খুব একটা জানে তাও নয়। কোনোরকমে চারটে ডালভাত, রুটি, ভাজি আর যেমন তেমন করে ট্যালট্যালে মাছের ঝোল এইটুকুই তার বিদ্যা। এর বেশি আর কিছু সে পারতো না।
বিপাশাকে রেখে আমি ভার্সিটিতে গেলে তাকে রাখার জন্যে আমার শাশুড়িও গ্রামের বাড়ি থেকে ভাশুরের বাসাবাড়িতে চলে এলেন।
আমি সেই বাসায় আসার পরে পার্টিশন দেয়া তিন অংশের এক অংশে মেয়েসহ আমার আর নমিতার থাকার ব্যবস্থা করা হল। যেখানে খুপরি ধরনের একটা জানালা আছে । তবে দরজা বলতে কিছুই নেই। ছোট্ট একটা পড়ার টেবিল সেই খুপরি জানালার কাছে পেতে তার দুপাশে দুটি সিংগল খাট পাতা হল।
ব্যাস ওতেই আর নড়াচড়ার জায়গা নেই। খাটে বসেই লেখাপড়া করতে হয়।এছাড়া আর জায়গা নেই।
জানালার ঠিক ওপারেই বস্তি। তাই জানালাটির নিচের অর্ধেক অংশে পর্দা টাঙানো হল।পুরো পর্দা লাগালে ঘর অন্ধকার হয়ে যাবে তাই অর্ধেকটা পর্দায় ঢেকে দেয়া। যদিও উঠে দাঁড়ালে জানালার অপর পাড়ে বস্তিবাসীদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রার সব কিছুই দেখা যায়। যেখানে অষ্টপ্রহর হৈ চৈ, ছেলেমেয়েদের মারধোর, মায়ে ঝিয়ে ঝগড়াঝাঁটি বা স্বামী স্ত্রীর অকথ্য চেঁচামেচি, মাইকে ভাষণ সারাক্ষণ লেগেই আছে।
এমন পরিবেশ আমার জন্যে একেবারেই অন্যরকম।
রাতে যে ঘুমাবো তারও কি উপায় আছে! কানের কাছে প্রায়ই উচ্চস্বরে মাইকে ভেসে আসে ওয়াজ মাহফিলের হুজুরের বয়ান।
এমনি এক রাতে কোন এক হুজুরের বয়ান শুনে আমি হাসবো না কাঁদবো নিজেই বুঝতে পারছিলাম না।
সেই হুজুর সেদিন খুব আবেগের সাথে বলছিলেন, “আজানের শব্দ এতই মধুর যে মুসলমান তো বটেই হিন্দুর বেটা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পর্যন্ত ফজরের আজান শুরু হলে তা শোনার জন্যে সাথে সাথে বালিশ থেকে কল্লা তুলে তা শোনার অপেক্ষায় থাকেন। এমন কী এই আজান শুনে আজান নিয়ে তিনি রীতিমতো একটি কবিতাও রচনা করেছেন”।
আমি কান খাড়া করে শুয়ে আছি আজান নিয়ে রবীন্দ্রনাথের সেই কবিতাটি শোনার জন্যে।
হুজুর তখন গদগদ কণ্ঠে আবৃত্তি করতে শুরু করলেন মহা কবি কায়কোবাদের আজান কবিতাটি।
‘কে ওই শোনালো মোরে আজানের ধ্বনি
মর্মে মর্মে সেই সুর
বাজিলো কি সুমধুর
আকুল হইল প্রাণ নাচিল ধমনী
কি মধুর আজানের ধ্বনি।
মনে মনে ভাবছিলাম যে হুজুর কষ্ট করে আজান কবিতাটি মনে রেখেছেন তিনি কেন সেই কবিতার রচয়িতার নাম জানেন না?
মনে মনে ভাবতাম এমন প্রতিকূল পরিবেশের মধ্যে আমি কি নিজেকে মানিয়ে নিয়ে লেখাপড়া করতে পারবো?
ভার্সিটিও কম দূরে নয়।
ঘর থেকে বেরিয়ে প্রথমে স্কুটার,এরপরে বাস বা ট্রেন,তারপরে আবার রিকশায় চড়ে যেতে হত। প্রথম কয়েকদিন ভার্সিটি থেকে স্কুটারে বাড়ি ফেরার সময়ে নিজেদের গলিই খুঁজে পেতাম না।
যখন ফিরতাম তখন বিকেল গড়িয়ে যেতো। দীর্ঘ সময় পরে যখন আমার মেয়ে আমাকে দেখতো তখন সে রোজ আমার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতো।
মেয়েকে আগে শান্ত করে মুখ হাত ধুয়ে কাপড় চোপড় ছেড়ে বসতে না বসতেই শাশুড়ি বলতেন, বউমা রাতে মাছটা তুমিই রান্না কোরো। সাঁচির বাপ ভাতটাই ঠিক মতো রান্না করতে পারে না মাছ রাঁধবে কি?
