সময়ের কাহন-৫ / অনুপা দেওয়ানজী
ধারাবাহিক স্মৃতিকথা
সময়ের কাহন-৫ / অনুপা দেওয়ানজী
সাগর পাড়ের মেয়ে আমি। কর্ণফুলী নদীর তীরে শ্বশুরবাড়ি। নদী বা সমুদ্রের দূরন্তপনা দেখেই বড় হয়েছি। জোয়ার ভাঁটা কি সে আমি খুব ভালোই জানি।তবে একস্রোতা নদী হিসেবে সুরমার সাথেই আমার প্রথম পরিচয়। বর্ষায় প্রবল স্রোতস্বিনী হলেও অন্য সময়ে সে যেন পটে আঁকা ছবির মতোই ভারি নিস্তরঙ্গ ও শান্ত এক নদী। আসামের বরাক নদী থেকে এদেশে নেমেই সুরমা নাম নিয়ে সে কুলকুল করে বয়ে চলেছে।
আমাদের ছোট্ট লঞ্চটি তার বুকের ওপর দিয়ে যেতে যেতে গর্জন তুলে যেন সেই নদীটিকে শাসাচ্ছে আর নদীও দিব্যি নির্বিবাদে তার শাসন উপভোগ করছে।
নদী শাসন মানলেও পাড় থেকে এলোমেলো দূরন্ত মাতাল হাওয়া ছুটে এসে আমাদের চোখে মুখে ঝাপটা দিয়েই পালিয়ে যাচ্ছে। সেই ঝাপটায় আমার চুলগুলি কিছুতেই তার শাসন মানতে চাইছে না। আমার কর্তা হাতের বাইনোকুলারটি রেখে আমার অপদস্থ অবস্থা দেখে হাসতে লাগলো।
আমি চুলগুলি কষে একটা শক্ত খোঁপায় আটকে কর্তার হাত থেকে বাইনোকুলারটা নিয়ে তাতে চোখ রাখলাম।
নদীর দুই তীরে ঘন ছায়ায় ঢাকা নিবিড় বৃক্ষরাজি, গ্রামের মানুষের কুটির, বউ ঝিদের নাইতে আসা,কাপড় কাচা,কলসী কাঁখে জল ভরা, দূরন্ত বাচ্চা ছেলেদের জলঝাঁপানো সাঁতার, জেলেদের জাল ফেলে মাছ ধরা।সব যেন আমার চোখের একদম কাছে এসে ধরা দিচ্ছিলো।
ভারি ভালো লাগছিলো!
বড় বড় লঞ্চগুলি যখন আমাদের লঞ্চের পাশ ঘেঁষে যাচ্ছিলো তখন আমাদের ছোট্ট লঞ্চটা মোচার খোলার মত দুলে উঠছিলো।অভিজ্ঞ সারেং কী এক অপূর্ব কায়দায় দক্ষ হাতে তা সামলে নিচ্ছিলো।
কখনো বা বিশাল বপুর শুশুক হঠাৎ জল থেকে মাথা তুলে এদিক ওদিক তাকিয়ে আবার ডাইভ দিয়েই জলে ডুব দিচ্ছিল। ওদের এই ডাইভ দেয়া দেখে ভারি মজা লাগছিলো।মনে হচ্ছিলো ওরা যেন নিজেদের মধ্যে লুকোচুরি খেলছে।
মাঝে মাঝে দেখা যায় বিশাল দৈত্যের মতো লম্বা চওড়া পুরনো কোনও নৌকা পাথর নিয়ে চলেছে। দেখলে মনে হয় নৌকাটি চলছে না, জলের ওপর স্থির যেন দাঁড়িয়ে আছে। যার গায়ে তখনো সনসহ ব্রিটিশ আমলে বড় বড় করে ইংরেজিতে ক্যালকাটা লেখা শব্দটা মুছে যায়নি।
কর্তাকে জিজ্ঞেস করে জানলাম ওগুলি নাকি গাধা বোট।
গাধা বোটই বটে। নইলে কী আর এত ভার বহন করতে সক্ষম!
