সময়ের কাহন -৬ / অনুপা দেওয়ানজী

সময়ের কাহন -৬ / অনুপা দেওয়ানজী

 

আবার সেই লঞ্চে করেই চলেছি ছাতকের সিমেন্ট কোম্পানিতে আতিক ভাইয়ের আমন্ত্রণে।

ছাতক নামটার সাথে এখানকার আদিবাসীদের কথা জড়িয়ে আছে। সে এখনকার কথা নয়। বহু প্রাচীন যুগ আগের কথা। ছাতকে তখনও  জনবসতি শুরু হয় নি। আদিবাসী পাহাড়িরা সপ্তাহে দুইদিন তখন ছোট্ট  একটা বাজারে চেলা পাহাড়ের কমলা বিক্রি করতে আসতো। রোদ আর বৃষ্টি থেকে বাঁচার জন্যে তারা বাঁশের পাতা দিয়ে একরকম ছাতা বানিয়ে ব্যবহার করতো আর তা থেকেই জায়গাটির নাম ছাতক, ছোট্ট সেই বাজারের নাম ছাতকবাজার আর সেইসাথে চেলার কমলাও ছাতকের কমলা বলে ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিয়েছে। দেশভাগের পরে চেলা  ভারতে পড়লেও ছাতকের কমলা নামটিই  তাই  রয়ে গেছে।

খনিজ নগরী ছাতকের সীমান্তে দাঁড়িয়ে আছে অরণ্যে ঘেরা খাসি ও সেই চেলার পাহাড়। ছোট ছোট টিলা, পাহাড়ে সজ্জিত  বিস্তীর্ণ এলাকা, আকাশ, পাহাড় আর নদীর মিতালি মিলে ছাতককে  দিয়েছে অনুপম এক সৌন্দর্য। তবে সিলেটের লোকেরা ছাতককে কেন যে  চাতক বলে তা বুঝতে পারি না।

সিমেন্ট কোম্পানিতে যাবার কিছু আগেই নদীর তীর ঘেঁষে ভারি সুন্দর একটা টিনের বাংলো অনাদরে,অবহেলায় পড়ে আছে। তাতে লেখা আছে ম্যাকলিন এণ্ড কোং। আমার কর্তাকে জিজ্ঞেস করে জানলাম ওটা নাকি ম্যাকলিনের কার্যালয়  ছিলো এক সময়। 

১৯৩৭ সালের নির্মিত দৃষ্টিনন্দন টিনের বাংলোটি এখনও  পথচারীদের দৃষ্টি কাড়ে। ঘন্টা দুয়েক পরে আমাদের  লঞ্চ কোম্পানির নিজস্ব  ঘাটে ভিড়তেই দেখি আমাদের জন্যে পাড়ে দাঁড়িয়ে আছে গাড়ি । আঁকাবাঁকা সর্পিল পাহাড়ি পথ পেরিয়ে যেতে যেতে চোখে পড়ে ব্রিটিশ আমলে নির্মিত কোম্পানির বিশাল কারখানা, শ্রমিক কলোনি, স্কুল, খেলার মাঠ,অফিসার্স ক্লাব, কেয়ারি করা ফুলের বাগান, অফিসারদের সুদৃশ্য বাংলো, ছবির মতো সুন্দর  গেস্ট হাউস। কর্তার মুখে শুনেছি গেস্ট হাউসের হেড বাবুর্চি বড়ুয়া লর্ড মাউন্টব্যাটনের সময়ে টেবিল বয় ছিলো। রান্নার হাত নাকি তার চমৎকার।