সেই সাথে বলতেন,” বুঝলে সেজো মা আমাদের বড় বউ আর সাঁচির বাপ এই দুইজনকে চেষ্টা করেও আমি রান্না তো দূরের কথা ভাত রান্নাটাও শেখাতে পারলাম না।”
সাঁচির বাপের সাথে আমার বড় জায়ের তুলনা দেয়াটা আমার একেবারেই ভালো লাগতো না।
রান্নাবান্না শেষ করে পড়তে বসলে বলতেন, ছোট বাচ্চার মার এত রাত জাগতে নেই।
কখনও আবার বলেন, এত রাত জেগো না। সকালে উঠে আবার দৌড়াতে হবে। ঘুমিয়ে পড়।
কিছুদিন ক্লাস করেই আমি আমার কর্তার কাছে বাধ্য হয়ে চিঠি লিখলাম, এই পরিবেশে থেকেআর যাই হোক আমি লেখাপড়া করতে পারবো না। তুমি এসে আমাকে নিয়ে যাও।
আমার চিঠির উত্তরে সে লিখে পাঠালো, ‘তুমি সেখানে সিলেটের পরিবেশ চাইলে তো আর পাবে না একটু কষ্ট করে মানিয়ে নিতে চেষ্টা কর। কষ্ট করতে শেখো।’
সে চিঠি পড়ে আমি মনে মনে ভাবলাম, কষ্ট করতে আমার আপত্তি নেই কিন্তু আমি যে পড়ার জন্যে সময় বা সুযোগ কোনটাই পাচ্ছি না। সকালে উঠেই ভার্সিটি দৌড়াই,ফিরতে ফিরতে বিকেল গড়িয়ে যায়, তারপর রান্নাবান্না করে পড়তে বসলেই শাশুড়ির হুকুম শুয়ে পড়ো। ছোট বাচ্চার মার এত রাত জাগতে নেই। এভাবে কি লেখাপড়া করা যায়?
আমাদের যুগে আমরা দেখেছি বাবা, মা বা বড় ভাই, বোনের কথার ওপরে ছোট ভাই বোনরা কখনও প্রতিবাদ করতেন না। তারপরও আমার কর্তা খুব ভয়ে ভয়ে বড় ভাইকে একবার বলেছিলো, এই বাসাটা বদলে আর একটা বড় বাসা নেয়া যায় না বড়দা?
একথা শুনেই আমার ভাশুর ক্ষেপে গিয়ে বললেন আমাদের কারো যদি এই বাসায় অসুবিধা না হয়ে থাক তাহলে বৌমার অসুবিধার কোন কারণ তো আমি দেখতে পাচ্ছি না।
ভাশুরের একথার পর আর কথা চলে না।
আমিও কষ্ট করেই ভার্সিটি আসা যাওয়া করতে লাগলাম।
সময়টা ছিলো তৎকালীন পাকিস্তান আমল। যখন বাংলাদেশও পাকিস্তানের অংশ ছিলো।
ভার্সিটির বাসে তাই পশ্চিম পাকিস্তানেরও বেশ কিছু ছাত্রছাত্রী আসা যাওয়া করতো।
বাসে করে আসা যাওয়ার সময়ে তাদের মধ্যে কেউ কেউ আমাকে জিজ্ঞেস করতো,আর ইউ নিউ কামার?