গাধা বোট ছাড়াও সরু আর লম্বা গড়নের এক ধরনের নৌকাও পাথর নিয়ে চলেছে ।ওগুলির নাম বার্কি নৌকা।
ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর আমলে কিম বার্কি নামে এক সাহেব দ্রুত পাথর আর কমলা পরিবহনের জন্যে এই নৌকার প্রচলন করেছিলেন ।
পাখিরা পাড়ের দিক থেকে উড়ে উড়ে সেই পাথরের স্তূপে কিছুক্ষণ বসেই হঠাৎ ছোঁ মেরে জল থেকে কোন একটা মাছ তুলেই আবার পাড়ের দিকে উড়ে চলে যাচ্ছে।
সত্যি কী সুন্দর আর স্বাধীন জীবন পাখিদের!
নদীর তীর ঘেঁষে মাঝে মাঝে চূনাপাথর পুড়িয়ে চুন বানানো হচ্ছে সেই ধোঁয়া উড়ে উড়ে বাতাসে মিশে যাচ্ছে।
আমার মেয়ের এক জায়গায় বসে থাকতে আর ভালো লাগছিলো না।
বাবা ওকে তাই লঞ্চ কিভাবে চালানো হয় তা দেখাতে নিয়ে গেলে সেও আবদার ধরে বসলো লঞ্চ চালাবে।
বাধ্য হয়ে মেয়ের আবদার পূরণের জন্যে বাবাকে সারেং-এর ভূমিকা নিতে হলো । আর মেয়েও মনের আনন্দে লঞ্চের স্টিয়ারিং ধরে বসে রইলো।
সুরমার জলে ভাসতে ভাসতে এক সময়ে আমরা দোয়ারাবাজার নামে একটা জায়গায় এসে পৌঁছালাম। আমাদের লঞ্চ যেখানে থামলো তার উল্টো দিকেই দোয়ারাবাজার ঘাট। ঘাটকে কেন্দ্র করে সেখানে বেশ বড় বাজার। তবে আমরা যে পাড়ে নামলাম সেই পাড়ের সাথে দোয়ারা ঘাটের কোন সংযোগ সেতু না থাকাতে কাঁচা রাস্তার উৎরাই পেরিয়ে আমাদের অন্য পাড়ে উঠতে হল।
উঠেই দেখি ল্যান্ডরোভার নিয়ে কর্তার অফিসের ড্রাইভার আম্বর আলী দাঁড়িয়ে আছে।
ড্রাইভারকে পেছনের সিটে বসতে বলে আমার কর্তা চালকের আসনে বসলো। আমি মেয়েকে কোলে নিয়ে পাশেই বসলাম। ল্যান্ডরোভার ছুটে চললো পাকিস্তান পেট্রোলিয়াম লিমিটেড কোম্পানীর তৈরি করা সুন্দর রাস্তা দিয়ে। এই পথ চলে গেছে টেংরা গ্যাস ফিল্ড পর্যন্ত।
পথের দু’পাশ জুড়ে যে কত রকমের জংলী গাছ আর লতাপাতা রাস্তাটিকে সবুজ করে রেখেছে তার কোন শেষ নেই। সেই সবুজের মাঝেই দেখা যায় নাম না জানা কোনও বুনো অর্কিড পাতার ফাঁকে তার মুখটা বাড়িয়ে রেখেছে। কোথাও আবার অজস্র জংলীফুল কোন এক জায়গাকে আলো করে ফুটে আছে। পাখিরা দল বেঁধে সেসব ঝাড়ে উড়ে উড়ে এসে নামছে আবার উড়ে যাচ্ছে।
সেসব ঝাড়ের ডালপালা মাঝে মাঝে আমাদের গাড়ির গায়ে এসেও ঠেকছে।
যেতে যেতেই দেখি বাচ্চা কোলে পথ চলতি কোন গাঁয়ের বধু আমাদের গাড়িটা দেখে চকিতে থমকে দাঁড়িয়ে আছে। চোখে তার অবাক সন্ত্রস্ত চাউনি। রাস্তা থেকে নিচে ঢালু জমিতে কৃষক লাঙ্গল ঠেলছে।
বহুদূরে দেখা যাচ্ছে মেঘালয়ের ধোঁয়া ধোঁয়া পাহাড়ের গায়ের ররূপালী ঝর্ণার অস্পষ্ট আভাস।
দেখতে দেখতে গাড়ি এসে থামলো টেংরা টিলাতে।
টেংরাটিলা নামটা কানাডার নাইকো সংস্থার কল্যাণে আজ আর কারও অজানা নয়।
আমরা এসে পড়তেই উর্দি পড়া দারোয়ান গেট খুলে দিলো। সবুজ টিলার গায়ে ধাপে ধাপে খাঁজকাটা পাকা সিঁড়ি বেয়ে অবশেষে আমি নিজেদের বাংলোতে ঢুকলাম। বাংলোতে ঢুকতে গিয়ে মনে হল আহা্ কতদিন পরে আমি আমার একান্ত সুখের নীড়টিতে প্রবেশ করলাম!