দেখতে দেখতে আমরা আতিক ভাইয়ের বিশাল কোয়ার্টারে এসে উপস্থিত হলাম। আতিকুর রহমান আর তাঁর স্ত্রী বানুভাবি দুজনেই চট্টগ্রামের মানুষ। স্বামী, স্ত্রী দুজনেই ভারি হাসিখুশি,  রসিক ও খোলা মনের মানুষ। ফুটফুটে দুটি ছোট্ট মেয়ে তাদের। আমার মেয়ের সাথে মুহূর্তের মধ্যেই তাদের বন্ধুত্ব হয়ে গেলো। তাদের সেই বন্ধুত্ব এখনও অমলিন । আতিক ভাইয়ের সাথে  মহানায়ক  উত্তমকুমারের  কোথাও যেন একটা মিল খুঁজে পাওয়া যায়। ছিপছিপে, লম্বা, তন্বী বানুভাবিও  ভারি সুন্দর  ।

ভাইয়ের কাছেই শুনেছি তিনি  আমার মেজোমামা অধ্যাপক অসিত লালার সহপাঠী ছিলেন। আমার মামার বাড়িতেও গিয়েছিলেন। তারা দুজন ছাড়া  কোম্পানির কেমিস্ট (পরে চেয়ারম্যান) আলী সাহেবকেও আমি  চিনি। যিনি আমার বিয়ের পরেই টেংরা টিলায় এসেছিলেন। আমাদের দুজনের অনেক ছবিও তুলেছিলেন।  উত্তর প্রদেশের মানুষ তিনি। অত্যন্ত সুপুরুষ, গায়ের রঙ উজ্জ্বল গৌরবর্ণ,  প্রায় ছ ফুটের কাছাকাছি লম্বা, মেদহীন শরীর। বেশির ভাগ সময়েই সাদা শার্ট-প্যান্ট পরতেন। কাজপাগল মানুষ বলতে যা বোঝায় তিনি ছিলেন ঠিক তাই। 

পাকিস্তান আর ভারত যখন আলাদা রাষ্ট্র গঠন করলো তখন তার পরিবারের সবাই উত্তর প্রদেশ থেকে লাহোরে চলে গেলেও তরুণ আলি লেখাপড়া শেখার পরে লাহোর ছেড়ে শুধু যে পূর্ব পাকিস্তানে চলে এসেছিলেন তাই নয়, ছাতক সিমেন্ট কোম্পানিতে সেই যে  যোগদান করেছেন তারপর থেকে লাহোরে  নাকি আর ফিরে যাচ্ছেন না। তার পরিবার তাই তাঁকে নিয়ে খুব চিন্তিত। বড় ভাই সরফরাজ খান আর্মিতে চাকরি করেন। তিনি  আর তার স্ত্রী  আলি সাহেবের জন্যে পাত্রী ঠিক করে লাহোর থেকে ছাতকে যখন এসেছিলেন  তখন টেংরাতে বেড়াতেও গিয়েছিলেন। তাদের মুখেই শুনেছি  তাকে কিছুতেই নাকি  সেখানে নিতে পারছেন না। বিয়ে নিয়ে ঠাট্টা করলে তিনি তা হেসে উড়িয়ে দেন।

গল্পগুজব করতে করতে খাওয়ার সময় হয়ে এলো। চমৎকার সব রান্নায় ভাবি টেবিল সাজিয়েছেন। খাবো কি দেখেই মন ভরে গেলো। বিকেলে চা খাওয়ার পরে ভাবি পরিচয় করিয়ে দিলেন কোম্পানির অফিসার গিয়াস ভাই আর ভাবির সাথে, মুন্সীবাবু ও তাঁর স্ত্রীর সাথে আর চক্রবর্তী বাবু আর চক্রবর্তী বৌদির সাথে। তাদের সবার কথা আজও মনে আছে । এরপর  ঘুরে ঘুরে দেখলাম ব্রিটিশ আমলের নির্মিত বিশাল  আসাম বেঙ্গল সিমেন্ট কোম্পানী। চুনাপাথরের সহজলভ্যতার জন্যে ১৯৩৭ সালে এই বিশাল কারখানাটি স্থাপিত হয়েছিল। দেশ বিভাগের পরে এটা পূর্ব পাকিস্তানের ভাগে পড়েছে। ১৯৬৫ সালের যুদ্ধের পরে যার নাম হয়েছে ছাতক সিমেন্ট কোম্পানী।   তৎলীন পূর্ব পাকিস্তানের একমাত্র সিমেন্ট কারখানা। 