হোয়াট’স ইওর মেজর ? তারপর একটু মিষ্টি হেসে নিজেদের মধ্যেই অনর্গল উর্দুতে বকবক করতে থাকতো যার একবর্ণও আমি বুঝতে পারতাম না।
আমি গ্রামে বড় হয়েছি। মোগল আমলের গ্র্যান্ড ট্রাংক রোড ধরে রোজ এক মাইল পায়ে হেঁটে তখনকার বিখ্যাত স্কুল পি,সি,সেন সারোয়াতলী স্কুলে আসা যাওয়া করেছি । যে স্কুলে আমার মা পড়েছেন, এমন কি বিপ্লবী বিনোদবিহারী চৌধুরিও পড়েছেন।
কোয়ার্টার থেকে পা বাড়ালেই ছিলো কলেজ।
বিয়ের পরে কর্তার অফিসের গাড়িতেই বরাবর চলাফেরা করেছি।
বাসে চড়ার অভ্যাস তাই আমার ছিলো না।
এজন্যে বাসে উঠে আমি ঠিক স্বাচ্ছন্দ্য অনুভব করতাম না।ৎমাঝে মাঝে অসুস্থ বোধও করতাম। হয়তো একারণেই পাকিস্তানি শিক্ষার্থীরা আমাকে দেখে এসব কথা জিজ্ঞেস করতো।
তবে শরীরের নাম মহাশয়, যা সহাও তাই সয়।
অভ্যাসে সবই সয়ে যায়। কিছুদিনের মধ্যেই এসব অসুবিধা আমারও অনেকটাই সয়ে গিয়েছিলো ।
শুধু ভার্সিটি থেকে ফিরে আসার পরে ছোট্ট ওই ঘরটাতে ঢুকলেই আমার দম যেন বন্ধ হয়ে আসতো।
আমি বড় হাঁপিয়ে উঠতাম।
ক্লাশ নাইনে পড়ুয়া আমার মেজো ভাশুরের বড় মেয়ে নমিতা ছিলো আমার সর্বক্ষণের সঙ্গী। যদিও আমি তার কাকীমা, বয়সে সে আমার চেয়ে খুব একটা ছোটও ছিলো না। আমাকে যেমন সে খুব ভালোবাসতো, আমিও তাকে খুব ভালোবাসতাম।
দুজনে মিলে রাতে শুয়ে শুয়ে অনেক সময় খুব নিচু গলায় আমরা দুজন এটা সেটা নানারকম গল্প করতাম। শাশুড়ি মার কানে গেলেই তিনি বকতেন, রাতে না ঘুমিয়ে এত গল্প কিসের?
পার্টিশন দেয়া বসার ঘরটাতে রাতে আমার ভাশুর ঘুমাতেন। সেই ঘরেও একটা খুপরি ধরণের জানালা ছিলো। স্কুল থেকে ফেরার পরে বিকেলবেলা নমিতা সেই ঘরের জানালার পাল্লাদুটিকে সামান্য একটু ফাঁক করে পথ চলতি মানুষের ব্যস্ত চলাফেরা বা যানবাহন কিংবা দূরের একচিলতে আকাশ দেখতে খুব ভালোবাসতো।
বড় ভাশুরের চোখে দৈবাৎ এই দৃশ্য পড়লে তিনি তাকে এ নিয়ে খুব বকাবকি বা শাসন করতেন। আমার শাশুড়ি নিজেও তাঁর নাতনির জানালার ধারে বসে এসব দৃশ্য দেখা একদম পছন্দ করতেন না।
আজ ভাবি, ছোট্ট একটা জানালার পাল্লার ফাঁক দিয়ে বাইরের জগতের কিই বা আর দেখা যায়? অথচ সেটুকু দেখার স্বাধীনতাও ওইটুক একটা কিশোরীর ছিলো না। সেই অর্থে এখনকার যুগের মেয়েরা কত স্বাধীন! তারা একা একা দুনিয়া জুড়ে ছুটে বেড়াচ্ছে।
এক বিকেলে সেই জানালার ধারে বসে নমিতা আমাকে ইশারায় ডেকে বললো, কাকী একটা মজার জিনিস দেখে যাও। আমি শাশুড়িমা কোথায় আছে দেখে নিয়ে জানালার ফাঁকে চোখ রেখে দেখি বস্তির এক মা তার মেয়েকে শাসাচ্ছে।
“এই বুলবুলি বিহান থাইক্যা তুই কয় কিস্তি খাওন খাইলি?
হ্যার বাদেও তোর প্যাট ভরে নাই?
এতগুলান আটা সিদ্ধর দলা রাইখ্যা গেলাম? দলাগুলি নিয়া যাস কই?
আমি অহন রুডি বানাইমু কি দিয়া?”
উঠতি বয়সের বুলবুলি নামের মেয়েটা মার বকাবকির তোয়াক্কা না করে তার জামার কোঁচড়ের মধ্যে রুটির জন্যে আটা সিদ্ধের দলাগুলি নিয়ে ততক্ষণে রাস্তা দিয়ে ছুটছে আর তার পিছু পিছু তার মা একটা কঞ্চি নিয়ে ছুটছে।
সেই দৃশ্য দেখে নমিতা হেসে গড়িয়ে পড়ছে। আমি হাসতে হাসতে বললাম, বুলবুলির পিঠে আজ নির্ঘাৎ ওই কঞ্চির বাড়ি না পড়ে যাবে না।
বেচারি নমিতা!