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি দুপুর সাড়ে বারোটা বাজে।
বেয়ারা এসে জিজ্ঞেস করলো চা খাবো নাকি?
লঞ্চে দু’বার চা খেয়েছি। তাই চা খেতে আর ইচ্ছে করলো না।
কাপড় বদলে অনেকদিন পরে হট শাওয়ার নিয়ে ডাইনিং রুমে এসে দেখি বাবুর্চি আলাউদ্দিন সুগন্ধি কালিজিরা চালের ভাত,পেঁয়াজ বেরেস্তা দিয়ে রুই মাছ ফ্রাই,ডাল,সব্জী আর রূপালি পাবদার সোনালী ঝোল রান্না করে খাবার টেবিল সাজিয়ে দিয়েছে।
বহুদিন পরে যেন তৃপ্তির সাথে ভাত খেলাম।
দীর্ঘ পথ ভ্রমণের ক্লান্তিতে আমার চোখ দুটি খাওয়ার পরেই ঘুমে জড়িয়ে আসছিলো। একটা লম্বা ঘুম না দিলে আমার এই ক্লান্তি যাবে না। আমি মেয়েকে নিয়ে নিপাট শয্যায় শুয়ে পড়লাম।
আমরা শুয়ে পড়লেও আমার কর্তাকে অফিসে যেতেই হবে। কোনরকমে তাড়াহুড়ো করে ভাতটা খেয়েই সে অফিসে চলে গেলো।
মেয়ের আগডুম বাগডুম কথা শুনে ঘুম ভাঙতেই দেখি সন্ধ্যে হয়ে গিয়েছে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি আমি লম্বা একটা ঘুম দিয়েছি। তার মানে সন্ধ্যে পার হয়ে গেছে অনেক আগেই।
তবে পাহাড়ি জায়গা বলে বিকেল পার হতে না হতেই সন্ধ্যেটা এখানে যেন ঝুপ করে নেমে আসে।
মেয়ের দুধ বানাতে বানাতে আলাদিনের কাছে শুনি আমার কর্তা অফিস থেকে ফিরে, স্নান সেরে চা খেয়েই অফিসের ক্লাবে ব্রিজ খেলতে চলে গেছে।
মনে মনে ভাবি কি কুম্ভকর্ণ ঘুমই না দিয়েছি যে আমি তার কিছুই জানলাম না!