সিমেন্ট তৈরির কাঁচামালের জন্য প্রায় ২০ কিলোমিটার রোপওয়ে দিয়ে ভারতের আসাম রাজ্যের কুমোরার নিজস্ব খনির পাথর ছাড়াও টেকেরঘাটের  চুনাপাথর উত্তোলন কেন্দ্র থেকেও রোপওয়ে দিয়ে এখানে পাথর আসে। পাকিস্তান পেট্রোলিয়াম লিমিটেডের টেংরা টিলা গ্যাস ফিল্ডের গ্যাস দিয়েই বিশাল এই কোম্পানিটির উৎপাদন হয়।

সারাদিন গল্পে গল্পে কোথা দিয়ে যে কেটে গেলো এক চমৎকার সময় নিজেও জানি না। ফিরে আসার সময় ঘুণাক্ষরে কি একবারও ভেবেছিলাম এই কোম্পানিতেই আমাকেও এক সময় আসতে হবে ম্যানেজিং ডিরেক্টরের স্ত্রী হয়ে?

দেখতে দেখতে আমার ছুটিও ফুরিয়ে গেলো। ভার্সিটি খুলে গিয়ে ক্লাশও শুরু হয়ে গিয়েছে। আমিও চট্টগ্রাম ফিরে যাবো বলে সব কিছু আবার গুছিয়ে নিয়েছি। মনকে নিজেই বোঝালাম  চট্টগ্রামের বাসাটি ভালো না লাগলেও  পড়তে যখন আরম্ভ করেছি তখন শেষ তো করতে হবে। 

আসার আগের রাতে আমার কর্তা  আমার মন ভালো করবার জন্য অফিসের ক্লাবে গান শোনাতে নিয়ে গেলো। সেদিন রাতে ক্লাবে  স্থানীয় বিশেষ শিল্পী লাল মিয়া  হাসন রাজার গান পরিবেশন করবেন। শিল্পী বেশ ভালোই গান করেন। দোতরা হাতে একটার পর একটা তিনি গেয়েই চলেছেন। আমরা মুগ্ধ হয়ে শুনছি। কিছুক্ষণ পরে  দেখি আমার কর্তা আমাকে আসছি বলে হঠাৎ করে উঠে গেলেন। একটু পরেই ফিরে এসে বললেন, গ্যাস প্রোডাকশন বাড়াবার জন্যে পাকিস্তানের বেলুচিস্তান প্রদেশের স্যুই গ্যাস ফিল্ডে তাকে নাকি জরুরি ভাবে বদলী করা হয়েছে। তিন বছর সেখানে থাকতে হবে।

আমি জিজ্ঞেস করলাম, জরুরি মানে কবে যেতে হবে?

সে বললো এক সপ্তাহের মধ্যে যেতে হবে। আরও শুনলাম ফ্যামিলি কোয়ার্টার খালি নেই বলে  এই মুহূর্তে  তাকে কোয়ার্টার দেয়া যাচ্ছে না। তবে খালি হলেই সে ফ্যামিলি  নিতে পারবে। কথাটা শুনেই আমার মাথায় তখন যেন বজ্রাঘাত হল।   লাল মিয়ার গাওয়া হাসন রাজার গান আমাকে আর কিছুতেই আকর্ষণ করছিলো না। ঘরে ফিরে এসে দেখলাম আমার কর্তা খুব চিন্তিত। আমি বুঝলাম এ চিন্তা আমার জন্যে। কারণ চট্টগ্রামে থাকাকালীন সময়ে আমার স্বাস্থ্য একে তো খারাপ হয়ে গিয়েছিলো তাতে আবার সে থাকবে না বলে আমাদের জন্যে সে খুব দুশ্চিন্তা করছিলো। আমাকে বললো, আমাকে তো বেলুচিস্তান যেতেই হবে। তুমি মেয়েকে নিয়ে চট্টগ্রামের বাসায় ঠিকঠাক পড়াশুনা চালিয়ে নিতে পারবে তো? আমি কিছু মাত্র না ভেবে সেই মুহূর্তে বলে দিলাম, আমি চট্টগ্রাম আর ফিরে যাচ্ছি না। আমার কর্তা আমার দিকে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো, ফিরে যাচ্ছো না মানে? আমি বললাম, ফিরে যাচ্ছি না মানে আমি  আর মাস্টার্স পড়বো না।