ঘরের ওই খুপরি জানালার ফাঁক দিয়ে এভাবেই বুঝি বিশাল পৃথিবীটাকে বুঝতে চেষ্টা করে।
আমার দেওর তখন সবেমাত্র চাকরি পেয়েছে। তার বিয়ের জন্যে মাঝে মাঝে পাত্রীর খবরও আসতে শুরু করেছে।
আমার শাশুড়ি এখন এই বাসায় আছে বলে সে সাপ্তাহিক ছুটির দিনে আর গ্রামের বাড়ি যায় না। তবে আমার ভাশুর যান। কারণ বড় জা ও তাঁর অন্য দুই ছেলেমেয়ে গ্রামের বাড়িতেই আছে।
এর মধ্যেই এক ছুটির দিন সকালে চা খেতে খেতে আমার দেওর বললো, “বৌদি চল আজ ইভনিং শোতে তুমি, আমি আর নমিতা ‘হারানো সুর’ সিনেমাটা দেখে আসি।
সিনেমা দেখার কথায় নমিতা খুশিতে ডগমগ হয়ে বললো, হ্যাঁ কাকী চল। খুব মজা হবে।
ছোট বেলায় কলেজে প্রজেক্টরে প্রচুর টকি দেখেছি। তবে সে সবই ছিলো তথ্যচিত্র। তাও আবার ইংরেজিতে। হলে গিয়ে বাংলা সিনেমা বিয়ের আগে আমি কখনোই দেখিনি। তাই দেবরের অনুরোধে আমার নিজেরও যাওয়ার খুব ইচ্ছে হলেও এত ছোট বাচ্চা নিয়ে তো আর সিনেমাহলে যেতে পারি না।
তাছাড়া শাশুড়ি মা আমাকে যেতে দেবেন কিনা সেই ভয়ও আছে। তাঁর অনুমতি ছাড়াই বা কি করে যাই?
তারপরেও দেবরের কথায় আমি যখন সাহস করে তাঁর কাছে অনুমতি চাইতে গেলাম তিনি না করলেন না। বললেন, ঠিক আছে যেও।
আমার জীবনে সেই প্রথম হলে গিয়ে সিনেমা দেখা।
ছোটবেলা থেকে আমি আমার মাকে হলে গিয়ে সিনেমা দেখতে কখনো দেখিনি, আর এ নিয়ে মাকে কোনদিন মন খারাপ করতেও দেখিনি।
লেখাপড়ার পাশাপাশি ফুলবাগান , গল্পের বই, গান, সেলাই, নানা রকম খেলাধুলার মধ্যেই আমরা বড় হয়েছি। যার মধ্যে ক্রিকেটও ছিলো।
সেই সময়ের সিনেমা পত্রিকা চিত্রালী ছাড়া শারদীয়া সংখ্যা উল্টোরথ, প্রসাদ, নবকল্লোল থেকে তখনকার নায়ক, নায়িকা সম্পর্কে এক আধটু যা জানতাম, চিত্রজগত সম্পর্কে এর বাইরে তেমন আর কিছু জানতাম না। সুচিত্রা সেনকে ভাবতাম উত্তম কুমারের বউ। বাবাই একদিন আমার এই ভুল ভাঙিয়ে দিয়েছিলেন।
তবে আকাশবাণী থেকে প্রচারিত পঙ্কজ মল্লিকের সঙ্গীত শেখার আসর, নাটক, শনি, রবিবারের অনুরোধের আসর শুনতাম নিয়মিত।
এছাড়া বাড়িতে পুরনো দিনের গানের রেকর্ড ছাড়াও পূজায় যেসব রেকর্ড বার হত সেসব কেনা হত। গ্রামোফোনে রেকর্ডের গান প্রায়ই শুনতাম।
আমাদের সময়ে স্কুল, কলেজে নিয়মিত রবীন্দ্র, নজরুল চর্চা ছাড়াও বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক অনুষ্ঠান হত।
তাতেও অংশ নিতাম।
আজ বুঝতে পারি, আমাদের মা তাঁর পাঁচ মেয়েকে বড় করে তোলার জন্যে অনেক শখই ত্যাগ করেছিলেন। সিনেমা তার মধ্যে একটি।
সবাই আমাদের দেখে বলতো, ওদের সাত ভাইবোনের মধ্যে এমন মিল যে বাইরের কোন বন্ধুর ওদের আর দরকার হয় না।