আমার কর্তার ব্রিজ খেলার খুব নেশা।সন্ধ্যের পরে রোজ তার ব্রিজ খেলা চাইই চাই।
আর খেলতে বসলে রাত নটার আগে সে ফিরবে না জানি।
আলাদিন চা এনে দিতেই আমি চাটা খেয়েই বারান্দায় এসে দেখি সেখানে একটা অল্প পাওয়ারের বাতি জ্বলছে আর বাতির চারিদিকে রাজ্যের যত ঘাসফড়িংয়েরা ভিড় জমিয়েছে।
মেয়েকে নিয়ে লনের সবুজ ঘাসে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করতে করতে দেখি দূরে সুরমা নদীর বুকে টিমটিমে আলো জ্বালিয়ে নৌকা চলছে। নদী বা নৌকা এখান থেকে রাতে দেখা না গেলেও চলন্ত নৌকার আলোগুলি দেখে বোঝা যায় নদীতে নৌকা চলছে ।
অন্ধকারে সেই আলো দেখে মনে হয় আলো হাতে আঁধারের যাত্রীরা জলের ওপর দিয়ে চলেছে।
আকাশ আজ ভারি পরিস্কার। অজস্র তারা ফুটে আছে সেখানে । দূরে পাহাড়ের গায়ে দেখা যাচ্ছে গ্রামের কুটিরের স্নিগ্ধ নরম আলো। বিজলি এখনও এখানকার গ্রামে প্রবেশ করেনি।
ছোট্ট এই গ্যাস ফিল্ডটি নিজস্ব জেনারেটরের আলোয় আলোকিত।
কিছুক্ষণ লনে মেয়ের সাথে খেলা করে ঘরে এসে বসতেই দেখি আমার কর্তা নটার আগেই চলে এসেছে। বাবাকে পেয়ে আমার কোল থেকে নেমে সে বাবার কোলে গিয়ে উঠলো। কর্তা রাতে রুটি খেতে ভালোবাসে।আমি চিরদিনের ভেতো বাঙালি। ভাত ছাড়া আমার চলে না।
খেতে বসে চট্টগ্রামের বাসা আর ভার্সিটির গল্প করতে করতে দেখি রাত এগারোটা বেজে গেছে।
পরদিন খুব ভোরে সূর্যের আলো তখনো ফোটেনি, পাখিদের দল তখন ভৈরবী গাইছে। এখানে আসলে পাহাড়ের কোলে সূর্য ওঠা আমার দেখা চাই। কতদিন হয়ে গেলো সেই সৌন্দর্য উপভোগ করিনি। পাখিদের ডাক শুনে বিছানা ছেড়ে ঘরের বাইরে এসে দাঁড়ালাম। এই সময়টা আমার খুব অপার্থিব মনে হয়। মনে হয় খুব নিঃশব্দে পবিত্রতার একটা ছোঁয়ায় পৃথিবীর যাবতীয় পংকিলতা দূর হয়ে যাচ্ছে।
বাংলো থেকে বেশ খানিকটা দূরে দেখা যাচ্ছে সরু রূপালী ঝিরিটা। ওটাকেও আমি খুব মিস করি! কেমন তিরতির ছন্দে সে নিজের মনে বয়ে চলে। এমন শান্ত ধারার ঝিরিটাকেই আবার দেখেছি বর্ষার সময়ে দূরন্ত কিশোরীর মত লাফিয়ে লাফিয়ে চলতে।
অনেক দূরে দেখা যাচ্ছে ভারত বাংলাদেশ সীমান্তের ঢেউ তোলা মেঘালয় পাহাড়ের সারি।
একটু পরে সূর্যদেব নিজের রথ নিয়ে প্রবেশ করতেই পাহাড়গুলি যেন সাথে সাথে রঙ বদলাতে শুরু করলো। সবুজ, গাঢ় সবুজ, কালচে সবুজ। সে যেন সবুজের এক হাট। সেই সাথে পাহাড়ের গায়ের ঝর্ণার অস্পষ্ট রূপালী ধারাগুলিও ফুটে উঠলো ।
চেরাপুঞ্জি এখান থেকে খুব কাছে। বৃষ্টির খ্যাপামিরও তাই অন্ত নেই।
যখন ইচ্ছে তখনই সে চলে আসে। এই যে আমি এখানে দাঁড়িয়ে আছি বৃষ্টির ইচ্ছে হলে এই মুহূর্তেই আমাকে ভিজিয়ে দিয়ে যেতে পারে। পাহাড়ের কোলে সূর্য ওঠা দেখার বদলে ভিজে একসা হতে হবে তখন। তবে সে ভেজায় আনন্দও কিন্তু কম নয়।
হঠাৎ পেছনে কর্তার গলা শুনতে পেলাম।,”এত ভোরে উঠে কী এমন দেখছো এত গভীর মন দিয়ে?
আমি বললাম সূর্য ওঠা দেখছি।
জানো কতদিন পরে পাহাড়ের কোলে সূর্য ওঠা দেখছি যতবারই দেখি প্রতিবারই যেন তার রূপটা একেবারেই অন্যরকম হয়ে ধরা দেয়।
এমন রূপের দিক থেকে যদি মুখ ফিরিয়ে রাখি তাহলে মনে হয় নিজেকেই আমি বঞ্চিত করলাম।
কর্তা বললো, হবে হয়তো । তবে আমার ওসব দেখার কোন দরকারই হয় না।
-দরকার হয় না মানে? পাহাড়, জঙ্গল, ঝর্ণা এসব দেখার মতো সময় বা চোখ কোনটাই তোমার নেই বল।
– না মহারাণী। সময় না থাকলেও চোখ থাকবে না কেন?