-পড়বে না?

-না। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে তিন বছর পরে ফিরে এলে তখন দেখা যাবে।

আমার মুখের দিকে চেয়ে সে কি ভাবলো জানি না।  কেন জানি  আর জোর করলো না  আমাকে পড়ার জন্যে। এরপর ঠিক হলো যে কটা দিন  সে কোয়ার্টার পাচ্ছে না সে কটা দিন আমি আমার মেজো ভাশুরের বাসায় থাকবো। তিনিও একই কোম্পানির (পাকিস্তান পেট্রোলিয়াম লিমিটেডের) সিলেটে অবস্থিত হরিপুর গ্যাস ফিল্ডে চাকুরী করতেন। সেখানকার কোয়ার্টারেই থাকতেন।

আবার নুতন করে সব গোছানো শুরু করলাম। তবে বাংলো থেকে নেয়ার মত তেমন কিছুই ছিলো না। কারণ কোম্পানী যাবতীয় জিনিস দিয়ে কোয়ার্টার সাজিয়ে দিতো। নির্দিষ্ট দিনে টেংরা টিলা থেকে হরিপুরে মেজোভাশুরের বাসার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম এবারে সুরমা নদীর দিকে আমি উদাস হয়ে তাকিয়েই রইলাম।তার অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করবার জন্যে  মনটা যেন আগের মতো সায় দিচ্ছে না।

ছাতক থেকে ট্রেনে সিলেট স্টেশনে নেমেই দেখি  হরিপুর গ্যাস ফিল্ডের গাড়ি আমাদের জন্যে দাঁড়িয়ে আছে। ফিল্ড থেকে সিলেট শহর খুব বেশি দূরে নয়। সেখানে বাঙালি অফিসারদের সাথে   পশ্চিম পাকিস্তানী অনেক অফিসারও আছেন। তাদের  ছেলেমেয়েরা ফিল্ডের গাড়িতে করেই রোজ সিলেট শহরের ইংলিশ মিডিয়াম  ব্লু বার্ড স্কুলে আসা যাওয়া করতো। তারা ছাড়া  ফিল্ডের বাঙালি ছেলেমেয়েয়া ফিল্ডের কাছেই  হরিপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়তো।

এখনকার মতো সেই সময়ে বাবা মায়েরা ছেলেমেয়েদের ইংলিশ মিডিয়ামে পড়াবার জন্যে  মোটেই মাথা ঘামাতেন না। এমনকি প্রত্যন্ত এলাকার স্কুলগুলির মানও বেশ ভালো ছিলো। হরিপুর গ্যাস ফিল্ডে পশ্চিম পাকিস্তানী অফিসারদের মধ্যে  গুলজার,আনসারি,আফজল,পুরি,ভাট্টি আর বেলায়েত সাহেবের কথা আজও মনে আছে। মনে আছে এই কারণে স্বাধীনতা যুদ্ধের আগে ওদের যেমন বন্ধুত্বপূর্ণ ব্যবহার দেখেছি  স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ে দেখেছি ঠিক তার বিপরীত রূপ। আমি  মেজো ভাশুরের বাসায় আসতেই আমার ভাশুরের ছেলেমেয়েরা সবাই আনন্দে মেতে উঠলো। ওদের সাথে আমার বরাবরই খুব মধুর সম্পর্ক । আমার ভাশুর আর জাও আমাকে খুব আদর করতেন। 