সারাক্ষণ যেন আনন্দে মেতে আছে সবাই।
সবচেয়ে ভালো লাগে এই পরিণত বয়সে এসেও আমাদের সেই বন্ধন আজও অটুট আছে।
তবে মেজকাকিমার মুখে শুনেছি দুপুরবেলায় ঠাকুমা ঘুমিয়ে পড়লে কাকিমা নাকি চুপিচুপি আমার ঠাকুর্দার ঘরে গিয়ে বলতেন, বাবা হলে একটা খুব ভালো বই চলছে আমি দেখতে যাবো। আমাকে কিছু পয়সা দিন। সেই সময়ে সিনেমা দেখাকে অনেকেই বই দেখাও বলতেন। আমার কাকিমাও তাই বলতেন।
ঠাকুর্দা কাকিমাকে বলতেন, দিতে পারি যদি তুমি সিনেমা দেখে এসে সেই গল্পটি আমাকে শোনাতে পারো। এই বলে বালিশের নিচ থেকে আট আনা তুলে নিয়ে কাকিমার হাতে তুলে দিতেন।
এরপর কাকিমা নাকি একটা ফিটন ডেকে নিয়ে দিব্যি সেই সিনেমা দেখে বাড়ি ফিরে আসতেন।
বিয়ের পরে সিনেমা যে দেখিনি তা নয়। তবে সে ছিলো উর্দু আর ইংরেজি সিনেমা। প্রতি পনেরো দিন পর পর পশ্চিম পাকিস্তানের হেড ব্রাঞ্চ থেকে সেসব সিনেমার রোল আসতো আমার কর্তাদের কোম্পানীতে।
অফিস স্টাফের সবাই পরিবার নিয়ে সেই সিনেমা দেখতো কোম্পানীর বিশাল ক্লাবে বসে।
আমি যে গ্যাস ফিল্ডে ছিলাম সেখান থেকে সিলেট শহর ছিলো অনেকদূরে।
আমি উর্দু তো এক বর্ণও বুঝতাম না। ইংরেজিও যে খুব ভালো বুঝতাম তাও নয়। তবুও পাকিস্তানের অবাঙালী নায়ক,নায়িকাদের মধ্যে সন্তোষ,সাবিহা,শামীম আরা,মহম্মদ আলী,জেবা,তালাত এদের অভিনয় খুব ভালো লাগতো।
মনে আছে বিখ্যাত ইংরেজি ছবি ‘রোমান হলিডে’ৎআর ক্রেইন্স আর ফ্লায়িং, আমি কর্তার অফিসের ক্লাবে বসেই দেখেছিলাম।
দেওরের সাথে প্রথম বাংলা সিনেমা দেখার কথা আমি আজো ভুলিনি। যদ্দূর মনে পড়ে সেই সময়ের বিখ্যাত নায়ক নায়িকা মোস্তফা আর শবনম ছিলেন তাতে।
‘হারানো সুর’ সিনেমার একটি গানের কথা আজও মনে আছে
‘আমি রুপনগরের রাজকন্যা রুপের যাদু এনেছি
ইরান তুরান পার হয়ে আজ তোমার দেশে এসেছি। ‘
আমার মেয়ে বিপাশা ছোট বেলা থেকেই খুব
শান্তস্বভাবের। ওকে ওর ঠাকুমার কাছে রেখে আমরা তিনজন সিনেমা দেখতে গেলাম।
হলের বিশাল পর্দায় বাংলা সিনেমা দেখে খুব খুশি মনে সেদিন বাড়ি ফিরে এসেছিলাম।
পরদিন সকাল বেলায় মেয়ের দুধের বোতল ধুতে গিয়ে বোতলের ব্রাশটা কোথাও খুঁজে পাচ্ছিলামনা।
এদিকে আমার ভার্সিটিতে যাওয়ার সময় তখন পার হয়ে যাচ্ছিলো। কি যে করি তখন? রান্নাঘরে ঢুকে দেখি সাঁচির বাপ চা বানাচ্ছে।
আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, ব্রাশটা সে কোথাও দেখেছে কিনা?
সাঁচির বাপ কেটলি থেকে সবার কাপে চা ঢালতে ঢালতে উত্তর দিলো, রাইতে মনে অয় ইন্দুরে লইয়া গেছে।
ইন্দুরে লইয়া গেছে শুনে আমি তার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে রইলাম।
(চলবে)
Facebook Comments Sync