আমার দেখার দরকার হয় না কারণ এর সবই আমি তোমার মধ্যে পেয়ে যাই।
সাতসকালে এমন কথায় কার না রাগ ধরে! রেগে উঠে বললাম, তোমার খালি যতসব আজেবাজে কথা।
-বাঃ আজে বাজে কেন? এত সুন্দর কাব্যিক ভাষায় নিবেদন করলাম আর আমার বউয়ের কিনা তা পছন্দই হল না?
-থাক কাব্যিক ভাষার দোহাই দিয়ে এই সুন্দর সকালে আদিরস ঢালবার কোন দরকার নেই।
– তা না হয় হল। কিন্তু ম্যাডাম বেডটি যে ঠান্ডা হতে চললো। না খেয়ে চলে এলে কেন?
– চলো যাচ্ছি।
ফিরে গিয়ে দেখি মেয়ে আমাদের না দেখে বিছানা ছেড়ে গুটি গুটি পায়ে বারান্দায় চলে এসেছে।
একটু পরেই গ্যাস প্ল্যান্টের ভেঁপু বেজে উঠতেই আমার কর্তা অফিসের জন্যে রেডি হয়ে নিলো।
ব্রেকফাস্টে আলাদিন আজ রেখেছে পরোটা, আলুভাজি, ডিমের অমলেট, কলা আর ক্যারামেল দেয়া পুডিং।
ব্রেকফাস্ট সেরে কিচেনে ঢুঁ দিলাম। আমি যখন এখানে আসি তখন নেহাত দরকার না হলে আলাদিনকে রাঁধতে দিই না। রান্না নিয়ে নানারকম পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে আমার মা’র মতো আমিও খুব ভালোবাসি।
যদিও আলাদিনের কাছ থেকে অনেক রান্নাই আমি শিখেছি।
১৯৬৪ সালে আমার বিয়ে হয়। এই চার বছরে যতবার এখানে এসেছি আলাদিনের কাছ থেকে ইংলিশ আর কিছু কিছু মোগলাই রান্না শিখেছি। বিয়ের আগে মা চা নাস্তা বানানো ছাড়া মেয়েদের রান্নাঘরে যেতে দেন নি কোন সময়েই। যদিও মার কাছ থেকে চোখে চোখে দেখে অনেক রান্না শিখেছি।
রান্নাঘরে আধুনিক গ্যাসের চুলা। ১৯৬৪ সালে বাড়িতে গ্যাসের উনুন বা চুলার কথা কেউ ভাবতেই পারতো না। অনেকে তার নামও শোনেনি।
বিয়ের দু তিন দিন পরে শ্বশুরবাড়িতে নিরামিষ রান্নাঘরে আমি যেদিন আমার শাশুড়ির জন্যে লাকড়ির চুলায় রান্না করছিলাম সেদিন আমার কর্তা পাশের আমিষ রান্নাঘরে মাংস রান্না করছিলো। দুটি ঘরের মাঝখানে ছিল বাঁশের জাফরি।
একে নতুন বউ তাতে আবার বাঁশের জাফরির ফাঁক দিয়ে আমার কর্তা বারবার আমাকে উঁকি দিয়ে দেখছিলো এটা বুঝতে পেরে আমি লজ্জা আর সংকোচে আড়ষ্ঠ হচ্ছিলাম।
চুলার আগুন নিভে এলে লজ্জায় তাই কিছুতেই বাঁশের চোঙায় ফুঁ দিতে পারছিলাম না। এদিকে লাকড়ি জ্বলার ধোঁয়ায় চোখের জল আর নাকের জলে ভেসে যাচ্ছিলাম।
আমার কর্তা আমার নাজেহাল অবস্থা দেখে বাঁশের জাফরির ওপার থেকে আমাকে বললো,” টেংরা টিলায় গেলে তোমাকে এত কষ্ট করতে হবে না সেখানে গ্যাসের চুলা”।
গ্যাসের চুলা শুনে আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। মনে মনে ভাবছিলাম গ্যাসের চুলা আবার কি রকম চুলা?