আমার বড় ভাশুর  ছিলেন খুব রাগী মেজাজের। তার ভয়ে বাড়ির সবাই সারাক্ষণ তটস্থ হয়ে থাকতো। মেজো ভাশুর ছিলেন ঠিক তার উল্টো। কাউকে নেহাৎ প্রয়োজন না হলে তিনি কখনও বকতেন না। দুর্দান্ত লন টেনিস খেলতেন। ব্রিটিশ খেলোয়াড়দের সাথে খেলে প্রচুর পুরস্কারও পেয়েছিলেন। গান,অভিনয়, আবৃত্তি খুব ভালোবাসতেন। আমার কর্তার মতো তিনিও ব্রিজ খেলতেন।

মেজো জা ছিলেন আমার চেয়ে প্রায় সতেরো বছরের বড়। ঠিক আমার মায়ের বয়সী। তিনি যখন শ্বশুরবাড়িতে বৌ হয়ে আসেন তখন আমার বয়েস দুই। নমিতা তাদেরই বড় মেয়ে। সাত ছেলেমেয়ে তাদের। তাদের বাসায় আমি এলেই  আনন্দের হাট বসে যেতো। আমি ভাশুরের বাসায় এলে আমার জা রান্নার ভার আমার ওপরেই ছেড়ে দিতেন। যদিও তিনি নিজেও ভালো রান্না করতেন কিন্তু আমি এলেই  ভাশুরের ছেলেমেয়েরা আমার হাতের রান্নাই খেতে চাইতো।

যাই হোক নির্দিষ্ট দিনে আমার কর্তা আমাকে মেজোভাশুরের বাসায় রেখে বেলুচিস্তানের স্যুই গ্যাস ফিল্ডের উদ্দ্যেশ্যে পশ্চিম পাকিস্তান রওয়ানা হয়ে গেলো। কর্তা চলে যাবার পরে ভাশুরের বাসায় আনন্দেই আমার দিনগুলি কাটলেও আমি অপেক্ষা করতাম কখন আমার কর্তার ডাক আসবে!

সময় কাটাবার জন্যে  তাই মাঝে মাঝে আমি আর আমার জা ফিল্ডের অন্যান্য অফিসারদের কোয়ার্টারে বেড়াতে যাই তারাও আমার সাথে দেখা করতে আসেন। মনে আছে পাঞ্জাবি অফিসার বেলায়েতের আড়াই বছরের ছেলে গুড্ডুর কথা। গুড্ডুকে নিয়ে তার মা বেড়াতে আসলে দেখতাম ছেলের  প্যান্টের কাপড়ে হিসু করার জায়গাটি গোল করে কেটে হিসু করার অঙ্গটাকে বের করে রাখতেন। বারবার হিসু করার ঝামেলা থেকে বাঁচার জন্যে তিনি এই ব্যবস্থা করে নিয়েছিলেন। ডায়াপার নামে বস্তুটার তখনো ব্যবহার আসেনি। ফিল্ডের সবাই এ নিয়ে খুব  হাসাহাসি করতো।

একদিন জায়ের সাথে বেড়াতে গেলাম হরিপুর ফিল্ডের অদূরে এই কোম্পানীরই আর একটা ফিল্ডে। যে ফিল্ডে আমার ভাশুর আগে ছিলেন। সেই ফিল্ডটা এখন জ্বলে পুড়ে কয়লার মতো কালো হয়ে গেছে। সবুজের কোন চিহ্ন নেই সেখানে। পুড়ে কালো হয়ে যাওয়া টিলার পাশেই বিশাল একটা পুকুরের জল থেকে  গ্যাসের বুদবুদ উঠছে। আগুনের ছোঁয়া পেলেই জলে আগুন জ্বলে উঠে। সেখানে তাই আগুন বা দেশলাই নিয়ে যাওয়া নিষেধ। গ্যাস ফিল্ডটার তখন সবে জন্ম হচ্ছিলো। প্ল্যান্ট তৈরি হলেও  বাংলো,অফিস এসব তখনও অস্থায়ী। স্থায়ী বাংলো আর অফিসের কাজ চলছিল।