শুধু আমি কেন টেংরাটিলাতে সেই সময়ে যাঁরা গ্যাস ফিল্ড দেখতে আসতেন তাঁরাও গ্যাসের চুলা দেখে অবাক হয়ে যেতেন।
চট্টগ্রামে আমার বড় ভাশুরের বাসায় ছিলো ছোট্ট একটা কেরোসিনের স্টোভ। ভার্সিটি থেকে ফিরে এসে সেই স্টোভে এতজনের রান্না রাঁধতে আমার খুব কষ্ট হত।
রান্নাঘরের লাগোয়া প্যান্ট্রিতে গিয়ে দেখতে লাগলাম সেখানে কী কী আছে? আর ঠিক তখন আলাদিন এলো বঁটি আর ছুরি নিয়ে যাবার জন্যে।
জেলে সর্দার আলকাস মিয়া সুরমা নদী থেকে তোলা বিশাল এক রুই মাছ পাঠিয়ে দিয়েছে। সে মাছ বাংলোর ব্যাকইয়ার্ডে রাখা হয়েছে। মাছটা কেটে তিন ভাগ করা হবে। এক ভাগ আমাদের আর বাকি দুই ভাগ নিচের টিলার দুইজন অফিসারের জন্যে।।
আমার যখন বিয়ে হয় পরিবহন ব্যবস্থা তখন তেমন ভালো ছিলো না বলে টেংরাটিলায় মাছ, মুরগী, ডিম,সবজি দুধ,ঘি সবই ছিলো খুব সস্তা। একটা মুরগীর দাম ছিলো পঞ্চাশ পয়সা, খুব বড় মুরগী হলে এক থেকে দেড় টাকা। দুধের সের ছিলো পঁচিশ পয়সা, ঘি এক সের ( তখন কেজি সিস্টেম ছিলো না) পাঁচ টাকা, ডিম এক টাকায় পঁচিশ থেকে তিরিশটা।
এলাকার লোকজনের শাকসবজি বা মাংসের চেয়ে মাছই বেশি প্রিয় ছিল । নদী বা হাওড়-বাওড় বা বিল ঝিলে প্রচুর মাছ পাওয়া যেতো। এছাড়া ফিল্ডের সংরক্ষিত জায়গার নিচু আর জলা জায়গাগুলিতে অহরহ কই, মাগুর শিং, টাকি মাছ কিলবিল করতো।
সে মাছ ফিল্ডের কর্মীরা যখন ধরতো তখন ভাগ করে সবার বাসায় তা দিয়ে যেতো। আমার মনে আছে সেসব মাছ খেতে খেতে ভালো না লাগলে বড় বড় জিওল মাছগুলি রেখে ছোটো জিওল মাছগুলিকে আমি সামনের ঝিরিটায় মুক্ত করে দিতাম।
তবে মাছ বা মুরগীর মতো সব রকম সব্জি টেংরা বা দোয়ারাবাজারে পাওয়া যেতো না।
বিশেষ করে ফুলকপি, বাঁধাকপি ওলকপি, পালংশাক এসব তো পাওয়াই যেতো না। এস্কর্ট দিয়ে সিলেট শহর থেকে আনাতে হত।
আলাদিন একবার ছুটিতে ছিলো বলে আমি অন্য একটা কাজের ছেলেকে বাঁধাকপি কাটার জন্যে বলেছিলাম। খানিকক্ষণ পরে দেখি সেই কপি ডাস্টবিনের শোভা বর্ধন করে আছে। আমি ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করলাম, কপিতে কি পোকা হয়েছিলো? ফেলে দিয়েছো কেন?
সে উত্তর দিয়েছিলো, “কপিটা মেমসাব ভালা নায়।
যেবলা কাটি হেবলা হুদাই পাতা আর পাতা বাইর অয়।কপি আর খুঁইজা পাই না। ইতা কপি খাইয়া আর কাম নাই। তাই ফালাইয়া দিছি।
আমি তো তার কথা শুনে থ!
আলাদিনের মাছ কাটা দেখতে দেখতে ভাবলাম অনেকদিন মাছের কালিয়া খাইনি।
আজ রুই মাছের কালিয়া রাঁধবো।
ছুটির দিনগুলি যে কোন দিক দিয়ে কেটে যাচ্ছিলো নিজেই জানি না।
বিশেষ করে জ্যোৎস্নারাতে নদীতে বেড়াবার কথা ভোলার নয়।
কর্তার সাথে ছোট্ট লঞ্চটিতে চড়ে সুরমা নদীতে যখন ভেসে বেড়াতাম তখন সুরমার কুলকুল করে বয়ে যাওয়া ঢেউগুলির ওপরে চাঁদের উছলে পরা কিরণ কী যে অপরূপ এক সৌন্দর্যের সৃষ্টি করতো! মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা ছাড়া তা বর্ণনা করা যায় না।
মনে হত চাঁদ যেন তার সবটুকু আবেগ দিয়ে প্রতিটি ঢেউয়ের মাথায় আলোর মুকুট পরিয়ে দিয়েছে।
নদীতে বেড়ানো ছাড়াও কখনো বা গাড়ি নিয়ে পাহাড়ের আঁকাবাঁকা পথ ধরে ভারত বাংলাদেশ সীমান্তের ধার পর্যন্ত ঘুরে আসি,কখনো আবার হাঁটতে হাঁটতে ফিল্ড ছেড়ে গ্রামের কাছাকাছি গিয়ে গ্রামের মানুষের সহজ,সরল জীবন নিজের চোখে দেখে আসি।
কখনো শ্রমিকদের নিজেদের হাতে লাগানো সব্জীর বাগান দেখি।
আমাদের কোয়ার্টারটা ছিলো একটা উঁচু টিলার ওপরে। টিলাটিকে ঘিরে যেখানে ছড়িয়ে আছে নোনা ফল,কাঁঠাল, পেঁপে আর পেয়ারা গাছ। সারাক্ষণ সেসব গাছের ডালে ডালে পাখিদের কিচির মিচির লেগেই থাকে।
এছাড়াও টিলাগুলির খাঁজে খাঁজে ছড়িয়ে আছে আশ্চর্য সব ভেষজ গাছ। হাঁটতে গেলে পায়ে পায়ে জড়িয়ে যায়। আমি সব ভেষজ পাতা না চিনলেও থানকুনি আর গাঁদাল পাতা চিনি। আমার শাশুড়ি একদিন ওই টিলা থেকে থানকুনি আর গাঁদাল পাতা তুলে নিয়ে রান্না করেছিলেন।তাই আমারও চেনা হয়েছে।
অবাক লাগতো টিলার খাঁজে খাঁজে পাহাড়ি কাছিমরা যখন গর্ত খুঁড়ে ডিম পেড়ে যেতো।
ফুল আর ফুল।কত রকমের ফুলের গাছ যে লাগানো হত। লিলি,বেলি,জবা,গোলাপ,ডালিয়া,চন্দ্রমল্লিকা, গাঁদা তা আর বলে শেষ করা যাবে না।
আমাদের বাংলোর লনের একধার বেলি ফুলে ধবধবে সাদা হয়ে থাকতো আর সেই ফুলের সৌরভে বাতাস সুরভিত হয়ে থাকতো।
পরিবেশ গ্রামীণ হলেও গ্যাসফিল্ডে তা বোঝার উপায় নেই। গ্যাস,নিজস্ব জেনারেটর, সার্বক্ষণিক বিদ্যুৎ ও জল,ডাক্তার, আধুনিক হাসপাতাল,প্রতি পনেরো দিন পর পর করাচি থেকে আসা উর্দু আর ইংরেজি সিনেমার রোল ফিল্ডের ক্লাবে বসে দেখা ছাড়াও অহরহ দেশ বিদেশের অতিথিদের আসা যাওয়া লেগেই থাকতো।
বিশেষ করে ঢাকা, করাচি আর বিলেত থেকে প্রায়ই অফিসের লোকজন আসা যাওয়া করতেন।
এছাড়া শীতের সময়ে অনেক অতিথি আসতেন শুধুমাত্র হাওড়ে পাখি শিকার করবার জন্যে।
অজস্র পাখিতে তখন হাওড়গুলি মুখরিত থাকতো। কত রকম পাখি যে তারা শিকার করতেন।