ব্রিটিশরা তখন এই ফিল্ডে কাজ করতো। আমার ভাশুরও আগের চাকরি ছেড়ে এই ফিল্ডে যোগ দিয়েছেন।জাকেও গ্রামের বাড়ি থেকে নিজের কোয়ার্টারে নিয়ে এসেছেন। নমিতার বয়েস তখন দুই বছর।

রোজ দিনের মতো সেদিন সন্ধ্যায়ও অফিস থেকে ফিরেছে সবাই। গ্যাসের উনুন তখনো  দেয়া হয়নি বলে  গৃহিণীরা  কাঠের উনুনে রান্না করতেন।

জায়ের মুখে শুনেছি এক সন্ধ্যায় কোন এক গৃহিণীর অসাবধানে ছুঁড়ে ফেলা জ্বলন্ত লাকড়ির ফুলকি  গ্যাস পাইপের এসে পড়তেই মুহূর্তে আগুন লেগে চারিদিকে আগুন দাউদাউ করে উঠলো। সাথে সাথে যে যেভাবে পারে এই ভয়াবহ আগুনের হাত থেকে রক্ষা  পাবার জন্যে তখন মরিয়া হয়ে ছুটতে লাগলো।

আমার জা ছিলেন তখন আসন্ন প্রসবা। ভাশুর তাড়াতাড়ি তাকে কাঁধে তুলে নিয়ে দু বছরের নমিতার হাত ধরে টিলার ঢালু পথ পেরিয়ে  কোনমতে বাইরে বেরিয়ে আসতে পেরেছিলেন। পরণে তার তখন শুধু লুঙ্গি আর গেঞ্জি। জায়ের পরণে আটপৌরে শাড়ি। সেই অবস্থায় তারা রাতের মেলে চট্টগ্রামে নিজের বাড়িতে এসে পৌঁছালেন পরের দিনদুপুর বারোটায়। আমার শাশড়ির তো তখন তাদের দেখে কেঁদেকেটে পাগলের মতো অবস্থা।

তবে তখনকার মানুষের বিশ্বস্ততা দেখে অবাক হতে হয়। আমার জায়ের সব জিনিস আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছিলো। সেই ছাইয়ের গাদায় শুধু মাত্র সোনার গয়নাগুলি আগুনে গলে একটা পিন্ডের মতো পড়েছিলো। পোড়া ছাইয়ের ভেতর থেকে তা উদ্ধার করে আমার জায়ের হাতে তা তুলে দেয়া হয়েছিলো।

খেলায় ছিনিয়ে আনা আমার ভাশুরের সব পুরস্কার আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছিলো। 

কোম্পানী অবশ্য সবাইকে ক্ষতিপূরণের টাকা দিয়েছিলো।

সময়গুলি যদিও আমার কাটছিলো  কখনো মাধবকুন্ড,কখনো শ্রীপুর, কখনো জাফলং, কখনো মনিপুরী পাড়ায় বা চা বাগানে,কখনো হযরত শাহ্ জালালের মাজারে ঘুরে ঘুরে। তারপরও মন পড়ে আছে  কখন বেলুচিস্তান থেকে কর্তার ডাক আসবে!

ওদিকে আমার কর্তা বেলুচিস্তান পৌঁছে দেখে কোম্পানী তাকে ফ্যামিলি কোয়ার্টার দিতে টালবাহানা শুরু করেছে। আমি মহা দুশ্চিন্তায় পড়লাম। তারপরও মনকে এই বলে প্রবোধ দিলাম  একান্তই যদি যেতে না পারি তাহলে  চট্টগ্রামে ভাশুরের বাসায় থেকে  লেখাপড়াটাই  শুরু করবো।

(চলবে)

অনুপা দেওয়ানজী 
অনুপা দেওয়ানজী