তার মধ্যে কাইম,বালিহাঁস, সারস,লেঞ্জা,বক,রাজহাঁসের কথা মনে আছে।
সেসব শিকার করা পাখি ফিল্ডের গেস্ট হাউসে এনে রোস্ট করা হত।
শিকার জিনিসটা আমি একেবারেই পছন্দ করি না। বিশেষ করে নিরাপদ আশ্রয়ের জন্যে আসা নিরীহ পাখিদের গুলি করে এভাবে মেরে ফেলাকে খুব নিষ্ঠুর বলে মনে হত । এ নিয়ে কর্তার সাথে আমি ঝগড়া করতেও ছাড়তাম না।
কারণ পাখি শিকারে সে নিজেও ছিল ওস্তাদ।
পাখির মাংস আমি বিয়ের আগে কখনো খাইনি। তবে এভাবে পাখি শিকার দেখার পর থেকে আমি পাখির মাংস তো বটেই এমন কি কবুতরের মাংসও খাই না।
বর্ষার মতো শীতেরও খুব দাপট ছিলো জায়গাটিতে। সূর্যদেব অনেক সময় দুপুর বারোটা পেরিয়ে তারপর দেখা দিতেন। রাতে প্রচণ্ড ঠান্ডা পড়তো।কথায় আছে ” মাঘের শীতে বাঘ কাঁপে। শীতকালে অনেক সময়ে বাঘের ডাকও শোনা যেতো। একবার একটা বাঘ শীতের হাত থেকে বাঁচার জন্যে কিভাবে যেন সীমানার কাঁটাতার পেরিয়ে ফিল্ডের ভেতরে ঢুকে সটান গেস্ট হাউসের বারান্দাতেই উঠে পড়েছিলো।
গেস্ট হাউসে তখন এ,আর রহমান নামে একজন অতিথি ছিলেন। তিনি এসেছিলেন পাখি শিকার করার জন্যে। বাঘটাকে দেখে ভদ্রলোকের হঠাৎ কী যে খেয়াল হল, সবার নিষেধ উপেক্ষা করে তিনি বাঘের ঠিক কপাল লক্ষ্য করে দুম করে গুলি করে বসলেন। তাও আবার কিনা এয়ারগান দিয়ে।
কপাল ভালো বাঘটা মারা গিয়েছিলো। এরপর বাঘ আর সেই ভদ্রলোকের একটা ছবি তুলে বাঁধিয়ে রাখা হয়েছিলো গেষ্ট হাউজে।
বাঘের প্রসঙ্গে মনে পড়ে গেলো আর একটি ঘটনা। এক দুপুরে আমি মেয়েকে নিয়ে শুয়েছিলাম। হঠাৎ ঘরে ফোঁস ফোঁস আওয়াজ শুনে ভয়ে চমকে ফিরে দেখি বিশাল এক গোসাপ টিলার জঙ্গল থেকে বেরিয়ে আমার বেডরুমে থপাস থপাস পা ফেলে এগিয়ে আসছে। আমি ভয়ে মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরে খাটের মাঝখানে দাঁড়িয়ে হাউমাউ করে চেঁচিয়ে উঠতেই কাজের লোকজন ছুটে এসে অবলীলায় সাপটির লেজ ধরে তুলে নিয়ে সেটিকে আবার জঙ্গলে নিয়ে ছেড়ে দিয়ে আসলো।
গোসাপকে ওরা কিছুতেই মারতো না।বলতো,” ওরা কারো ক্ষতি করে না মেমসাহেব। বরং অন্য সাপগুলি ওদের ভয়ে এদিকে আসে ন “।
দেখতে দেখতে আমার ছুটির দিনগুলি ফুরিয়ে আসছিলো। আমিও আবার চট্টগ্রাম ফিরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম ।
এর মধ্যে আমার কর্তা একদিন ছাতক সিমেন্ট কোম্পানীতে অফিসের কাজে যাবে।
যাবার আগের দিন রাতে আমাকে বললো, ‘ কাল সকালে তুমিও আমার সাথে যাবে। আতিক ভাই আর ভাবি তোমাকে নিয়ে যেতে বলেছেন’।
( চলবে)
Facebook Comments Sync